রাব্বুল আলামীনের গুণ-পরিচয়
যেসব সিফাত তাঁর সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য
গত সংখ্যায় আমরা আলোচনা করেছি, আল্লাহ তাআলার সিফাতে ‘রুবুবিয়্যাত’ সম্পর্কে। অর্থাৎ তাঁর কর্মগত গুণাবলি সম্পর্কে। এবং আলোচনা করেছি, তাঁর ‘ইলাহিয়্যাত’ ও উপাস্যত্ব সম্পর্কে; যা মূলত তাঁর ‘রুবুবিয়্যাত’ গুণেরই অপরিহার্য দাবি ও হক।
এখন সামনে আমরা আলোচনা করব, আল্লাহ তাআলার সত্তাগত ঐসব অপরিহার্য সিফাত ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে, যেগুলো সাধারণ বিচার-বুদ্ধিতেও তাঁর সকল সৃষ্টিকর্মের ও প্রতিপালনকর্মের মূল ভিত্তি। অর্থাৎ সত্তাগত যেসব সিফাতের অধিকারী হওয়ার কারণে কিংবা সত্তাগত যেসব সিফাত দ্বারা তিনি সৃষ্টিকর্ম করেন, সৃষ্টিকে প্রতিপালন করেন, পরিচালনা করেন এবং বিচার করেন। অন্যভাবে বললে, যেসব সিফাত ছাড়া জগতের সবকিছুকে সৃষ্টি করা এবং সকল সৃষ্টিকে প্রতিপালন করা ও নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হওয়ার কারণে সেগুলো মহামহিম আল্লাহর পবিত্র সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হওয়া যুক্তি-বুদ্ধির বিচারে সহজেই বোধগম্য।
যেমন, সহজাত বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা একথা সহজেই বোধগম্য যে, ‘ইলাহ’ ও মাবূদ কেবল এমন কোনো সত্তাকেই বলা যায়, যিনি হবেন চিরন্তন ও অবিনশ্বর এবং সর্বশক্তিমান। ফলে যা-ইচ্ছা হয় তা-ই তিনি করতে সক্ষম হবেন, যে-কোনো কাজ করার ক্ষমতা তাঁর থাকবে, সকলের উপর তিনি বিজয়ী ও পরাক্রমশালী হবেন, যাঁর ইচ্ছায় সবকিছু ঘটবে, কিন্তু তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই ঘটবে না। এমনিভাবে তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সর্বোতভাবে নির্মুখাপেক্ষী হবেন; সবাই যাঁর মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি কারও বা কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন। যিনি তাঁর সকল মাখলূকের ও সকল বান্দার প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হবেন, সবার ডাক ও প্রার্থনা শুনতে সক্ষম হবেন এবং সবার ডাকে সাড়া দিতেও সক্ষম হবেন। যিনি দৃশ্য ও অদৃশ্য এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্বন্ধে সমানভাবে ও পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাত হবেন, যাঁর জ্ঞান হবে নিখঁুত, নিশ্চিত ও অনন্ত অসীম।
তাই তো কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলাই যে প্রকৃত ইলাহ ও রব্ব তার স্বপক্ষে উপরিউক্ত গুণাবলিকেই প্রামাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর গায়রুল্লাহ যে খোদা ও ইলাহ হওয়ার মোটেও যোগ্য নয়, তা সাব্যস্ত করার জন্য তাদের নশ্বরতা, অক্ষমতা, অসহায়ত্ব, মুখাপেক্ষিতা, দুর্বলতা, অসম্পূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার কথাই তুলে ধরা হয়েছে। নমুনাস্বরূপ কুরআন কারীমের কিছু আয়াত এখানে উল্লেখ করছি। এবিষয়ে কুরআনে কারীমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যুক্তি-প্রমাণ সমৃদ্ধ যেসব সংলাপ বর্ণিত হয়েছে তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
যেমন, সূরা বাকারার ২৫৮ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে—
اَلَمْ تَرَ اِلَي الَّذِيْ حَآجَّ اِبْرٰهٖمَ فِيْ رَبِّهٖۤ اَنْ اٰتٰىهُ اللهُ الْمُلْكَ اِذْ قَالَ اِبْرٰهٖمُ رَبِّيَ الَّذِيْ يُحْيٖ وَ يُمِيْتُ قَالَ اَنَا اُحْيٖ وَ اُمِيْتُ قَالَ اِبْرٰهٖمُ فَاِنَّ اللهَ يَاْتِيْ بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَاْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِيْ كَفَرَ وَ اللهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظّٰلِمِيْنَ.
তুমি কি সেই ব্যক্তির অবস্থা চিন্তা করেছ, যাকে আল্লাহ রাজত্ব দান করার কারণে সে নিজ প্রতিপালক সম্পর্কে ইবরাহীমের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়?
যখন ইবরাহীম বলল, আমার প্রতিপালক তিনিই, যিনি জীবনও দান করেন এবং মৃত্যুও!
তখন সে বলতে লাগল, আমিও জীবন দেই এবং মৃত্যু ঘটাই!
ইবরাহীম বলল, আচ্ছা! তাহলে আল্লাহ তো সূর্যকে পূর্ব থেকে উদিত করেন, তুমি তা পশ্চিম থেকে উদিত কর তো! এ কথায় সে কাফির নিরুত্তর হয়ে গেল। আর আল্লাহ (এরূপ) জালিমদেরকে হেদায়েত করেন না। —সূরা বাকারা (২) : ২৫৮
এ আয়াত থেকে সহজেই বোঝা যায়, প্রকৃত রবের একটি অপরিহার্য গুণ হল, তিনি জীবন ও মৃত্যুদানে সক্ষম হবেন এবং নিজ ইচ্ছা অনুসারে অন্য যে-কোনো কাজ করতে সক্ষম হবেন। এমনকি তিনি ইচ্ছা করলে প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের ঊর্ধ্বেও সবকিছু করতে সক্ষম হবেন। তিনি সূর্যকে পূর্বদিকের পরিবর্তে পশ্চিম দিক থেকেও উদিত করতে পারেন। তাই তো কিয়ামতের পূর্বে তাঁর হুকুমে সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে।
সূরা আনআমে ইরশাদ হয়েছে—
وَ اِذْ قَالَ اِبْرٰهِيْمُ لِاَبِيْهِ اٰزَرَ اَتَتَّخِذُ اَصْنَامًا اٰلِهَةً اِنِّيْۤ اَرٰىكَ وَ قَوْمَكَ فِيْ ضَلٰلٍ مُّبِيْنٍ، وَ كَذٰلِكَ نُرِيْۤ اِبْرٰهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ لِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوْقِنِيْنَ،فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ الَّيْلُ رَاٰ كَوْكَبًا قَالَ هٰذَا رَبِّيْ فَلَمَّاۤ اَفَلَ قَالَ لَاۤ اُحِبُّ الْاٰفِلِيْنَ،فَلَمَّا رَاَ الْقَمَرَ بَازِغًا قَالَ هٰذَا رَبِّيْ فَلَمَّاۤ اَفَلَ قَالَ لَىِٕنْ لَّمْ يَهْدِنِيْ رَبِّيْ لَاَكُوْنَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّآلِّيْنَ،فَلَمَّا رَاَ الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هٰذَا رَبِّيْ هٰذَاۤ اَكْبَرُ فَلَمَّاۤ اَفَلَتْ قَالَ يٰقَوْمِ اِنِّيْ بَرِيْٓءٌ مِّمَّا تُشْرِكُوْنَ، اِنِّيْ وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ حَنِيْفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ.
