অজ্ঞতা ও রসম রেওয়াজের কবলে শাবান-শবে বরাত
নববী নির্দেশনাই মুক্তির উপায়
আল্লাহর ক্ষমা ও পুরস্কারপ্রাপ্তির মহিমান্বিত মুহূর্তগুলো আমাদের জীবনে বারবার ঘুরে ফিরে আসে। রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে মাগফিরাতের কপাট খুলে বান্দার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকেন রাহীম ও গাফূর মহান রাব্বুল আলামীন। অতি কাছ থেকে বান্দাকে হাতছানি দিয়ে বারবার আহ্বান করা হয়। আছে কি অনুতপ্ত কোনো পাপী বান্দা, যে ক্ষমা প্রাপ্তির সুসংবাদ নেবে? আছে কি বিপদগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি, যে বালা-মুসিবত থেকে মুক্তির ঠিকানা খুঁজে নেবে? ধন-সম্পদ ও রিযিক তলবকারী কোনো বান্দা আছে কি, যে অফুরন্ত খাযানা থেকে রিযিকের নিশ্চয়তা নেবে? বুদ্ধিমান তারাই যারা এই সুযোগগুলো সাদরে গ্রহণ করে। আদর্শ ও পবিত্র জীবনের হাতছানিকে যথাযথভাবে কাজে লাগায়। কিন্তু আফসোস, আমরা অনেকেই নিজেদের কর্মকাণ্ডের দোষে মহান প্রভুর এ দান থেকে উপকৃত হই না বরং বঞ্চিত হই। কেউ একে অবহেলায় কাটিয়ে দেয়, আবার অনেকে এ সুযোগের অপব্যবহার করে। কারণ যাই হোক, ফলাফল কিন্তু একটাই, তা হল বঞ্চনা।
নগদ ও দৃশ্যমান বস্তুর উপর অতি বিশ্বাসী আমরা কেউ কেউ নিজের পাপের বোঝা দেখে শঙ্কিত হই। ভাবি, এত কিছুরও ক্ষমা সম্ভব? অথচ ভুলে যাই আল্লাহর গাফফার (বারবার ক্ষমাকারী) সিফাতের কথা।
এ প্রসঙ্গে শুধু একটি ‘হাদিসে কুদসী’ উল্লেখ করছি। আল্লাহ বলেন, হে আদম-সন্তান! তুমি যা দুআ করবে, যা আশা করবে আমি বিগত জীবনের সবকিছু ক্ষমা করে দেব। আমি কারো পরোয়া করি না। হে আদম-সন্তান! তোমার পাপ যদি আকাশসমও হয় অতঃপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি সব ক্ষমা করে দেব। হে আদম-সন্তান! তুমি যদি পুরো পৃথিবীর ভূমি সমপরিমাণ অপরাধ নিয়ে আমার কাছে আস এবং শিরকমুক্ত হয়ে আমার পথে ফিরে আস তাহলে আমিও এর সমপরিমাণ ক্ষমা ও মার্জনা নিয়ে তোমার কাছে হাজির হব।—তিরমিযী, হাদিস ৩৫৪০
অন্যদিকে আমরা অনেকেই এ সুবর্ণ সুযোগকে হাতছাড়া করি এর অপব্যবহার করে। প্রথমত অনেকে অতি চালাকি করে ভেবে রাখি, এখন যা ইচ্ছা করে তেমনই করতে থাকি। অমুক অমুক রাতে তওবা ও কান্নাকাটি করলে সব পাপ-পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমাদের অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা একদিকে যেমন খুবই মারাত্মক অন্যদিকে হাস্যকরও বটে। মারাত্মক এজন্য যে, এর দ্বারা শুধু নিজেই প্রতারিত হচ্ছি না, বরং অতিবুদ্ধির জোরে যেন (নাউযুবিল্লাহ) আমরা আল্লাহকেই বোকা বানাতে চাচ্ছি। তাছাড়া তাওবা অর্থ আত্মসমর্পণ, যে ব্যক্তি কোনো না কোনো দিন অনুতপ্ত ও অনুশোচনাকারী হয়ে আত্মসমর্পণের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, সে ব্যক্তি আত্মসমর্পণের আগে-পরে এমন কর্মকাণ্ডে কীভাবে লিপ্ত হতে পারে যার জন্য তাকে অনুশোচনা করতে হয় বা শান্তি ভোগ করা লাগে।
