প্রতারক যখন শিক্ষিত
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। আমি তখন বি-বাড়িয়া তেলীনগর মাদরাসার শিক্ষক। কামরার দিকে আসছি, আমাকে দেখে দু-তিন জন ছাত্র হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে বের হয়ে বলল, হুযুর! আপনার সুখবর আছে।
আচ্ছা! কী সুখবর? অনেকক্ষণ থেকে মোবাইল বাজছিল, তাই আমরা রিসিভ করলাম। ফোনটি এসেছিল গ্রামীণ ফোন কোম্পানি থেকে। আপনি নাকি বিশাল পুরস্কার পেয়েছেন। এই নম্বরে ফোন করতে বলল।
ফোন করলাম।
আসসালামু আলাইকুম, কী ভাই! এই নম্বরে কি আপনি ফোন করেছিলেন।
জ্বী স্যার, এই নম্বরটি কি আপনার?
হাঁ, আমার।
স্যার, আপনি খুব ভাগ্যবান। গ্রামীণ ফোনের পক্ষ থেকে একটি লটারি হয়েছিল স্যার। সৌভাগ্যক্রমে আপনার নাম অর্থাৎ মোবাইল নম্বরটি এসেছে স্যার। স্যার, আপনি সারা বাংলাদেশে ২য় স্থান অধিকার করেছেন। স্যার, আপনি আমাদের কোম্পানি থেকে পাচ্ছেন বিশ হাজার টাকা মূল্যের ১টি মোবাইল সেট। নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং শ্রীলংকার একটি আপডাউন টিকেট। স্যার, আপনাকে এখন যে কাজটি করতে হবে তা হল ৩০০/- টাকার দুইটি গ্রামীণফোন কার্ড কিনে গোপন নম্বরটি দিতে হবে স্যার। এরপর কীভাবে কী করতে হবে তা পরে জানতে পারবেন স্যার। তবে কাজটি দ্রুত করতে হবে কিন্তু, পারবেন তো স্যার? আমি বললাম, দেখি আমার বসের সঙ্গে পরামর্শ করি, তিনি কী বলেন। না স্যার, দ্রুত করেন, হেলায় সুযোগ হারাবেন না। ২টি কার্ডের জন্য এতো কিছু হারাবেন স্যার? আধঘণ্টার ভিতরে ২টি কার্ড কিনে এই নম্বরে ফোন করেন স্যার। ঠিক আছে স্যার?
দেখি, চেষ্টা করি।
থ্যাংক ইউ স্যার। ... ।
তার কথার ভঙ্গি ছিল খুবই সুন্দর, স্পষ্ট উচ্চারণ ও কোমল আওয়াজ ছিল। প্রত্যেক কথায় স্যার বলছিল। কেন যেন আমার সন্দেহ হল যে, পুরস্কার পাব ভালো কথা, কিন্তু ৬০০ টাকা দিতে হবে কেন? নাকি এটা কোনো প্রতারণা?
আমি তখন উস্তাযে মুহতারাম মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ সাহেবকে ফোন করলাম। আমার কথা শুনে তিনি হাসলেন এবং বললেন, একটি প্রতারক গোষ্ঠী এই পদ্ধতিতে সরলমনা মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বাস্তবে এমন কিছু হলে কোম্পানি থেকে মেসেজ আসবে এবং পত্র-পত্রিকায় তা প্রচার হবে। সন্দেহ নেই এটি একটি ধোঁকা, তাই সতর্ক থেকো।
হুজুরের কথায় আমি নিশ্চিত হলাম। এবার তার সঙ্গে কিছু গল্প করার জন্য ওই নম্বরে মিসকল দিলাম। সে কল ব্যাক করল। জিজ্ঞেস করলাম, পুরস্কারগুলো আমার প্রাপ্য, কিন্তু এরজন্য ৬০০ টাকা দিতে হবে কেন? বিষয়টি তো আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তাছাড়া এমন ক্ষেত্রে কোম্পানির সিস্টেম হল মোবাইলে মেসেজ আসে এবং পত্রপত্রিকায় প্রচার করা হয়। তৃতীয় কোনো ব্যক্তির নিজস্ব নম্বর থেকে ফোন আসার তো কথা নয়। আর আধ ঘণ্টার ভিতরেই যোগাযোগ করতে হবে তারই বা কী রহস্য? ভাইজান, আপনার পরিচয়টা বলেন তো, কী উদ্দেশ্য আপনার?
আমার কথার জবাব না দিয়েই ওপাশ থেকে ফোন রেখে দেওয়া হল।
গত এপ্রিলের শেষ দিকে সোনারগাঁও এর বোয়ালদি মাদরাসায় ইসলাহী জোড়ে হাজির হয়েছিলাম। অস্থায়ী ছোট একটি স্টলে নাস্তা করতে বসেছি। সামনে বসা লোকটি ফোনে কথা বলছে। তার চেহারায় আনন্দের ছাপ। কয়টি কার্ড কিনতে হবে? কতক্ষণের মধ্যে যোগাযোগ করতে হবে? ইত্যাদি প্রশ্ন বার বার করে সে নিশ্চিত হচ্ছিল। বিষয়টি আমার বুঝার বাকী রইল না। মোবাইলে কথা শেষ হওয়ার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম ভাই ফোনটি কোত্থেকে এসেছিল?' গ্রামীণ ফোন থেকে। সে জবাব দিল। বললাম, এমন একটি ফোন আমার কাছেও এসেছিল, তাই জিজ্ঞেস করলাম। পরে বিস্তারিত বিবরণ দিলাম। সব ঘটনা শোনার পর তিনি বুঝতে পারলেন যে, এটা আসলে একটি প্রতারক গোষ্ঠীর কাজ। তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে বললেন, ভাই আমি তো বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম, আপনি আমাকে বাঁচালেন।
পরে শুনেছি, এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। এবং মোবাইল কোম্পানিগুলো পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের সতর্কও করেছে। তবে এরই মধ্যে নিশ্চয়ই অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন। এর জন্য প্রতারিতদেরও কিছুটা দোষ আছে বৈ কি। আর যারা এসব প্রতারণার পিছনে আছে, তারা যেহেতু খুব ভদ্রভাবে সুন্দর করে কথা বলতে পারে তাই অনুমান করি, তারা চাষাভূষা শ্রেণীর কেউ নয়; বরং বর্তমান সময়ে যাদের শিক্ষিত বলা হয় এরা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। সমাজের শিক্ষিত একটি শ্রেণীই যখন এরূপ চুরি, বাটপারি, প্রতারণা ও অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে তখন সেই শিক্ষার ব্যাপারে ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ হতে থাকে। আমরা যেন নির্মোহ মনে তিক্ত কিন্তু প্রয়োজনীয় ভাবনাগুলো ভাবতে পারি- আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দিন।
হামীদুল্লাহ
কানাইঘাট, সিলেট