এবং (সেই সময়ের বৃত্তান্ত শোন) যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিল, আপনি কি মূর্তিদেরকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছেন? আমি তো দেখছি, আপনি ও আপনার স¤প্রদায় স্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত রয়েছেন। আর এভাবেই আমি ইবরাহীমকে আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর রাজত্ব প্রদর্শন করাই। আর উদ্দেশ্য ছিল, সে যেন পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপনকারীদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে যায়। সুতরাং যখন তার উপর রাত ছেয়ে গেল, তখন সে একটি নক্ষত্র দেখে বলল, ‘এই আমার প্রতিপালক’। অতঃপর সেটি যখন ডুবে গেল, সে বলল, যা কিছু ডুবে যায় আমি তা পছন্দ করি না। অতঃপর যখন সে চাঁদকে উজ্জ্বলরূপে উদিত হতে দেখল তখন বলল, ‘এই আমার রব্ব’। কিন্তু যখন সেটিও ডুবে গেল, তখন বলতে লাগল, আমার রব্ব আমাকে হেদায়েত না দিলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্ট লোকদের দলভুক্ত হয়ে যাব। তারপর যখন সে সূর্যকে সমুজ্জ্বলরূপে উদিত হতে দেখল তখন বলল, এই আমার রব্ব। এটি বেশি বড়। তারপর যখন সেটিও ডুবে গেল তখন সে বলল, হে আমার কওম! তোমরা যেসকল জিনিসকে (আল্লাহর সঙ্গে) শরীক কর, তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিজের মুখ ফেরালাম, যিনি আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি শিরককারীদের অন্তভুর্ক্ত নই। —সূরা আনআম (০৬) : ৭৪-৭৯
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ‘ইরাকের নীনাওয়া’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেখানকার লোকেরা মূর্তি ও নক্ষত্র পূজা করত। তাঁর পিতা আযরও সেই বিশ্বাসেরই অনুসারী ছিল; বরং সে নিজে মূর্তি তৈরি করত। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম শুরু থেকেই তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি শিরককে ঘৃণা করতেন। তবে তিনি নিজ সম্প্রদায়কে চিন্তা-ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে এই সূক্ষ্ম পন্থা অবলম্বন করলেন যে, তিনি চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রকে দেখে প্রথমে নিজ কওমের ভাষায় কথা বলা শুরু করলেন। উদ্দেশ্য ছিল একথা বোঝানো যে, তোমাদের ধারণায় তো এসব নক্ষত্র আমার রব্ব। তবে এসো, আমরা খতিয়ে দেখি, একথা মেনে নেওয়ার উপযুক্ত কি না। সুতরাং যখন নক্ষত্র ও চন্দ্র ডুবে গেল এবং শেষ পর্যন্ত সূর্যও; তখন প্রত্যেকবারই তিনি নিজ কওমকে স্মরণ করালেন যে, এসব তো অস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল জিনিস। যে জিনিস নিজেই অস্থায়ী আবার তাতে ক্রমাগত পরিবর্তনও ঘটতে থাকে, সে সম্পর্কে এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, সে নিখিল বিশ্বকে প্রতিপালন করে— এটা কতই না অযৌক্তিক ও নির্বুদ্ধিতাপ্রসূত কথা।
তো হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের উপরোক্ত যৌক্তিক সংলাপ থেকে আমরা স্পষ্টতই বুঝতে পারি যে, নশ্বরতা ও অস্থায়িত্ব এবং পরিবর্তনশীলতা হল ইলাহিয়্যাতের পরিপন্থী বিষয়। আর লয়, ক্ষয় ও পরিবর্তন থেকে মুক্ত হওয়া এবং নিত্যতা ও চিরন্তনতা হল ইলাহিয়্যাত ও ইশ্বরত্বের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য।
‘সূরা শুআরা’য় ইরশাদ হয়েছে—
وَ اتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَاَ اِبْرٰهِيْمَ، اِذْ قَالَ لِاَبِيْهِ وَ قَوْمِهٖ مَا تَعْبُدُوْنَ،قَالُوْا نَعْبُدُ اَصْنَامًا فَنَظَلُّ لَهَا عٰكِفِيْنَ،قَالَ هَلْ يَسْمَعُوْنَكُمْ اِذْ تَدْعُوْنَ،اَوْ يَنْفَعُوْنَكُمْ اَوْ يَضُرُّوْنَ،قَالُوْا بَلْ وَجَدْنَاۤ اٰبَآءَنَا كَذٰلِكَ يَفْعَلُوْنَ،قَالَ اَفَرَءَيْتُمْ مَّا كُنْتُمْ تَعْبُدُوْنَ،اَنْتُمْ وَ اٰبَآؤُكُمُ الْاَقْدَمُوْنَ،فَاِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِّيْۤ اِلَّا رَبَّ الْعٰلَمِيْنَ، الَّذِيْ خَلَقَنِيْ فَهُوَ يَهْدِيْنِ،وَ الَّذِيْ هُوَ يُطْعِمُنِيْ وَ يَسْقِيْنِ،وَ اِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِيْنِ،وَ الَّذِيْ يُمِيْتُنِيْ ثُمَّ يُحْيِيْنِ، وَ الَّذِيْۤ اَطْمَعُ اَنْ يَّغْفِرَ لِيْ خَطِيْٓـَٔتِيْ يَوْمَ الدِّيْنِ.
(হে নবী!) তাদেরকে শোনাও ইবরাহীমের বৃত্তান্ত। যখন সে তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কীসের ইবাদত কর?
তারা বলল, আমরা প্রতিমাদের ইবাদত করি এবং তাদেরই সামনে ধরনা দিয়ে থাকি।
ইবরাহীম বলল, তোমরা যখন তাদেরকে ডাক তখন তারা কি তোমাদের কথা শোনে? কিংবা তারা কি তোমাদের কোনো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে?
তারা বলল, আসল কথা হল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এমনই করতে দেখেছি।
ইবরাহীম বলল, তোমরা কি কখনো গভীরভাবে লক্ষ করে দেখেছ, তোমরা কীসের ইবাদত করছ? তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদাগণ? এরা সব আমার শক্র— এক রাব্বুল আলামীন ছাড়া। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনিই আমার পথপ্রদর্শন করেন। এবং আমাকে খাওয়ান ও পান করান। এবং আমি যখন পীড়িত হই, আমাকে শেফা দান করেন। এবং যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, ফের আমাকে জীবিত করবেন। এবং যার কাছে আমি আশা রাখি, হিসাব-[নিকাশের দিন তিনি অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন।—সূরা শুআরা (২৬) : ৭৯-৮২
লক্ষ করুন, উপরোক্ত আয়াতগুলোতে ডাক ও ফরিয়াদ না-শোনা, ডাকে সাড়া দিতে না-পারা এবং চাইলেই কারও উপকার বা ক্ষতি করতে না-পারাকে ইলাহিয়্যাত ও ইশ্বরত্বের বিরোধী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, সকল বান্দার ডাক ও ফরিয়াদ শুনতে পারা, ডাকে সাড়া দিতে পারা এবং নিজ ইচ্ছানুযায়ী কারও ইষ্ট-অনিষ্ট করার ক্ষমতা হল ইলাহের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য। এমনিভাবে সৃষ্টি করার ক্ষমতা, জীবন ও মৃত্যুদানের ক্ষমতা, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করার ক্ষমতা, রোগ-বালা থেকে শেফা দানের ক্ষমতা এবং অপরাধ মার্জনা করার ক্ষমতা ইত্যাদি ইলাহের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। এসব মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকা যে প্রকৃত ইলাহের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য এবং না-থাকা ইলাহ না-হওয়ার প্রমাণ— তা কুরআন মাজীদের আরও বহু আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
যেমন, সূরা ফাতিরে বর্ণিত হয়েছে—
يُوْلِجُ الَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَ يُوْلِجُ النَّهَارَ فِي الَّيْلِ وَ سَخَّرَ الشَّمْسَ وَ الْقَمَرَؗ كُلٌّ يَّجْرِيْ لِاَجَلٍ مُّسَمًّي ذٰلِكُمُ اللهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ وَ الَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهٖ مَا يَمْلِكُوْنَ مِنْ قِطْمِيْرٍ، اِنْ تَدْعُوْهُمْ لَا يَسْمَعُوْا دُعَآءَكُمْ وَ لَوْ سَمِعُوْا مَا اسْتَجَابُوْا لَكُمْ وَ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ يَكْفُرُوْنَ بِشِرْكِكُمْ وَ لَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيْرٍ،يٰۤاَيُّهَا النَّاسُ اَنْتُمُ الْفُقَرَآءُ اِلَي اللهِ وَ اللهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيْدُ، اِنْ يَّشَاْ يُذْهِبْكُمْ وَ يَاْتِ بِخَلْقٍ جَدِيْدٍ، وَ مَا ذٰلِكَ عَلَي اللهِ بِعَزِيْزٍ.
তিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবিষ্ট করান এবং দিনকে প্রবিষ্ট করান রাতের মধ্যে। তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কাজে লাগিয়ে রেখেছেন। (এর) প্রত্যেকটি এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত পরিভ্রমণ করে। ইনিই আল্লাহ— তোমাদের প্রতিপালক। সকল রাজত্ব তাঁরই। তাঁকে ছেড়ে যাদেরকে (অর্থাৎ যেসব অলীক প্রভুকে) তোমরা ডাক, তারা খেজুর বিচির আবরণের সমানও কিছুর অধিকার রাখে না। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনবেই না আর শুনলেও তোমাদেরকে কোনো সাড়া দিতে পারবে না। কিয়ামতের দিন তারা নিজেরাই তোমাদের শিরককে অস্বীকার করবে। যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে অবগত সত্তার মতো সঠিক সংবাদ তোমাকে আর কেউ দিতে পারবে না। হে মানুষ! তোমরা সকলেই আল্লাহর মুখাপেক্ষী, কিন্তু আল্লাহ কারও মুখাপেক্ষী নন এবং তিনিই প্রশংসার উপযুক্ত। তিনি চাইলে তোমাদের সকলকে ধ্বংস করে দিতে পারেন এবং অস্তিত্বে আনয়ন করতে পারেন এক নতুন সৃষ্টিকে। আর এ কাজ আল্লাহর জন্য কিছুমাত্র কঠিন নয়। —সূরা ফাতির (৩৫) : ১৩-১৭
সূরা মায়িদায় হযরত ঈসা ইবনু মারইয়াম আলাইহিস সালামের ব্যাপারে খ্রিস্টানদের ভ্রান্ত আকীদার খণ্ডনে বলা হয়েছে—
لَقَدْ كَفَرَ الَّذِيْنَ قَالُوْۤا اِنَّ اللهَ هُوَ الْمَسِيْحُ ابْنُ مَرْيَمَ قُلْ فَمَنْ يَّمْلِكُ مِنَ اللهِ شَيْـًٔا اِنْ اَرَادَ اَنْ يُّهْلِكَ الْمَسِيْحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَ اُمَّهٗ وَ مَنْ فِي الْاَرْضِ جَمِيْعًا وَ لِلهِ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ مَا بَيْنَهُمَا يَخْلُقُ مَا يَشَآءُ وَ اللهُ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ.
