কুরবানী বিষয়ক কিছু হাদীস ও আছার
কুরবানী ইসলামের শিআর। আল্লাহ তাআলার কুরব তথা নৈকট্য অর্জনের এক বিশেষ বিধান। কুরবানী মিল্লাতে ইবরাহীমীর সাথে উম্মতে মুসলিমার এক মেলবন্ধন। এতে আছে রাব্বুল আলামীনের আদেশের সামনে সমর্পিত হওয়ার মহা দীক্ষা। কুরবানীর প্রচলন পৃথিবীর শুরু থেকেই। ইতিহাসের প্রথম কুরবানী তো সুপ্রসিদ্ধ। আদিপিতা আদম আ.-এর দুই পুত্রের কুরবানী। কুরআন মাজীদে যার বিবরণ এসেছে এভাবে-
وَ اتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَاَ ابْنَيْ اٰدَمَ بِالْحَقِّ اِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَ لَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْاٰخَرِ قَالَ لَاَقْتُلَنَّكَ قَالَ اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ.
আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের কাহিনীটি শুনিয়ে দিন। যখন তারা দুজনে কুরবানী করল এবং একজনের কুরবানী কবুল হল আর অন্যজনেরটি কবুল হল না। তখন সে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ তো মুত্তাকীদেরই কুরবানী কবুল করেন। -সূরা মায়েদা (৫) : ২৭
পরবর্তীতে যুগ ও জাতির বিভিন্নতায় কুরবানীর বিধান ও পদ্ধতিতেও আসে ভিন্নতা। তবে উম্মতে মুসলিমা তথা শ্রেষ্ঠ নবী এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের জন্য কুরবানীর বিধানটি মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম আ. কর্তৃক নিজ পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানী করার মহিমান্বিত দাস্তানের সাথে যুক্ত। যার বর্ণনা কুরআন মাজীদে এভাবে এসেছে-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يٰبُنَيَّ اِنِّيْۤ اَرٰي فِي الْمَنَامِ اَنِّيْۤ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَا تَرٰي قَالَ يٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِيْۤ اِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصّٰبِرِيْنَ، فَلَمَّاۤ اَسْلَمَا وَ تَلَّهٗ لِلْجَبِيْنِ، وَ نَادَيْنٰهُ اَنْ يّٰۤاِبْرٰهِيْمُ، قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْيَا اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ، اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلٰٓؤُا الْمُبِيْنُ، وَ فَدَيْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ، وَ تَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْاٰخِرِيْنَ، سَلٰمٌ عَلٰۤي اِبْرٰهِيْمَ، كَذٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ، اِنَّهٗ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِيْنَ.
অনন্তর যখন পুত্রটি তাঁর সাথে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হল, তখন তিনি বললেন, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। অতএব তুমিও চিন্তা কর, তোমার কী মত। তিনি বললেন, আব্বাজান! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পূর্ণ করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তভুর্ক্ত পাবেন।
ফলকথা, যখন তাঁরা আত্মসমর্পণ করলেন এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শায়িত করলেন এবং আমি তাঁকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহীম! নিশ্চয়ই আপনি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছেন। আমি বিশিষ্ট বান্দাদেরকে এরূপই পুরস্কার প্রদান করে থাকি। প্রকৃতপক্ষেও তা ছিল একটি বড় পরীক্ষা। আর আমি তার পরিবর্তে একটি শ্রেষ্ঠ যবেহের পশু দান করলাম। এবং আমি তাঁর জন্য পশ্চাতে আগমনকারীদের মধ্যে এই বাক্য থাকতে দিলাম যে, ইবরাহীমের প্রতি সালাম হোক। আমি বিশিষ্ট বান্দাদেরকে এরূপই পুরস্কার প্রদান করে থাকি। নিঃসন্দেহে তিনি আমার ঈমানদার বান্দাগণের অন্যতম ছিলেন। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০২-১১১
পিতা-পুত্রের এই ত্যাগ ও আত্মত্যাগ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এত পছন্দনীয় হল যে, তিনি কিয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতের জন্য তা বিধিবদ্ধ করে দিলেন।
নিম্নে কুরবানী সম্পর্কিত কিছু হাদীস ও আছার উল্লেখ করা হল।
কুরবানীর বিধান
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ.
