Zilhajj 1444   ||   July 2023

কুরআন কারীমে জুলুমের বিস্তৃত অর্থ

Mawlana Mummadullah Masum

জুলুম একটি বড় পাপ। জুলুম অতীতের নেক আমলগুলো নষ্ট করে দেয়, ভবিষ্যতের জন্য ডেকে আনে কঠিন পরিণতি। জুলুমের কারণে লোকে ঘৃণা করে, মজলুম বদদুআ করে। সর্বোপরি আল্লাহর অসন্তুষ্টি নেমে আসে জুলুমের কারণে। জুলুমের শাস্তি ও পরিণতিও সুদূরপ্রসারী। দুনিয়া ও আখেরাত, সবখানে জুলুমকারী শাস্তি পেতে থাকে।

জুলুম কেবল অন্যের প্রতি নয়, নয় কেবল বান্দার হক নষ্ট করার মাধ্যমে; জুলুম হয় নিজের প্রতিও- বিভিন্ন গোনাহ ও শরীয়তের হুকুম লঙ্ঘনের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ مَنْ يَّتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهٗ..

কেউ আল্লাহর (স্থিরীকৃত) সীমারেখা লঙ্ঘন করলে, সে তো তার নিজের উপরই জুলুম করল। -সূরা ত্বলাক (৬৫) : ১

আল্লাহর হুকুমের সামান্য বরখেলাফও যে নিজের প্রতি জুলুম, সেই অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল মানবের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, মানবজাতির পিতা হযরত আদম আ.-এর পবিত্র হৃদয়ে। তাই তিনি বলেছিলেন-

رَبَّنَا ظَلَمْنَاۤ اَنْفُسَنَا وَ اِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَ تَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِيْنَ.

হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজ সত্তার উপর জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও আমাদের প্রতি রহম না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অকৃতকার্যদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে যাব। -সূরা আরাফ (৭) : ২৩

প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটি বিষয়ও স্মরণ রাখতে পারি। অন্যের প্রতি অন্যায়-অনাচার করার যে জুলুম সেটিও কেবল অন্যের প্রতি নয়; প্রকারান্তরে নিজের প্রতিই জুলুম। এর ফলে জুলুমকারীর দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَّ لَا تُمْسِكُوْهُنَّ ضِرَارًا لِّتَعْتَدُوْا  و مَنْ يَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَه.

(স্ত্রীদেরকে) কষ্ট দেওয়ার লক্ষ্যে এজন্য আটকে রেখ না যে, তাদের প্রতি জুলুম করতে পারবে। যে ব্যক্তি এরূপ করবে, সে স্বয়ং নিজ সত্তার প্রতিই জুলুম করল। -সূরা বাকারা (২) : ২৩১

যাইহোক, আজকের অবসরে কুরআন কারীম থেকে জুলুমের বিশেষ কয়েকটি রূপ এখানে তুলে ধরার প্রয়াস পাব।

শিরকের মাধ্যমে নিজের প্রতি জুলুম

সত্যের সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ের প্রতি ঝুঁকে যাওয়া জুলুমের সারকথা। আল্লাহ আমার স্রষ্টা, এ সত্যও কি অস্বীকার করা যায়? কত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাকে! সুন্দর গড়ন ও গঠন, জ্ঞান-বুদ্ধি ও রুচি-প্রকৃতি, বৈচিত্র্যময় জীবন-যাপনের ব্যবস্থা- সবই তাঁর অপার দান। তিনি আমাদের রিযিক দান করেন। অসুস্থ হলে সুস্থ করেন। আমাদের আরও যত প্রয়োজন, সব তিনিই পূরণ করেন। সুতরাং ইবাদতও একমাত্র তাঁর জন্যে নিখাদ ও নিরংকুশভাবে নির্ধারিত। কিন্তু এতে যদি কাউকে শরীক ও অংশীদার বানানো হয়, তবে পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে! তাই আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে শিরককে সবচেয়ে বড় জুলুম আখ্যায়িত করেছেন। লোকমান আ. তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিয়েছিলেন এই বলে-

يٰبُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِ. اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ.