যারা বলে, মারইয়াম তনয় মাসীহই আল্লাহ, তারা নিশ্চিত কাফির হয়ে গিয়েছে। (হে নবী! তাদেরকে) বলে দাও, মারইয়াম তনয় মাসীহ, তার মা এবং পৃথিবীতে যারা আছে তাদের সকলকে যদি আল্লাহ ধ্বংস করতে চান, তবে কে আছে, যে আল্লাহর বিপরীতে কিছুমাত্র করার ক্ষমতা রাখে? আকাশমণ্ডল, পৃথিবী ও এতদুভয়ের মাঝখানে যা-কিছু আছে, সে সমুদয়ের মালিকানা কেবল আল্লাহরই। তিনি যা-কিছু চান সৃষ্টি করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী। —সূরা মায়েদা (০৫) : ১৭
এই আয়াতে হযরত মাসীহ আলাইহিস সালাম এবং তাঁর মাতা মারইয়ামকে খোদা বলে বিশ্বাস করার ভ্রান্ত আকীদাকে খণ্ডন করা হয়েছে তাদের ধ্বংসশীলতার কথা উল্লেখ করে। এরপর আসমান—যমীনের একক মালিকানা, যা-ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করার ক্ষমতা এবং সর্ব বিষয়ে পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হওয়াকে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
সূরা মায়িদার অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে—
مَا الْمَسِيْحُ ابْنُ مَرْيَمَ اِلَّا رَسُوْلٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ وَ اُمُّهٗ صِدِّيْقَةٌ كَانَا يَاْكُلٰنِ الطَّعَامَ اُنْظُرْ كَيْفَ نُبَيِّنُ لَهُمُ الْاٰيٰتِ ثُمَّ انْظُرْ اَنّٰي يُؤْفَكُوْنَ، قُلْ اَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لَا يَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَّ لَا نَفْعًا وَ اللهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ.
মাসীহ ইবনে মারইয়াম তো একজন রাসূলই ছিলেন, (তার বেশি কিছু নয়)। তার পূর্বেও বহু রাসূল গত হয়েছে। তার মা ছিল সিদ্দীকা। তারা উভয়ে খাবার খেত। দেখ, আমি তাদের সামনে নিদর্শনাবলি কেমন সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করছি। তারপর এটাও দেখ যে, তাদেরকে উল্টোমুখে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! (হে নবী! তাদেরকে) বলে দাও, তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন সৃষ্টির ইবাদত করছ, যা তোমাদের কোনো উপকার করার ক্ষমতা রাখে না এবং অপকার করারও না? অথচ আল্লাহই সবকিছুর শ্রোতা ও সকল বিষয়ের জ্ঞাতা। —সূরা মায়েদা (০৫) : ৭৫-৭৬
দেখুন, উক্ত আয়াতে খাবারের প্রতি মুখাপেক্ষিতা বা খাবার গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে ইলাহ না-হওয়ার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এমনিভাবে ইচ্ছানুসারে ইষ্ট-অনিষ্ট করার ক্ষমতা না-থাকাকেও ইলাহ না-হওয়ার প্রমাণরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী হওয়াকে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
সারকথা হল, খোদা বা ইলাহের সত্তাগত এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো ছাড়া তাঁর ইলাহ হওয়ার বিশ্বাস সম্পূর্ণ অমূলক ও অযৌক্তিক। তাই প্রকৃত ইলাহ সেসব সত্তাগত সিফাত ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারীÑ এই বিশ্বাস রাখা যৌক্তিকভাবে তাঁর অস্তিত্বের বিশ্বাসের অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এধরনের সত্তাগত ও অপরিহার্য গুণাবলিগুলো কী কী তার তালিকা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ সামনে উল্লেখ করা হল।
১. আল্লাহ তাআলা ‘আলআওয়াল’ — আদি ও সর্বাতীত সত্তা
কেননা যিনি সবকিছুর সৃষ্টিকারী ও সূচনাকারী তিনি অবশ্যই সবকিছুর আগে থাকবেন, তাঁর আগে কিছুই থাকবে না এবং তাঁর অস্তিত্ব হবে সূচনাবিহীন, নিত্য, চিরন্তন ও অবশ্যম্ভাবী। অন্যথায় তিনি সবকিছুর স্রষ্টা হবেন কীভাবে? তো আল্লাহ তাআলাই যেহেতু জগতের সবকিছুর স্রষ্টা, তাই তিনি অবশ্যই সর্বাতীত ও আদি সত্তা, তার আগে কিছু নেই। তিনি সূচনাবিহীন আদি সত্তা, তাঁর অস্তিত্বের কোনো শুরু নেই, তিনি সর্বদাই আছেন, তিনি তখনো ছিলেন যখন অন্য কিছু ছিল না। তারপর তিনি একসময় নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন বস্তু পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন, যার বিস্তারিত বিবরণ কুরআনে কারীমে এবং হাদীসে নববীতে বর্ণিত হয়েছে।
কুরআন মাজীদে সূরা হাদীদের ৩ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে—
هُوَ الْاَوَّلُ وَ الْاٰخِرُ وَ الظَّاهِرُ وَ الْبَاطِنُ وَ هُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ.
উক্ত আয়াতে একসঙ্গে পাঁচটি সিফাত বর্ণিত হয়েছে। প্রথমে ‘আলআওয়াল’ সিফাতটি বর্ণিত হয়েছে, যার অর্থ প্রথম ও আদি সত্তা। কালামশাস্ত্রবিদগণ এই সিফাতটিকে বোঝানোর জন্য যুক্তিশাস্ত্রের ভাষায় ‘আলকদীম’ শিরোনামে উল্লেখ করে থাকেন।
এক হাদীসে বর্ণিত আছে, ইয়ামান থেকে আগত কিছু সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমরা আপনার কাছে এসেছি দ্বীনের সমঝ অর্জনের জন্য এবং এই সৃষ্টিজগতের সূচনা কীভাবে হল তা জিজ্ঞাসা করার জন্য।
তখন নবীজী জবাবে বললেন—
كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ غَيْرُهُ، وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى المَاءِ، وَكَتَبَ فِي الذِّكْرِ كُلَّ شَيْءٍ، ثُمَّ خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ.
(جمعا بين الروايتين من صحيح البخاري برقم ৩১৯১، و৭৪১৮).
অর্থাৎ আল্লাহ সর্বদাই আছেন। একসময় আল্লাহ ছাড়া কিছুই ছিল না। তারপর পানির উপর আল্লাহর আরশ সৃষ্টি হল এবং আল্লাহ তাআলা ‘যিকরে’ (অর্থাৎ লাওহে মাহফূযে) সবকিছু লিখলেন। তারপর তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করলেন। —সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১৯১, ৭৪১৮
২. তিনি ‘আলআখির’ — অন্ত ও সর্বশেষ সত্তা
আল্লাহ তাআলাই যেহেতু সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, ধ্বংসকর্তা এবং বিচারকর্তা, তাই তিনি সর্বদা থাকবেন, সবকিছু ফানা ও ধ্বংস হওয়ার পরও তিনি থাকবেন। তিনি মৃতকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম এবং ধ্বংসপ্রাপ্তকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম। তাই তিনিই সৃষ্টিজগৎকে ফানা ও ধ্বংস করার পর তা পুনরায় সৃষ্টি করবেন। সবকিছু ধ্বংসশীল, কিন্তু তাঁর পবিত্র সত্তা সবধরনের লয় ও ক্ষয় থেকে চিরপবিত্র। তাই সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও তিনি থাকবেন। তিনি সর্বদাই ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
সূরা আররহমানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ،وَّ يَبْقٰي وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلٰلِ وَ الْاِكْرَامِ.
ভূ-পৃষ্ঠে যা-কিছু আছে, সবই ধ্বংস হবে। বাকি থাকবে কেবল তোমার প্রতিপালকের গৌরবময়, মহানুভব সত্তা। —সূরা আররাহমান (৩৬) : ২৬-২৭
সূরা কাসাসে ইরশাদ করেন—
كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ اِلَّا وَجْهَهٗ لَهُ الْحُكْمُ وَ اِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ.