সুতরাং আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। -সূরা কাওসার (১০৮) : ২
তাফসীরবিদগণ বলেন, এ আয়াতে ‘নাহর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল ঈদের নামায-পরবর্তী কুরবানী।
ইমাম কুরতুবী রাহ. বলেন, فَصَلِّ -এর একটি তাফসীর এ-ও যে, আপনার রবের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাত আদায় করুন। তিনজন তাবেয়ী ইমাম- কাতাদাহ রাহ., আতা রাহ. ও ইকরিমা রাহ. বলেন, আপনার রবের উদ্দেশ্যে নাহরের (কুরবানী) দিনে ঈদের নামায আদায় করুন।
وَانْحَرْ অর্থাৎ আপনার কুরবানীর পশু যবাই করুন। -তাফসীরে কুরতুবী ২০/১৪৮
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَ نُسُكِيْ وَ مَحْيَايَ وَ مَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ، لَا شَرِيْكَ لَهٗ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ.
আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত (কুরবানী) ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। তাঁর কোনো শরীক নেই। আর আমি এরই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলমান। -সূরা আনআম (৬) : ১৬২-১৬৩
উপরোক্ত প্রথম আয়াতে وَانْحَرْ শব্দটি আদেশসূচক পদ। উসূলে ফিকহের একটি স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতি হল, আদেশসূচক শব্দ ওয়াজিব তথা আবশ্যকীয় বোঝায়।
আর দ্বিতীয় আয়াতে আছে, وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ (আর আমি এ বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছি।)
বলাবাহুল্য যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার আদিষ্ট হয়েছেন তা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্যও ওয়াজিব। যদি আদেশটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বিশিষ্ট হওয়ার কোনো দলীল না থাকে।
সুতরাং উপরোক্ত আয়াতদুটি থেকে কুরবানীর বিধান ওয়াজিব তথা আবশ্যক হওয়া প্রমাণিত হয়।
আর হাদীস শরীফেও কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
من قدر على سعة فلم يضح فلا يقربن مصلانا.
কুরবানী করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮২৫৬
مسند أحمد، تحقيق : أحمد شاكر ١٦/١٢٠ : إسناده حسن، وأخرجه ابن ماجه (٢١٢٣)، وأحمد (٨٢৫৬) واللفظ له.
আবু হুরায়রা রা. থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
من كان عنده سعة فليضح، فمن لم يضح فلا يقربن مسجدنا.
কারো সামর্থ্য থাকলে সে যেন কুরবানী করে। এর পরও কেউ কুরবানী না করলে সে যেন আমাদের মসজিদের কাছেও না আসে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৬০; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৯/২৬০
উভয় রেওয়ায়েত সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের একটি মত এ-ও রয়েছে যে, এটি মারফূ হাদীস নয়; মূলত সাহাবী আবু হুরায়রা রা.-এর বক্তব্য। পরবর্তী বর্ণনাকারী ভুলবশত এটিকে মারফূ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সাহাবীর ফতওয়াও শরীয়তে দলীলের মান রাখে।
مع احتمال قوي أن يكون مرفوعا حكميا.
যাইহোক, এই রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, কেউ যদি কুরবানী না করে তাহলে সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। এর বাহ্যিক অর্থ দ্বারাও কুরবানী আবশ্যক হওয়া প্রতীয়মান হয়। কেননা, এর দ্বারা ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া ও নামায পড়তে নিষেধ করা উদ্দেশ্য নয়। -শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৭/৩১১
قال الطحاوي في مختصره :৭/৩১১ : والثاني : قوله : فمن لم يضح فلا يقربن مصلانا، والمعقول من ظاهر هذا اللفظ الوجوب، لأنه معلوم أنه لم يرد به نهيه عن الصلاة، وحضور المسجد، وإنما المراد والله أعلم : على غير سبيلنا، وبمنزلة من خالف سنتنا، أو ما جرى مجرى ذلك.
