তালিবে ইলমদের প্রথম দায়িত্ব
দরসিয়াতের বিষয়ে গুরুত্বারোপ
الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد!
এটি একটি স্বীকৃত কথা যে, দরসী কিতাব ইসতি‘দাদ তৈরির মূল ভিত্তি এবং উস্তায থেকে ইলম হাসিলের প্রধান মাধ্যম দরস। সেজন্য দরস, দরসী কিতাব ও দরস সংক্রান্ত যাবতীয় কাজই তালিবে ইলমের ইলমী ব্যস্ততার প্রধান উপকরণ। এগুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া এবং এগুলোর হক আদায় করা তালিবে ইলমের প্রধান দায়িত্ব।
ইসতি‘দাদের অনেক স্তর। একদম প্রাথমিক স্তরগুলোর মধ্যে একটি হল, ভাষাগত যোগ্যতা হাসিল করা। আরেকটি হল, ইলমী কিতাবগুলোর অর্থ-মর্ম সঠিকভাবে বোঝা, এরপর সেটাকে যবানে ও কলমে নিজের ভাষায় যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারা। এগুলো ইলমী যিন্দেগীর প্রধান শর্ত। এগুলো ছাড়া ইলমের ময়দানে এক কদমও চলা সম্ভব নয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব যোগ্যতা হাসিলের জন্যই দরসের ইনতিযাম। তাই তালিবে ইলমের যিন্দেগীতে দরসিয়াতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। দরসিয়াতের বিষয়ে যে কোনো ধরনের শিথিলতা ও উদাসীনতা মারাত্মক অন্যায়। এই উদাসীনতা ও শিথিলতা তালিবে ইলমের ইলমী যিন্দেগীকে বরবাদ করে দেয়।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উসূল হল —
ثَبِّت العَرْشَ، ثُمَّ انْقُشْ.
‘প্রথমে ভিত তৈরি কর, এরপর নকশা কর।’
তালিবে ইলমের যিন্দেগীতেও এই উসূল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রথম দায়িত্ব হল, ইলমী যিন্দেগীর ভিত তৈরি করা। ইসতি‘দাদের যে প্রাথমিক দুইটি মারহালা বলা হল, প্রথমে সেগুলো হাসিলের চেষ্টা করা।
এসো আরবী শিখি, তাইসীর থেকে কাফিয়া— এ জামাতগুলোর মূল উদ্দেশ্য ভাষাগত যোগ্যতা অর্জন করা। অর্থাৎ কিতাবের ইবারত শুদ্ধভাবে অনায়াসে পড়তে পারা, নাহবী তারকীব বোঝা, শব্দের ছরফী রূপ ও লুগাবী মাফহুম বোঝা এবং আরবী ভাষার সাধারণ যে কোনো কিতাব পড়ে বুঝতে পারা। সেজন্য খেয়াল রাখতে হবে, হেদায়াতুন নাহু, কাফিয়া জামাত পড়তে পড়তে যেন এই ন্যূনতম যোগ্যতাটুকু হাসিল হয়ে যায়। কেউ যদি কাফিয়া পর্যন্ত প্রত্যেক জামাতের দরসী কিতাবগুলো উস্তাযের নির্দেশনা মেনে মনোযোগ সহকারে তামরীন ও ইজরার সঙ্গে অধ্যয়ন করে, ইনশাআল্লাহ তার প্রথম মারহালার ইসতি‘দাদ তৈরি হয়ে যাবে।
আর কানয-শরহে বেকায়া থেকে দাওরায়ে হাদীস— এ জামাতগুলো মূলত ইলমী ও ফন্নী ইসতি‘দাদ তৈরি করার জন্য এবং ইলমী কিতাবের অর্থ-মর্ম, উসলূব ও তা‘বীর যথাযথভাবে বোঝার যোগ্যতা হাসিলের মেহনতের জন্য। অর্থাৎ কানয, আলবাহরুর রায়েক, হিদায়া, ফাতহুল কাদীর, তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে কুরতুবী, রূহুল মাআনী, ফায়যুল বারী, উমদাতুল কারী, ফাতহুল বারী, মাআরিফুস সুনান বা এ ধরনের যে কোনো ইলমী কিতাব যেন পড়ে বুঝতে পারে। মুশকিল জায়গাগুলোতে কেন ইশকাল হচ্ছে তা যেন অনুধাবন করতে পারে। তার মধ্যে যেন ভুল বুঝে ‘ইনশিরাহ’ হয়ে যাওয়ার রোগ না থাকে; অর্থাৎ কোনো ভুল অর্থ যেহেনে আসলে সেটা গ্রহণ করবে না, বরং সঠিক মর্মটা বোঝার চেষ্টা করবে। ইসতি‘দাদের এই মারহালার মেহনত কানয—শরহে বেকায়া থেকে শুরু করে দেওয়া উচিত।
উদাহরণস্বরূপ শরহে বেকায়ার খুতবায় আছে—
...لِتُغَيَّرَ النُّسَخُ الْمَكْتُوبَةُ إلَى هذا النَّمَط.