সবকিছুই ধ্বংসশীল, কেবল আল্লাহর সত্তাই ব্যতিক্রম। শাসন কেবল তাঁরই এবং তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। —সূরা কাসাস (২৮) : ৮৮
উপরোক্ত দুটি সিফাতের সারকথা হল, আল্লাহ তাআলা আদি-অন্তহীন, চিরন্তন ও নিরন্তন সত্তা। তিনি তাঁর সকল মহিমা ও গুণাবলিসহ নিত্য ও চিরন্তন। তাঁর সত্তা যেমন চিরন্তন ও নিরন্তন তেমনি তাঁর সত্তাগত সকল সিফাত ও গুণও নিত্য ও চিরন্তন।
৩. তিনি সবোর্তভাবে নির্মুখাপেক্ষী এবং স্বয়ং অস্তিÍত্বশীল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা
আল্লাহ তাআলা যেহেতু সর্বদা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। যখন কোনো মাখলূক ও সৃষ্টি ছিল না তখনো তিনি ছিলেন এবং সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও তিনি থাকবেন। তখন তাঁর অস্তিত্ব ও স্থিতি অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল হবে কীভাবে? সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, তিনি হলেন স্বয়ং অস্তিত্বশীল ও স্বয়ংস্থিত সত্তা। তাঁর অস্তিত্ব ও স্থিতি সকল বাধা-বন্ধন, সীমা ও পরিসীমার ঊর্ধ্বে এবং তিনি স্থান ও কালের গণ্ডি থেকে চিরপবিত্র। তিনি স্থান-কাল সৃষ্টির আগেও ছিলেন, সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও তিনি থাকবেন।
আল্লাহ তাআলার এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং অমুখাপেক্ষিতার বৈশিষ্ট্যের কথা কুরআন ও হাদীসে বিভিন্ন শব্দে ও বাক্যে বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে। আলআসমাউল হুসনার মধ্য থেকে ‘গনী’, ‘সামাদ’ এবং ‘কায়্যুম’ —এই গুণবাচক শব্দগুলো তাঁর অমুখাপেক্ষিতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার বৈশিষ্ট্যকেই বিশেষভাবে ব্যক্ত করে থাকে। ‘গনি’ মানে সর্বোতভাবে নির্মুখাপেক্ষী, ‘সমাদ’ মানে যিনি পরিপূর্ণ এবং অন্য সকলেই যার মুখাপেক্ষী এবং ‘কায়্যুম’ শব্দের অর্থ যিনি স্বয়ং অস্তিত্বশীল এবং অন্য সকলকে স্থিতি দানকারী। তিনিই সকল মাখলূককে অস্তিত্ব দান করেছেন এবং তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সকল উপকরণ সৃষ্টি করে নিজ কুদরতে তাদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছেন। সুতরাং অন্যদের অস্তিত্ব ও স্থিতি তাঁর সৃষ্টি করা বিভিন্ন উপকরণের উপর নির্ভরশীল; কিন্তু তাঁর অস্তিÍত্ব ও স্থিতি অন্য কারও উপর বা কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। তিনি ‘সমাদ’ তাই জগতের সবই তাঁর মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি সর্বোতভাবে নির্মুখাপেক্ষী।
৪. তিনি এক ও একক সত্তা
এক ও একক হওয়া আল্লাহর পবিত্র সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। কারণ প্রকৃত রব্ব ও ইলাহ একাধিক হওয়া কিংবা যৌগ সত্তা হওয়া অসম্ভব। কেননা ইলাহের সত্তা একাধিক হওয়া কিংবা মুরাক্কাব ও যৌগ হওয়া তাঁর কামাল ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার, তাঁর গিনা ও নির্মুখাপেক্ষিতার এবং তাঁর নিত্যতা ও চিরন্তনতার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই এক ও একক হওয়া তাঁর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।
তাই তো বহু ‘ইলাহ’ থাকার ভ্রান্ত বিশ্বাসের খণ্ডনে কুরআন মাজীদে এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে—
لَوْ كَانَ فِيْهِمَاۤ اٰلِهَةٌ اِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحٰنَ اللهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُوْنَ.
যদি আসমান ও যমীনে আল্লাহ ছাড়া অন্য মাবুদ থাকত, তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। সুতরাং তারা যা বলছে, আরশের মালিক আল্লাহ তা থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। —সূরা আম্বিয়া (২১) : ২২
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে—
قُلْ لَّوْ كَانَ مَعَهٗۤ اٰلِهَةٌ كَمَا يَقُوْلُوْنَ اِذًا لَّابْتَغَوْا اِلٰي ذِي الْعَرْشِ سَبِيْلًا، سُبْحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰي عَمَّا يَقُوْلُوْنَ عُلُوًّا كَبِيْرًا.
বলুন, আল্লাহর সঙ্গে যদি আরও ইলাহ থাকত, তবে তারা আরশ অধিপতি (প্রকৃত ইলাহ)-এর উপর প্রভাব বিস্তারের কোনো পথ খুঁজে নিত। বস্তুত তারা যেসব কথা বলে, তাঁর সত্তা তা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র ও সমুচ্চ। —সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৪২-৪৩
এটা তাওহীদের পক্ষে ও শিরকের বিরুদ্ধে এমন এক দলীল, যা যে-কারো পক্ষেই বোঝা সহজ। দলীলটির সারমর্ম হল, ‘ইলাহ’ এমন কোনো সত্তাকেই বলা যায়, যিনি হবেন সর্বশক্তিমান, যে-কোনো রকমের কাজ করার ক্ষমতা যার আছে এবং যিনি কারও অধীন হবেন না। বিশ্বজগতে আল্লাহ ছাড়া আরও ইলাহ থাকলে প্রত্যেকেই এ গুণের অধিকারী হত। ফলে প্রত্যেকেই অন্যের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হত এবং প্রত্যেকেরই ক্ষমতা হত পরিপূর্ণ। আর সেক্ষেত্রে সব ইলাহ মিলে আরশ অধিপতি খোদার উপর প্রভাবও বিস্তার করতে সক্ষম হত। যদি বলা হয়, আল্লাহর উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা তাদের নেই, বরং তারা আল্লাহর কতৃর্ত্বাধীন, তবে তারা কেমন ইলাহ হল? এর দ্বারা প্রমাণ হয়ে যায়— প্রকৃত ইলাহ একজনই। তিনি ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নয়।
আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্তার পরিচয় সম্পর্কে কুরআন মাজীদে সূরা ইখলাসে তাঁর সত্তাগত একত্ব, অনন্যতা এবং তাঁর স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে—
قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ،اَللهُ الصَّمَدُ، لَمْ يَلِدْ وَ لَمْ يُوْلَدْ،وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.
বলে দাও, কথা হল, আল্লাহ সব দিক থেকে এক। আল্লাহ্ই এমন যে, সকলে তাঁর মুখাপেক্ষী, তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তার কোনো সন্তান নেই এবং তিনিও কারও সন্তান নন। এবং তার সমকক্ষ নয় কেউ। —সূরা ইখলাস
এই সূরায় আল্লাহ তাআলাকে ‘আহাদ’ বলা হয়েছে; যার অর্থ, এক ও একক। অর্থাৎ তিনি সব দিক থেকে এক অদ্বিতীয়; তিনি সত্তাগত দিক থেকেও এক অদ্বিতীয়, ইলাহী গুণাবলির দিক থেকেও এক ও অনন্য এবং ইলাহী কর্মকাণ্ডের দিক থেকেও এক ও একক এবং ইলাহী হুকুক ও অধিকারের ক্ষেত্রেও এক অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরীক নেই।
উল্লেখ্য, তাঁর সত্তাগত একত্বের প্রধান দুটি দিক রয়েছে :
এক. তিনি স্বতন্ত্র এবং অবিভাজ্য একক সত্তা; তিনি কোনো মুরাক্কাব বা যৌগ সত্তা নন। সুতরাং তিনি কারও অংশ নন, তাঁরও কোনো অংশ নেই। এমনিভাবে তিনি অন্য কোনো সত্তার সাথে একীভূত হওয়া, অন্য কারও ভেতরে প্রবিষ্ট হওয়া কিংবা তাঁর সত্তার সাথে অন্য কেউ একীভূত হওয়া, তাঁর সত্তার ভেতরে অন্য কেউ প্রবিষ্ট হওয়া থেকে চিরপবিত্র।
ঈশ্বরের সত্তাকে যৌগ ও বিভাজ্যরূপে কল্পনা করত প্রাচীন কোনো কোনো মুশরিক জাতি, আজও তাদের উত্তরসূরিরা এমন বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। নাসারারাও প্রাচীন মুশরিক জাতির অনুকরণে ঈশ্বরের ত্রি-সত্তায় বিশ্বাস করে। এদের সকলের এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসকে ইসলাম খণ্ডন করেছে।