এ বিষয়ে ইমাম গাযালী রাহ. এর একটি কথা স্মরণ রাখার মতো। তিনি বলেন, তুমি বড় নিবোর্ধ, আল্লাহর ক্ষমা ও দয়ার আশা করে বসে থাকলে, আর তার শক্তি ও পরাক্রমতার কথা একেবারে ভুলে গেলে। ভুলে গেলে তোমার ইবাদতের প্রতি তিনি অমুখাপেক্ষী। অথচ এক টুকরো রুটি, এক মুঠো সম্পদ আর এক লোকমা খাদ্যের জন্য তুমি আল্লাহর দয়ার আশায় হাত পা গুঁজে বসে থাক না। বরং ছুটে যাও কাজের সন্ধানে, নেমে পড় কোমর বেঁধে। এই অসঙ্গতিপূর্ণ চাওয়াই তোমাকে নবীজীর পক্ষ থেকে বোকা ও নিবোর্ধ উপাধির অধিকারী করল। নবীজী বলেছেন, বুদ্ধিমান সে ব্যক্তি যে নিজেকে চিনল এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি নিল। নির্বোধ সে যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির অনুগামী হল এবং আল্লাহর রহমতের আশায় দিন কাটাল। -তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৯; ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন ৮/৪৪১
ঈমাম গাযালী রহ. আরও বলেন, সম্ভব সকল উপায় অবলম্বনের পরই আশা ও প্রত্যাশার পর্ব আসে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
اِنَّ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ الَّذِیْنَ هَاجَرُوْا وَ جٰهَدُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ ۙ اُولٰٓىِٕكَ یَرْجُوْنَ رَحْمَتَ اللّٰهِ.
‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে, আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই আল্লাহর রহমতের আশা করে।’ অর্থাৎ এসব গুণ অর্জনকারীরাই আল্লাহর রহমত পাওয়ার অধিক হক্বদার। অন্যথায় সে ওই ব্যক্তির ন্যায় হবে যে ধু ধু মরুভূমিতে বীজ বপন করল, আর কোনো পানি সিঞ্চন ব্যতিরেকেই ফল পাওয়ার আশায় বসে রইল। ইয়াহইয়া ইবনে মুআয বলেছেন, সবচেয়ে প্রতারিত সে ব্যক্তি যে সারাদিন গুনাহে লিপ্ত থাকে আর কোনো অনুশোচনা ব্যতিরেকেই ক্ষমা পাওয়ার আশা করে। আল্লাহর আনুগত্য করে না, অথচ তাঁর নৈকট্য কামনা করে। জাহান্নামের বীজ বপন করে আর জান্নাতের ফল কামনা করে, অপরাধ করে বেড়ায় আর অনুগতদের ন্যায় মর্যাদার প্রত্যাশা করে। সীমালঙ্ঘন করে, ফের আল্লাহর রহমত আশা করে।
ترجو النجاة و لم تسلك مسالكها + إن السفينة لا تجرى على اليبس
মুক্তি পেতে চাও তো বটে,
সে পথে কভু চলোনি তুমি
নৌকা ভ্রমণের সাধ নিয়ে আজও
আকঁড়ে আছ মরুভূমি।
—ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/১৯৯
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তমরূপে অজু করে দু’রাকাত নামাযের উপর বিগত দিনের সকল পাপের ক্ষমার সুসংবাদ ঘোষণা করে এই বলে হুঁশিয়ার করেছেন, ‘প্রতারিত হয়ো না, ধোঁকা খেয়ো না’ যার অর্থ হল ক্ষমা পাওয়ার উপর অধিক ভরসা করে গুনাহে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহস করো না, কেননা সবকিছু তো আল্লাহর ইচ্ছার উপরই নির্ভরশীল। —উমদাতুল কারী ২৩/৪৪
হাফেজ ইবনে হাজার বলেছেন, এ মাগফিরাতের সুসংবাদ তো সে আমলের জন্য যা আল্লাহর কাছে মাকবুল হয়, কিন্তু আমার এ আমল কবুল হয়ে গেছে এ নিশ্চয়তা কেইবা দিতে পারে? —ফাতহুল বারী ১১/২৫৬
অতএব শবে বরাত ও শবে কদরের মতো মহিমান্বিত দু’টি রজনী আর শাবান ও রমযানের মতো রহমত ও বরকতপূর্ণ দুটি মাহিনা আমাদের দ্বারে উপস্থিত। এই মুহূর্তে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীটির দুটি অংশের কোনোটিই যাতে আমরা বিস্মৃত না হই-
نَبِّئْ عِبَادِیْۤ اَنِّیْۤ اَنَا الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُۙ۴۹ وَ اَنَّ عَذَابِیْ هُوَ الْعَذَابُ الْاَلِیْمُ.
