Muharram 1432   ||   December 2010

আইনের বচন: ‘আইন পরিপন্থী’ ধর্মচর্চা কীভাবে চলবে?

Khasru Khan

নভেম্বরের শেষ দিকে সশস্ত্রবাহিনী দিবস ঘটা করে পালিত হয়। অন্যান্য বারের মতো এাবারও সংবাদপত্রের পাতায় দেখলাম, ফজরের নামায ও সম্মিলিত দুআর মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দিবসটির পালন শুরু করেন। অথচ এর প্রায় দু’-একদিন পরই দেখলাম, এ দেশের সাবেক এক সেনাপ্রধান একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সেনানিবাসে রাজনীতি ও ধর্মচর্চা আইনের পরিপন্থী

সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন ছিল সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক কারণে বিতর্কিত না করার আহ্বান নিয়ে। একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে আরেকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে করা ওই সংবাদ সম্মেলনের ভালোমন্দ নিয়ে এখানে আলোচনার কোনো আগ্রহ নেই। বিষয়টিকে আমরা দলীয় রাজনীতির বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়া সমীচীন মনে করছি। যদিও সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কের শিকার না বানানোর মূল আহ্বানটির সঙ্গে আমরা একমত। কিন্তু সেনানিবাসে কোন্‌ কোন্‌ আচরণ নিষিদ্ধ, তার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে সাবেক এই সেনাপ্রধান ধর্মচর্চাকেও সেনানিবাসের নিষিদ্ধ আচরণের অন্তর্ভুক্ত করলেন। তিনি কি বিষয়টি ভেবে বলেছেন? সংবাপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী তার বক্তব্যটি ছিল লিখিত। তাহলে তো বক্তব্যটিকে হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলার পর্যায়ে রাখা যায় না। ভেবে চিন্তেই বক্তব্যটি কপি করা হয়েছে এবং পরিবেশন করা হয়েছে বলে মনে করা যেতেই পারে।  

প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এ বক্তব্যের একদিন্তদুদিন আগে যে সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের সদস্য ও কর্মকর্তারা ফজরের নামায ও সম্মিলিত দুআর মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপন শুরু করলেন, তারা কি একটি আইন পরিপন্থী  কাজ দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন? আরও প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের প্রতিটি সেনানিবাসের ভেতরে যে বিশালায়তন সুন্দর সুন্দর মসজিদ রয়েছে, যেগুলোতে সেনাবাহিনীর ভাইয়েরা ওয়াক্তিয়া নামাযের জামাতে, জুমায়, ঈদে, তারাবিতে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আগ্রহ নিয়ে অংশ নেন এসব মসজিদের কী হবে? এসব মসজিদে সেনাসদস্যদের নামায-ইবাদত ও ধর্মচর্চার কী হবে? এগুলোও কি আইনপরিপন্থী? নাকি সাবেক ওই সেনাপ্রধানের নির্দেশনা অনুযায়ী তার পছন্দের কোনো সরকার এগুলোকে আইনপরিপন্থী হিসেবে সাব্যস্ত করবেন? অথবা বিচার বিভাগের নতুন কোনো সিদ্ধান্ত এনে এসব ধর্মচর্চাকেও বে-আইনী ঘোষণা করা হবে?

২৫ নভেম্বর প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকা থেকে সাবেক ওই সেনাপ্রধানের সংবাদ সম্মেলনের খবরের প্রথম দুটি প্যারা শিরোনামসহ তুলে দেওয়া হল।  

সেনানিবাসে রাজনীতি ও ধর্মচর্চা আইনের পরিপন্থী-লে.জে. হারুন 

বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার ঢাকা সেনানিবাস মইনুল রোডের বাড়ি নিয়ে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়েছে অভিযোগ করে আওয়ামী সমর্থিত কতিপয় সেনা কর্মকর্তা গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সেনাবাহিনী এ দেশের একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে কোনো ব্যক্তি কিংবা দলের পক্ষে-বিপক্ষে টানার সুযোগ নেই। সেনানিবাসের অভ্যন্তরে বসবাস করে রাজনীতি করা উচিত নয় মন্তব্য করে সাবেক সেনাপ্রধান হারুন বলেন, সেনানিবাসকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠা একেবারেই অবাঞ্ছিত। সেনানিবাসের অভ্যন্তরে রাজনীতি চর্চা, ধর্মচর্চা এবং এ সম্পর্কিত আলোচনা সেনা আইনের পরিপন্থী।

গতকাল মহাখালীর ট্রাস্ট মিলনায়তনে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাবৃন্দর ব্যানারে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে সেনা বাহিনীকে বিতর্কিত না করার আহ্বান জানানো হয়। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান লে.জেনারেল (অব.) হারুন অর রশীদ। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মেজর জেনারেল (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) রফিকুল ইসলাম এমপি প্রমুখ।

রাজনৈতিক বিতর্কের জন্য নতুন একটি শব্দের এ দেশে উদ্ভাবন ও প্রচলন হয়েছে। সেটি হচ্ছে, ‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। যদিও মুসলমান মাত্রেরই বিশ্বাস থাকা উচিত যে,  মুসলমানের রাজনীতি ধর্মভিত্তিক হওয়াই দরকার, তারপরও দলীয় রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তের এ অস্থির সময়ে তিনি যদি সেনানিবাসের ভেতরের নিষিদ্ধ আচরণগুলোর মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকথাটি বলতেন, আমরা একটি দুর্বল ব্যাখ্যা হলেও খুঁজে পেতাম। কিন্তু সোজা সাপ্টা ধর্মচর্চাকে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে আইন পরিপন্থী আখ্যা দেওয়ার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই সাবেক কর্মকর্তাকে বর্তমান সেনাবাহিনীর কোনো প্রতিনিধি বলে মনে করা জরুরি নয়। অন্য অনেক অবসর পাওয়া, চলে যাওয়া, বের করে দেওয়া এবং বিচার হওয়া সেনা সদস্যের বক্তব্যকে যেমন সেনাবাহিনীর ভাষ্য মনে করা যায় না, তেমনি তারটাও। তারপরও তার বক্তব্যে সেনানিবাসে ধর্মচর্চার আইন সিদ্ধতা-অসিদ্ধতা নিয়ে যে উদ্ভট তথ্য পরিবেশন হল, এটাকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। তার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিগত আনুকূল্য আর ধর্মীয় ইস্যুতে বিচার বিভাগের তাৎপর্যপূর্ণ আচরণের এই ঘোলাটে পরিবেশে এ বক্তব্যে ধর্মচর্চানিয়ে ভবিষ্যত-ষড়যন্ত্রের গন্ধ কারো নাকে লাগলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তবে আশার কথা হল, দলীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচে জেতা আর আল্লাহর দ্বীন্তধর্মের বিষয়ে ষড়যন্ত্রে বিজয় অর্জন এক কথা নয়। বিষয়টা অনেক কঠিন। দেখা যায়, পার্থিব ক্ষেত্রে এভারেস্ট পার হয়ে এসেও ধর্মীয় বিষয়ে অশিষ্টাচারের কারণে মেঠো পথে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন, এমন মানুষ এ দুনিয়ায় লাখো লাখো।

 

advertisement