দুই. তাঁর সত্তার সমশ্রেণী, সমকক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোনো সত্তা নেই। তিনি তো অন্য কারও থেকে জন্মগ্রহণ করেননি, তাঁর থেকেও কেউ জন্মগ্রহণ করেনি। সুতরাং তাঁর সমশ্রেণী অন্য কোনো সত্তা থাকা অসম্ভব। তিনি পরম একক সত্তা। তাঁর মতো অবশ্যম্ভাবী এবং অনাদি—অনন্ত সত্তা আর কেউ নেই বা কোনো কিছু নেই।
৫. لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ‘তাঁর মতো বলতে কিছুই নেই’
অর্থাৎ তিনি সত্তা, সিফাত ও ক্রিয়াকর্ম-সর্বক্ষেত্রে মাখলূকের সাদৃশ্য ও সমশ্রেণিতা থেকে চিরপবিত্র। তাঁর সত্তা মাখলূকের সত্তার মতো নয়, তাঁর কোনো সিফাত মাখলূকের সিফাতের মতো নয় এবং তাঁর কোনো ক্রিয়া মাখলূকের ক্রিয়ার মতো নয়।
তাঁর সত্তা মাখলূকের মতো নয়— একথার অর্থ হল, আমরা দুচোখ দিয়ে যা কিছু দেখি এবং অন্তর দিয়ে যা কিছু কল্পনা করি, তিনি সেরকম কিছু নন। সুতরাং তিনি মাখলূকের মতো দেহধারী বা সাকার নন। আসলে তাঁর মতো বলতে কিছুই নেই, তিনি বেনযীর, বেমেছাল।
তাঁর সিফাত মাখলূকের মতো নয়; মানে তাঁর কুদরত ও শক্তি মাখলূকের শক্তির মতো নয়। তাঁর ইলম ও জ্ঞান মাখলূকের জ্ঞানের মতো নয়। তাঁর হায়াত ও জীবন মাখলূকের মতো নয়। তাঁর কালাম ও কথন এবং শোনা ও দেখা মাখলূকের মতো নয়। এমনিভাবে তাঁর আরও যত সিফাত রয়েছে কোনো সিফাতই মাখলূকের মতো নয়।
বস্তুত তাঁর গুণাবলি মাখলূকের গুণাবলি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর গুণ পূর্ণ, নিজস্ব, শ্বাশ্বত ও সব ধরনের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। পক্ষান্তরে মাখলূকের গুণ ক্ষীণ, ক্ষণস্থায়ী, সীমাবদ্ধতাযুক্ত ও আল্লাহপ্রদত্ত।
এমনিভাবে তাঁর ক্রিয়াপদ্ধতি মাখলূকের মতো নয়। কারণ মাখলূক কর্মসম্পাদনের জন্য অঙ্গ ও উপকরণ ব্যবহারের মুখাপেক্ষী। কিন্তু আল্লাহ তাআলা কোনো অঙ্গ ও উপকরণ ছাড়া এবং কোনো মাধ্যম ছাড়া সবকিছু করতে সক্ষম। তিনি যখন কিছু করতে চান তখন তাঁকে কিছুই করতে হয় না, শুধু তিনি বলেন ‘হও’ অমনি হয়ে যায়। তিনি কোনো কর্ম নিজের প্রয়োজনে বা মুখাপেক্ষিতার জন্য করেন না। এমনিভাবে তিনি কোনো কর্ম অনর্থক করেন না, কারণ তিনি হাকীম ও প্রজ্ঞাময়।
এতক্ষণ উপরে আমরা যে পাঁচটি সিফাত নিয়ে আলোচনা করলাম এগুলোকে পরিভাষায় ‘সিফাতে সালবিয়্যাহ’ বলা হয়। অর্থাৎ নঞর্থক বা না-বাচক গুণ। কারণ এগুলো প্রত্যক্ষভাবে মূলত বিভিন্ন রকমের দোষ-ত্রুটি এবং অনুপযোগী গুণাবলি আল্লাহর সত্তায় না-থাকা বুঝায়। এগুলোকে ‘সিফাতে তানযীহ’ এবং ‘সিফাতে তাকদীস’ অর্থাৎ পবিত্রতাসূচক গুণাবলিও বলা হয়।
মনে রাখতে হবে, সিফাতে সালবিয়্যাহ বা না-বাচক গুণাবলি পাঁচ সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং আরও অসংখ্য সিফাত রয়েছে। তবে উপরোক্ত পাঁচটি বিষয় হল এমন মৌলিক ও ব্যাপক অর্থবোধক যার অধীনে আরও অসংখ্য ‘সিফাতে সালবিয়্যাহ’ শামিল রয়েছে। আর এ কারণে কালাম-শাস্ত্রবিদগণ উপরোক্ত পাঁচ প্রকার সিফাতে সালবিয়্যাহ বিশেষভাবে আলোচনা করে থাকেন। কেননা তাঁরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, কুরআন ও হাদীসে পবিত্রতাসূচক যত গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে তা সবই উপরোক্ত পাঁচ প্রকারের কোনো না কোনোটার মধ্যে অন্তভুর্ক্ত রয়েছে।
সর্বোপরি, উপরোক্ত পাঁচটি সিফাতে সালবিয়্যাহ একসঙ্গে কুরআনে কারীমের সূরা ইখলাসে অতি সংক্ষিপ্ত ও অর্থময় শব্দে বর্ণিত হয়েছে। কেননা, ‘আহাদ’ শব্দটি তাঁর একত্ব বুঝায়। ‘সমাদ’ শব্দটি তাঁর স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও নির্মুখাপেক্ষিতা বুঝায়। لَمْ يَلِدْ ‘জন্ম দেননি’ কথাটি ‘অনন্ত হওয়া’ বুঝায়, কেননা তাঁর কোনো সন্তান না-থাকার অন্যতম কারণ হল, তিনি অনন্ত অসীম এবং নির্মুখাপেক্ষী। وَ لَمْ يُوْلَدْ ‘তিনি জন্মগ্রহণ করেননি’ কথাটি বুঝায়, তিনি নিত্য ও চিরন্তন, তাঁর কোনো শুরু নেই। আর وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ ‘কোনো কিছু তাঁর সদৃশ নয়’ কথাটি বুঝায়, তিনি মাখলূকের সাদৃশ্য ও সমশ্রেণিতা থেকে চিরপবিত্র।
একটু চিন্তা করে দেখুন, উপরোক্ত পাঁচ প্রকার সিফাতে সালবিয়্যাহ মূলত সর্বোতভাবে নফি বা নাকচ করে, আল্লাহ তাআলার সাথে সর্বপ্রকার শিরক ও সাদৃশ্যকে, সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটিকে। মোটকথা তাঁর শান ও মানের পরিপন্থী সব বিষয়কে নাকচ করে।
এতো গেল কেবল ‘সিফাতে সালবিয়্যাহ’ এর কথা। এখনো বাকি থেকে গেছে তাঁর সত্তাগত ঐসব মৌলিক সিফাতের আলোচনা, যেগুলোকে পরিভাষায় ‘সিফাতে ছুবুতিয়্যাহ’ বলা হয়। অর্থাৎ যেগুলো হাঁ-বাচক অর্থ প্রকাশ করে এবং উৎকৃষ্ট কোনো গুণ বিদ্যমান থাকা বোঝায়। এখন আমরা সেসব সিফাতে ছুবুতিয়্যাহ সম্পর্কে আলোচনা করব।
১. তিনি ‘কদীর’ ও সর্বশক্তিমান
বলার অপেক্ষা রাখে না, যে-কোনো কাজ করতে পারা শক্তি ও ক্ষমতার প্রমাণ। সুতরাং যিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা তিনি অবশ্যই কুদরত ও শক্তির অধিকারী এবং অক্ষমতা ও দুর্বলতা থেকে চিরপবিত্র। কেননা কুদরত ছাড়া সৃষ্টি করা বা প্রতিপালন করা অসম্ভব।
তাই বিশ্বাস রাখতে হবে, মহান আল্লাহ তাআলাই হলেন প্রকৃত কুদরত ও শক্তির অধিকারী। তাঁর কুদরত ও ক্ষমতা পূর্ণ, নিজস্ব ও চিরস্থায়ী। আর অন্য সকলের মধ্যে যে শক্তি ও ক্ষমতা দেখা যায় তা সীমিত ও অসম্পূর্ণ, অস্থায়ী এবং আল্লাহপ্রদত্ত।
কোনো কিছুকে নাস্তি থেকে সৃষ্টি করার ক্ষমতা, সৃষ্টির পর অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা, সৃষ্টবস্তুর অস্তিত্বকে বিলীন করার ক্ষমতা এবং বিলীন করার পর পুনরায় অস্তিত্বদানের পূর্ণ ক্ষমতা কেবল আল্লাহ তাআলারই রয়েছে। সমগ্র সৃষ্টিজগতের উপরই তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে। কোনো কিছু তাঁর জন্য কঠিন নয়, সবই তাঁর জন্য সহজ। কেউ বা কোনো কিছুই তাঁকে অক্ষম করতে পারে না, কেউই তাঁকে পরাজিত করতে পারে না। তিনি সবার উপর এবং সবকিছুর উপর বিজয়ী ও পরাক্রমশালী।
তিনিই প্রকৃত ক্ষমতাবান। মাখলূকের মধ্যে যার যে শক্তি ও ক্ষমতা তা আল্লাহ তাআলারই দান ও অনুগ্রহ; তিনি যখন যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারেন।
উল্লেখ্য, আমরা সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কর্মসংশ্লিষ্ট বহু গুণাবলি জানতে পারি। তবে এই চিন্তাভাবনার মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে সর্বপ্রথম যে গুণদুটি সম্পর্কে আমরা সহজেই জানতে পারি তার একটি হল, তাঁর অসীম কুদরত ও ক্ষমতা এবং অপরটি হল, তাঁর অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন—
اَللهُ الَّذِيْ خَلَقَ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ وَّ مِنَ الْاَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْاَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوْۤا اَنَّ اللهَ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ وَّ اَنَّ اللهَ قَدْ اَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا.
আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ এবং তার অনুরূপ পৃথিবীও। তাদের মাঝে আল্লাহর হুকুম অবতীর্ণ হতে থাকে, যাতে তোমরা জানতে পার আল্লাহ সর্ব বিষয়ে পরিপূর্ণ শক্তি রাখেন এবং আল্লাহর জ্ঞান সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে। —সূরা তলাক (৬৫) : ১২
২. তিনি ‘আলীম’ ও ‘হাকীম’ অর্থাৎ সর্বজ্ঞানী ও মহাপ্রজ্ঞাবান
জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছাড়া এই সুবিশাল, সুনিপুণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ জগতের সৃষ্টি অসম্ভব। তাই যিনি এই জগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক তিনি অবশ্যই প্রকৃত জ্ঞানের এবং অসীম জ্ঞানের অধিকারী হবেন। তাঁর জ্ঞান অবশ্যই পরিপূর্ণ, নিখুঁত ও নিশ্ছিদ্র। অজ্ঞতা, অনবগতি, বিস্মৃতি, সন্দেহ-সংশয় ইত্যাদি থেকে তিনি চিরপবিত্র। তিনি চিরজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞানী। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব কিছু সম্পর্কে তিনি পূর্ণ অবগত। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছু তাঁর কাছে সমান। কোনো কিছু ঘটার আগেই তিনি সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনাদি কাল থেকেই জানেন। কোনো কিছুই তাঁর অজ্ঞাতসারে ঘটে না। তিনি যা-কিছু বলেন এবং যা-কিছু করেন সবই তিনি তাঁর অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুসারে করেন।
আল্লাহর এই সিফাতের প্রতি ঈমানের দাবি হল, আল্লাহকে ভয় করা এবং এই বিশ্বাস সর্বদা জাগরুক রাখা যে, বান্দার সকল কাজকর্ম সম্পর্কে তিনি সম্যক অবগত।
তাঁর এই সিফাতের আরও দাবি, তাঁর সংবাদ ও সাক্ষ্যকে সর্বান্তকরণে সত্য বলে বিশ্বাস করা। সর্বোপরি তাঁর সকল আহকাম ও বিধি-বিধানকে শিরোধার্য করা। কারণ আল্লাহ তাআলাই যেহেতু সর্বজ্ঞানী এবং তিনিই মানবের স্রষ্টা তাই তাঁর যোগ্যতা-দুর্বলতা, কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত, আর সৃষ্টির প্রতি তাঁর দয়া ও করুণা প্রশ্নাতীত, কজেই তাঁর নির্দেশিত পথেই বান্দার মুক্তি ও সাফল্য।
৩. তিনি নিরঙ্কুশ ইচ্ছাশক্তির অধিকারী
যিনি জগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক তিনি অবশ্যই ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। যে কোনো ক্ষমতাবান ও জীবন্ত কর্তার কোনো কিছু করা বা না করার স্বাধীনতা থাকে। সে ইচ্ছা করলে করতেও পারে বা ইচ্ছা করলে নাও করতে পারে। করা না-করার স্বাধীন ক্ষেত্রদ্বয়ের মাঝে কোনো একটি ক্ষেত্রে সে যে স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে অর্থাৎ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে— তাকেই মূলত আরবীতে মাশিয়্যাত ও ইরাদাহ বলা হয় এবং বাংলায় বলা হয় ইচ্ছাধিকার।
সুতরাং যিনি সমগ্রজগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং বিচারকর্তা তিনি যে অবশ্যই পরিপূর্ণ ও নিরঙ্কুশ ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আসলে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাই হচ্ছে অনাদি অনন্ত, কামিল ও পূর্ণাঙ্গ, মুতলাক ও বাধা-বন্ধনহীন এবং সকল দুর্বলতা থেকে মুক্ত। সব ধরনের জড়তা, নিষ্ক্রিয়তা, বিস্মৃতি, সংকল্পহীনতা, সিদ্ধান্তহীনতা, চাপ ও বাধ্যবাধকতা থেকে তিনি চিরপবিত্র। তিনি যা করেন নিজ ইচ্ছায় করেন এবং যা করেন না তা নিজ ইচ্ছায় করেন না।
তাঁর ইচ্ছাশক্তি সর্বব্যাপী। তাঁরই ইচ্ছায় সবকিছুর স্থিতি ও লয়, হ্রাস ও বৃদ্ধি। মানুষের জীবন-মৃত্যু, রুজি-রোজগার, সুস্থতা-অসুস্থতা, সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য, হেদায়েত-গোমরাহী সবকিছুতেই তাঁর ইচ্ছা ও ফয়সালা কার্যকর। সৃষ্টিজগতের প্রতিটি অণু-পরমাণু প্রতি মুহূর্তে তাঁর জ্ঞান ও ইচ্ছার বেষ্টনীতে আবদ্ধ।
তাঁর ইচ্ছা সকল মাখলূকের ইচ্ছার উপর গালেব ও বিজয়ী। এমনকি বান্দার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। বান্দার চাওয়া আল্লাহর চাওয়া ছাড়া হতে পারে না।
তিনি فَعَّالٌ لِمَا يُرِيد ‘যা-কিছু ইচ্ছা করেন তা করে ফেলেন’। তাঁর ইচ্ছার ব্যতিক্রম কখনো ঘটে না। তাঁর ইচ্ছা বস্তবায়নে কেউ বা কোনো কিছুই বাধা হতে পারে না। তাঁর শান হল এই—
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُون.
তাঁর অবস্থা তো হল, তিনি যখন কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন তখন শুধু বলেন, ‘কুন’ (হও) আর তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়। —সূর ইয়াসীন (৩৬) : ৮২
তাঁর এই মহান সিফাতের দাবি হচ্ছে, সকল কথা ও কাজে কেবল তাঁরই উপর ভরসা করা এবং কেবল তাঁকেই ভয় করা। এই সিফাতের প্রতি সুদৃঢ় ঈমান ও বিশ্বাস যার অন্তরে বদ্ধমূল হবে, কোনো মাখলূকের ভয়-ভীতি তার অন্তরে কখনো স্থান পাবে না, বরং যত প্রবল পরাক্রান্তই হোক, মাখলূকের ভয়—ভীতি তার অন্তর থেকে মুছে যাবে। তার অন্তরে শুধু থাকবে আল্লাহ তাআলার ভয়, যিনি একমাত্র দাতা ও বিধাতা, যার নিয়ন্ত্রণে বিশ্বজগতের সবকিছু।
এছাড়া আল্লাহ তাআলার কুদরত, তাঁর অসীম জ্ঞান এবং তাঁর নিরঙ্কুশ ইচ্ছাধিকার— এই তিন গুণেরই অনিবার্য দাবি হল, তাকদীরে বিশ্বাস করা। কেননা তাকদীরে বিশ্বাস করার সারমর্ম হল, একথা বিশ্বাস করা যে, জগতে যা-কিছু ঘটে এবং আমাদের জীবনে যা-কিছু ঘটে সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা অনাদিকাল থেকেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবগত, সবকিছু তাঁরই অনাদি ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে এবং তাঁরই কুদরতে ঘটে। কোনো কিছুই তাঁর অজ্ঞাতসারে বা তাঁর অনিচ্ছায় এবং তাঁর কুদরতের ইশারা ছাড়া ঘটে না।
৪. তিনি الْحَيُّ (আলহাইয়ু) চিরজীবী
যিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী এবং নিরঙ্কুশ ইচ্ছাময় কর্তা, তিনি অবশ্যই হায়াত ও জীবনশক্তির অধিকারী। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, নিরঙ্কুশ ইচ্ছাময়তা এবং কতৃর্ত্ব ও সক্রিয়তা তাঁর হায়াত ও জীবন গুণের সুস্পষ্ট প্রমাণ। সুতরাং আল্লাহ তাআলাই হলেন শ্বাশ্বত, পূর্ণ ও নিজস্ব প্রাণশক্তির অধিকারী। পূর্ণাঙ্গতম প্রাণশক্তি কেবল তাঁরই রয়েছে। তাই তিনি চির প্রাণময়। লয়, ক্ষয়, জরা; নিদ্রা, তন্দ্রা, মৃত্যু ইত্যাদি সবকিছু থেকে তিনি চিরপবিত্র।
মাখলূক প্রাণের অধিকারী, কিন্তু এমন প্রাণ, যার শুরু আছে, শেষ আছে, যার মধ্যে সর্বপ্রকার দুর্বলতা রয়েছে, তন্দ্রা রয়েছে, নিদ্রা রয়েছে, কিন্তু আল্লাহ তাআলার হায়াত সর্বপ্রকার দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা থেকে পবিত্র।
তাঁর হায়াত ও জীবন গুণ মাখলূকের মতো নয়। তাঁর জীবন গুণ তাঁর নিজস্ব গুণ আর মাখলূকের জীবন আল্লাহ তাআলার দান। এমনিভাবে মাখলূকের জীবন রূহ ও রক্ত-প্রবাহের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু আল্লাহ তাআলার হায়াত ও জীবন অন্যকিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। তিনি চিরজীবী, সর্বদাই তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তাঁর কোনো লয় ও ক্ষয় নেই।
৫. তিনি سميع (‘সামীউন’) সর্বশ্রোতা
যিনি প্রকৃত ইলাহ তিনি অবশ্যই শ্রবণশক্তির অধিকারী হবেন। অন্যথায় তিনি বান্দাদের কথা শুনবেন কীভাবে? তাদের ডাক ও প্রার্থনা শুনবেন কীভাবে? এবং তাদের ডাকে সাড়া দেবেন কীভাবে? সুতরাং যিনি প্রকৃত রব্ব ও ইলাহ তিনি অবশ্যই শ্রবণশক্তির অধিকারী এবং বধিরতা থেকে চিরপবিত্র।
সুতরাং আমাদেরকে বিশ্বাস রাখতে হবে, আসমান ও যমীনের যেকেনো আওয়াজ এবং ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তা যতই ক্ষীণ ও গোপন হোক না কেন তিনি তা শোনেন। এমনকি অন্ধকার রাতে শক্ত পাথরের উপর পিপিলীকার ধীর পদক্ষেপের ক্ষীণ আওয়াজও তাঁর শ্রবণের বাইরে নয়। তাঁর বান্দাগণ যখন তাঁকে ডাকে, তাঁর কাছে দুআ করে, তাঁর যিকির করে কিংবা তাঁর কাছে কোনো ফরিয়াদ জানায় তখন তিনি তা শোনেন।