‘আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দিন যে, আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু এবং আমার শাস্তিই হল যন্ত্রণাদায়ক।’ —সূরা হিজর, আয়াত ৪৯-৫০
বিশেষত শবে বরাত একেবারেই সন্নিকটে। অতি উৎসাহী যেকোনো কর্মকাণ্ড আমাদেরকে এরাতের রহমত ও মাগফিরাতের মহা নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করে দিতে পারে। আর কিছু আমলের ব্যাপারে আমরা খুব যত্নবান হলেও তা খুবই অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয়। হালুয়া-রুটি বিতরণ, আতশবাজি ও পটকাবাজির সাথে ইবাদতের কী সম্পর্ক? মৃতদের রূহ এ রাতে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি বেড়াতে আসে এ ধরনের অমূলক ধারণা পোষণ করা, বিশেষভাবে এই দিনে ঘর-বাড়িতে আলোকসজ্জা করা, মাজারে মাজারে মোমবাতি দিতে হুড়মুড় করার ফযীলতই বা কী? মসজিদে মসজিদে ওয়াজ মাহ্ফিলের ব্যবস্থা করে সম্মিলিত বা একাকী নামাযের জন্য আহ্বান করা, তথাকথিত বানোয়াট বিশেষ পদ্ধতির শবে বরাতের নামায তো একেবারেই পরিত্যাজ্য। এ ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন রসম-রেওয়াজ প্রচলিত। ঢাকায় না এলে আরও নব উদ্ভাবিত কিছু বিদআত ও কুসংস্কারের সাথে হয়তো আর একটু দেরিতে পরিচিত হতাম। ঢাকায় এসে দেখেছি, এরাত উপলক্ষে পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় রাস্তায় পাউরুটি বা কেক দিয়ে তৈরি বিশাল বিশাল কৃত্রিম মাছ ও কুমিরসহ বিভিন্ন প্রজাতির জীব-জানোয়ারের পসরা দিয়ে গড়ে ওঠে বিভিন্ন দোকানের সমাহার। প্রত্যেক দোকানের সামনে লেগে থাকে ক্রেতাদের ভিড়। আবার সারা রাত রিক্সা ও ঠেলাগাড়িতে চড়ে তরুণ বয়সের পাঁচ-দশ জন মিলে নিজেরা ড্রাইভিং করে শহরময় অলিতে-গলিতে ঘুরে আনন্দ উল্লাসের দৃশ্যটাও ঢাকায় এসে প্রথম দেখলাম। খুব উৎসুক হয়েও এসবের কোনো উৎস খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছি। সবচেয়ে মারাত্মক যে বিশ্বাসটি এখনও অনেক মানুষ পোষণ করে থাকেন তা হল, এই রাতকে শবে কদরের চেয়েও বেশি মহিমান্বিত মনে করা এবং শবে কদরের ফযীলতগুলোকে এই রাতের সাথে সংযুক্ত মনে করা। আবার সেই আমরাই রমযানের শেষ দশকে হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ রাতের তালাশ না করে ঈদ-বাজার নামক ক্রমবর্ধমান বেপর্দেগীর সংস্কৃতিতে ডুবে থাকি। এ অজ্ঞতা বড়ই অন্যায় এবং শরীয়ত নির্ধারিত সীমার চরম লঙ্ঘন।
এসব রসম-রেওয়াজ, বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি ও অজ্ঞতা-বিদআত থেকে মুক্তি পেতে চলুন আমরা ছুটে যাই নববী নির্দেশনার পানে। হাদীসের আলোকেই নির্ধারণ করি শাবান ও শবে বরাত আমাদের কী করণীয় আর কী বর্জনীয়। আর এ উদ্দেশ্যেই আমরা শাবান ও শবে বরাত সম্পর্কিত সহীহ, হাসান, নির্ভরযোগ্য ও অন্তত ফাযায়েলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হাদীসগুলো সংক্ষিপ্তকারে উল্লেখ করছি।
