বাইতুল্লাহর মুসাফির-৪
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আবে যামযামের তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তির পর আরো সৌভাগ্য আমাকে নিয়ে গেলো সাফা-মারওয়ার মাঝে। আমার স্বপ্নের ছাফা ও মারওয়া আজ আমার চোখের সামনে! কীভাবে সম্ভব হলো তা? আমলের গুণে? যোগ্যতার বলে? না, আমার ইহরাম, আমার লাব্বাইক, এই তাওয়াফ, এই সাঈ শুধু আল্লাহর দান; ‘জীবনে-মহাজীবনে’ বান্দার যা কিছু প্রাপ্তি তা শুধু আল্লাহর মেহেরবানি।
ছাফা-মারওয়ার কেন এত বড় শান? এত বড় সম্মান? কারণ, ছাফা ও মারওয়া আল্লাহর মুহব্বতের নিশান। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন-
اِنَّ الصَّفَا وَ الْمَرْوَةَ مِنْ شَعَآىِٕرِ اللّٰهِ ۚ فَمَنْ حَجَّ الْبَیْتَ اَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَیْهِ اَنْ یَّطَّوَّفَ بِهِمَا
নিশ্চয় ছাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মাঝে গণ্য, সুতরাং যে (আল্লাহর) ঘরের হজ্জ বা ওমরা করবে সে যেন ঐ দু’টির মাঝে সাঈ করে।
সমস্ত মর্যাদা ও মহিমা একমাত্র আল্লাহর। তিনি যখন ইচ্ছা করেন পাথরের পাহাড়কেও এভাবে মর্যাদা দান করেন।
সময়ের প্রয়োজনে ছাফা ও মারওয়া যদিও কেটে কেটে সমান করা হয়েছে, তবু তা চার হাজার বছর আগের ছাফা-মারওয়া; এখনো দাঁড়িয়ে আছে মা হাজেরার পুণ্যস্মৃতি ধারণ করে। যত দিন আসমান আছে, যমীন আছে তত দিন থাকবে ছাফা-মারওয়া আল্লাহর ইশক ও মুহব্বতের নিশান হয়ে।
যুগ যুগ ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষের স্রোত চলছে ছাফা ও মারওয়ার মাঝে, যত দিন চাঁদ-সূর্যের উদয়াস্তের পরিক্রমা অব্যাহত থাকবে, তত দিন ছাফা-মারওয়ার এই জনস্রোত চলতেই থাকবে মা হাজেরার মমতা ও ব্যাকুলতাকে স্মরণ করে ।
ছাফা-মারওয়ায় আশিকানের এই যে নূরানি জামাত, তাতে শামিল হবো বলেই তো আমি হাযির হয়েছি ইহরামের পাক-সফেদ লিবাস ধারণ করে! তাই আমি প্রস্তুত হলাম সাঈর আমল শুরু করার জন্য এবং তনু-মন একত্র করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ছাফা পাহাড়ের দিকে।
এই ছাফা পাহাড়ে আল্লাহর ঘরকে সামনে রেখে আল্লাহর নবী একদিন দাঁড়িয়েছিলেন হকের আওয়ায নিয়ে। এখান থেকেই সত্যের পথে ডেকেছিলেন তিনি মক্কার কোরেশদের। এখানে আবু জেহেল ছিলো, আবু লাহাব ছিলো, উতবা ছিলো, উমাইয়া ছিলো; ছিলো আরো অনেক দুর্ভাগা। তারা শুনেনি আল্লাহর নবীর দরদ-ভরা ডাক। বাতিলের শোরগোলে হকের আওয়াযকে তারা চাপা দিতে চেয়েছে। আল্লাহর নবী তখন ছাফা পাহাড় থেকে নেমে এসেছিলেন ব্যথিত হৃদয়ে। চৌদ্দশ বছর পর সেই ছাফা পাহাড় আজ আমার সামনে। ছাফা পাহাড়ের সেই দরদী ডাকেরই তো ফসল আমি অধম উম্মতি! দুরু দুরু বুকে, বিগলিত হৃদয়ে আমি আরোহণ করলাম ছাফা পাহাড়ে। এখান থেকেই শুরু হবে আমার সাঈ। কারণ আল্লাহর কালামে রয়েছে মারওয়ার আগে ছাফা। অনুসরণ ও আনুগত্যই হলো ইসলামের দাবী। আদমের পরিচয় সিজদা, ইবলিসের পরিচয় যুক্তি।
আমি দাঁড়ালাম ছাফা পাহাড়ে বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে। দেখতে পেলাম কালো গিলাফের সামান্য আভাস। তাতে হৃদয়ের গভীরে ভাবের ও আবেগের যে জোয়ার এলো তা সবকিছু যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। এখন দু‘আ কবুলের মুহূর্ত, এখন তুমি যা চাবে তাই পাবে, কিন্তু কী চাইবো এখানে আমি আমার আল্লাহর কাছে! হৃদয়ে ভাবের জোয়ার আছে, কিন্তু মুখে নেই ভাষা। এখানে দাঁড়িয়ে সবাই কি হয়ে পড়ে এমনই নির্বাক! হারিয়ে
ফেলে ভাষা ও শব্দের অবলম্বন! সাঈ শুরু করার আগে এখানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নবী কী দু‘আ করেছিলেন! মাওলার দরবারে উম্মতের জন্য কী চেয়েছিলেন! হে আল্লাহ, তোমার পেয়ারা হাবীবের সেই দু‘আর, সেই চাওয়া ও পাওয়ার সামান্য কিছু অধম এ উম্মতিকেও দান করো; তোমার শান মোতাবেক দান করো।
মানুষ উঠছে, আর নামছে! খুব সাধারণ দৃশ্য, কিন্তু কী অপূর্ব দৃশ্য! এখানে সবকিছু সাধারণ, তবু সবকিছু অসাধারণ!
আমার চারপাশে শুধু শুভ্রতা, আর শুভ্রতা! যত দূর দৃষ্টি যায়, যেন শুভ্রতার এক অন্তহীন স্রোত! এতদিন শুধু শুনেছি, আর স্বপ্ন দেখেছি; আজ সৌভাগ্য হলো এ শুভ্রতা অবলোকন করার, এবং এ শুভ্রতায় অবগাহন করার। তুমি হে আল্লাহ, তাওফিক দাও, জীবন-চলার পথে এ শুভ্রতার ধারক হওয়ার।
ছাফা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলাম এবং চলতে শুরু করলাম যেন সময়ের প্রাচীর ভেঙ্গে অতীতের দিকে। একেক সময়ে একেক কাফেলার সঙ্গ লাভ করে করে আমি যেন পৌঁছে গেলাম সেই নূরানী কাফেলার পিছনে! সেখানে মাথার উপর ছাদ নেই, আছে নীল আকাশে মেঘের ছায়া; সেখানে পাখার বাতাস নেই, আছে রহমতের শীতলতা; সেখানে বিদ্যুতের ঝলমলতা নেই, আছে নূরের স্নিগ্ধতা। সেখানে আধুনিক যুগের কিছু নেই, কিন্তু আছে আসমানের সবকিছু। যখন কিছু থাকে না বন্ধু! তখনই সব থাকে। যখন সব থাকে তখনই সবকিছু হারাতে থাকে। পাওয়ার ঘোরে হারানোর কথা একেবারেই ভুলে যায় মানুষ।
হঠাৎ আমি পড়ে গেলাম হোঁচট খেয়ে এবং ধন্য হলাম আল্লাহর বান্দাদের পদচাপে। এক বান্দা আমাকে টেনে উঠালেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম; তখন দেখি, সবকিছু বর্তমান, সবকিছু বিদ্যমান। ছাদ আছে, বাতি আছে, পাখা আছে; তবু মনে হলো, মুহূর্তের জন্য অতীতের যেন ছায়া পড়েছিলো! যুগে যুগে এভাবেই অতীত ছায়া দেয় বর্তমানকে, কিংবা বর্তমান ছায়া গ্রহণ করে অতীত থেকে। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের এই বন্ধন যত দিন থাকবে তত দিন খুব সামান্য হলেও আলোর পরশ আমাদের জীবনে থাকবে।
আমার সাঈ চলতে থাকলো ছাফা ও মারওয়ার মাঝে। বারবার আমি ছাফা থেকে নামলাম, বারবার আমি মারওয়ায় উঠলাম। বারবার আমি দৌড়ে পার হলাম সবুজ আলোর সীমানা, মাতৃত্বকে, মায়ের মমতা ও ব্যাকুলতাকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
সেদিন পাহাড়-ঘেরা এ নির্জন মরু-উপত্যকায় মা ও সন্তান ছাড়া কেউ ছিলো না, কিছু ছিলো না। সবুজ আলোর এই সীমানা তখন ছিলো এক ঢালুভূমি।
কল্পনার চোখে আমি দেখতে পেলাম, এখন যেখানে যামযাম সেখানে শুয়ে আছেন ফুলের মত সুন্দর ছোট্ট শিশু ইসমাঈল। পিপাসায় কাতর, কিন্তু পানি নেই একফোঁটা। কী করবেন মা হাজেরা! অস্থির হয়ে একবার তিনি ছুটে যান ছাফা পাহাড়ে, যদি দূরে কোথাও দেখা যায় কোন কাফেলার ছায়া! আবার গিয়ে ওঠেন মারওয়ায়। আর ফিরে ফিরে দেখেন, পিপাসায় ছটফট করা কলিজার টুকরো তাঁর বেঁচে আছে কি না! ঢালুতে এসে কলিজার টুকরো তাঁর চোখের আড়াল হয়ে যায়, তাই তিনি তা দৌড়ে পার হন।
এই হলো সবুজ সীমানার মাঝে দৌড়ের কাহিনী। এখন কিছু নেই। সব সমান, মসৃণ, সমতল। তবু এখানে এসে তোমাকে দৌড়তে হবে মা হাজেরার মমতা ও ব্যাকুলতার পুণ্যস্মৃতি স্মরণ করে। আল্লাহর নবী দৌড়েছেন, তাঁর নূরানী কাফেলার সকলে দৌড়েছেন। যুগে যুগে এ পুণ্যভূমিতে যারাই এসেছেন, দৌড়েছেন। তোমাকেও দৌড়তে হবে। কেন? না, কোন প্রশ্ন করো না। তোমাকে দৌড়তে হবে শুধু অনুকরণের জন্য, শুধু সাদৃশ্য গ্রহণের জন্য। যেন হাশরের মাঠে বলতে পারো, মাওলা গো! আমার আমলনামায় গোনাহ ছাড়া এবং বদআমলের অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। তবে, তবে আমি দৌড় দিয়েছিলাম তোমার বান্দীকে অনুকরণ করে, তোমার হাবীবের সাদৃশ্য গ্রহণ করে।
মারওয়ায় এসে আমার সাঈ শেষ হলো, ফজরের আযানও শুরু হলো। হারামের মাঝে হারামের সুমধুর আযানধ্বনি জীবনে এই প্রথম শোনা হলো। আযান তো আমি শুনেছি জীবনভর! আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার! কিন্তু কী ছিলো হারামের আযান-ধ্বনিতে! হয়ত সেই আযানের প্রতিধ্বনি! হে ভাই, তুমি যদি ইচ্ছা করো, তুমি যদি হৃদয়কে উন্মুক্ত করো তাহলে আজকের আযানের মাঝেও শুনতে পারো অতীতের নূরানী আযানের সুমধুর আসমানী সুর!