পরিপূর্ণ শ্রবণগুণ একমাত্র আল্লাহ তাআলারই রয়েছে। তাঁর শ্রবণ নিখুঁত ও পরিপূর্ণ। সব ধরনের অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা থেকে তাঁর শ্রবণ মুক্ত। তাঁর শ্রবণ কল্পনায় অনুভূত শ্রবণ নয়; বরং সরাসরি প্রত্যক্ষ শ্রবণ। সমগ্র জগতের সকল আওয়াজ এবং সকলের ডাক তিনি একইসঙ্গে শোনেন। কোনো একটি আওয়াজ শোনা তাঁর আরেকটি আওয়াজ শোনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয় না। তেমনিভাবে জগতের সকল ভাষা তিনি একইসঙ্গে শোনেন ও বোঝেন। ভাষার বিভিন্নতা তাঁর শোনা ও বোঝার ক্ষেত্রে কোনোরূপ জটিলতা তৈরি করে না।
তিনি সর্বশ্রোতা, কিন্তু মাখলূকের মতো শ্রবণেন্দ্রি্রয় থেকে তিনি মুক্ত। তাঁর শোনা শর্তমুক্ত ও বাধা-বন্ধনহীন, দূরত্ব, ব্যবধান বা কোনো কিছুই তাঁর শোনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয় না। কেননা তাঁর পবিত্র সত্তা যেমন মাখলূকের সত্তার মতো নয়, তেমনি তাঁর গুণাবলি মাখলূকের গুণাবলির মতো সীমাবদ্ধ নয়।
আল্লাহর এই সিফাতের দাবি হল, অন্তরে সর্বদা এই বিশ্বাস জাগরুক রাখা যে, বান্দার সকল কথাবার্তা আল্লাহ তাআলা শোনেন। সুতরাং বান্দা তার যবান ও মুখকে অশ্লীল, অসত্য ও অনর্থক কথা থেকে হেফাজত করবে। এমনিভাবে বান্দা তার সকল প্রয়োজনে আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করবে।
৬. তিনি بصير (বাসীর) সর্বদ্রষ্টা
যিনি প্রকৃত ইলাহ তিনি অবশ্যই দৃষ্টিশক্তির অধিকারী। অন্যথায় তিনি দর্শনীয় বিষয়াবলি সম্পর্কে জানবেন কীভাবে? এবং এই সুবিশাল সৃষ্টিজগৎকে সুচারুরূপে পরিচালনা করবেন কীভাবে? সুতরাং মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তাআলা অবশ্যই দৃষ্টিশক্তির অধিকারী এবং অন্ধত্ব ও দৃষ্টিহীনতা থেকে চিরপবিত্র। আল্লাহ তাআলা যে ‘সামীউন’ ও সর্বশ্রোত এবং ‘বসীরুন’ ও সর্বদ্রষ্টা তা কুরআনে কারীমে এবং হাদীস শরীফে সুস্পষ্টভাবে বারংবার বর্ণিত হয়েছে।
তাই আমাদেরকে বিশ্বাস রাখতে হবে, আল্লাহ সবকিছু দেখেন, তাঁর দেখার গুণ পূর্ণাঙ্গ ও সর্বব্যাপী। অসমান ও যমীনের ছোট-বড় সবকিছু তিনি দেখেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সকল কাজকর্ম এবং সকল অবস্থা দেখেন।
তাঁর দর্শনগুণ নিখুঁত, পরিপূর্ণ। তাঁর দর্শন কল্পনায় অনুভূত দর্শন নয়; বরং সরাসরি দর্শন। দূরত্ব, অন্ধকার এবং অন্য কোনো কিছুই তাঁর দেখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয় না। তাঁর দর্শন শর্তমুক্ত ও বাধা-বন্ধনহীন।
জগতের সকল বস্তু ও সকল বিষয় তিনি একইসঙ্গে দেখেন। সকল বস্তু, সকল স্থান এবং সকল কাল তাঁর দৃষ্টির সামনে উপস্থিত। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবকিছু তিনি একইসঙ্গে সমানভাবে দেখতে পান। তাঁর সত্তা যেমন অনাদি অনন্ত তেমনি তাঁর দর্শনগুণও অনাদি অনন্ত।
তিনি সর্বদ্রষ্টা, কিন্তু দর্শনের ক্ষেত্রে মাখলূকের মতো দর্শনেন্দ্রিয় থেকে মুক্ত ও পবিত্র। কেননা তাঁর পবিত্র সত্তা যেমন মাখলূকের সত্তার মতো নয়, তেমনি তাঁর গুণাবলিও মাখলূকের গুণাবলির অনুরূপ নয়।
এই সিফাতের প্রতি ঈমানের দাবি হল, আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা, তাঁকে লজ্জা করা এবং সর্বত্র-সর্বক্ষণ ‘আল্লাহ দেখছেন’ —এই চিন্তা ও অনুভূতিকে জাগরুক রাখা। এই বিশ্বাস ও অনুভূতিই হল লোভ ও প্রলোভন এবং প্রবৃত্তির প্ররোচনার মুখে আত্মসংযম, সততা, নৈতিক শুচিতা ও চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার অসল রক্ষাকবচ। একা নির্জনে লোকচক্ষুর আড়ালে, যেখানে কেউ দেখে না সেখানেও বান্দা আল্লাহকে লজ্জা করবে। এক হাদীসে ‘ইহছান’-এর ব্যাখায় বলা হয়েছে—
أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ.
তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে, যেন তুমি আল্লাহ্কে দেখছ। কেননা তুমি যদি আল্লাহ্কে দেখতে না পাও, তবে আল্লাহ তাআলা তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন।’ —সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০
৭. তিনি কালাম ও বাকশক্তির অধিকারী
কালাম আরবী শব্দ। এর অর্থ কথা ও বাণী; যার দ্বারা মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে এবং পরস্পরের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে।
তো কথা বলতে পারা একটি উৎকৃষ্ট গুণ, আর বোবা ও মূক হওয়া একধরনের ক্রটি ও সীমাবদ্ধতা। যিনি প্রকৃত ইলাহ তিনি সবধরনের দোষ-ত্রুটি হতে চিরপবিত্র। সুতরাং প্রকৃত রব্ব ও ইলাহ অবশ্যই কালাম ও কথন গুণের অধিকারী। অন্যথায় তিনি বান্দার ডাকের জবাব দেবেন কীভাবে? এবং কীভাবে তিনি বান্দাদেরকে হেদায়েত ও নির্দেশনা এবং আদেশ-নিষেধ প্রদান করবেন? মহান আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে যে নবী ও রাসূলদের সঙ্গে ওহী মারফত কালাম করেছেন এবং তাদের উপর যে পবিত্র বাণী ও পবিত্র গ্রন্থ নাযিল করেছেন তা তাঁর কালাম ও কথন গুণের সুস্পষ্ট প্রমাণ।
তাই আমাদেরকে দৃঢ় ঈমান রাখতে হবে, মহামহিম আল্লাহ তাআলা হলেন, ‘সবাক সত্তা’; যিনি অনাদি অনন্ত সিফাতে কালাম বা ‘বাগ’ গুণের অধিকারী। বাকশক্তিহীন বা নির্বাক হওয়া থেকে তিনি চিরপবিত্র।
তিনি ‘কুন’ (হয়ে যাও)— এই নির্দেশমূলক কালাম দ্বারা জগতের সবকিছু সৃষ্টি ও পরিচালনা করেন। তিনি কালাম গুণ দ্বারাই তাঁর ইলম ও জ্ঞান, আদেশ-নিষেধ এবং কোনো বিষয়ে খবর ও সংবাদ ওহী আকারে প্রকাশ করেন।
তিনি বিভিন্ন সময় ওহী আকারে ফিরিশতাদের সাথে কথোপকথন করেন। যুগে যুগে তিনি নবী-রাসূলগণের সঙ্গে ওহীর মাধ্যমে কথা বলেছেন। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সাথে তিনি সরাসরি কথা বলেছেন। এমনিভাবে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মেরাজের রজনীতে সরাসরি কথা বলেছেন। নবী-রাসূলগণের উপর তিনি যেসব কিতাব নাযিল করেছেন সেগুলো তাঁর কালাম গুণেরই বহিঃপ্রকাশ। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী হেদায়েতগ্রন্থ আলকুরআন তো আল্লাহ তাআলারই পবিত্র কালাম।
আল্লাহ তাআলার প্রতিটি কালাম পরিপূর্ণ সত্য ও ন্যায়ানুগ।
আল্লাহ তাআলার ইলম ও জ্ঞান যেমন অনাদি অনন্ত এবং অসীম তেমনি অনিবার্যভাবেই তাঁর ইলমের সাথে সংশ্লিষ্ট কালাম ও বাণীও অনাদি অনন্ত ও অসীম।
আল্লাহ তাআলার কথোপকথনের সিফাত ও গুণ যেমন অনাদি-অনন্ত তেমনি সেই গুণ দ্বারা তিনি যা-কিছু কালাম করেন বা বলেন সেই কালাম ও বাণীও অনাদি-অনন্ত।
কেননা তাঁর কালাম ও বাণী মানুষের কথার মতো নয়। মানুষের জ্ঞান যেমন ক্ষণস্থায়ী তেমনি তার কথাও ক্ষনস্থায়ী। মানুষ ভবিষ্যত অবস্থা সম্পর্কে পূর্ব থেকে ওয়াকিফহাল থাকে না। এটা মানুষের সীমাবদ্ধতা। তাই অবস্থার প্রেক্ষিতে মানুষ নতুন নতুন কথা তৈরি করে। কিন্তু মহামহিম আল্লাহ তাআলার জ্ঞান অসীম এবং অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত ব্যাপীয়া। আর তাই ভূত ও ভবিষ্যতের সকল অবস্থা ও বিষয় যেমন তাঁর অনাদি জ্ঞানের বেষ্টনীতে আবদ্ধ, তেমনি অনন্তকালব্যাপী যা-কিছু বলার তার সবকিছুই অনাদিকাল থেকে তাঁর পবিত্র কালাম ও বাণীর অন্তভুর্ক্ত।
সুতরাং আল্লাহ তাআলার সর্বব্যাপী ইলম ও জ্ঞান যেমন আনাদি চিরন্তন তেমনি তাঁর কালাম ও কথাও আনাদি চিরন্তন। আর তিনি তাঁর সেই অনন্ত অসীম কালাম থেকে কিছু কালাম ও বাণী বিভিন্ন প্রেক্ষিতে মাখলূকের কাছে ব্যক্ত করে থাকেন, তার প্রক্রিয়া যাই হোক না কেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর পাক কালাম কুরআন মাজীদে বলেন—
وَ مَا كَانَ لِبَشَرٍ اَنْ يُّكَلِّمَهُ اللهُ اِلَّا وَحْيًا اَوْ مِنْ وَّرَآئِ حِجَابٍ اَوْ يُرْسِلَ رَسُوْلًا فَيُوْحِيَ بِاِذْنِهٖ مَا يَشَآءُ اِنَّهٗ عَلِيٌّ حَكِيْمٌ.