মিখনাফ ইবনে সুলাইম রা. বলেন-
كُنّا وُقُوفًا مَعَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِعَرَفَاتٍ، فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: يَا أَيّهَا النّاسُ، عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيّةٌ.
আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আরাফায় অবস্থান করছিলাম। তখন তাঁকে বলতে শুনেছি, হে লোকসকল! প্রত্যেক ঘরওয়ালার উপর প্রতি বছর কুরবানী আবশ্যক। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫১৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৭৮৬
তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর কুরবানী করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-
أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلّ سَنَةٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় দশ বছর ছিলেন। প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৯৫৫
এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়মিত কুরবানী করার কথা আছে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কাজ নিয়মিত করাই কাজটির ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ। -তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৪৯
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের আলোকে ইমাম আবু হানীফা রাহ. বলেন, সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
ইমাম রাবীয়াহ রাহ., আওযায়ী রাহ., লাইস ইবনে সা‘দ রাহ., ছাওরী রাহ., নাখায়ী রাহ. প্রমুখের অভিমতও অনুরূপ।
ইমাম মালেক রাহ.-এরও একটি মত এরূপ। তাছাড়া মুজাহিদ রাহ., মাকহূল রাহ. ও শা’বী রাহ. প্রমুখ থেকেও এমনটি বর্ণিত আছে। -শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৭/৩০৭; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ১৩/৩৬০; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৩; তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৪৮
সারকথা, কুরবানী ইসলামের শিআর এবং জরুরি ইবাদত। এতে ইমামদের মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। ইখতিলাফ শুধু এতটুকু যে, অনেক ইমাম একে ওয়াজিব বলেন। আর আমাদের নিকট এই বক্তব্যের দলীলই শক্তিশালী। আর ইমাম শাফেয়ী রাহ.-সহ অনেক ফকীহ একে সুন্নত বলেন। তবে সুন্নত দ্বারা তাদের অনেকের উদ্দেশ্য সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। আর সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ জরুরি আমলেরই অন্তর্ভুক্ত।
উল্লেখ্য, আজকাল কাউকে দেখা যায়, তারা কুরবানী সুন্নত বা মুস্তাহাব হওয়ার বক্তব্য ঢালাওভাবে প্রচার করতে থাকেন। এই আমলটি যে ইসলামের শিআর এবং জরুরি ইবাদত- তা তারা এড়িয়ে যান। এটি সংশোধনযোগ্য।
নিম্নে আমরা কুরবানীর কিছু জরুরি মাসআলা পেশ করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
মাসআলা : কুরবানীর দিনগুলোতে (১০ যিলহজ্ব ফজর উদয়ের পর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত) কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
গায়রুল্লাহর নামে যবাইকারীর প্রতি অভিসম্পাত
আবুত তুফায়েল রা. বলেন, আমরা আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর নিকট আরয করলাম, আপনার কাছে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গুপ্ত রাখা কোনো বিষয় সম্পর্কে অবহিত করুন। তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে কোনো কিছু আমার কাছে গুপ্ত রাখেননি। তবে আমি তাঁকে বলতে শুনেছি-
لعن الله من ذبح لغير الله، ولعن الله من آوى محدثا، ولعن الله من لعن والديه، ولعن الله من غير المنار.
আল্লাহ তাআলা অভিসম্পাত করেন গায়রুল্লাহর নামে যবাইকারীর প্রতি। তিনি অভিসম্পাত করেন মুহদিসকে (বিশৃঙ্খলা ও অনর্থ সৃষ্টিকারী) প্রশ্রয়দানকারীর প্রতি, পিতামাতাকে অভিসম্পাতকারীর প্রতি এবং জমির সীমানা-চিহ্ন পরিবর্তনকারীর প্রতি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৫৫, ৯৫৪; শরহু মুসলিম, নববী ২/১৬০, ১/৪৪১
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَلْعُونٌ مَنْ سَبَّ أَبَاهُ، مَلْعُونٌ مَنْ سَبَّ أُمَّهُ، مَلْعُونٌ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللهِ، مَلْعُونٌ مَنْ غَيَّرَ تُخُومَ الْأَرْضِ، مَلْعُونٌ مَنْ كَمَّهَ أَعْمَى عَنِ الطَّرِيقِ، مَلْعُونٌ مَنْ وَقَعَ عَلَى بَهِيمَةٍ، مَلْعُونٌ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ.