আলহামদু লিল্লাহ! তাওয়াফ ও সাঈর মাধ্যমে আমার ওমরা সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। এখন আমি ইহরাম থেকে মুক্ত হবো, তবে ইহরামের শিক্ষা থেকে নয়। ইহরাম তো ধারণ করাই হয় এর শিক্ষাকে সারা জীবন ধারণ করে রাখার জন্য।
মারওয়ার পিছনে আল্লাহর বান্দারা দাঁড়িয়ে ছিলো ক্ষুর-কাঁচি হাতে। একজন জিজ্ঞাসা করলো, ছেঁটে দেবো, না কামিয়ে দেবো? আমি বললাম, একেবারে কামিয়ে দাও। জীবনের যা কিছু জঞ্জাল সব যেন আজ সাফ হয়ে যায়। আজকের এই পবিত্র মুহূর্ত থেকে জীবনের পথচলা আমি নতুন করে শুরু করতে চাই। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, নফসের গান্দেগি থেকে কলবের বান্দেগির দিকে।
সমগ্র হারাম তখন লোকে লোকারণ্য। আমার ভাষার দৈন্যকে ক্ষমা করো হে ভাই! হারামের যে স্বর্গীয় সৌন্দর্য সেদিন আমি দেখেছিলাম তা শুধু শব্দের ফুল সাজিয়ে তোমার সামনে তুলে ধরার সাধ্য আমার নেই। আমি শুধু বিমুগ্ধ চোখে তা অবলোকন করেছিলাম, আর অভিভূত হৃদয়ে উপভোগ করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো সময় যেন শুধু পিছিয়ে চলেছে একেবারে দূর অতীতের দিকে।
মাতাফের এক কাতারে জায়গা পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আহ, কী শান্তি! রহমতের ফিরেশতারা যেন নেমে আসছে আসমান থেকে ঝিরঝির করে ‘নূরের শিশির’ ঝরিয়ে। এমন পবিত্র মুহূর্তের জন্যই তো মুমিনের সারা জীবনের স্বপ্ন দেখা! সেই স্বপ্নকে হৃদয়ের গভীরে লালন করে যাওয়া! তুমি হতে পারো গোনাহগার, হতে পারে তোমার গোনাহ বেশুমার, তাই বলে তুমি নিরাশ হয়ো না। তুমিও আজ হতে পারো স্নাত নূরের এই শিশির-স্নানে। তুমিও যে শামিল হয়েছো হারামের জামা‘আতে! তুমি তো আসো নি, তোমাকে তো আনা হয়েছে। আর দাতা ডেকে আনেন তো দান করারই জন্য!
ইকামাত হলো, ফজরের জামা‘আত শুরু হলো। জীবনের অনন্য এক ফজর! আল্লাহর ঘরকে সামনে রেখে আদায় করা ফজর! সারা জীবনে কি আমি এক লক্ষ ফজর আদায় করেছি! অথচ আজ! হায়, তবু কেন আমি শোকর আদায় করি না আমার মেহেরবান মাওলার!
ইমাম সিজদায় গেলেন, আমিও সিজদায় গেলাম। সিজদায় বান্দা আল্লাহর সবচে’ নিকটবর্তী হয়। তবে আজকের নৈকট্য যেন অন্য রকম; আরো গভীর, আরো নিবিড়। আল্লাহর ঘর যে আমার সামনে! আমি যে ঘরওয়ালার মেহমান! ঘরের তাওয়াফ করা মেহমান! যামযামের পেয়ালায় চুমুক দেয়া মেহমান!
শৈশব থেকে যে স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করেছি; যে স্বপ্নের পুলকে, শিহরণে, ব্যথায়, আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছি সে স্বপ্ন আজ আমার পূর্ণ হলো। স্বপ্ন যিনি দান করেছেন তিনি আজ সে স্বপ্ন পূর্ণ করেছেন মায়া করে এবং কৃতার্থ করে।
সময়ের গতি খুব দ্রুত এটা সত্য, কিন্তু এখানে সবকিছু যেন আরো দ্রুত ঘটে গেলো! ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ সব যেন সময়ের চেয়ে দ্রুত ঘটে গেলো! স্বপ্ন যেন পূর্ণ হলো স্বপ্নেরই মাঝে! সামান্য কিছু অনুভব করার সুযোগ হলো, আর বহু অনুভব যেন সুপ্তই রয়ে গেলো আমার হৃদয় ও আত্মার বিহ্বলতার মাঝে। জীবনের এত বড় সৌভাগ্য এত সহজে কীভাবে সত্য হলো! এত মলিনতার মাঝে এমন শুভ্রতা, এত আবিলতার মাঝে এমন পবিত্রতা কীভাবে সম্ভব হলো! এ শুধু দয়াময়ের দয়া এবং করুণাময়ের করুণা। যিনি বলেছেন, সত্য বলেছেন- ‘যা কিছু দান সব দাতার, আর যা কিছু ত্রুটি সব বান্দার। তিনি দয়াশীল এবং ক্ষমাশীল। তিনি দয়া করে দান করেন এবং দয়া করে ক্ষমা করেন।
সুখের সময় যদি ঘুমের প্রয়োজন না হতো! আনন্দের মুহূর্তগুলো নিদ্রার গহ্বরে হারিয়ে গেলে আর আনন্দ কোথায়! কিন্তু মাটির মানুষ মাটির মতই দুর্বল। সুখের দিনেও সে ঘুমিয়ে পড়ে। আনন্দের মাঝেও সে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে। ফজরের পর খুব ক্লান্তি বোধ হলো। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম হারাম শরীফে। তবে সে ঘুম ছিলো বড় শান্তির ঘুম। মুমিনের ঘুমকে বলা হয়েছে ইবাদত। আমার অতীতের জীবনে ঘুমকে কখনো ইবাদত মনে করার সুযোগ হয়ত আসেনি। সেদিন হারাম শরীফের ঘুমকে মনে হয়েছিলো অনেক বড় ইবাদত। সে ঘুমের মাঝে যে মধুর স্বপ্ন দেখেছিলাম তা আজ এত বছর পরো আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেখানে ফুলের বাগান ছিলো, ফলের বাগিচা ছিলো, ঝিরঝির পানির ঝরণা ছিলো। পাখীদের কলতান ছিলো। আর ছিলো ...!
আহা, কী সৌভাগ্যের ঘুম ঘুমিয়েছিলাম সেদিন! জেগে ওঠে চোখ মেলেই দেখি আল্লাহর ঘর এবং তার কালো গিলাফের সৌন্দর্য! আমি যতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম, আল্লাহর ঘর যেন আমাকে দেখছিলো স্নেহে মমতায় সিক্ত করে। আমার কথা শুনে অবাক হও কেন বন্ধু! আমি যে সে ঘরের মেহমান! মনে পড়ে না তোমার কবি ইকবালের কথা! বাইতুল্লাহর আমরা ‘পাসেবান’, বাইতুল্লাহ পাসেবান আমাদের! আমরা বাইতুল্লাহকে দেখতে এসেছি কত দীর্ঘ জীবন বুকে স্বপ্নের বেদনা লালন করে, তাহলে বাইতুল্লাহ কি দেখবে না আমাদেরকে তার কালো গিলাফে আসমানের মমতা মেখে! হাশরের মাঠে যখন দুলহানের সাজে সাজিয়ে হাজির করা হবে বাইতুল্লাকে আমাদের সামনে তখন তাহলে সে চিনবে কীভাবে আমাদের!