হিদায়াতে ‘নাওয়াকিযুল উযূ’র বহসে আছে—
ولأن خروجَ النجاسةِ مُؤثِّرٌ في زوالِ الطهارة، وهذا القدرُ في الأصلِ معقولٌ، والاقتصارُ على الأعضاءِ الأربعةِ غيرُ معقولٍ، لكنه يتعدّى ضرورةَ تعدِّي الأوّلِ.
তালিবে ইলমের কর্তব্য— যখন সে এ ধরনের ইবারত পড়বে, সে না বুঝে অগ্রসর হবে না। অনেক ছাত্র না বুঝেই সামনে চলে যায়। এরকম দায়সারাভাবে পড়লে কখনো ফাহম হাসিল হবে না।
হিদায়া সালেসের ‘ফাসলুন ফী আহকামিহী’-এর প্রথম মাসআলা ও এই ফসলেরই শেষ কয়েকটি মাসআলা—
ومن اشترى جارية بيعا فاسدا...
-সহ এ ধরনের বেশ কিছু জায়গা আছে, যেগুলোর শুধু শাব্দিক অর্থ জেনেই অধিকাংশ তালিবে ইলম তুষ্ট ও পরিতুষ্ট হয়ে যায় এবং মনে করে, বুঝে গেছে ও গভীর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
মোটকথা, কানয ও শরহে বেকায়ার জামাত থেকেই ইলমী ইসতি‘দাদ তৈরির অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
কিন্তু সমস্যা হল, আজকাল অনেক তালিবে ইলম ‘কিতাব বোঝা’ কাকে বলে— সেটাই বোঝে না। তারা অসম্পূর্ণ বুঝকে পূর্ণ বুঝ মনে করে। অস্পষ্ট বুঝকে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ বুঝ মনে করে। এমনকি গলদ বুঝকেও বুঝ মনে করে। মনে রাখবেন, শুধু তারকীব বোঝা বা শাব্দিক তরজমা বোঝাকে কিতাব বোঝা বলে না। কিতাব বোঝার সঠিক অর্থ হল, ইবারত বিশুদ্ধভাবে পড়তে পারা, নাহবী তারকীব বোঝা, আলফাযের ছরফী রূপ ও লুগাবি মাফহুম বুঝতে পারা। অতঃপর ইবারত থেকেই তার অর্থ-মর্ম এবং আলোচিত বিষয়ের সমাধান বুঝতে পারা। কোনো আরবী ইলমী শরহের সাহায্যে এই বুঝ অর্জন হওয়া দূষণীয় নয়। এমনকি প্রয়োজনে কারও সঙ্গে মুযাকারা করে যদি মতলব ও মাফহুম ইবারতের উপর মুনতাবিক করে নেওয়া যায়, সেটাও কিতাব বোঝা বলে গণ্য। মেহনত অব্যাহত থাকলে আশা করা যায়, একপর্যায়ে তা ইসতি‘দাদে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু শুধু দরসী তাকরীর শুনে বা কোনো শারহের সাহায্য নিয়ে মতলব ও মাফহুম বা তার খোলাসা অনুমান করতে পারলেও যদি এবারতের সাথে মিলিয়ে নিতে না পারে তাহলে তা কিতাবি ইসতি‘দাদের কোনো স্তরেই পড়ে না। এভাবে পড়ার দ্বারা ইসতি‘দাদ হাসিল হয় না। যিলকদ ১৪৩৩ হি. (অক্টোবর ২০১২ ঈ.) সংখ্যায় এ বিভাগে ‘তলাবায়ে কেরাম! কিতাব বুঝে পড়ুন’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহীগণ সেটি পড়তে পারেন। সেখানে আরও উদাহরণসহ বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে।
যাহোক এখানে আমার উদ্দেশ্য হল, তালিবে ইলমদের মেহনতের মূল ও প্রথম ক্ষেত্র কোনটি তা দেখানো। উপরের আলোচনা থেকে বোঝা গেল, মৌলিক ইসতি‘দাদ হাসিলের প্রধান মাধ্যম হল দরসী কিতাব। এটাই ইসতি‘দাদের মূল ভিত্তি। অতএব দরস ও দরস সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্মের পেছনে মেহনত করা তালিবে ইলমদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।