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় পুরো শাবান মাসই রোযা রাখতেন। রমযানের পর এই একটি মাসেই তিনি সবচেয়ে বেশি রোযা রাখতেন। এর কারণ প্রথমত রমযান ও রজব মধ্যবতীর্ এ মাসটিকে মানুষ হেলায় নষ্ট করে ফেলে। তাই রমযানের প্রস্তুতি স্বরূপ নবীজী এ মাসে বেশি বেশি রোযা রাখতেন। দ্বিতীয় এ মাসে পুরো বছর মৃত্যুবরণকারী সব মানুষের মৃত্যুর কথা লিপিবদ্ধ করা হয়। নবীজী চাইতেন, তাঁর মৃত্যুর কথা এমন সময় লেখা হোক যখন তিনি রোযাদার। -বুখারী, হাদীস ১৯৬৯-১৯৭০; ফাতহুল বারী ৪/২৫১-২৫৩; আবু ইয়ালা, হাদীস ৪৮৯০; আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১১৭
আবার অন্যান্য কিছু হাদীসে শাবানের শেষ ক’দিন বিশেষত ২৮ থেকে ৩০ শে শাবান রোযা রাখতে নবীজী নিষেধ করতেন। কারণ এতে রমযানের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। —বুখারী, হাদীস ১৯১৪; ফাতহুল বারী ৪/১৫২-১৫৪
এ বিষয়ে হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) মাখলুকের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৬৬৫
قال الهيثمى في مجمع الزوائد : رجاله ثقات
وقال الزرقاني في شرح المواهب : فإن ابن حبان قد صححه وكفى به عمادا،
এমনিভাবে বাযযার (হাদীস ২০৪৮) এ হযরত আওফ ইবনে মালেক হতে, ইবনে খুযাইমা ‘কিতাবুত তাওহীদ’ এ (এর পৃষ্ঠা ১৩৬) যা তাঁর ‘সহীহ’ কিতাবেরই একটি অংশ হযরত আবু বকর রা. হতে এবং ইবনে মাজায় (হাদীস ১৩৯০) হযরত আবু মুসা রাযি. হতে প্রায় একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
اما حديث عوف بن مالك والصحيح فيه الإرسال فقال عنه البيهقى في شعب الإيمان : وهذا مرسل جيدا
وحديث أبى بكر فقد صححه ابن خزيمة و حسنه، البزار
وحديث ابى موسى قال عنه البوصري في مصباح الزجاجة إسناده ضعيف
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বর্ণিত একটি হাদীসের শেষাংশে এসেছে যে, আল্লাহ এ রাতে বিদ্বেষ পোষণকারী ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারী ছাড়া সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। -মুসনাদে আহমদ ৪/১৭৬
হযরত উসমান ইবনুল আস হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, এরাতে আল্লাহ মুশরিক ও ব্যভিচারিনী মহিলা ব্যতীত সকলেরই চাওয়া পূরণ করে থাকেন। —শুআবুল ঈমান৩/৩৮৩
লালকায়ীর ‘কিতাবুস সুন্নাহ’, আর ‘শুয়াবুল ঈমান’ ৩/৩৮২ -এ হযরত আবু সালাবা রা. হতে বর্ণিত হাদীসে আছে, যখন অর্ধ শাবানের রাত্রি আসে তখন আল্লাহ মাখলুকের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। অতঃপর মুমিনকে ক্ষমা করে দেন, কাফেরদেরকে (ফিরে আসার) সুযোগ দেন। এবং হিংসুকদেরকে হিংসা পরিত্যাগ ব্যতীত ক্ষমা করেন না।
قال البيهقي : وهو بين مكحول و أبى ثعلبة مرسل جيد
হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা! তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক্ব নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান, এটা কোন্ রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন।