হারাম শরীফ থেকে বের হয়ে জরুরত সেরে নিলাম। তারপর আমার দুই সফরসঙ্গী মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব ও ফারুক ভাইয়ের সন্ধানে বের হলাম। তালাশ করে করে আমি যেখানে গেলাম সেটা হলো মিসফালা। সেখানে বেশুমার বাঙ্গালি, কিন্তু আমি যে দুই বাঙ্গালির খোঁজে বের হয়েছি তারা আছেন কিদওয়া অঞ্চলে। একজন বললেন, কিদওয়া হলো ঐদিকে। হেঁটে হেঁটে গেলাম সেখানে। আল্লাহর এক বান্দা সাহায্য করলেন, তাই সহজেই ঠিকানাটা পাওয়া গেলো। নইলে একা একা তালাশ করে সঠিক স্থানে পৌঁছা বেশ কঠিন হতো। বেশ পুরোনো বাড়ী। ভিতরে অন্ধকার এবং শুঁটকির গন্ধ। মালিকের নাম শামসুদ্দীন বাঙ্গালী। প্রথমেই তার সঙ্গে দেখা হলো। আমাদের দেশে শুঁটকির গন্ধটা যে অঞ্চলের তিনি সে অঞ্চলেরই মানুষ। হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে তালাশ করছি। এ ভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো, তাই বুঝতে সমস্যা হলো না। তিনি আমাকে পৌঁছে দিলেন আমার সঙ্গীদ্বয়ের কাছে।
খুব অল্প সময় ছিলাম তার ঠিকানায়। তিনি যে অন্তরঙ্গ আচরণ করেছিলেন এখনো তা মনে পড়ে। পরে আর কখনো তার দেখা পাইনি। হয়ত এখন তিনি এই দুনিয়ার বাসিন্দা নন, হয়ত তিনি এখন সেই নীরব শহরের বাসিন্দা, যেখানে আমারও জন্য রয়েছে একটি ঘর, যে ঘর আমাকে সাজিয়ে যেতে হবে এখান থেকে আমলের ফুল দিয়ে। আল্লাহ যেন ঐ ভালো মানুষটিকে কবুল করেন এবং তার ও আমাদের সবার ‘ঘর’ সাজিয়ে দেন মাগফিরাতের সজ্জা দিয়ে।
মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব ও ফারুক ভাই তখন হারাম শরীফে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। আমাকে দেখে তারা খুশী হলেন; ওমরা থেকে ফারিগ হয়ে এসেছি শুনে আরো খুশী হলেন। জীবনের প্রথম সফরে একা একা সব কীভাবে করলাম, ভেবে তারা অবাক হলেন এবং মোবারকবাদ জানালেন। আমি মনে মনে বললাম, একা কোথায়! ‘তিনি’ তো সঙ্গ দিয়েছেন এবং পথ দেখিয়েছেন! আর তিনি যখন পথ দেখান কঠিনতম পথও তখন সহজ হয়ে যায়।
তারা উভয়ে আমার সঙ্গে আলিঙ্গন করলেন, কিন্তু আমি উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ পেলাম না। আমার মনে কিসের যেন একটা ছায়াপাত ঘটলো। মনে হলো, আমাদের আলিঙ্গনে আরেকটু প্রাণরসের এবং সজীবতার প্রয়োজন ছিলো। অবশ্য আমার এ ভাবনাটা ছিলো মুহূর্তের। সঙ্গে সঙ্গেই মন থেকে তা ঝেড়ে ফেললাম এই ভেবে যে, হয়ত এটা আমার অসুস্থ চিন্তার ফল।
তিনজন একসঙ্গে হারামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আশা ছিলো, পথে অনেক কথা হবে। কিছু বলবো, কিছু শোনবো। কিন্তু না, বিশেষ কোন কথা হলো না। মনে হলো, তারা কোন
চিন্তায় আচ্ছন্ন। সেই ছায়াটা আমার মনের আকাশে আবার ফিরে এলো। আমি উৎকণ্ঠিত হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কোন সমস্যা! আপনাদের পেরেশান মনে হচ্ছে!
মৃদু হাসির আবরণ দিয়ে তারা বললেন, না তো!
আমি আর কিছু বললাম না, তবে মনের ভিতরে সেই ছায়াটা আরো ঘনীভূত হলো, আকাশে কালো মেঘ জমলে যেমন হয়। কী হতে পারে! এমন কি সমস্যা, যা আমাকে জানাতে অসুবিধা! আল্লাহ যেন ভালো করেন! আল্লাহ যেন ভালো রাখেন!
হারাম শরীফে যোহর পড়লাম। আযানের আগে এসেও ভিতরে জায়গা পেতে কষ্ট হলো। দূর থেকে দেখলাম, এই ‘কাঠফাটা’ রোদেও মাতাফ পরিপূর্ণ। অর্ধেক অংশে কাতারে কাতারে নামাযের ইনতিযার, বাকি অংশে তাওয়াফের তরঙ্গ-জোয়ার। নামায শেষে একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম। মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব বললেন, এই একতালা অংশটি তুর্কী আমলের। আর এই যে, এই স্থানটি হলো উম্মেহানি। আব্বাজান (হযরত হাফেজ্জী হুজুর) এখানে বসেন। এটা ছিলো নবীজীর চাচা আবু তালিবের কন্যা হযরত উম্মেহানি (রা)-এর ঘর। এই যে, দুই খুঁটির মাঝখানে একটু উঁচু স্থান, মেরাজের রাত্রে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে শয্যারত ছিলেন। এখান থেকেই শুরু হয়েছিলো তাঁর বাইতুল মাকদিসের ইসরা (নৈশযাত্রা) ...
তিনি বলে গেলেন, আমি তন্ময় হয়ে শুনলাম, আর হৃদয়ে অপার্থিব এক প্রশান্তি অনুভব করলাম। আমরা তিনজন উম্মে হানিতে গিয়ে বসলাম। উঁচু স্থানটিতে একজন মাত্র মানুষ শয়ন করতে পারে। এক বৃদ্ধ, সম্ভবত পাকিস্তানী (অথবা হিন্দুস্তানী) শুয়ে আছেন। মুখম-লের জ্যোতির্ময়তা যে কাউকে ভক্তি-আপ্লুত করবে। নিমীলিত চোখ, তবে জাগ্রত, হাতে তাসবীহ। মনে হলো তাসবীহ পড়ছেন, তবে মুখে নয়, দিলে। আমলের ফলাফল নিয়তের উপর, আর নিয়ত হলো দিলের বিষয়। সুতরাং কারো সম্পর্কে কিছু বলার নেই। কোন মুমিন সম্পর্কে উত্তম ধারণা পোষণ করাই উত্তম। তবে উম্মেহানির এ দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো, মুহব্বতের আদব এরকম নয়, অন্য কোন রকম। আমাদের হযরত হাফেজ্জী হুজুর এখানে এভাবে কখনো শয়ন করেন নি এবং তা পছন্দ করেন নি। কারণ মুহব্বত শুধু কাছেই আনে না, দূরেও রাখে।
অপলক দৃষ্টিতে অনেক্ষণ আমি ঐ স্থানটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম এবং হৃদয়ের তরঙ্গ-দোলার অপূর্ব স্বাদ অনুভব করতে লাগলাম।
ইতিহাসের সত্যতা ইতিহাস জানে। কলবের ইশক, দিলের মুহব্বত এবং হৃদয়ের প্রেম ও ভালোবাসার জন্য আমাদের তো প্রয়োজন শুধু একটুখানি অবলম্বনের। ইতিহাস যদি আমাদেরকে সেই অবলম্বনটুকু সরবরাহ করে তাহলে চুলচেরা তদন্তের কী প্রয়োজন! আমাদের তো বরং ইতিহাসের প্রতি কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করা উচিত। আল্লাহর নবী এখানে শয়ন করেছেন, এখানে জিবরীল আমীন বোরাক নিয়ে এসেছেন, এখান থেকে শুরু হয়েছে মি‘রাজের মহাযাত্রা, - অন্তরে মুহব্বতের মউজ এবং প্রেমের তরঙ্গ সৃষ্টি করার জন্য এর চেয়ে সুন্দর অবলম্বন আর কী হতে পারে! তবে এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রকৃত প্রেমের সুন্দরতম প্রকাশ হলো সংযমের মাঝে। সংযমের অভাব থেকেই ইশক ও মুহব্বত কলঙ্কিত হয় বিদ‘আতের পঙ্কিলতায়। এ বেদনাদায়ক সত্য এখানে এই উম্মেহানিতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম বহু বছর পর। পরবর্তী কোন সুযোগের অপেক্ষায় এখন থাক সে আলোচনা।
উম্মেহানি থেকে আল্লাহর ঘরের রোকনে ইয়ামানি ও হাজারে আসওয়াদের মধ্যবর্তী অংশটুকু দেখা যায়। এখান থেকে বাইতুল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকতে অন্যরকম একটি ভালো লাগা অন্তরকে আপ্লুত করে। বাইতুল্লাহর দুয়ার থেকে একটু আড়ালে। যেন বান্দার পক্ষ হতে লাজ-কুণ্ঠার একটুখানি আড়াল! প্রেমিক-হৃদয়ে ভাবের কত রকম রংধনুর উদ্ভাস যে ঘটে! এক প্রেমিক বান্দাকে বলতে শুনেছি, ‘আমার তো ভালো লাগে ঐখানে বসে আল্লাহর ঘর দেখতে যেখান থেকে ঘরের দুয়ার দেখা যায়। ভিক্ষুক তো মনিবের দুয়ারের দিকেই তাকিয়ে থাকে!’ কবি সত্যই বলেছেন-
প্রেমিক হবে ফুলের মত
কেউ কস্তুরি, কেউ গোলাব
নানা বর্ণের, কিন্তু ছড়াবে সুবাস
কিংবা যেমন বিভিন্ন রঙের শরাব।
মাতাফে তখন তাওয়াফের অকল্পনীয় এক দৃশ্য! এমন কঠিন রোদ ও গরম উপেক্ষা করে আল্লাহর বান্দারা কিসের টানে, কিসের আকর্ষণে এমন উতালা! কার প্রেমে, কার মুহব্বতে এমন দিওয়ানা! চারদিক থেকে মানুষ শুধু মাতাফে নামছে এবং তাওয়াফের ঢেউ-তরঙ্গে শামিল হচ্ছে। শুধু নামছে, কেউ তো উঠে আসছে না! অন্তত আমি দেখতে পাচ্ছি না কাউকে উঠে আসতে! যারা তাওয়াফ করে রোদও কি তাদের ছায়া দান করে! না হলে এমন রোদে, এমন গরমে কীভাবে সম্ভব লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রশান্ত ও আত্মসমাহিত এমন তাওয়াফ! ঢেউ আছে, তরঙ্গ আছে, তবে অশান্ত নয়, প্রশান্ত। রোদের গরম তাপকে যেন শুষে নিচ্ছে ভিতরের উত্তাপ। এ শুধু সম্ভব তাদেরই পক্ষে, আল্লাহর ইশকে দিওয়ানা মাজনু যারা। যদিও আমি মাজনু নই, তবু লোভ হলো, আমিও মিশে যাই আল্লাহর মাজনুদের তরঙ্গ-স্রোতে। কিন্তু হযরত হাফেজ্জী হুজুর উপদেশ দিয়েছেন, জোশের সঙ্গে হুশ করে চলার। কারণ দীর্ঘ চার মাসের সফর। তাই তখন প্রেম-দৃশ্যের শুধু দর্শক হয়ে থাকলাম। কিন্তু হায়, আমি যদি জানতাম আগামী কালের খবর! কেউ যদি আমাকে বলে দিতো, তুমি আর মাত্র দুদিনের মেহমান! সেই যে কবি বলেছেন-
মিলনের সুখে ভেবেছি বিভোর আমি
ফুরাবে না রাত, হবে না ভোর
কিন্তু হায়, নিভলো না মোমের আলো
অথচ তারকার আলো নিভে গেলো!