কোনো মানুষের এ ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন (অর্থাৎ সামনাসামনি), তবে ওহীর মাধ্যমে (বলতে পারেন) অথবা কোনো পর্দার আড়াল থেকে কিংবা তিনি কোনো বার্তাবাহী (ফিরিশতা) পাঠিয়ে দেবেন, যে তাঁর নির্দেশে তিনি যা চান সেই ওহীর বার্তা পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই তিনি অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, হেকমতের মালিক। —সূরা শূরা (৪২) : ৫১
আল্লাহ তাআলা তাঁর সেই অনাদি কালাম থেকেই ওহী আকারে নবীদের উপর অবতারণ করেছেন হেদায়েতগ্রন্থ। খাতামুন নাবিয়্যীন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আল্লাহ তাআলা যে মহাগ্রন্থ আলকুরআন নাযিল করেন তার উৎসও মূলত তাঁরই পবিত্র কালাম ও অসীম জ্ঞান। তাই কুরআন মাজীদ হল স্বয়ং আল্লাহ তাআলার কালাম। এই কালাম তিনি ওহী আকারে ফিরিশতা জিবরীলের মাধ্যমে আসমান থেকে নাযিল করেছেন।
আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তাআলা কালাম গুণের অধিকারী; কিন্তু তাঁর কালাম গুণ তাঁর মহান সত্তায় কীভাবে বিদ্যমান তা আমরা জানি না, জানার প্রয়োজনও নেই। অন্যান্য সিফাতের মতোই আল্লাহর ‘সিফাতে কালাম‘ও কোনো মাখলূকের কালাম বা ‘বাগ’-গুণের সদৃশ নয়। মানুষের ক্ষেত্রে কণ্ঠ, নাসিকা এবং মুখের অভ্যন্তরে অবস্থিত জিহ্বা ইত্যাদি বাগ-যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি ও অক্ষর দ্বারা গঠিত শব্দসমষ্টিকে কথা বলা হয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলার কালাম এমন নয়, কারণ তাঁর যাত ও সিফাত মাখলূকের মতো নয়, তিনি মাখলূকের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। সুতরাং তাঁর সিফাতে কালামের হাকীকত ও স্বরূপ কেবল তিনিই জানেন, আমরা জানি না।
এ পর্যন্ত আমরা পাঁচটি ‘সিফাতে সালবিয়্যাহ’ এবং সাতটি ‘সিফাতে ছুবুতিয়্যাহ’ মোট বারোটি ‘সিফাতে যাতী’ তথা ‘সত্তাগত গুণাবলি’ সম্পর্কে আলোচনা করেছি।
এগুলো ছাড়াও আল্লাহ তাআলার আরও অনেক সিফাত রয়েছে। কিন্তু এখন আমরা আলোচনা এই কয়েকটি সিফাতের ব্যাপারেই ক্ষান্ত করছি।
ইসলামী আকীদা বিষয়ে কালামশাস্ত্রের গ্রন্থাবলিতে বিশেষজ্ঞ আলিমগণ সিফাত সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনাকে সাধারণত এই কয়েকটি সিফাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। এ থেকে কেউ কেউ এই কু-ধারণায় লিপ্ত হয়েছে যে, কালামশাস্ত্রবিদদের মতে আল্লাহ তাআলার সিফাত এই কয়েকটি সিফাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং তারা আল্লাহ তাআলার অন্যান্য সিফাতকে অস্বীকার করে! নাউযুবিল্লাহ! কালামশাস্ত্রবিদদের সম্পর্কে তাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কারণ কালামশাস্ত্র হল, ইসলামী আকীদার বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থাপন। তাই কালামশাস্ত্রবিদগণ তাদের গ্রন্থাবলিতে সিফাত সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ঐসব সিফাত সম্পর্কে আলোচনা করেন, যেগুলো যুক্তি-বুদ্ধির বিচারে আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাত ও ইলাহিয়্যাতের আকীদার এবং তাওহীদের আকীদার মৌলিক ভিত্তি। আর এজন্যই তারা এসব গুণাবলিকে সিফাতে আকলিয়্যাহ (অর্থাৎ বোধগম্য ও বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা সমর্থিত) নামে অভিহিত করেন। অন্যভাবে বললে আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাত ও ইলাহিয়্যাতের পরিচয় লাভের জন্য এবং তাঁর তাওহীদ ও একত্বের আকীদা জানার জন্য কমপক্ষে যেসব সিফাত সম্পর্কে জানা জরুরি সেগুলো তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।
তো বিশেষ মাকসাদে বিশেষভাবে কিছু সিফাত সম্পর্কে আলোচনা করার উদ্দেশ্য কখনই অন্যসব সিফাত অস্বীকার করা নয়। তারা কখনই সিফাতে ইলাহীকে সীমিত মনে করেননি; বরং সিফাতে ইলাহী অসংখ্য অগণিত— একথা তারা স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। এসম্পর্কে ইমাম সাবূনীর একটি বক্তব্য এই প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিতে (মার্চ-এপ্রিল ২০২৩ ঈ. সংখ্যায়) উদ্ধৃত করা হয়েছে।
এছাড়াও কালামশাস্ত্রবিদগণ ‘আল-আসমাউল হুসনা’ এবং সিফাতে ইলাহী সম্পর্কে যেসব স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলোতে তারা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত আল্লাহ তাআলার অন্যান্য গুণাবলি সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ এধরনের কিছু গ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করছি :
১. ইমাম আবূ আব্দিল্লাহ হুসাইন হালীমী রাহ. (ওফাত : ৪০৩ হি.)-এর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আলমিনহাজ ফী শুআবিল ঈমান’।
২. ইমাম আবূ মানসূর আব্দুল কাহির বাগদাদী (ওফাত : ৪২৯ হি.)-এর ‘আলআসমা ওয়াস সিফাত’।
৩. ইমাম আবূ বকর অহমাদ বায়হাকী রাহ. (ওফাত : ৪৫৮ হি.)-এর ‘কিতাবুল আসমা ওয়াস সিফাত’ এবং ‘শুআবুল ঈমান’।
৪. ইমাম আবুল কাসিম আব্দুল কারীম কুশায়রী (ওফাত : ৪৬৫ হি.)-এর ‘আততাহবীর ফী তাযকীর’।
৫. ইমাম আবূ হামিদ গাযালী (ওফাত : ৫০৫ হি.)-এর ‘আলমাকসাদুল আসনা ফী শরহি আসমায়িল্লাহিল হুসনা’।
৬. ইমাম আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনুল আরাবী রাহ. (ওফাত : ৫৪৩ হি.)-এর ‘আলআমাদুল আকসা ফী শরহি আসমাইল্লাহিল হুসনা’।
৭. ইমাম আবূ ইসহাক ইবরাহীম সফফার হানাফী (ওফাত : ৫৩৪ হি.)-এর ‘তালখীসুল আদিল্লাহ লি দালায়িলিত তাওহীদ’।
৮. ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (ওফাত : ৬০৬ হি.)-এর ‘লাওয়ামিয়ুল বায়্যিনাত শরহুল আসমা ওয়াস সিফাত’।
৯. প্রখ্যাত মুফাসসির ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ কুরতুবী রাহ. (ওফাত : ৬৭১ হি.)-এর ‘আলআসনা ফী শরহি আসমাইল্লাহিল হুসনা’।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)