আল্লাহ যার হয়ে যাবে
সমস্ত সৃষ্টিকুলও তার হয়ে যাবে
কথিত আছে যে, এককালের অর্ধজগতের শাসনকর্তা বাগদাদের প্রতাপশালী খলীফা হারুন-উর-রশিদ তাঁর এক কালো-কুৎসিত দাসীর উপর গর্বিতা ছিলেন। তাঁকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। বাদশার এই অযৌক্তিক দুর্বলতা নিয়ে উজির-নাজির ও আমির-ওমারাদের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জরণ ও তাচ্ছিল্যের ভাব সৃষ্টি হয়। হারুন-উর-রশিদ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে একদিন উপরস্থ আমির-ওমারাদের সকলকে ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানালেন। ভোজসভার এক পর্যায়ে দাস-দাসীদের উদ্দেশ্য করে বাদশাহ একটি ফরমান জারি করলেন, এই মুহূর্তে যে যেই বস্তুর উপর হাত রাখবে, সে ঐ বস্তুর মালিক হয়ে যাবে। বাদশার ঘোষণাটি বলার দেরী আর আমনি দাস-দাসীদের ছোটাছুটি কে দেখে! কেউ সোনার স্তুপের উপর গিয়ে হাত রাখছে তো অন্যজন রূপার স্তুপের উপর হাত রাখছে। আবার কেউ মণি-মুক্তা, হিরা-জাওহারের মতো মূল্যবান বস্তুর দিকে এগিয়ে গিয়ে তাতে হাতখানি রেখে দিচ্ছে। মোট কথা, দাস-দাসীদের কেউ আর বাকী থাকেনি, সবাই দৌড়-ঝাঁপ দিয়ে যার যার সাধ্যমতো রাজভান্ডারের মূল্যবান বস্তু সামগ্রীর মালিক হবার এক মহা কসরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই কালো-কুৎসিত দাসীটি বাদশার পেছনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে কোনো দৌড়-ঝাপে অংশগ্রহণ করেনি। বাদশার মাথার উপর মৃদুভাবে তার হাতখানি শুধু একটু রেখে দেয়। বাদশাহ রাগতঃস্বরে তাকে বলেন, বেক্বু কোথাকার, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার ঘোষণা শুনিসনি? রাজভান্ডারের মালিক হবার এইতো সুবর্ণ সুযোগ।
দাসীটি তখন অনুচ্চস্বরে শুধু বলল, জাহাপনা! আপনার ঘোষণা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমি বেকুব নই, আমি আসল জায়গায়ই হাত দিয়েছি। ওরা শুধু যে যেখানে হাত রেখেছে তারই মালিক হতে পারবে। অন্য আর কিছুর মালিক তারা হতে পারবে না। পক্ষান্তরে আমি এমন এক ব্যক্তিত্বের মাথায় হাত রেখেছি যিনি দেশের সমস্ত ধনভান্ডারসহ গোটা অর্ধজগতের মালিক। আমি ঐ ব্যক্তির মালিক হওয়ার মানেতো ঐ সমস্ত বস্তুরও মালিক হয়ে যাওয়া। তারা প্রত্যেকে শুধু একেকটা বস্তুর মালিক হতে যাচ্ছে, আর আমি অর্ধজগতের মালিক হতে যাচ্ছি।
এবার বাদশাহ উজির-নাজির ও আমত্যবর্গের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, দেখুন! তার তীক্ষè বুদ্ধি! তাকে ভালো না বেসে কোনো উপায় আছে?