তাকিয়ে থাকি বাইতুল্লাহর দিকে। চোখের দৃষ্টি যেন স্নিগ্ধ থেকে স্নিগ্ধতর হয়ে আসে। এমন ঝলসানো রোদে তো চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু আশ্চর্য! কালো গিলাফে ঢাকা আল্লাহর ঘর যেন সুশীতল ছায়াঘেরা এক মরুদ্যান। এ ঘরের দিকে তাকাও, তাকাতে থাকো এবং তাকাতেই থাকো; তোমার চক্ষু শীতল হবে, হৃদয় জুড়িয়ে যাবে, আত্মার গভীরে প্রশান্তি নেমে আসবে। নামায পড়া যেমন ইবাদত, তাওয়াফ করা যেমন ইবাদত তেমনি আদব ও মুহব্বতের সঙ্গে আল্লাহর ঘরের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকাও ইবাদত।
একটি ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকা ইবাদত, এ শুধু আল্লাহর ঘরেরই শান! চোখ জুড়িয়ে, হৃদয়-মন তৃপ্ত করে আমরা তাকিয়ে থাকলাম আল্লাহর ঘরের দিকে। ঘরের গিলাফের কালোতে এবং আমাদের চোখের তারার কালোতে যেন মাখামাখি হলো। কাল রাতে প্রথম দেখেছিলাম, এখন মনে হলো, আল্লাহর ঘর এই প্রথম দেখা হলো। হজের সফরনামায় আল্লাহর আশিক বান্দারা বলেছেন, আল্লাহর ঘর তুমি যত বার দেখবে মনে হবে, প্রথম বার দেখা হলো। প্রতিবারই হৃদয় তোমার স্পর্শ লাভ করবে নতুন ভাবের এবং নতুন অনুভবের।
পৃথিবীর সুন্দরতম ইমারত দেখো, সবচে’ আলোঝলমল অট্টালিকার সৌন্দর্য অবলোকন করো, এক সময় তোমার চোখে তার সৌন্দর্য ম্লান হয়ে আসবে। তোমার দৃষ্টি নতুন কোন সৌন্দর্যের প্রতি আকুল হবে। কিন্তু এ ঘরের সৌন্দর্য কখনো ম্লান হবে না। যত দেখবে, এ ঘরের নতুন সৌন্দর্যে তুমি আরো মুগ্ধ হবে, এ ঘরের নতুন জ্যোতির্ময়তায় হৃদয় তোমার আরো উদ্ভাসিত হবে।
কী আছে এ ঘরের মাঝে! এই কালো গিলাফের আবরণে! এমন সাধারণ, অথচ এত অসাধারণ! কী রহস্য এর! শুধু এই যে, এ আমার আল্লাহর ঘর! আচ্ছা, তুমি আল্লাহর ঘর বলে তোমার এত সৌন্দর্য ও মহিমা! তোমার এত মর্যাদা ও গরিমা! তাহলে আমি যদি আল্লাহর বান্দা হতে পারি! যদি আল্লাহর রঙে নিজেকে রাঙাতে পারি! হে আল্লাহ! তোমার ঘর দেখে দেখে, চোখে তোমার ঘরের কৃষ্ণতার সুরমা মেখে মেখে আমি যেন হতে পারি তোমার ...!
আছরের আযান হলো, আছরের জামাত হলো। কিছুক্ষণ পর রোদ কিছুটা ‘নরম’ হলো, আমারও একটু সাহস হলো। আমি নেমে এলাম মাতাফে, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম হাজারে আসওয়াদের দিকে। নিজেকে সমর্পণ করলাম আল্লাহর প্রেমিক বান্দাদের তরঙ্গ-জোয়ারের মাঝে। তাওয়াফ সমাপ্ত হলো, কিন্তু যামযামের পানি পান করা হলো না। এখন তো আমি রোযাদার; আমার কাছে এখন যামযামের চেয়ে বেশী স্বাদ পিপাসার! তাই শুধু নীচে নেমে যামযামের নিকটে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। খুব শীতল স্থান। এ যেন যামযামেরই শীতলতা! যামযাম পান করলাম ইফতারের সময় এবং তাওয়াফের দু’রাকাত আদায় করলাম মাগরিবের পর।
এশার আযান হলো। এশার পর তারাবী। হারাম শরীফে জীবনের প্রথম তারাবী পড়ার সৌভাগ্য হলো। সে সৌভাগ্যের কথা কীভাবে কোন ভাষায় প্রকাশ করবো? মুখের শব্দ তো হৃদয়ের অনুভবকে কখনো সঙ্গ দেয় না, তাই অনুভবকে শুধু অনুভব করা যায়, প্রকাশ করা যায় না। শুধু বলতে পারি, সবকিছু এখানে অন্য, সবকিছু এখানে অনন্য। সবকিছু এখানে নূরে নূরানি। তিলাওয়াতে, সিজদায় এবং মুনাজাতে শুধু তৃপ্তি আর তৃপ্তি! শুধু প্রশান্তি আর প্রশান্তি!
তুমি যদি আমার বন্ধু হও, আমি কামনা করবো; তুমি যদি আমার শত্রু হও তবু আমি কামনা করবো, হারাম শরীফের একটি তারাবীর সৌভাগ্য যেন আল্লাহ তোমাকে দান করেন। কারণ এমন সৌভাগ্যে শত্রুর প্রতিও কৃপণতা সাজে না।
আমার জন্মভূমিতে, আমার দেশের মসজিদে তারাবী আমি পড়েছি, কিন্তু তারাবীর স্বাদ যেন মাত্র আজ অনুভব করলাম। জানি না, এ তিলাওয়াত যমীনের, না আসমানের! মানুষের, না ফিরেশতার! এ তিলাওয়াত যদি চলতে থাকে তাহলে দিলগুলো তো গলে গলে শেষ হয়ে যাবে!
ইমামুল হারাম যখন সিজদায় গেলেন, লক্ষ লক্ষ বান্দার অবনত মস্তকের সঙ্গে আমার কপালও হারামের পবিত্র ভূমি স্পর্শ করলো। সুবহানা রাব্বিয়াল আ‘লা। ভিতর থেকে আমার, কে যেন বলে উঠলো, হে আল্লাহ! সিজদায় যদি পাওয়া যায় তোমাকে তাহলে তো আমি আজ পেয়েছি তোমাকে! সুতরাং এ সিজদার মাঝেই কেটে যাক আমার জীবন। সুবহানা রাব্বিয়াল আ‘লা।
ধীরে ধীরে আমি যেন নূরের সাগরে ডুবে গেলাম। হে আল্লাহ! চিরজীবন যেন ডুবে থাকি তোমার মারেফাতের নূর-সাগরে! সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা।
আহ, জীবনে আরেকবার যদি নছীব হতো এমন একটি সিজদা!
বিতিরের কুনূতের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আশ্চর্য এক মুনাজাত হলো। এ মুনাজাতও আমার জীবনে প্রথম। মুনাজাতে মানুষ কাঁদে, মুনাজাতে চোখের পানি ঝরে- এ দৃশ্য আমি দেখেছি, তুমিও দেখেছো। এ হলো মুনাজাতের কান্না, কিন্তু আজকের মুনাজাত ছিলো কান্নার মুনাজাত! এ মুনাজাত ছিলো আল্লাহর ঘরে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে। এ মুনাজাত যেন একবার দিলকে জখম করে, একবার শীতল প্রলেপ দেয়। একবার কান্নার জোয়ার আনে, একবার আনে আনন্দের উচ্ছ্বাস। ইমামের সঙ্গে সমগ্র হারামে যখন কান্নার রোল ওঠে তখন নিজেকে নিজের মাঝে ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভিতরের আমি যেন তখন আমাকে এই বলে আশ্বাস দান করে-
‘এ মুনাজাত সব কিছু ধুয়ে ফেলার এবং সবকিছু মুছে ফেলার মুনাজাত। এখন আসমান থেকে অবশ্যই নেমে আসবে কবুলিয়াত ও মাগফেরাত।’
আমি শুনছি, ইমামুল হারাম তার কলবের ইযতিরাব ও হৃদয়ের আকুতি নিয়ে ফরিয়াদ করছেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা আজ বড় অসহায়, তুমি আমাদের সাহায্য করো। এ ঘোর অন্ধকারে মুসলিম উম্মাহকে তুমি হে আল্লাহ, রক্ষা করো। আফগানিস্তানে, কাশ্মীরে, ফিলিস্তীনে মুজাহিদীনদের তুমি মদদ করো।
হে আল্লাহ! তোমার এবং তোমার দ্বীনের দুশমনদের ‘নিস্তনাবুদ’ করো।
হে আল্লাহ! আমাদের শাসকদের তুমি সঠিক পথে পরিচালিত করো। আমাদের প্রতি তাদের নির্দয় করো না, সদয় করো।’
কোন সন্দেহ নেই, সব ভাষার সব মুনাজাত আল্লাহ শোনেন এবং কবুল করেন, তবে ইমামুল হারামের যবানে আরবী মুনাজাতের যে জ্যোতির্ময়তা সেদিন আমার অন্তর অনুভব করেছে তার সত্যি কোন তুলনা নেই। মনে হয়েছে, আরবী ভাষাই যেন মুনাজাতের নিজস্ব ভাষা। ভাবের তরঙ্গে ইমামুল হারাম বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন। মুনাজাতের প্রতিটি মিনতির সাথে লক্ষ কণ্ঠের আহাজারি ও আমীন, আমীন ধ্বনি যেন আল্লাহর আরশেও কম্পন সৃষ্টি করছিলো।
তারাবীর পর আমি যখন ভাব ও অনুভবের অন্য এক জগতে আত্মসমাহিত; সৃষ্টিজগতের সকল সৌন্দর্য এক কালো গিলাফের সৌন্দর্যে অবলোকন করার আনন্দে, পুলকে ও শিহরণে আমি যখন শিহরিত এবং স্বপ্ন-সৌভাগ্যের প্রস্ফুটিত গোলাবের সৌরভে আমার অন্তর যখন পূর্ণ সুরভিত তখন, ঠিক তখন মনে হলো আমার কলজের ভিতরে যেন খঞ্জর আঘাত করলো। লাল রক্তে আমার ভিতরটা যেন ভিজে উঠলো। কবির ভাষায় আমাকে যেন বলা হলো-
তোমার স্বপ্নের গোলাব পিষে ফেলতে হবে
তোমাকে তোমারই পায়ের তলে এবং
পেয়ালা থেকে ঠোঁট সরিয়ে এখন তোমাকে
উঠে যেতে হবে শরাবের জলসা থেকে!