যে পিতাকে গালি দেয় সে অভিশপ্ত, যে মাকে গালি দেয় সে অভিশপ্ত। গায়রুল্লাহর নামে যবাইকারী অভিশপ্ত। জমির সীমানা-চিহ্ন পরিবর্তনকারী অভিশপ্ত। অন্ধকে ভুল পথ নির্দেশকারী অভিশপ্ত। চতুষ্পদ প্রাণীর সাথে সঙ্গমকারী অভিশপ্ত। আর যে লূত সম্প্রদায়ের মতো কাজ করে সে অভিশপ্ত। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৭৫
আরও দেখুন : সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৪১৭
যে ব্যক্তি কুরবানীর ইচ্ছা করবে সে যিলহজ্ব মাসের শুরু থেকে নখ ও চুল কাটবে না
উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَن رأى منكم هِلالَ ذي الحِجَّةِ فأراد أن يُضَحِّيَ فلا يأخُذْ من شعرِه وأظفارِه حتى يُضَحِّيَ.
যিলহজ্বের চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর তোমাদের মধ্যে যে কুরবানীর ইচ্ছা রাখে সে যেন কুরবানী করা পর্যন্ত তার নখ, চুল ইত্যাদি না কাটে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫২৩
ওলীদ ইবনে মুসলিম বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন আজলানকে যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, আমাকে নাফে রাহ. বলেছেন-
إن ابن عمر مر بامرأة تأخذ من شعر ابنها في الأيام العشر، فقال : لو أخرتيه إلى يوم النحر كان أحسن.
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এক নারীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। যিনি যিলহজ্বের দশকের ভেতর তার সন্তানের চুল কেটে দিচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, যদি ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তবে বড় ভালো হত। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫৯৫
অন্য বর্ণনায় মু‘তামির ইবনে সুলাইমান আততাইমী রাহ. বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি-
كان ابن سيرين يكره إذا دخل العشر أن يأخذ الرجل من شعره حتى يكره أن يحلق الصبيان في العشر.
ইবনে সীরীন রাহ. যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা অপছন্দ করতেন। এমনকি এই দিনগুলোতে বাচ্চাদের মাথা মুণ্ডণ করাও অপছন্দ করতেন। -আল মুহাল্লা, ইবনে হাযম ৬/২৮
মাসআলা : যিলহজ্বের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানীর আগ পর্যন্ত নিজের নখ, চুল, মোচ, নাভীর নিচের পশম ইত্যাদি না কাটা। এটা মুস্তাহাব আমল।
আর যে ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম নয় সেও এ আমল করবে। অর্থাৎ নিজের চুল, নখ, গোঁফ ইত্যাদি কাটবে না; বরং তা কুরবানীর দিন কাটবে।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أمرت بيوم الأضحى جعله الله عيدا لهذه الأمة. قال له رجل: يا رسول الله! أرأيت إن لم أجد إلا منيحة أنثى أفأضحي بها؟ قال : لا، ولكن خذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك، فذلك تمام أضحيتك.
আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের জন্য তা ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়েছে?
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না; বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুণ্ডাবে বা ছোট করবে), নখ কাটবে, মোচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৭৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫
যবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলা
আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُضَحِّي بِكَبْشَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ، وَكَانَ يُسَمِّي وَيُكَبِّرُ، وَلَقَدْ رَأَيْتُهُ يَذْبَحُهُمَا بِيَدِهِ وَاضِعًا عَلَى صِفَاحِهِمَا قَدَمَهُ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড় শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো বর্ণের দুটি নর দুম্বা কুরবানী করতেন এবং তিনি বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার বলতেন।
বর্ণনাকারী আরও বলেন, আমি তাঁকে পশুর ঘাড়ের ডানপাশে পা রেখে নিজ হাতে যবাই করতে দেখেছি। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৯৬০, ১২১৪৭
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে অন্য বর্ণনায় আছে-
أَنَّهُ رَأَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَبَحَ أُضْحِيَّتَهُ بِيَدِهِ، وَكَانَ يُكَبِّرُ عَلَيْهَا.
