Shaban-Ramadan 1428   ||   September-October 2007

অহেতুক ও অবান্তর প্রশ্ন ত্যাগ করাই সদ্গুণ

Abu Tashrif

প্রশ্নকে বলা হয়ে থাকে অজ্ঞতার চিকিৎসা। প্রশ্নকে বলা হয়ে থাকে জ্ঞান বা ইলমের অর্ধেক। এটা তো তখনই বলা হয়, যখন প্রশ্ন করে কোনো ইলম হাসিল করা  উদ্দেশ্য হয় প্রশ্নকারীর। প্রশ্নটি যদি অর্থবোধক ও ইতিবাচক হয় তাহলে আহলে ইলম ও প্রাজ্ঞজনদের উত্তরে জ্ঞানের নতুন সুন্দর ভুবন উন্মোচিত হয় প্রশ্নকারীর সামনে। কিন্তু প্রশ্ন যদি অর্থহীন, অহেতুক কিংবা বিভ্রান্তিকর হয়, তবে কি সে প্রশ্ন কোনো সুফল বয়ে আনে? ফালতু ও বিরক্তিকর প্রশ্ন করা কি সমীচীন? কল্পিত কোনো বিষয় নিয়ে, তাৎপর্য ও উদ্দেশ্যহীন কোনো কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন সব বিবেচনা থেকেই নিরুৎসাহযোগ্য একটি প্রবণতা। এ প্রবণতা পরিত্যাগ করতে পারাই হচ্ছে সফলতা। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী মনীষীগণের বাণী ও আমল থেকে এ বার্তাই পাওয়া যায়। হযরত মুআবিয়া রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভ্রান্তিকর ও জটিলতা সৃষ্টিকারী প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছেন।

হযরত সাহল ইবনে সাদ রা. প্রমুখ থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু প্রশ্নকে অপছন্দ করেছেন এবং সেগুলোকে মন্দরূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য এটা কেন, ওটা কিভাবে (এমনতর জিজ্ঞাসা) এবং অধিক প্রশ্ন করাকে অপছন্দনীয় করেছেন।

হযরত আমীর ইবনে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কা্স  রা. তার পিতাকে বলতে শুনেছেন যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মুসলমানদের ওপর সেই ব্যক্তি সবচেয়ে বড় নিপীড়নকারী যে মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ নয় এমন বিষয়ে প্রশ্ন করার ফলে বিষয়টি নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

তাউস থেকে বর্ণিত, হযরত উমর ইবনুল খাত্তার  রা. মিম্বরে অবস্থান করা কালে বলেন, ওইসব ব্যক্তির ব্যাপারে আমি আল্লাহর নামে সতর্ক করছি, যারা ভিত্তিহীন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা অস্তিত্ব আছে এমন সব বিষয়ই সুস্পষ্ট বর্ণনা করেছেন। তাউস বর্ণিত হযরত উমর  রা. এর আরো একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। হযরত উমর বলেন, কোনো মানুষের জন্য বৈধ নয় এমন বিষয়ে প্রশ্ন করা, যা আসলে কিছুই নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা যে বিষয়ের ভিত্তি রয়েছে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন।

হযরত ইবনে উমর  রা. থেকে বর্ণিত , তিনি বলেন, হে লোক সকল! তোমরা এমন বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যার কোনো ভিত্তি নেই। নিশ্চয়ই হযরত উমর  রা. ভিত্তিহীন বিষয়ে প্রশ্নকর্তাকে অভিশাপ দিয়েছেন। আওযায়ী বলেন, যখন আল্লাহ তার কোনো বান্দাকে ইলমের বরকত থেকে মাহরূম করতে ইচ্ছা করেন তখন তার মুখে অহেতুক ও বিভ্রান্তিকর কথা নিক্ষেপ করেন।

হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মাঝে মন্দ লোক তারা, যারা মন্দ প্রশ্ন করে এবং সেসব প্রশ্ন দ্বারা আল্লাহর বান্দাদের ফিৎনায় ফেলে দেয়। ইয়াহইয়া ইবনে আইয়ুব বলেন, আমার কাছে এ তথ্য পৌঁছেছে যে, প্রাজ্ঞজনেরা বলতেন, যখন আল্লাহ ইচ্ছা্ করেন তার বান্দাকে ভালো কিছু শেখাবেন না তখন তাকে বিভ্রান্তিকর কথাবার্তায় নিমগ্ন করে দেন।