নবীজী তখন ইরশাদ করেলেন, এটা হল অর্ধ শাবানের রাত। আল্লাহ তাআলা এ রাতে তার বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন। ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। -শুআবুল ঈমান ৩/৩৮২
قال البيهقى : هذا مرسل جيد
হযরত আয়েশা রা. হতে তিরমিযীসহ অন্যান্য কিতাবে ভিন্ন সূত্রের বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, নবীজী এ রাতে জান্নাতুল বাকীতে এসে মৃতদের জন্য দু’আ ও ইস্তিগফার করেছেন। এরপর আয়েশা রা.কে বলেছিলেন, এ রাতে আল্লাহ কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়েও বেশি গুনাহ ক্ষমা করে দেন। -তিরমিযী, হাদীস ৭৩৯
قال الراقم : وفيه انقطاع بين حجاج و يحي بن كثير كما قال ابن معين.
একটি ‘জয়ীফ’ সনদে হযরত আলী রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, চৌদ্দ শাবানের দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা এরাতে সূর্যাস্তের পর হতে আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিকপ্রার্থী? আমি তাদের রিযিক দেব। আছে কি কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি? তাকে আমি উদ্ধার করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা বলে বলে তাদের আহ্বান করতে থাকেন। -ইবনে মাজা ১৩৮৪
এ হাদীসটির সনদ যদিও দুর্বল তদুপরি হাফেজ ইবনে রজব রহ. বলেছেন যে, এ দিনে রোযা রাখা নিষেধ নয়, কারণ এতো আইয়ামে বীয অর্থাৎ প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের মুস্তাহাব রোযারই অন্তভুর্ক্ত। -লাতায়িফুল মাআরিফ ১৫১
তাছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি রোযা রাখার ব্যাপারে সহীহ হাদীস তো আমরা কিছু পূর্বেই জেনে এসেছি।
উপরোক্ত হাদীসগুলি দ্বারা যা বুঝা যায় তার সারসংক্ষেপ হল, এ রাতে আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকা, একনিষ্ঠ মনে কৃত পাপাচারের জন্য ইস্তিগফার ও তাওবা করাই প্রত্যেক মু’মিনের কর্তব্য। মুসলমান মাত্রই ওই সকল গুনাহ থেকে বেচেঁ থাকা উচিত যা এই মহান রাতের ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ ও দু’আ কবুলের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করে বলে হাদীসে এসেছে। শিরক, হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায় হত্যাকাণ্ড ও ব্যভিচারের মতো আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত পাপাচার এর অন্যতম। -ইবনে রজব, লাতায়িফুল মাআরিফ ১৫৪-১৫৫
এ ছাড়াও উপরোক্ত হাদীস দ্বারা আরও প্রমাণিত হল রাতে দীর্ঘ ক্বেরাত ও সিজদা ইত্যাদি দ্বারা বেশি বেশি নফল নামায পড়া, মৃতদের কবর যিয়ারত করা ও সম্ভব হলে এর পরদিন রোযা রাখা এ সময়ের মাসনুন আমল। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এ রাতে গর্হিত ও অহেতুক সব কর্মকাণ্ড বর্জন করে হাদীসে বর্ণিত এসব আমল দ্বারা একটি সু্ন্দর ইসলামী জিন্দেগী গঠনের তাওফীক দান করুন।