অর্থাৎ তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাকবীর বলতে বলতে নিজ হাতে কুরবানীর পশু যবাই করতে দেখেছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৪৬৬
তিনি আরও বলেন-
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَبَحَ، فَسَمَّى وَكَبَّرَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বললেন অতঃপর যবাই করলেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৮৯৩
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরবানী
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন বড় শিংবিশিষ্ট ও সাদা কালো বর্ণের দুটি নর দুম্বা যবাই করেছেন। যখন যবাইয়ের জন্য শোয়ালেন, তখন বললেন-
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ، حَنِيْفًا مُسْلِمًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنَّ صَلَاتِيْ، وَنُسُكِيْ، وَمَحْيَايَ، وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَبِذلِكَ أُمِرْتُ، وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ، بِسْمِ اللهِ، واللهُ أَكْبَرُ، اللهُمَّ مِنْكَ، وَلَكَ عَنْ مُحَمَّدٍ، وَأُمَّتِهِ.
এরপর বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার বলে যবাই করলেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫০২২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৫
পূর্বে আনাস ইবনে মালেক রা.-এর একটি বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড় শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো বর্ণের দুটি নর দুম্বা কুরবানী করতেন এবং তিনি বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার বলতেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৯৬০, ১২১৪৭
এছাড়াও সামনে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর একটি বর্ণনা আসছে। যাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য বড় শিং এবং দুই পা, হাঁটু ও চোখের আশপাশে শুভ্রতাবিশিষ্ট একটি দুম্বা সংগ্রহের আদেশ করলেন। অতঃপর তা আনা হলে তিনি আমাকে বললেন, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে এস। অতঃপর বললেন, পাথর দিয়ে তা ধার দাও। আমি তা করলাম। অতঃপর তিনি তা নিলেন এবং দুম্বাটিকে ধরে শোয়ালেন। এরপর-
باسْمِ اللهِ، اللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُحَمَّدٍ، وآلِ مُحَمَّدٍ، ومِن أُمَّةِ مُحَمَّدٍ .
-বলতে বলতে তা যবাই করলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯২
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা
আলী রা. প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন।
আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-
أمرَني رَسولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أن أُضحِّيَ عنهُ، فأَنا أضحِّي عنهُ أبدًا.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসিয়ত করেছেন। তাই আমি সবসময় তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করি। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৭৭
অন্য বর্ণনায় হানাশ রাহ. বলেন, আমি আলী রা.-কে দুটি দুম্বা কুরবানী করতে দেখলাম। তখন জিজ্ঞাসা করলাম, দুটি কেন? তিনি বললেন-
إِنّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَوْصَانِي أَنْ أُضَحِّيَ عَنْهُ فَأَنَا أُضَحِّي عَنْهُ.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসিয়ত করেছেন। তাই আমি তাঁর পক্ষ থেকেও কুরবানী করি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯০; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৮৬
কুরবানীর পশুর বয়সসীমা
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَا تَذْبَحُوا إِلّا مُسِنّةً، إِلّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ، فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ الضّأْنِ.