কাজী ইয়ায রাহ. তারতীবুল মাদারিক গ্রন্থে ইমাম মালেক রাহ.-এর শাগরিদ যিয়াদ ইবনে আব্দুর রহমান আল কুরতবীর (যিনি শাবতুন উপাধিতে প্রসিদ্ধ) একটি ঘটনা হাবীব নামের এক ব্যক্তির উদ্ধৃতিতে লিখেছেন। হাবীব বলেন, আমরা যিয়াদের কাছে বসে ছিলাম। এক বাদশার একটি চিঠি এল। তিনি তার কলম কালিতে চুবিয়ে উত্তরপত্র লিখলেন। সিলমোহর করে দূতকে দিয়ে তা পাঠিয়ে দিলেন। এরপর তিনি বললেন, তোমরা জান এ পত্র প্রেরণকারী আমাকে কোন্ বিষয়ে প্রশ্ন করেছে? প্রশ্ন করেছে কেয়ামতের দিন আমল মাপার পাল্লার ডালা দুটি কিসের হবে- স্বর্ণ নাকি রূপার? আমি উত্তরে লিখে দিয়েছি, শিহাবের উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে বর্ণনা করেছেন মালেক, তিনি বলেছেন যে, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, ইসলামের একটি সৌন্দর্য হচ্ছে অর্থহীন বিষয়কে বর্জন করা; সুতরাং অচিরেই সে পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তুমি বিষয়টি জানতে পারবে। ইমাম শাবী রাহ.-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করলো, ইবলিশের স্ত্রীর নাম কি? তিনি তাকে উত্তর দিলেন, তাদের বিবাহে তো আমি ছিলাম না। কাজী ইয়ায তারতীবুল মাদারিক গ্রন্থে ইমাম মালেক রাহ. কে কৃত অবান্তর প্রশ্ন এবং তার উত্তরে মালেক কী বলেছেন, তা-ও লিপিবদ্ধ করেছেন। এক ব্যক্তি এসে মালেক রাহ. কে জিজ্ঞাসা করলো- যদি মৃত মুরগীকে এক ব্যক্তি পা দিয়ে পিষে দেয় অতঃপর সে মুরগী থেকে একটি ডিম বের হয়ে আসে এবং সে ডিম তার কাছে বাচ্চা দেয় তাহলে সে কি ওই বাচ্চাটিকে খেতে পারবে? মালেক বললেন, যা ঘটে তা জিজ্ঞাসা কর, যা ঘটে না তা নিয়ে জিজ্ঞাসা বর্জন কর। আরেক ব্যক্তি একই ধরনের আরেকটি প্রশ্ন করলে তিনি প্রথমে নিরুত্তর থাকেন। সে ব্যক্তি যখন বললো, উত্তর দিচ্ছেন না কেন হে আবু আব্দুল্লাহ! তখন তিনি বললেন, যদি এমন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে যা দ্বারা তুমি উপকৃত হতে পারবে তাহলে অবশ্যই জবাব দিতাম। আরেক ব্যক্তি ইমাম মালেক রাহ. কে জিজ্ঞাসা করলো  এমন ব্যক্তির শাস্তির ব্যাপারে, যে অপরজন কে বলে- হে গাধা! মালেক বললেন, তাকে বেত্রাঘাত করতে হবে। প্রশ্নকারী বললো যদি ওই ব্যক্তি হে ঘোড়া বলে অপরজনকে ডাকে, তখন? মালেক বললেন, তাহলে তোমাকে বেত মারতে হবে। হে নির্বোধ! তুমি কি শুনেছ, কেউ আরেকজনকে হে ঘোড়া বলে ডেকেছে?

অহেতুক ও অবান্তর প্রশ্নে কোনো উপকার নেই। কিন্তু এ ধরনের প্রশ্নের কোনো সীমানাও নেই। দ্বীনী ইলমের পোশাক পরিয়েই এসব প্রশ্ন নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষকে ব্যাকুল হয়ে যেতে দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে অবান্তর, অহেতুক ও বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন। অধিকাংশ সময়ই মেধার চাতুর্য ও মনের বিলাস প্রবণতা থেকে এধরনের প্রশ্নের উদ্ভব হয়। প্রশ্নকারীর নিজের কোনো ফায়দা যেমন এসবে জড়িত নেই তেমনি এ সবের উত্তরের সঙ্গে বিশ্বাসগত, আমলগত কিংবা শরীয়ত প্রবর্তকের পক্ষ থেকে নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞাগত কোনো বিধানেরও সম্পর্ক নেই। এ ধরনের প্রশ্ন তো সাধারণভাবে উত্তরযোগ্য নয়ই, তবে তিরস্কার, তাচ্ছিল্য ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রশ্ন করা হলে নিঃসন্দেহে তা নিষিদ্ধ ও অবৈধ।

প্রশ্ন যদি জানার জন্য, বাস্তব ভিত্তিক ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে হয় তাহলে উত্তরদাতা প্রশ্নকারীর চাহিদা পূরণ করতে পেরে তৃপ্তি বোধ করেন, শান্তি পান। সর্বোপরি তার ওপর অর্পিত ইলমী দায়িত্ব সম্পন্ন করতে পারার আনন্দ লাভ করেন। তাই আহলে ইলম ও প্রাজ্ঞজনকে দ্বীনের যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে সে প্রশ্নের বাস্তবতা, উপকারিতা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনতা বজায় রাখা সবারই প্রয়োজন।

[শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ রাহ. রচিত মানহাজুস সালাফ ফিস সুয়াল আনিল ইলম পুস্তিকার ২২-২৯ পৃষ্ঠা অবলম্বনে লিখিত]

 

advertisement