হে আল্লাহ, একি হলো! একি ঘটলো! বড় কোন অপরাধ হয়েছে নিশ্চয়! তোমার ঘরের আদব লঙ্ঘিত হয়েছে নিশ্চয়! বান্দার গান্দেগি দ্বারা তোমার হারামের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়েছে নিশ্চয়! হে আল্লাহ, একি তারই শাস্তি! সেজন্যই কি এ মাহরূমি! হে আল্লাহ, তোমার মাগফিরাত তাহলে কার জন্য! কখনকার জন্য!
আমার চোখ থেকে তখন ঝরঝর করে শুধু পানি ঝরতে লাগলো। ঘটনা এই-
মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব আমাদের ছোট্ট কাফেলার আমীর। তারাবির পর তিনি বললেন, আমরা এসেছি মাদরাসার ফায়দার জন্য, অথচ তা হচ্ছে না। তাই এখানে আমাদের তিনজনের দীর্ঘ অবস্থান মাদরাসার জন্য উপকারী মনে হয় না, বরং ভালো হয় যদি শুধু ফারুক থেকে যায়, আমরা দু’জন ফিরে যাই।’
শুরুতে যেমন বলেছি, হঠাৎ যেন কলজের ভিতরে খঞ্জর বিঁধলো এবং তা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলো। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত যেন ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়লো। কাঁদছি না, শুধু অশ্রু ঝরছে। কিছুক্ষণ পর কিছুটা আত্মস্থ হলাম। আমাদের আমীর আবার তার যুক্তি তুলে ধরলেন। অস্বীকার করার উপায় আছে বলে মনে হলো না, যদিও তা আমার জন্য চরম মর্মবিদারক। ফারূক ভাইকে আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করুন, তিনি জোরালোভাবে তিনজন একসঙ্গে থাকার পক্ষে মত প্রকাশ করলেন।
আমার ভিতরের ব্যথা ও কষ্ট আমিই শুধু বুঝতে পারছিলাম। একটি মধুর স্বপ্ন শুরু না হতেই শেষ হয়ে যাবে! সৌভাগ্যের দুয়ার খুলতে না খুলতেই মাহরূমির ঝাপটায় বন্ধ হয়ে যাবে! একি হলো! একি ঘটলো! হে আল্লাহ, এ সৌভাগ্য তো আমি অর্জন করিনি, তুমি দান করেছো। অযোগ্যকে দান করে অযোগ্যতার কারণে সেই দান কি তুমি ফিরিয়ে নেবে!
এখন আমার কী করণীয়! হৃদয়ের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও ব্যথা-বেদনার মাঝেও মনে হলো, মাদরাসার কল্যাণ-চিন্তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ফারুক ভাই বললেন, আমাদের একত্র অবস্থানেই মাদরাসার কল্যাণ। কিন্তু আমীর ছাহেব তার যুক্তিতে অটল। তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন, আগামীকাল বিকেলে আমরা দু’জন মদীনা শরীফ যাবো এবং পরদিন ফিরে এসে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করবো।
আসলে এটা ছিলো আমার জীবনের এক মর্মান্তিক ভুল, যা তখন বুঝতে পারিনি; পারলাম, দেশে ফিরে যখন হযরত হাফেজ্জি হুজুরের সামনে দাঁড়ালাম, কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
দুর্ভাগ্য, নইলে একবারও কেন মনে হলো না, হযরতের তো পরিষ্কার আদেশ ছিলো হজ্জ পর্যন্ত অবস্থান করার এবং হযরতের সঙ্গে হজ্জ করার! হযরত তো বলেছিলেন, তোমরা হলে আমার মুকাদ্দামাতুল জায়শ! (অগ্রগামী বাহিনী) অন্তত এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে হযরতকে জানানো কি আমাদের উচিত ছিলো না? কিন্তু তখন এসব কিছু মনে হয় নি; শুধু মনে হয়েছে, মাদরাসার কল্যাণ চিন্তা করেই আমাদের দু’জনের ফিরে যাওয়া উচিত।
যাই হোক, এই কঠিন সিদ্ধান্তের পর তারা দু’জন কিদওয়ার ঠিকানায় ফিরে গেলেন, আমি হারাম শরীফে রাত্রিযাপনের জন্য থেকে গেলাম।
সেদিন আমার ইফতার ছিলো শুধু খেজুর-পানি। তাই বেশ ক্ষুধা অনুভব হলো। হারাম থেকে একটু দূরে এক খাবারের দোকানে গেলাম। প্রথমেই নযরে পড়লো ভিতরে দেয়ালের গায়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা কোরানের আয়াত -
وَ مَا تَشَآءُوْنَ اِلَّاۤ اَنْ یَّشَآءَ اللّٰهُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ.
তোমরা যা চাও তা হবে না, যদি না আল্লাহ তা চান।
নির্বাক বিস্ময়ে আয়াতটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এখানে এই আয়াত যেন আমারই জন্য! শুধু আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার এবং আমাকে আলো দান করার জন্য! আমি সান্ত্বনা লাভের এবং আলো গ্রহণের চেষ্টা করলাম।
প্রায় সব টেবিলে পাকিস্তানী হাজীরা পাকিস্তানীদের মতই খানাপিনা করছিলেন, নামটাও ছিলো ‘করাচী হোটেল’। টেবিলে টেবিলে খাবার পরিমাণে এত যে, অর্ধেক থেকে যায়। তাই ভাবলাম, এই যে খাবার নষ্ট হচ্ছে, এগুলো থেকেই আমি প্রয়োজন সেরে নেবো। স্বভাব-সংকোচ বাধা হয়ে দাঁড়ালো, তবু টেবিল থেকে উঠে যাওয়া একজনকে কুণ্ঠিতভাবে বললাম, আপনার অনুমতি হলে এই উচ্ছিষ্ট খাবার আমি খেতে পারি। তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, কেন! আমি আপনাকে নতুন খাবার আনিয়ে দেই!
বললাম, আমি চাই, এ খাবার নষ্ট না হোক। তিনি বললেন, খোদা আপকা ভালা কারে, ইয়ে বহুত আচ্ছী বাত হায়!
দু’একজন অবশ্য এদিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন, কিন্তু আমি তা গায়ে মাখলাম না। আমার পেট পুরলো, খাবার বাঁচলো, পয়সাও বাঁচলো।
এখানে এই একটা বিষয় মনে বড় কষ্ট দেয়, খাবারের অপচয়। আমাদের দেশে আর যাই হোক এভাবে অপচয় হয় না। খাবার কোন না কোনভাবে গরীবের পেটে যায়।
রাত তখন বারটা। হারামে ফেরার পথে দেখি, ছোট্ট একটি হাবশী মেয়ে কালো উড়না মাথায় হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। জানি না কোন দেশের, তবে মুসলিম মা-বাবার সন্তান তো অবশ্যই। দেখে মায়া হলো এবং চকোলেট দু’টোর কথা মনে পড়লো। মেয়েটির হাতে একটি রিয়াল এবং চকোলেট দু’টি দিলাম। ছোট্ট মেয়েটির মুখে সেদিন খুশির যে ঝিলিক দেখেছিলাম আমি তা এখনো ভুলিনি। কত সহজেই আমরা ছোট বড় সব মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারি!
মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ! পাকিস্তানে তোমার এক ছোট্ট অবুঝ বান্দা তোমাকে দেয়ার জন্য এই চকোলেট আমার হাতে দিয়েছে। তার ভাবনা, চকোলেট পেয়ে তুমি খুশী হবে, যেমন সে খুশী হয়। অবুঝ শিশু চকোলেট দিয়ে তোমাকে খুশী করতে চেয়েছে। আমি অবুঝ শিশু নই, তবু আমি নিয়ে এসেছি অবুঝ শিশুর উপহার, তোমাকে দেয়ার জন্য। আশা করি, তোমার হাতে আমি তা পৌঁছাতে পেরেছি হে আল্লাহ!