তোমরা কুরবানীতে ‘মুছিন্না’ ছাড়া যবাই করো না। যদি তা পাওয়া দুষ্কর হয় তবে ৬ মাস বয়সের ভেড়া-দুম্বা যবাই করতে পার। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৭৯
ইমাম নববী রাহ. বলেন, মুছিন্না হল, ৫ বছর বয়সী উট, ২ বছরের গরু, মহিষ এবং ১ বছর বয়সী ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা। - শরহুল মুসলিম, ইমাম নববী ২/১৫৫
আরও দেখুন : তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৫৮
মাসআলা : কুরবানীর জন্য উট কমপক্ষে ৫ বছর বয়সের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ন্যূনতম ৬ মাস বা তার বেশি বয়সের কোনো ভেড়া বা দুম্বা যদি হৃষ্টপুষ্টতার কারণে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। ৬ মাসের কম হলে জায়েয হবে না।
উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে তা দ্বারা কোনো অবস্থাতেই কুরবানী করা জায়েয হবে না। -ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬
কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম
হাদীসে এসেছে-
أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ ضَحّى بِكَبْشَيْنِ سَمِينَيْنِ عَظِيمَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ مُوْجَيَيْنِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বড় শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো বর্ণের হৃষ্টপুষ্ট নর দুম্বা যবাই করেছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫০৪৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৫৯
যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয নয়
বারা ইবনে আযেব রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-
لَا يَجُوزُ مِنَ الضَّحَايَا أَرْبَعٌ : الْعَوْرَاءُ الْبَيِّنُ عَوَرُهَا، وَالْعَرْجَاءُ الْبَيِّنُ عَرَجُهَا، وَالْمَرِيضَةُ الْبَيِّنُ مَرَضُهَا، وَالْعَجْفَاءُ الَّتِي لَا تنقي.
চার প্রকারের পশু কুরবানী করা জায়েয নয়। যথা : পশুর উভয় বা কোনো এক চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট হলে, কোনো এক পা খেঁাড়া হলে, অতি রুগ্ন হলে এবং এত শীর্ণ পশু, যার অস্থিমজ্জা সারশূন্য হয়ে পড়েছে। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯২১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০২; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৪৪
আলী ইবনে আবী তালেব রা. বলেন-
نهى رسولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أن يُضَحّى بالمُقابَلَةِ أو بمُدابَرَةٍ أو شَرْقاءَ أو خَرْقاءَ أو جَدْعاءَ.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কানের অগ্রভাগ কাটা প্রাণী, কানের গোড়া থেকে কেটে ঝুলে আছে এমন প্রাণী, কান ফেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া প্রাণী, কানে গোল ছিদ্রবিশিষ্ট প্রাণী ও কান বা নাক একেবারে কেটে গেছে- এমন প্রাণী কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬০৯
আরেক বর্ণনায় আলী রা. বলেন-
نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم أن يضحي بعضباء القرن والأذن.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কান কিংবা শিংয়ের অর্ধেক বা তার বেশি ভেঙে গেছে- এমন প্রাণী কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৩৩
আলী রা. আরও বলেন-
أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نستشرف العين والأذن.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে (হাদী ও কুরবানীর) প্রাণীর চোখ ও কান সুস্থ হওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার আদেশ করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯২০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৪৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৩২
অন্য বর্ণনায় আছে, হুজাইয়া ইবনে আদী রাহ. বলেন, জনৈক ব্যক্তি আলী রা.-কে কুরবানীর গরু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, সাতজনের পক্ষ থেকে।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, শিং ভাঙা হলে?
আলী রা. বললেন, সমস্যা নেই।
জিজ্ঞাসা করলেন, আরজা (খোঁড়া) হলে?
তিনি বললেন, যবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারলে তা যবাই কর। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে (হাদী ও কুরবানীর) পশুর চোখ ও কান সুস্থ হওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার আদেশ করেছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৩৪
মাসআলা : এমন শুকনো ও দুর্বল পশু, যা যবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৭; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪
মাসআলা : যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙে গেছে, যার দরুন মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশু কুরবানী করা জায়েয নয়। কিন্তু শিং ভাঙার কারণে যদি মস্তিষ্কে আঘাত না পৌঁছে তাহলে সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। তাই যে পশুর শিং অর্ধেক বা কিছু অংশ ফেটে বা ভেঙে গেছে কিংবা শিং একেবারেই ওঠেনি, সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। -জামে তিরমিযী ১/২৭৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৭; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪
মাসআলা : যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশু কুরবানী করা জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের কম হয় তাহলে তা কুরবানী করা জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫; মুসনাদে আহমাদ ১/৬১০; ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৭-২৯৮; ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৫২
কুরবানীর পশু নিজে যবাই করা
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-
كان يذبح أضحيته بالمصلى يوم النحر، وذكر أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يفعله.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নহরের দিন ঈদগাহে পশু কুরবানী করতেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই যবাই করতেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫৮৭৬
আনাস ইবনে মালেক রা.-এর বর্ণনায় আছে-
أَنَّهُ رَأَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَبَحَ أُضْحِيَّتَهُ بِيَدِهِ، وَكَانَ يُكَبِّرُ عَلَيْهَا.