বাছা! আল্লাহর সাথে শিরক করো না। নিশ্চয়ই শিরক অনেক বড় জুলুম -সূরা লুকমান (৩১) : ১৩

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَ لَمْ يَلْبِسُوْۤا اِيْمَانَهُمْ بِظُلْمٍ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمُ الْاَمْنُ وَ هُمْ مُّهْتَدُوْنَ..

(প্রকৃতপক্ষে) যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমানকে জুলুমের সাথে মিশ্রিত করেনি, নিরাপত্তা ও স্বস্তি তো কেবল তাদেরই অধিকার এবং তারাই সঠিক পথে পেঁৗছে গেছে-সূরা আনআম (৬) : ৮২ 

মুফাস্সিরীনে কেরাম বলেন, এখানে জুলুম অর্থ শিরক।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন-

যখন আয়াতটি নাযিল হল, সাহাবায়ে কেরামের কাছে বিষয়টি অনেক কঠিন এবং চাপের হয়ে গেল। তাঁরা বললেন-

أَيُّنَا لَمْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ؟

ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে নিজের প্রতি অবিচার করে না?

তখন নবীজী বললেন, তোমরা যেমনটা বুঝেছ, তেমনটা নয়। লোকমান আ.-তাঁর সন্তানকে বলেছেন-

إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ.

নিশ্চয় শিরক বিরাট জুলুম। -তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ৪/১৩৩৩; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/২৯৪

আল্লামা তাবারী রাহ. লেখেন-

ولم يلبسوا إيمانهم بظلم، أي: بشرك.

-তাফসীরে তাবারী, ১১/৪৯৩

মূসা আ.-এর গোত্রের কিছু লোক যখন বাছুরের পূজা করেছিল, তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন-

يٰقَوْمِ اِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ اَنْفُسَكُمْ بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ.

হে আমার সম্প্রদায়! বাছুরকে উপাস্য বানিয়ে প্রকৃতপক্ষে তোমরা নিজেরা নিজেদের প্রতিই জুলুম করেছ। -সূরা বাকারা (২) : ৫৪

এছাড়াও কুরআন কারীমের আরও আয়াতে আল্লাহর সাথে শিরক করাকে জুলুম আখ্যায়িত করা হয়েছে।

গোনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া নিজের প্রতি জুলুম

ছোট হোক বা বড়, গোনাহ তো গোনাহই এবং সেটি নিজের প্রতি বড় অবিচার ও জুলুম। আল্লাহ তাআলা সেটিকে জুলুম আখ্যা দেওয়ার পর তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে ক্ষমার ঘোষণাও দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন-

وَ مَنْ يَّعْمَلْ سُوْٓءًا اَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهٗ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللهَ يَجِدِ اللهَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا..

যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ করে ফেলে বা নিজের প্রতি জুলুম করে বসে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, সে অবশ্যই আল্লাহকে অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালুই পাবে। -সূরা নিসা (৪) : ১১০

দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৪০৮

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

وَ الَّذِيْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوْبِهِمْ.

এবং তারা সেইসকল লোক, যারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনোভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রম্নতিতে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৫

দ্র. তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ৩/৭৬৫

শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন নিজের প্রতি জুলুম

যত নিআমত আল্লাহ আমাদের দান করেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ নিআমত ঈমান ও ইসলামী শরীয়ত। যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ ও রাসূলের নিখুঁত আনুগত্য প্রকাশ করতে পারি। বেঁচে যেতে পারি নিজের প্রতি জুলুম থেকে। কারণ শরীয়তের বাইরে মনচাহি জীবন যাপন প্রকৃতপক্ষে নিজের প্রতিই জুলুম ও অবিচার।

মুশরিক নর-নারীর সাথে বিবাহ নিষিদ্ধকরণ, পারিবারিক জীবন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিকনির্দেশনার পাশাপাশি অতি প্রয়োজনে বিচ্ছেদ বা ছাড়াছাড়ির পথে হাঁটতে হলে তার জন্যও পবিত্র কুরআন উৎকৃষ্ট পন্থা বাতলে দিয়েছে। পরিশেষে এসব বিধানকে আখ্যা দেয়া হয়েছে সীমা বলে। নীতিসম্মত এসব বিধান অমান্য করাকে বলা হয়েছে- সীমালঙ্ঘনআর এই সীমালঙ্ঘন যে করবে তাকে বলা হয়েছে- জালিমআয়াতের শেষে বলা হয়েছে-

تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ فَلَا تَعْتَدُوْهَا  وَ مَنْ يَّتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الظّٰلِمُوْن.