এই ছোট্ট মেয়েটির হাত, সে তো তোমারই হাত! তুমি তো বলেছো, অসুস্থের সেবা করা, তোমারই সেবা করা। পিপাসার্তকে পানি দেয়া, তোমাকেই তৃপ্ত করা! এবং ক্ষুধার্তকে আহার দান করা তোমারই ক্ষুধা দূর করা!
বুকভরা ব্যথা এবং সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণাপূর্ণ এক অনুভূতি নিয়ে হারাম শরীফে প্রবেশ করলাম। কাঁদছি না, কিন্তু কান্না এসে যায়। নিজের অজান্তেই চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসে। তখন এই বলে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করি-
সম্ভবত এটাই আল্লাহর ইচ্ছা এবং আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ হয়, বান্দার ইচ্ছা নয়। বান্দা যদি অম্লান বদনে আল্লাহর ইচ্ছা মেনে নেয় তাতে বান্দারই কল্যাণ।
হে আল্লাহ! জানি না, কী তোমার ইচ্ছা, তবে তোমার ইচ্ছার কাছেই নিজেকে আমি সমর্পণ করলাম।
কিয়ামুল্লায়ল শেষ হলো। বিষণ্ন মনে তাওয়াফের জন্য এগিয়ে গেলাম। জখমি দিলের জন্য তাওয়াফের চেয়ে বড় সান্ত¡না আর কী হতে পারে! তাওয়াফ শেষ করলাম। মুলতাযামে বুক লাগিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ হলো না। দুয়ারের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে মুনাজাত করলাম। চোখ থেকে নেমে এলো বাঁধভাঙ্গা জোয়ার
হে আল্লাহ! আমাকে পথ দেখাও, আমাকে দয়া করো, আমাকে রক্ষা করো। হে আল্লাহ! আমার স্বপ্নের উদ্যানে যে ফুল ফুটেছে তা যেন ঝরে না যায়, বরং নতুন নতুন ফুল যেন ফোটে, ফুটতেই থাকে। হে আল্লাহ! তোমার ঘরের হজ্জ যেন নছীব হয়।
তাওয়াফের সময় অদ্ভুত এক ঘটনা দেখলাম। মনে হলো,ব্যথা, বেদনা ও কষ্টের মাঝে আল্লাহ যেন আমার জন্য একটু আনন্দের আয়োজন করলেন। উর্দূভাষিণী এক বৃদ্ধা, সঙ্গে তার ছেলে, তাওয়াফ করছিলো। সহজ সরল বুড়ি আল্লাহর ঘর দেখে ভাবনায় পড়ে গেলো। জানালা নেই, একটি মাত্র দরজা, তাও বন্ধ। আল্লাহ মিয়াঁ এর ভিতরে থাকেন কীভাবে! কষ্ট হয় না! আল্লাহ মিয়াঁ কো খানা কৌন পোঁহচাতা হায়!
ছেলে দেখলাম, বুড়ি মাকে তার বুদ্ধির সীমানার ভিতরে বোঝাবার চেষ্টা করছে যে, এটা আল্লাহ মিয়াঁর ঘর, তবে আল্লাহ মিয়াঁ এখানে থাকেন না। এটা তিনি বান্দাদের জন্য বানিয়েছেন, যেন তারা তাওয়াফ করতে পারে। আল্লাহ মিয়াঁ আসমান থেকে বান্দার তাওয়াফ দেখে খুশী হন। মাঁ, তোমহারা তাওয়াফ ভী আল্লাহ মিয়াঁ দেখ রাহে হ্যাঁয়! বুড়িমা আহ্লাদিত হয়ে বললেন, সাচ্!
কিছুক্ষণ আমি তাওয়াফ থেকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম এবং বুড়িমার কথা ভাবছিলাম। হাদীছ শরীফে তো আছে, কোন কোন বান্দার ছেলেমানুষিতে আল্লাহ হেসে দেন এবং আল্লাহর কাছে তা ভালো লাগে। বুড়িমার এই সব ‘ছেলেমানুষি’ কথায় আল্লাহ কি হেসেছেন! আল্লাহর কি ভালো লেগেছে! হয়ত বা।
বনী ইসরাঈলের এক বান্দা নাকি আল্লাহর মুহব্বতে অস্থির হয়ে বলেছিলো, আল্লাহকে যদি পেতাম, যত্ন করে তার মাথাটা ধুয়ে দিতাম, চুলগুলো আঁচড়ে দিতাম, আর মুখে লোকমা তুলে খাইয়ে দিতাম। আল্লাহ মিয়াঁর এত কাজ, তিনি কি আর নিজের খোঁজ নিতে সময় পান!
আসলে আল্লাহর মুআমালা হবে বান্দার দিলের অবস্থা অনুসারে এবং তার জ্ঞানের পরিধি বিচারে। তাই তো এক দাসীর ঈমান পরীক্ষা করতে আল্লাহর নবী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আল্লাহ কোথায়?
আসমানের দিকে ইশারা করে দাসীর সরল উত্তর ছিলো, আল্লাহ মিয়াঁ আসমানে!
এ-ই ছিলো দাসীর জ্ঞানের দৌড়, তাই ঈমান হিসাবে এটাকেই আল্লাহর রাসূল অনুমোদন করেছিলেন। অথচ আল্লাহ নিরাকার। স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে তিনি। তাঁর মত কোন কিছু নেই। সৃষ্টিকুলের যাবতীয় দুর্বলতা ও স্থূলতা থেকে তিনি চিরপবিত্র। কোরআনে যে রয়েছে, রাহমান আরশে সমাসীন হয়েছেন! হাদীছ শরীফে যে এসেছে, আল্লাহ হাসেন, এমনকি তাঁর মাঢ়ীর দাঁত প্রকাশ পায়! আল্লাহর হাত, পা, চেহারা! ..... এগুলোর হাকীকত আমরা জানি না। আল্ল্হা এবং আল্লাহর রাসূল যা বলেছেন এবং যে অর্থে বলেছেন আমরা শুধু তা বিশ্বাস করি।
এর বাইরে আল্লাহর যাত ও ছিফাত নিয়ে চুলচেরা ও সূক্ষ্ম-জটিল আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া মোটেও সঙ্গত নয়, নিরাপদও নয়। কারণ আল্লাহর সত্তাকে অনুধাবন করার মত আকল বান্দার নয়। এক্ষেত্রে ছালাফে ছালেহীন ও পূর্ববর্তী বরণীয় ব্যক্তিগণ যা বলেছেন সেটাই হতে হবে আমাদের আকীদা ও বিশ্বাস। তবে কখনো যদি এই রকম বুড়িমার দেখা পাওয়া যায় তবে তাকেও পেরেশান করা উচিত নয়।
যামযামের পাড়ে গিয়ে দেখি, আল্লাহর এক বান্দা কেবলামুখী হয়ে যামযামের পাত্র সামনে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। পানি পান করছেন না, বিড়বিড় করে দু‘আ করছেন, আর চোখ থেকে শুধু অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। চোখের পানি, আর যামযামের পানি একাকার হয়ে যাওয়ার এ অপূর্ব দৃশ্য আমার হৃদয়কে নাড়া দিলো, আমার খুব ভালো লাগলো। হায়, স্বপ্ন তো দেখেছিলাম, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আল্লাহর ঘরের পড়শী থাকবো, আর প্রাণ-মন শীতল করে যামযামের পানি পান করবো, কিন্তু স্বপ্ন শুরু হওয়ার আগেই যদি স্বপ্ন ফুরিয়ে যায়! মানুষ তদবীর করে, আর তকদীর মুচকি হাসে। তাকদীরের বিপক্ষে মানুষের তাদবীর কি কোন কাজে আসে!
হারাম শরীফের সবচে’ আনন্দের ও প্রশান্তির সময় আমার মনে হয় ফজরের পর সূর্য উপরে ওঠার আগের সময়টুকু। এসময় একটি তাওয়াফ করলাম এবং দীর্ঘ সময় বিষণ্ন দৃষ্টিতে আল্লাহর ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তখন অবলোকনের অপার্থিব আনন্দ যেমন ছিলো তেমনি ছিলো আসন্ন বিচ্ছেদ-চিন্তার কষ্ট। আমি কি কল্পনাও করেছিলাম, দুদিনেই ফুরিয়ে যাবে মিলনের আনন্দ! কিন্তু বান্দা! তোমার জীবনে তোমার ইচ্ছা নয়, পূর্ণ হবে আমারই ইচ্ছা। তুমি শুধু উৎসর্গ করো তোমার ইচ্ছাকে আমার ইচ্ছার উদ্দেশ্যে। কিন্তু একটি ভাবনা বারবার আমাকে অশান্ত করে তুলছে, সিদ্ধান্ত নিতে আমি ভুল করছি না তো? আল্লাহর ঘরের দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে রক্ষা করো, আমাকে তোমার ইচ্ছার পথে চালিত করো।
একবার মনে হলো, আমার তো উচিত আসবাবের পরিবর্তে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা। যিনি আমাকে তাঁর ঘরে এনেছেন, আমি যদি তাঁর উপর ভরসা করি তাহলে কি তাঁর সাহায্য পাবো না! কিন্তু তাওয়াক্কুলের যে মাকাম আল্লাহর খাছ বান্দাদের শান, আমার মত কমযোর ও গোনাহগার বান্দা কীভাবে তার হিম্মত করতে পারে! ঘটনায় আছে, আল্লাহর এক মাজনু বান্দা পাথেয় ছাড়া চলেছেন আল্লাহর ঘরে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার পাথেয় কোথায়? পাথেয় ছাড়া হজ্জের সফর করা কি জায়েয? আল্লাহ তো বলেছেন, তোমরা পাথেয় গ্রহণ করো।
আল্লাহর পেয়ারা বান্দা জবাব দিলেন, শরীফ মেযবান যদি তোমাকে তার ঘরে দাওয়াত করেন তাহলে তুমি কি খানা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে? না শরীফ মেযবান তা পছন্দ করবেন? আর পাথেয়? তুমি কি শুনোনি আল্লাহর বাণী - তোমরা পাথেয় গ্রহণ করো, তবে তাকওয়াই হলো সর্বোত্তম পাথেয়।
কিন্তু কোথায় আমাদের সে তাকওয়া! আমাদের তো পা থেকে মাথা গোনাহের গান্দেগিতে ভরা!