কিন্তু অধিকাংশ তালিবে ইলমের অবস্থা হল, তারা ভিত তৈরির ব্যাপারে চরম উদাসীন। অনেকে ইবতিদায়ী জামাতগুলোতেই উদাসীন থাকে; ফলে তাদের ইলমী যিন্দেগী অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। আর অনেকে ইসতি‘দাদের দ্বিতীয় মারহালা, অর্থাৎ ইলমী কিতাবসমূহ বোঝার মারহালায় এসে উদাসীন হয়ে যায়। ফলে তাদের আর ইলমী কিতাব বোঝার যোগ্যতা হয় না; বরং অলসতা ও উদাসীনতার কারণে প্রথম মারহালার ইসতি‘দাদও দুর্বল হয়ে যায়। এই উদাসীনতার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এক হল, ইলমের মহব্বত কমে যাওয়া, ইনহিমাক না থাকা ইত্যাদি। উদাসীনতার আরেকটা কারণ আছে, যেটা নেক সুরতে ধোঁকা। সেজন্য অনেকে তা ধরতে পারে না। সেটা হল, ইযাফী ও খারেজী মুতালাআর নামে দরসী কিতাবের বিষয়ে অবহেলা করা; ফলে মৌলিক ইসতি‘দাদ কাঁচা থেকে যায়।
একজন হিদায়া জামাতে পড়ছে। হঠাৎ মনে হল, তারীখে ইসলামী সম্পর্কে তার জানা দরকার। ব্যস, হিদায়ার মুতালাআ, তাকরার ও মুযাকারা রেখে সে ‘তারীখে উম্মতে মুসলিমা’ পড়া শুরু করল! আরেকজনের মনে হল, আরবী বা বাংলা সাহিত্যে মাহের হওয়া দরকার। সে দরসের পড়া রেখে সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। বছর শেষে দেখা যায়, মৌলিক ইসতি‘দাদে সে একেবারে কাঁচা।
এটা ইযাফী মুতালাআর গলত ব্যবহার। মনে রাখবেন, ইযাফী মুতালাআর দ্বারা মালূমাত হাসিল হয়; তবে ইসতি‘দাদ তৈরি হয় দরসিয়াতের দ্বারাই। কয়েক সংখ্যা আগেও এ বিভাগে ইযাফী মুতালাআ বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কারণ জরুরি ও উপকারী কাজও যদি বে-উসূলীর সঙ্গে করা হয়, সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে যায়।
সেজন্য তালিবে ইলমের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব দরসিয়াতের বিষয়ে যত্নবান হওয়া। অর্থাৎ—
১. নিয়মতান্ত্রিকভাবে সামনের সবক মুতালাআ করা।
২. দরসে নিয়মিত উপস্থিত থাকা এবং উস্তাযের তাকরীর মনোযোগ সহকারে শোনা ও পাঠ্যাংশ ভালোভাবে বুঝে নেওয়া।
৩. দরসের পর তাকরার ও মুযাকারার মাধ্যমে বিষয়টি ভালোভাবে আত্মস্থ করা।
৪. উস্তাযে মুহতারামের দেওয়া কাজগুলো যত্নসহকারে করা।
৫. তামরীন ও ইজরার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ ‘আততারীক ইলাল আরাবিয়া’র সঙ্গে ‘আততামরীনুল কিতাবী’-এর তামরীনগুলো যথাযথভাবে করা। নাহু-ছরফের যেসব বহস ও কায়েদা পড়া হয়েছে সেগুলো নিজে নিজে তামরীন করার চেষ্টা করা। কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতের সময় সেগুলো ইজরা করা।
৬. মুসান্নিফীনে কেরামের উসলূবে আরয এবং তাঁদের ইলমী তা‘বীরাতের সাথে উন্স পয়দা করার চেষ্টা করা।
৭. কিতাবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার খোলাসা নিজের ভাষায় লিখে উস্তাযকে দেখানো।
৮. উস্তাযের তত্ত্বাবধানে মুআবিনে নেসাব হিসেবে নির্বাচিত সামান্য কিছু শুরূহ-হাওয়াশী বা কিতাব মুতালাআ করা এবং সেখানকার কিছু বহস উস্তাযকে শুনিয়ে নিজের বুঝ যাচাই করা এবং উস্তায যে সমস্যা ও দুর্বলতাগুলো ধরিয়ে দেবেন সেগুলো দূর করার চেষ্টা করা।
৯. আসাতিযায়ে কেরামের কাছে থেকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মাসলাক ভালোভাবে বুঝে নেওয়া এবং আকাবির ও আসলাফের যওক ও মেযাজ বোঝার চেষ্টা করা।
১০. আদব, আখলাক ও আফকারের এসলাহের চেষ্টা করা।
এগুলো তালিবে ইলমের প্রধান ইলমী ও আমলী কাজ। সবর ও ইসতিকামাতের সঙ্গে এ কাজগুলো করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ একসময় ইসতি‘দাদের এ স্তরটি পাকা হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন— আমীন।
আরযগুযার
বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
২২-১০-৪৪ হি. শনিবার