এ থেকেই সহজে আমরা বুঝতে পারি যে, পৃথিবীর একজন বাদশার সন্তুষ্টি ও তাঁকে নিজের আওতায় আনতে পারলে যদি তাঁর সমস্ত ধন-ভান্ডার ও সমগ্র রাজত্বের মালিক হওয়া যায়, তাহলে আমার উপর আমার আল্লাহ যদি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং তিনি আমার হয়ে যান, তবে তো আসমান-জমিন, গ্রহ-তারাসহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকুলই আমার হয়ে যেতে বাধ্য। কবি বলেন, ‘আগার এক তু নেহী মেরা তো কুই শাইনেহী মেরা জু তু মেরা তো ছব মেরা ফলক মেরা জমীঁ মেরী’।
প্রায় তের‘শ বছর আগেকার কথিত একটি গল্প দিয়ে বিষয়টি বোঝার চাইতে চলুন আমরা বিংশ শতাব্দীর একটি বাস্তব ঘটনা দিয়েই তা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করি।
১৯৮৩ ইসায়ীর ২৯শে আগষ্টের টাইম্স অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের সরকারী দলের দু’জন সংসদ সদস্য মিষ্টার অরুণ নেহরু এবং মিষ্টার উদে সিং রাও ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কিউবা সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের কিউবার বার্ষিক উৎসবে অংশগ্রহণের কথা ছিল। তারা উৎসব শেষে কিউবার প্রেসিডেন্ট ড. ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী হলেন। এতদুদ্দেশ্যে তারা প্রেসিডেন্টের দফতরে দরখাস্ত পেশ করলেন। দুইদিন অপেক্ষার পর তাদের জানানো হল, আজ রাতের ভোজসভায় প্রেসিডেন্ট আপনাদের দু’জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু সংসদসদস্যরা বুঝতে পারলেন যে, তারা প্রেসিডেন্টের এ অনুগ্রহ থেকে উপকৃত হতে পারবেন না। কারণ সেদিন সন্ধ্যা পাঁচটার দিকে তাদের ফিরতি টিকিট ছিল। তাই তারা প্রেসিডেন্টের দফতরে তাদের অক্ষমতার বার্তা সবিনয়ে পৌঁছে দিলেন। নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী তারা বিমান বন্দরের দিকে যাত্রা করলেন।
তারা বিমান বন্দরে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো স্বয়ং নিজেই বিমান বন্দরে আসেন। ভারতের উভয় সংসদসদস্যের সাথে তিনি উষ্ণ আন্তরিকতার সাথে মিলিত হন এবং বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে তাদের সাথে স্বভাবসুলভ আলোচনা আরম্ভ করেন। কিছুক্ষণ পর প্রেসিডেন্টের দোভাষী অনুভব করলেন যে, এম.পি সাহেবদের চেহারায় ভয় ও শংকার নিদর্শন প্রকাশ পাচ্ছে। তাঁর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বললেন, মহামান্য প্রেসিডেন্টের আলোচনা দীর্ঘায়িত হতে চলেছে; অথচ ঘড়ির সময় অনুযায়ী আমাদের বিমানের সময় হয়ে গেছে। তখন দোভাষী মুচকি হেসে বললেন, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনাদের বিমান ততক্ষণ পর্যন্ত উড্ডয়ন করবে না, যতক্ষণ না প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে গ্রীণ সিগনাল দেওয়া হবে।
বিমান বন্দরের ব্যবস্থাপকরা যদি অবহিত হয় যে, রাষ্ট্র প্রধান স্বয়ং বিমান বন্দরের ওয়েটিং রুমে তাঁর সফররত বন্ধুদের সাথে কথা বলছেন, তখন তারা নিজেরাই বিমানকে তাদের আরোহণ পর্যন্ত অপেক্ষায় রাখবে। রাষ্ট্র প্রধানের পক্ষ থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আদেশনামা জারি করার তখন আর প্রয়োজন হবে না।