আবার মনে হলো, এখন থেকে হজ্জ পর্যন্ত আমি করযরূপে খরচ করবো এবং দেশে গিয়ে মাদরাসাকে তা পরিশোধ করে দেবো। কিন্তু আমার নিজের তো কোন সঙ্গতি নেই। করযের ভার বহন করতে হবে আব্বাকে, আর আব্বার সংসারের যে করুণ অবস্থা তাতে আব্বাকে কষ্ট দিয়ে হজ্জ করা কি আমার জন্য জায়েয হবে!
না, আমি মনে হয় ভুল করছি না। আমার ফিরে যাওয়াই হয়ত আল্লাহর ইচ্ছা। সুতরাং তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক হে আল্লাহ!
ক্লান্তিতে, বিষণ্নতায় এবং শ্রান্তিতে, অবসন্নতায় শরীর যেন ভেঙ্গে আসছে। উম্মেহানিতে বসে আল্লাহর ঘর দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারবো না। কিন্তু শান্তির ঘুম আর হলো না। আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনায় হৃদয় যার ক্ষত-বিক্ষত, তার কীভাবে হতে পারে শান্তির ঘুম! চোখ খুলে যায়, আবার চোখ বুজে আসে। ঘুম ভেঙ্গে যায়, আবার ঘুমিয়ে পড়ি। এ অবস্থায় একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম, যা আমার ব্যথিত হৃদয়ের জন্য কিছুটা হলেও সান্ত্বনা বয়ে আনলো। দেখলাম, এক সুন্দর ফুলবাগানে হযরত হাফেজ্জী হুজুর বসে আছেন। আমি হযরতের দিকে এগিয়ে গেলাম, তিনি হাসিমুখে আমার হাতে একটি ফুল দিলেন।
ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে দেখি আল্লাহর ঘর! স্বপ্নের কথা মনে পড়লো, তাতে ভিতরের যন্ত্রণার কিছুটা যেন উপশম হলো।
একবার ইচ্ছে হলো, স্বপ্নটা মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেবকে বলি, কিন্তু ভিতর থেকে সায় পেলাম না, তাই বললাম না। শুধু ভাবলাম, আমি কাফেলার আমীরের ফায়ছালা মেনে চলবো, আল্লাহ অবশ্যই আমার কল্যাণের ফায়ছালা করবেন।
যোহরের জামা‘আতে আবার তিনজন একত্র হলাম। একসাথে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করলাম। ফারূক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বড় ঈর্ষা হলো। তার ভাগ্যে আছে আল্লাহর ঘরের পড়শী হওয়া, আমার ভাগ্যে হয়ত নেই। তার তো দোষ নেই। তিনি তো চাচ্ছেন, আমরা যেন থেকে যাই।
আছরের আগে আরেকবার তাওয়াফ করলাম, মুরদা মানুষের মুরদা তাওয়াফ। হাঁ, এমনই মনে হলো আমার কাছে। আমি যেন যিন্দা লাশ। তাওয়াফের স্রোতে নিজেকে শুধু ভাসিয়ে দিয়েছি, কিন্তু নিজেই জানি না, কী করছি! বেদনাহত বান্দার বিদগ্ধ হৃদয়ের বিষণ্ন তাওয়াফ আল্লাহ যদি কবুল করেন।
আছরের পর হারাম শরীফ থেকে আমরা দু’জন রওয়ানা হলাম মদীনা শরীফের উদ্দেশ্যে। বাস ছাড়লো মাগরিবের কিছু আগে। বিষণ্ন মনেও জাগলো আনন্দের শিহরণ। স্বপ্নভঙ্গের বেদনার মাঝেও লাভ করলাম আরেকটি স্বপ্নের পূর্ণতা লাভের মধুরতা।
অল্পক্ষণেই মক্কার সীমানা পার হয়ে বাস ছুটে চললো সুপরিসর মহাসড়কে। মরুভূমিতে এখানে সেখানে বালুর ছোট বড় টিলা। লম্বা ছায়া পড়েছে সেই টিলাগুলোর। দূরে পাহাড়শ্রেণী। সূর্য কখনো পাহাড়ের আড়ালে চলে যায়, কখনো আবার দুই শৃঙ্গের মধ্যখানে দেখা দেয়। অস্তমুখী সূর্যকে মনে হলো বড় বিষণ্ন, যেন আমারই মনের প্রতিবিম্ব। জানি না, সূর্যের বিষণ্নতা আমার মনকে বিষণ্ন করেছে, নাকি আমার মনের বিষণ্নতা সূর্যের উপর ছায়া ফেলেছে!
আরবদেশে পাহাড়ের আড়ালে সূর্যের অস্ত যাওয়া এই প্রথম দেখা হলো। বড় বেদনাবিধুর মনে হলো। বেদনাদগ্ধ হৃদয় এছাড়া আর কী ভাবতে পারে!
মাগরিবের সময় বাস থামানো হলো। যার কাছে যা, তাই দিয়ে ইফতার করা হলো। তবে এই সামান্য ইফতার অসামান্য হয়ে উঠলো, যখন প্রত্যেকে তার সামান্য ইফতারে অন্যকে শরীক করার ব্যাকুলতা প্রকাশ করলো। মানবিক চরিত্রের এ অনুপম সৌন্দর্য পৃথিবীর আর কোন জাতি ও সভ্যতা দাবী করতে পারে না। তোমার মুখের লোকমা আমি খাবো, আর তুমি কৃতার্থ হবে, এ শুধু কল্পনা করা যায় দুই রোযাদারের মাঝে। দেশ ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, অভিন্ন শুধু আল্লাহর জন্য উপবাস। কেউ এগিয়ে দিলো খেজুর, কেউ রুটির টুকরো, কেউ অন্য কিছু। সবাই এক সঙ্গে যা দিলো তা হলো, ‘গ্রহণ করে আমাকে কৃতার্থ করো’!
আমাদের দু’জনের কাছে পানি ছাড়া কিছু ছিলো না। তাই আমরা শুধু শরীক হলাম, শরীক করা সম্ভব হলো না।
মরুভূমির নরম এবং গরম বালুর উপর জামাতের সাথে নামায হলো। উন্মুক্ত মরুভূমিতে উন্মুক্ত আকাশের নীচে আমরা মাগরিবের নামায আদায় করলাম। দিগন্তহীন মরুভূমিতে মদীনার কাফেলার সেই যে নামায, তা স্মরণ করে হৃদয় আমার এখনো আপ্লুত হয়। সারা জীবন আমরা নামায পড়ি, কিন্তু শুধু দু’একটি নামায সম্পর্কে কিছু আশা করি, তবে ‘পোল’ যদি পার হতে চাই, পার হতে হবে শুধু আল্লাহর রহমতের ভরসায়, আমলের ভরসায় নয়।
বাস আবার যাত্রা শুরু করলো আল্লাহর নবীর শহর মদীনার উদ্দেশ্যে। আকাশের তারারা মিটি মিটি জ্বলছে, আমারও বুকের ভিতর স্বপ্নের জোনাকিরা নিভছে, জ্বলছে। কত দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন আজ পূর্ণ হতে চলেছে! কত বড় সৌভাগ্য এ! এত ছোট্ট কপালে সইবে তো এত বড় সৌভাগ্য! হে আল্লাহ, তুমি সঙ্গ দান করো! অধম বান্দাকে আদব দান করো, বে-আদবির ছায়া থেকেও রক্ষা করো।
সম্ভবত শেষ রাতে আমরা প্রবেশ করবো নবীজীর সোনার মদীনায়, হায়াত যদি থাকে, আল্লাহ যদি কবুল করেন। হায়াতের কী ভরসা! ‘নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই’- এটা নিছক কথা নয়; এটা জীবনের পরম সত্য, চূড়ান্ত হাকীকাত। আমরা যেমন পথ অতিক্রম করছি মদীনার দিকে, আমাদের জীবনও পথ অতিক্রম করছে মৃত্যুর দিকে। কে জানে, কার পথ আগে ফুরোবে!
গত রামাযানের ঘটনা। মক্কায় কর্মরত যুবক ছেলে বুড়ো মা-বাবাকে আনিয়েছে ওমরা করাতে। ওমরা শেষ করে মা-বাবাকে যিয়ারাত করাবে বলে মদীনায় রওয়ানা হয়েছে। কিন্তু তা আর হলো না। সুস্থ জোয়ান ছেলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো এবং পরক্ষণেই তার রূহ আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে গেলো। বুড়ি মা, কিংবা বুড়ো বাবা নয়, তাদের জোয়ান ছেলে পৌঁছে গেলো মৃত্যুর দুয়ারে। মদীনার পথ ফুরোবার আগেই ফুরিয়ে গেলো তার জীবনের পথ।
সুতরাং আমাকে বলতে হবে, যদি হায়াত থাকে এবং যদি আল্লাহ কবুল করেন তাহলে সম্ভবত শেষ রাতে আমরা প্রবেশ করবো মুমিনের সারা জীবনের স্বপ্নের শহর সোনার মদীনায়।
কেমন হবে আমার কলবের কাইফিয়াত! কেমন হবে আমার হৃদয়ের অনুভূতি সবুজ গম্বুজ প্রথম দেখার মুহূর্তে! আমার হৃদয় পারবে তো সেই সবুজের পুণ্যস্পর্শ গ্রহণ করতে! আমার আত্মা পারবে তো সেই সবুজের নূরে অবগাহন করতে!