অর্থাৎ তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাকবীর বলতে বলতে নিজ হাতে কুরবানীর পশু যবাই করতে দেখেছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৪৬৬
উট, গরু বা মহিষে অংশিদার হওয়া
উট, গরু বা মহিষে এক থেকে সাত পর্যন্ত যেকোনো ভাগেই কুরবানী করা যায়। আর ভেড়া, দুম্বা বা ছাগল একজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা যায়। একাধিক অংশে তা কুরবানী করা জায়েয নয়।
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন-
خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مُهِلِّينَ بِالْحَجِّ : فَأَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ نَشْتَرِكَ فِي الْإِبِلِ وَالْبَقَرِ، كُلّ سَبْعَةٍ مِنّا فِي بَدَنَةٍ.
আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকে প্রতি উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করার আদেশ করলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৮
অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, একটি গরু সাত জনের পক্ষ থেকে এবং একটি উট সাত জনের পক্ষ থেকে (কুরবানী করা হবে)। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০০৬; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৯০১; জামে তিরমিযী, হাদীস ৯০৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০৮
এই হাদীসে একটি উট ও গরু সাতজনের পক্ষে যথেষ্ট হওয়ার কথা আছে। তাই অধিকাংশ আহলে ইলমের মতে, উট বা গরু সর্বোচ্চ সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয।
আলী রা., আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা., আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও আয়েশা রা. থেকে এমনটি বর্ণিত আছে।
এছাড়া আতা রাহ., তাওস রাহ., সালেম রাহ., হাসান রাহ. ও আমর ইবনে দীনার রাহ., ছাওরী রাহ., আওযায়ী রাহ., শাফেয়ী রাহ., আবু ছাওর রাহ. ও হানাফীগণও অনুরূপ বলেন।
তবে ওমর রা.-এর মতে, একটি প্রাণী সাতজনের পক্ষে যথেষ্ট হতে পারে না। ইমাম মালেক রাহ.-ও অনুরূপ মত পোষণ করেন।
ইমাম আহমাদ রাহ. বলেন, সাতজনের পক্ষ থেকে একটি প্রাণী যথেষ্ট না হওয়ার মতটি ওমর রা. ব্যতীত অন্য কেউ পোষণ করেন বলে আমার জানা নেই। -আলমুগনী, ইবনে কুদামা ১৩/৩৬৪
মাসআলা : উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। অর্থাৎ কুরবানীর পশুতে এক সপ্তমাংশ বা এর অধিক যে কোনো অংশে অংশীদার হওয়া জায়েয। এক্ষেত্রে ভগ্নাংশ যেমন, দেড় ভাগ, আড়াই ভাগ, সাড়ে তিন ভাগ হলেও কোনো সমস্যা নেই। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭
একটি দুম্বা বা ছাগল গোটা পরিবারের পক্ষে যথেষ্ট নয়
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন-
أنّ رَسولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أمَرَ بكَبْشٍ أقْرَنَ يَطَأُ في سَوادٍ، ويَبْرُكُ في سَوادٍ، ويَنْظُرُ في سَوادٍ، فَأُتِيَ به لِيُضَحِّيَ به، فَقالَ لَها: يا عائِشَةُ، هَلُمِّي المُدْيَةَ، ثُمَّ قالَ: اشْحَذِيها بحَجَرٍ، فَفَعَلَتْ: ثُمَّ أخَذَها، وأَخَذَ الكَبْشَ فأضْجَعَهُ، ثُمَّ ذَبَحَهُ، ثُمَّ قالَ: باسْمِ اللهِ، اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُحَمَّدٍ، وآلِ مُحَمَّدٍ، ومِن أُمَّةِ مُحَمَّدٍ، ثُمَّ ضَحّى بهِ.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য বড় শিং এবং দুই পা, হাঁটু ও চোখের আশপাশে কালো বর্ণ বিশিষ্ট একটি দুম্বা সংগ্রহের আদেশ করলেন। অতঃপর তা আনা হলে তিনি আমাকে বললেন, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আসো। অতঃপর বললেন, পাথর দিয়ে তা ধার দাও। আমি তা করলাম। অতঃপর তিনি তা নিলেন এবং দুম্বাটিকে ধরে শোয়ালেন। এরপর-
باسْمِ اللهِ، اللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُحَمَّدٍ، وآلِ مُحَمَّدٍ، ومِن أُمَّةِ مُحَمَّدٍ .