ভারতের দু’জন সংসদ সদস্য একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে যে অভিজ্ঞতা লাভ করলেন তা পুরো সৃষ্টি জগতের পরিচালক মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে আরো অধিক পরিমাণে সঠিক। যদি আপনি সৃষ্টি জগতের অধিপতির কাজে নিয়োজিত থাকেন যদি আসমান-জমিনের বাদশার সাথে আপনার সাক্ষাৎ (সম্পর্ক) অব্যাহত থাকে, তখন আপনার ব্যাপার আর সাধারণ কোনো ব্যাপার থাকবে না ; বরং বিশেষ ব্যাপারে পরিণত হবে। আল্লাহ তা’আলার কাজে নিবেদিত থাকার কারণে যে কাজ আপনি স্বয়ং করতে অপারগ, তা আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টি আপনার পক্ষ থেকে আঞ্জাম দেবে। যেখানে সাধারন মানুষের কাজ বিফল হয় সেখানে আপনার কাজ সফলকাম হবে। সাধারণ মানুষ যখন সুযোগ হারিয়ে ফেলে, তখন সুযোগ আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। আপনি আসবেন এবং তা ব্যবহার করবেন।
তাবলীগ জামাতের কিছু লোক রেলে সফর করছিল। পথিমধ্যে নামাজের সময় হল। সাথীরা সিদ্ধান্ত নিল, সকলে মিলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করবে। অতঃপর যখন পরবর্তী স্টেশনে রেল থামল, পুরো জামাত প্লাটফর্মে নেমে পড়ল, কেউ বলল, এখানে রেল কেবল দু’মিনিট অপেক্ষা করে। আপনারা নামাজ পড়তে যাবেন, আর ওদিকে রেল চলে যাবে। কাফেলার আমীর সাহেব বললেন, আমরা আল্লাহর কাজ করতে যাচ্ছি এবং রেলও আল্লাহ তা’আলারই অনুগত। এ কেমন করে হতে পারে যে, সেটি আমাদের রেখে সামনে অগ্রসর হবে? ঘটনা তাই ঘটল। সাথীরা জামাতের সাথে স্থিরচিত্তে নামাজ আদায় করল। গাড়ির ইঞ্জিনে তখনই হর্ণ বাজল, যখন তারা আপন আপন বগিতে ফিরে আসতে সমর্থ হল। একজন রাষ্ট্র প্রধানের বন্ধুদের জন্যে যদি উড়োজাহাজ বিলম্ব করতে পারে তখন আমাদের আশ্চর্য হবার কিছু থাকে না। যদি খোদার বন্ধুদের খাতিরে রেলও কিছুক্ষণ বিলম্ব করে তখন আর অবাক হওয়ার কী থাকে!
এ ধরনের ঘটনা কিন্তু দু’একটি নয়, এমন হাজারো ঘটনা রয়েছে যা ইতিহাসের পাতায় ইতিহাস হয়েই বিদ্যমান আছে। খলীফা হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর মদীনার মসজিদে নববীতে জুমার খোৎবায় ‘ইয়া সারিয়াতুল জাবাল’ বলে প্রায় এক হাজার মাইল দূরে মুসলিম সেনাবাহিনীকে দিক-নির্দেশনা দেওয়া এবিষয়েরই অন্তর্ভুক্ত। বারো হাজার সেনাবাহিনী নিয়ে পানির উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দিয়ে সাগর পাড়ি দেওয়া এরই দৃষ্টান্ত। আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে মুসলমানদের সেনাছাউনী বানানোর প্রয়োজনে সেনাপতি কর্তৃক জীব-জন্তুদের অন্যত্র চলে যাওয়ার ফরমান জারী এবং তাদের তা মানতে বাধ্য হওয়া এরই দৃষ্টান্ত। তবে শর্ত হল, পৃথিবীতে আল্লাহ তা’আলার এমন কিছু বান্দা তৈরি হতে হবে, যারা কেবল আল্লাহ তা’আলাকেই নিজেদের বন্ধু ও কর্মবিধায়ক হিসাবে গ্রহণ করবে।
বর্তমানে পৃথিবীতে আমাদের দুভার্গ্য হল, আমরা নিজেদের সমস্যাকে খোদায়ী সমস্যা হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত নই, আমরা যা কিছু করছি, জড়বাদী অনুভূতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে করছি খোদায়ী অনুভূতিতে নয়। আমাদের আন্দোলন ও নেতাদের কর্মতৎপরতা প্রমাণ করে যে আমাদের সমস্যা এখন পর্যন্ত কেবল জাগতিক স্বার্থ ও জাতীয় সমস্যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। আমরা আল্লাহর জন্যে নই; বরং গায়রুল্লাহর জন্যে ব্যতিব্যস্ত রয়েছি। এমতাবস্থায় হতে পারে আমরা আমাদের জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব এবং আমাদের বিমান আমাদের জন্যে অপেক্ষা না করেই উড্ডয়ন করে ছেড়ে যাবে।