এটা আল্লাহর স্থিরীকৃত সীমা। সুতরাং তোমরা এসব লঙ্ঘন করো না। যারা আল্লাহর সীমা অতিক্রম করে তারা বড়ই জালিম। -সূরা বাকারা (২) : ২২৯

(বিস্তারিত দ্র. সূরা বাকারার ২২৯ নাম্বার আয়াত; তাফসীরে তাবারী, ৪/৫৮৪)

শরীয়ত-বিমুখতা নিজের প্রতি জুলুম

ইসলামী শরীয়ত আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া এক মহা নিআমত। এই নিআমতের যথাযথ মূল্যায়ন জরুরি। আর সেটি হতে পারে একমাত্র শরীয়ত অনুসরণের মাধ্যমেই। ইরশাদ হয়েছে-

ثُمَّ جَعَلْنٰكَ عَلٰي شَرِيْعَةٍ مِّنَ الْاَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَ الَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ.

(হে রাসূল!) আমি তোমাকে দ্বীনের এক বিশেষ শরীয়তের উপর রেখেছি। সুতরাং তুমি তারই অনুসরণ কর এবং যারা প্রকৃত জ্ঞান রাখে না, তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। -সূরা জাসিয়া (৪৫) : ১৮

এক হল শরীয়ত অনুসরণে ত্রুটি কিংবা অলসতা করা; কিন্তু যদি সরাসরি বিমুখতা প্রদর্শন করা হয়, বা ছলে-বলে-কৌশলে শরীয়তের বিধি-বিধানকে পাশ কাটিয়ে মনচাহি জীবন যাপন করা হয়, জেনেও না জানার ভান করে আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ-উপদেশকে উপেক্ষা করা হয়, তবে তা মহা অপরাধ এবং বড় জুলুম। ইরশাদ হয়েছে-

وَ مَنْ اَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِاٰيٰتِ رَبِّهٖ فَاَعْرَضَ عَنْهَا وَ نَسِيَ مَا قَدَّمَتْ يَدٰهُ.

সেই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় জালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া হলে সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং নিজ কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়? -সূরা কাহফ (১৮) : ৫৭

এছাড়াও আরও বহু আয়াত ও হাদীস রয়েছে, যেখানে শরীয়তের বিধান উপেক্ষা করাকে নিজের প্রতিই জুলুম সাব্যস্ত করা হয়েছে। কাজেই মুমিনের উচিত, এমন জুলুম থেকে সতর্কতার সাথে বেঁচে থাকা।

আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলা বড় জুলুম

সব যুগেই কুপ্রবৃত্তির অনুসারী লোকদের জন্য ঐশী অনুশাসন মেনে নেওয়া কষ্টকর হয়ে থাকে। তাই একেক সময় একেক উদ্দেশ্যে তারা শরীয়তের ব্যাপারে মিথ্যা আরোপ করে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত যেহেতু মক্কার মুশরিকদের আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী, তাদের পৌত্তলিকতাকে রদ করে, তাদের চিন্তা-চেতনার বিভ্রান্তি প্রমাণ করে এবং খেয়াল-খুশিমত জীবন-যাপনের নিন্দা করে, তাই একে মেনে নিতে তাদের কষ্ট হত। এ কারণেই তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কুরআনের রদবদল চেয়েছিল। তারা বলেছিল-

ائْتِ بِقُرْاٰنٍ غَيْرِ هٰذَاۤ اَوْ بَدِّلْهُ.

অন্য কোনো কুরআন নিয়ে এসো অথবা এতে পরিবর্তন আন।

আল্লাহ তাআলা নবীজীকে তার জবাব শিখিয়ে দিয়েছেন। পরিশেষে বলেছেন-

فَمَنْ اَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرٰي عَلَي اللهِ كَذِبًا اَوْ كَذَّبَ بِاٰيٰتِهٖ اِنَّهٗ لَا يُفْلِحُ الْمُجْرِمُوْنَ.