বলতে বলতে তা যবাই করলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯২
হাদীসে-
اللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُحَمَّدٍ، وآلِ مُحَمَّدٍ.
(হে আল্লাহ! আপনি তা মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কবুল করুন।) শব্দ থেকে বোঝা যায়, একটি কুরবানী ব্যক্তি ও তার পরিবারের সকলের পক্ষ থেকে গৃহিত হয়।
হাদীসের ব্যাখ্যা
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন, কুরবানীতে ব্যক্তির সাথে তার পরিবার-পরিজনদের অংশীদার হওয়ার দুটি অর্থ হতে পারে। যথা :
১. কুরবানী একজনের পক্ষ থেকেই আদায় হবে। তবে কুরবানীদাতা তার কুরবানীর সওয়াবটুকু অন্যদেরকে হাদিয়া করে দিবেন।
২. দ্বিতীয় অর্থ হল, কুরবানীর ছাগলের মালিকানার মধ্যেই অংশীদারিত্ব সাব্যস্ত হবে এবং তা দ্বারা একাধিক ব্যক্তির কুরবানী আদায় হয়ে যাবে।
অন্যান্য দলীলের আলোকে ইমাম আবু হানীফা রাহ. এই হাদীসে প্রথম অর্থেই পরিবার-পরিজনদের শরীক হওয়া উদ্দেশ্য নিয়েছেন। অর্থাৎ ব্যক্তির সাথে তার পরিবার-পরিজন শুধু কুরবানীর সওয়াবে অংশীদার হবে। মূল কুরবানীতে নয়। -তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৬৪
কুরবানীর গোশত জমিয়ে রাখা
মদীনাযুগের প্রথম দিকে একবার খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সাহাবায়ে কেরামকে তিন দিনের বেশি কুরবানীর গোশত সংরক্ষণ করে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। পরে সংকট দূর হলে তিনি আবার সংরক্ষণ করে রাখার অনুমতি দেন। জাবের রা. বলেন-
نَهَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عَنْ أَكْلِ لُحُومِ الضّحَايَا بَعْدَ ثَلَاثٍ، ثُمّ قَالَ بَعْدُ: كُلُوا، وَتَزَوّدُوا، وَادّخِرُوا.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন দিনের পর কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বললেন, খাও, পাথেয় হিসেবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২
আবু মূসা আশআরী রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
نَهَيْتُكُمْ عن زِيارَةِ القُبُورِ فَزُورُوها، ونَهَيْتُكُمْ عن لُحُومِ الأضاحي فَوْقَ ثَلاثٍ، فأمْسِكُوا ما بَدا لَكُم....
আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা তা যিয়ারত কর। তোমাদেরকে কুরবানীর গোশত তিন দিনের পরে খেতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমাদের খুশিমতো তা সংরক্ষণ করে রাখ। ... -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৩৯১, ৫৪০০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২০৩৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৯৮
সুলাইমান ইবনে বুরায়দা রাহ. নিজ পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
كنت نهيتكم عن لحوم الأضاحي فوق ثلاث ليتسع ذو الطول على من لا طول له، فكلوا ما بدا لكم، وأطعموا وادخروا.
আমি তোমাদেরকে তিন দিনের পর কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলাম, যেন স্বচ্ছল লোকেরা অসচ্ছলকে উদারভাবে তা দিতে পারে। এখন তোমরা যত খুশি খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সঞ্চয় করে রাখ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫১০
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই কুরবানী করার তাওফীক দান করুন। সকল ভুল-ত্রুটি থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের পক্ষ থেকে তা কবুল করুন- আমীন।