বাইরে যার গান্দেগি, ভিতরে যার গান্দেগি, আগাগোড়া যার গান্দেগি সে কীভাবে দাখেল হবে নূরের মদীনায়! কীভাবে হাযির হবে নুরের রওযায়! হে আল্লাহ, আমাকে পাক-ছাফ করে দাও তোমার রহমতের দরিয়ায় ডুবিয়ে। আমাকে উপযুক্ত করে দাও তোমার নবীর শহরে প্রবেশ করার, তোমার হাবীবের রওযায় উপস্থিত হওয়ার এবং দুরূদ ও সালাম নিবেদন করার। ছাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদ! ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মধ্যপথে বিশ্রাম গ্রহণের জন্য বাস থামলো। দেড় ঘণ্টা পর বাস ছাড়বে। এখানে খাবার ও বিশ্রাম গ্রহণের মোটামুটি ব্যবস্থা রয়েছে। অনেকে এখানেই সেহরী খেয়ে নিলো। আমরাও হালকা কিছু খাবার খেলাম।
আসমানে রামাযানের বিদায়ী চাঁদ ছিলো, আর আমরা ছিলাম। হায়, হিজাযের দিগন্ত থেকে এ চাঁদ বিদায় নেয়ার এবং শাওয়ালের সোনালী চাঁদ উঁকি দেয়ার আগেই হয়ত আমাকে বিদায় নিতে হবে হিজাযের ভূমি থেকে, মদীনার ধূলোবালি থেকে, মক্কার অলিগলি থেকে, যামযাম থেকে, খেজুর-বাগান থেকে, কালো গিলাফ থেকে, সবুজ গম্বুজ থেকে। অথচ স্বপ্ন ছিলো কত দীর্ঘ! কত মনোরম! শাওয়ালের চাঁদ দেখবো, দেখবো যীকা‘দার পর যিলহাজের চাঁদ! আমিও শামিল হবো জাবালে রাহমাতের কাফেলায়! কিন্তু হায়!
হালকা আলোয় মরুভূমি পার হয়ে দূরে পাহাড়শ্রেণীর ছায়া দেখা যায়। এ সময় অন্যরকম এক অস্থিরতা আমার মনকে দোলা দিলো। মনে হলো, নির্জন মরুভূমিতে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে যদি প্রকৃতির নিঃসঙ্গতার মাঝে সঁপে দিতে পারি তাহলে হয়ত শান্তি পাবো। একটু একটু করে আমি অনেক দূর এগিয়ে গেলাম মরুভূমির ভিতরে, বালু-সাগরের গভীরে। বড় আপন এবং অন্তরঙ্গ মনে হলো মক্কা-মদীনার মাঝখানের এ নাম না জানা মরুভূমিকে। নরম বালুতে পা একটু একটু দেবে যায়, যেন সোহাগ করে জড়িয়ে ধরতে চায়। কে জানে, এ মরুভূমি সেই মরুভূমি কি না! আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে ইসলামের নতুন আবাসভূমির উদ্দেশ্যে হিজরতের মহান কাফেলা যে মরুভূমির বালুতে পদছাপ রেখে গিয়েছিলো এ সেই মরুভূমি কি না! এ মরুভূমি ও তার বালুরাশি তাহলে কত ভাগ্যবান! পরম আদর করে নরম বালুর উপর হাত বুলালাম। মুঠে নিয়ে পরম মমতায় চুমু খেলাম। যদি হয়! এ বালু যদি সেই বালু হয়! হৃদয় তখন এমনই উদ্বেলিত হলো যে, ইচ্ছে হলো ...। তবে নিজেকে সংযত রাখলাম। কারণ যে ভালোবাসা এবং যে মুহব্বতের প্রকাশ যত শালীন ও সংযত, আল্লাহর কাছে তা তত প্রিয়।
একবার তাকালাম সেই দিকে যেদিকে মক্কা শহর; আল্লাহর ঘরের পড়শী হয়েও যে শহরের বাসিন্দারা আল্লাহর নবীকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলো। হিজরতের রাতে অন্ধকারের মাঝে সবার চোখে ‘ধূলো’ দিয়ে আল্লাহর নবী মক্কা ত্যাগ করেছিলেন। প্রিয় জন্মভূমি মক্কা, যেখানে রয়েছে আল্লাহর ঘর, সেই মক্কাভূমি ছেড়ে যেতে কত কষ্ট হয়েছিলো পেয়ারা নবীর! তিনি যখন বলছিলেন, ‘হে মক্কা! তোমার সন্তানেরা যদি আমাকে বের করে না দিতো তাহলে কখনো আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না’ -তখন পেয়ারা নবীর চোখ দু’টো নিশ্চয় অশ্রুসিক্ত ছিলো! আহা, কী ব্যথা, কী মর্মযাতনা প্রতিটি শব্দের উচ্চারণে! যুগে যুগে কত শত কোটি আশিকানে নবী চোখের জলে ভিজিয়ে রেখেছে আল্লাহর নবীর পবিত্র মুখে উচ্চারিত এ শব্দগুলো! আমাদের মত পাথরদিলও বিগলিত হয় এবং চোখ অশ্রুসিক্ত হয় যখন পড়ি এ বাক্যগুলো-
হে মক্কা! তোমার সন্তানেরা যদি আমাকে বের করে না দিতো তাহলে কিছুতেই আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।
অথচ তিনি তাদের কাছে কী চেয়েছিলেন! ধন! সম্পদ!! রাজত্ব!! না, তিনি তো শুধু চেয়েছিলেন তাদের দুনিয়ার শান্তি এবং পরকালের মুক্তি।
এবার আমি তাকালাম সেই দিকে যেদিকে নবীর শহর মদীনা, যে মদীনা পরম সমাদরে আশ্রয় দিয়েছিলো আমাদের নিরাশ্রয় নবীকে। যে পবিত্র ভূমি এখনো বুকে ধারণ করে আছে আল্লাহর পেয়ারা হাবীবকে।
কত ভালো মানুষ ছিলো মদীনার বাসিন্দারা! সেই ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা! নূরের নবীকে যারা বরণ করেছিলো ‘সুরের মালা’ দিয়ে! ‘তালাআল বাদরু আলাইনা’ গেয়ে গেয়ে!
তাই তো আল্লাহর পেয়ারা হাবীব বলেছিলেন, মক্কাবিজয়ের পর যখন আনছার ভেবেছিলেন, আল্লাহর নবী হয়ত এখন তাদের ছেড়ে আপন জন্মভূমি মক্কায় থেকে যাবেন, আল্লাহর পেয়ারা হাবীব তখন বলেছিলেন-
‘বলো হে মদীনার আনছার! তোমরা কি খুশী নও যে, অন্যরা ফিরে যাবে গনীমতের মাল নিয়ে, আর তোমরা ফিরে যাবে তোমাদের ঘরে আল্লাহর নবীকে সঙ্গে করে!
শোনো হে মদীনার আনছার! আমার জীবন তোমাদের মাঝে, আমার মরণ তোমাদের মাঝে। হে আল্লাহ, রহম করো আনছারদের! রহম করো তাদের সন্তানদের! রহম করো তাদের সন্তানের সন্তানদের!’
আহা, মদীনার আনছার যারা কত ভাগ্যবান তারা!
আমি একবার তাকাই মক্কার দিগন্তে, একবার তাকাই মদীনার প্রান্তে। একবার নবীর জন্মভূমির দিকে, একবার নবীর হিজরতভূমির পানে। হঠাৎ .. একেবারে হঠাৎ আমার সমগ্র অন্তর যেন কোন অদৃশ্য আলোকে উদ্ভাসিত হলো! নির্জন মরুভূমিতে রাতের অন্ধকারে একটি আলোকরেখা যেন দক্ষিণ থেকে উত্তর অভিমুখী হলো! সময়ের মহাসড়ক অতিক্রম করে আমি যেন হাযির হলাম চৌদ্দশ বছর পূর্বের এই মরুভূমিতে! আমি যেন দেখতে পেলাম এক নূরানী কাফেলার উটের পদচিহ্ন! আমার উপর আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারালাম এবং নূরে ঝলমল সেই পদচিহ্ণের উপর লুটিয়ে পড়লাম, কিন্তু সময়ের কঠিন বাঁধন সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে আনলো আমাকে আমার বর্তমানে। নির্জন মরুভূমিতে অদ্ভুত অন্ধকার! অদ্ভুত নৈঃশব্দ! কিন্তু অন্ধকারেও রয়েছে আলোর আভাস! নৈঃশব্দেও রয়েছে মর্মের মর্মর ধ্বনি! এমনই হয় যখন অতীত ও বর্তমানের মিলন হয়! অতীত যখন ফিরে আসে বর্তমানের কাছে কিছু আলো দিতে, কিংবা বর্তমান যখন ফিরে যায় অতীতের কাছে কিছু আলো নিতে!
ঝিরঝির বাতাস বইছে। আমার মনে হলো, এ বাতাস যেন শুধু দেহকে শীতল করার জন্য নয়, বরং হৃদয় ও আত্মাকেও সুশীতল করার জন্য। আমার মনে হলো মরুভূমির নির্জনতা ও নৈঃশব্দ আমাকে যেন সঙ্গ দান করলো; মরুভূমির ঝিরঝির বাতাস আমার অন্তরে যেন আশ্বাসবাণী শোনালো এবং মরুভূমির বালুকণা আমাকে যেন মদীনার পথে পাথেয় দান করলো। এটা আমার আল্লাহর দান। তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
মরুভূমির কোল থেকে আমি ফিরে এলাম যেন শুচিশুদ্ধ ও পুত-পবিত্র হয়ে, হৃদয়ে ও আত্মায় শান্তি ও প্রশান্তির স্বর্গীয় অনুভব নিয়ে। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি মদীনার ধূলোবালির সুরমা, মদীনার খেজুর বাগানের ছায়া এবং মদীনার জাবালে অহুদের একটুখানি ভালোবাসা। হে আল্লাহ! আমাকে তাওফীক দান করো, চৌদ্দশ বছরের দান তোমার হাবীবের রওযা থেকে আঁচল পেতে গ্রহণ করার।
(চলবে, ইনশাআল্লাহ)