ওই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় জালেম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে কিংবা তার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে? বিশ্বাস কর, অপরাধীরা কৃতকার্য হয় না। -সূরা ইউনুস (১০) : ১৭

অর্থাৎ তারচেয়ে বড় জালিম আর কেউ নেই, যে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করে, তাঁর কালামকে পরিবর্তন করে এবং তার মধ্যে সংযোজন-বিয়োজন করে। এমনকি এই কুরআনকে প্রত্যাখ্যান বা অস্বীকার করে। (দ্র. তাফসীরে কুরতুবী ৮/৩২১)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

وَ مَنْ اَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرٰي عَلَي اللهِ كَذِبًا اَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَآءَهٗ  اَلَيْسَ فِيْ جَهَنَّمَ مَثْوًي لِّلْكٰفِرِيْنَ.

তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে কিংবা যখন তার কাছে সত্য বাণী পৌঁছে, তখন তা প্রত্যাখ্যান করে? (এরূপ) কাফেরদের ঠিকানা কি জাহান্নামে নয়? -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৬৮

অনেক সময় নিজেদের অন্যায়কে সঠিক সাব্যস্ত করার জন্যও তারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

তবে সেই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় জালেম আর কে হবে, যে কোনো জ্ঞানের ভিত্তি ছাড়াই মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ জালেম লোকদেরকে সৎপথে পেঁৗছান না। -সূরা আনআম (৬) : ১৪৪

অন্যায়ভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়া জুলুম

ইসলামের প্রথম যুগে প্রিয় সাবাহায়ে কেরামকে কত কষ্টই না সহ্য করতে হয়েছে। অপরাধ কেবল একটাই- কেন তারা ঈমান আনল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর? মরুভূমির উত্তপ্ত বালুরাশির ওপর খালি গায়ে তাঁদের শুইয়ে দিত। শুধু তাই নয়, দুষ্ট বালকদের লেলিয়ে দেওয়া, তাদের হাতে তুলে দেওয়া, গলায় রশি বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে অলিগলিতে ঘুরানোসহ হেন কোনো নির্যাতন নেই, যা তাঁরা মহান সাহাবায়ে কেরামের ওপর করেনি। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কিছু সাহাবী নবীজীর নির্দেশে হাবাশায় হিজরত করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের বিষয়ে বলেন-

وَ الَّذِيْنَ هَاجَرُوْا فِي اللهِ مِنْۢ بَعْدِ مَا ظُلِمُوْا لَنُبَوِّئَنَّهُمْ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً.

যারা নির্যাতিত হওয়ার পর আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হিজরত করেছে নিশ্চিত থেক আমি দুনিয়ায়ও তাদেরকে উত্তম নিবাস দান করব আর আখেরাতের প্রতিদান তো নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। -সূরা নাহল (১৬) : ৪১

মক্কা মুকাররমায় সুদীর্ঘ তের বছর পর্যন্ত মুমিনদেরকে সবর ও সংযম অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারাও সর্বোচ্চ ত্যাগের সাথে সেই নির্দেশ পালন করে গেছেন। যত কঠিন নির্যাতনই করা হোক অস্ত্র দ্বারা তার মোকাবেলা করার অনুমতি ছিল না। ফলে মুসলিমগণ জুলুমের জবাব সবর দ্বারাই দিতেন। একসময় পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ইরশাদ হয়-

اُذِنَ لِلَّذِيْنَ يُقٰتَلُوْنَ بِاَنَّهُمْ ظُلِمُوْا.

যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদেরকে অনুমতি দেওয়া যাচ্ছে (তারা নিজেদের প্রতিরক্ষার্থে যুদ্ধ করতে পারে)। যেহেতু তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। -সূরা হজ্ব (২২) ৩৯

অন্যের হক নষ্ট করা ভয়াবহ জুলুম

অন্যের হক নষ্ট করা বা যে কোনোভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়া ভয়াবহ জুলুম। এটি হয়ে থাকে সাধারণত শক্তিশালী কতৃর্ক দুর্বলের প্রতি, বড়র পক্ষ থেকে ছোটের প্রতি, ধনী কতৃর্ক গরিবের প্রতি, মালিক কতৃর্ক শ্রমিক বা কর্মচারীর প্রতি এবং শাসক কতৃর্ক জনগণের প্রতি। অথচ একটুও চিন্তা করা হয় না যে, যদিও আজ সে দুর্বল হওয়ার কারণে তার প্রতি জুলুম করা হচ্ছে, কাল আল্লাহ তাকে সবল করে দিতে পারেন। দুনিয়াতে যদিও কোনোভাবে পার পাওয়া যায়, কিন্তু আখেরাতে কী উপায়? কুরআন কারীমে এর জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা এসেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ لَمَنِ انْتَصَرَ بَعْدَ ظُلْمِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ مَا عَلَيْهِمْ مِّنْ سَبِيْلٍ، اِنَّمَا السَّبِيْلُ عَلَي الَّذِيْنَ يَظْلِمُوْنَ النَّاسَ وَ يَبْغُوْنَ فِي الْاَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ  اُولٰٓىِٕكَ لَهُمْ عَذَابٌاَلِيْمٌ..

যারা নিজেদের উপর জুলুম হওয়ার পর (সমপরিমাণে) বদলা নেয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ তো তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের উপর জুলুম করে ও পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। এরূপ লোকদের জন্য আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি। -সূরা শূরা (৪২) : ৪১-৪২

জুলুম হয় কখনো শারীরিকভাবে, কখনো মানসিকভাবে। কখনো সম্পদ লুট করে, কখনো সম্ভ্রমহানি করে। তা যেভাবেই করুক কিয়ামতের দিন তার মূল্য দিতেই হবে।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لِأَخِيهِ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَيْءٍ، فَلْيَتَحَلّلْهُ مِنْهُ اليَوْمَ، قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ  دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ، إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ، وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْهِ.

যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের সম্মানহানির মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রকারে তার উপর জুলুম করেছে, সে যেন আজই তার সাথে মুআমালা সাফ করে নেয়; সেই দিন আসার পূর্বেই, যেদিন তার কাছে কোনো দিনার-দিরহাম (টাকা-পয়সা) থাকবে না। সেদিন যদি তার কাছে কোনো নেক আমল থাকে তবে তার জুলুম পরিমাণ সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে (এবং পাওনাদারকে আদায় করা হবে।) আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে তাহলে যার উপর জুলুম করেছে তার পাপের বোঝা জুলুম অনুযায়ী জালেমের ঘাড়ে চাপানো হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪১৯

আরেকটি হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

اتَّقُوا الظُّلْمَ، فَإِنّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাকো! কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন বহু অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৯

হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي، وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا، فَلَا تَظَالَمُوا.

হে আমার বান্দাগণ! আমি জুলুম করাকে নিজের প্রতি হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং একে-অন্যের প্রতি জুলুম করো না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৯২

দ্বীনী কাজে বাধা দেয়া জুলুম

মসজিদ-মাদরাসা বা দ্বীনী কোনো কাজে বাধা দেয়া নিজের প্রতি জুলুম। মুশরিকরা বাইতুল্লাহ্র পথে মানুষকে বাধা দিত। তেমনি খ্রিস্টানরা বাধা দিত বাইতুল মাকদিসের পথে, যেমন আজ দিচ্ছে ইহুদীরা। এমন ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে দুনিয়াতে লাঞ্ছনা এবং আখেরাতে মহা শাস্তি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ مَنْ اَظْلَمُ مِمَّنْ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللهِ اَنْ یُّذْكَرَ فِیْهَا اسْمُهٗ وَ سَعٰی فِیْ خَرَابِهَا اُولٰٓىِٕكَ مَا كَانَ لَهُمْ اَنْ یَّدْخُلُوْهَاۤ اِلَّا خَآىِٕفِیْنَ،  لَهُمْ فِی الدُّنْیَا خِزْیٌ وَّ لَهُمْ فِی الْاٰخِرَةِ عَذَابٌ عَظِیْمٌ .

সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে আছে, যে আল্লাহর মসজিদসমূহে আল্লাহর নাম নিতে বাধা প্রদান করে এবং তাকে বিরান করার চেষ্টা করে? এরূপ লোকের তো ভীত-বিহ্বল না হয়ে তাতে প্রবেশ করাই সঙ্গত নয়। তাদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা এবং আখেরাতে রয়েছে মহা শাস্তি। -সূরা বাকারা (২) : ১১৪

জুলুমের রয়েছে আরও নানান রূপ, নানান ধরন। এখানে কিছু নমুনা পেশ করা হল। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার জুলুম থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement