রাব্বুল আলামীনের গুণ-পরিচয়
ইলাহী সিফাত সম্পর্কে ইলম ও ঈমানের বিভিন্ন স্তর
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মহামহিম আল্লাহ তাআলার পরিচয় ও মারিফত কেবল তাঁর গুণ ও কর্মের পরিচয় লাভের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই তাঁর গুণ ও কর্মের পরিচয় অর্জন করা প্রত্যেক বিবেকসম্পন্ন মানুষের উপরই ফরয। কিন্তু তাঁর সিফাত ও গুণাবলি সম্পর্কে সবার জ্ঞান স্বভাবতই সমান হবে না এবং তা সম্ভবও নয়। কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে মহান আল্লাহর যত নাম ও গুণ বর্ণিত হয়েছে তার সংখ্যাও অনেক। সেগুলো সব জানা সবার পক্ষে সহজ নয়, তাই তাঁর যত নাম ও গুণ বর্ণিত হয়েছে প্রত্যেকটি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা সবার উপর ফরয নয়।
তবে ইলাহী সিফাতের মধ্যে এমন মৌলিক কিছু সিফাত রয়েছে, যা সবার জন্য জানা জরুরি। আর অন্যসব সিফাতের প্রতি এজমালীভাবে ঈমান রাখা যথেষ্ঠ। অর্থাৎ এজমালীভাবে এই আকীদা রাখা যে, আল্লাহ তাআলা সকল উত্তম ও উৎকৃষ্ট গুণে গুণান্বিত এবং সকল দোষ-ত্রুটি হতে চিরপবিত্র।
তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, আল্লাহ তাআলার গুণ ও কর্ম এবং তাঁর গুণবাচক নামসমূহ বিস্তারিতভাবে যত জানা যায় ততই ভালো। কারণ নাম ও গুণাবলিই হল আল্লাহ তাআলার মারিফাত ও পরিচয় লাভের একমাত্র উপায় এবং তাঁকে ডাকার, তাঁর কাছে প্রার্থনা করার, তাঁর হামদ ও ছানা অর্থাৎ গুণগান করার, তাঁর শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায়ের, তাঁকে স্মরণ করার এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এসব উদ্দেশ্যেই তো মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর সিফাত ও গুণাবলির এবং তাঁর ‘আলআসমাউল হুসনা’ তথা গুণবাচক নামসমূহের জ্ঞান নাযিল করেছেন।
ইতিপূর্বে আমরা কুরআন কারীমের একটি আয়াত উল্লেখ করেছিলাম তা এখানে অবারও উল্লেখ করছি—
وَ لِلهِ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰي فَادْعُوْهُ بِهَا وَ ذَرُوا الَّذِيْنَ يُلْحِدُوْنَ فِيْۤ اَسْمَآىِٕهٖ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ.
সুন্দরতম নামসমূহ আল্লাহরই। সুতরাং তাঁকে সেইসব নামেই ডাক। যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বক্রপথ অবলম্বন করে, তাদেরকে বর্জন কর। তারা যা-কিছু করছে, তাদেরকে তার বদলা দেওয়া হবে। —সূরা আরাফ (৭) : ১৮০
লক্ষ করুন, উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলাকে গুণবাচক সুন্দরতম নামসমূহ দ্বারা ডাকতে আদেশ করা হয়েছে এবং তাঁর নামসমূহে ‘ইলহাদ’ ও বক্রপথ অবলম্বনকে বর্জন করতে বলা হয়েছে। সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না, এর জন্য আল্লাহ তাআলার গুণাবলি সম্পর্কে সহীহ জ্ঞান অর্জন করা কতটা জরুরি।
কুরআন মাজীদের অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরত ও গুণাবলির নিদর্শনাবলি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন—
اِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمٰٓؤُا اِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ غَفُوْرٌ.
নিশ্চয়ই আল্লাহকে তো তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে কেবল তারাই ভয় করে, যারা জ্ঞানের অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি ক্ষমাশীল। —সূরা ফাতির (৩৫) : ২৮
উল্লেখ্য, উপরোক্ত আয়াতে ‘আলউলামা’ অর্থাৎ ‘যারা জ্ঞানের অধিকারী’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্ব এবং তাঁর গুণাবলি সম্পর্কে যাদের জ্ঞান ও উপলব্ধি রয়েছে। কারণ উপরোক্ত কথাটি বলা হয়েছে মূলত আল্লাহ তাআলার কুদরত এবং তাঁর একত্ব ও মহত্বের নিদর্শনাবলি বর্ণনা প্রসঙ্গে। এরপর শেষে বলা হয়েছে— ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি ক্ষমাশীল।’ তার মানে, যাদের এই বিশ্বাস ও উপলব্ধি রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা সর্বশক্তিমান ও পরাক্রমশালী, কল্যাণ ও অকল্যাণ সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে, তিনি যা ইচ্ছা করতে সক্ষম, যেকোনো অপরাধের জন্য তিনি শাস্তি দিতে পারেন এবং তিনি ক্ষমাশীলও বটে, ফলে ইচ্ছা করলে কারো অপরাধকে ক্ষমাও করতে পারেন। এই বিশ্বাস ও উপলব্ধি যাদের রয়েছে, তারা অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করে চলবে।
তাই তো উপরোক্ত আয়াতের ‘আলউলামা’ শব্দের ব্যাখ্যায় সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে—
الذين يعلمون أن الله على كل شيء قدير.
অর্থাৎ যাদের এই জ্ঞান ও উপলব্ধি রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। (দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর ৬/৫৪৪)
সারকথা, আল্লাহ তাআলার আযমত ও বড়ত্ব এবং তাঁর গুণাবলি সম্পর্কে যে যত বেশি জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করবে আল্লাহ সম্পর্কে তার মারিফাত ও পরিচয় ততো সমৃদ্ধ হবে, আল্লাহ তাআলার প্রতি তার তাকওয়া ও ভয়-ভীতি, মহব্বত ও ভালবাসা, আশা ও প্রত্যাশা ততো বেশি হবে এবং সে ততো বেশি আল্লাহর হামদ ও ছানা, প্রশংসা ও গুণগান করতে সক্ষম হবে।
আসলে আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে এবং তাঁর বিধানাবলি সম্পর্কে জ্ঞান ও উপলব্ধির বিভিন্ন স্তর ও পর্যায় রয়েছে। এই জ্ঞান ও ঈমানের স্তর অনুসারে আল্লাহর বান্দাদেরও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। ফলে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান ও উপলব্ধি যার মধ্যে যে পরিমাণ আল্লাহ তাআলার প্রতি তার ভয় ও ভালবাসা এবং ইতাআত ও আনুগত্যও সেই পরিমাণ। এখানে আমরা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে ইলম ও ঈমানের মৌলিক চারটি স্তর নিয়ে আলোচনা করব :
প্রথম স্তর
আল্লাহর পরিচয় লাভের প্রথম স্তর হল, সেই সাধারণ পরিচয়, যা কোনো ব্যক্তি নিছক বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে অর্জন করে; কিন্তু এ বিষয়ে তার কাছে ইলমে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত কোনো জ্ঞান নেই। কারণ সে নবী ও রাসূলকে এবং তাঁদের উপর অবতীর্ণ কিতাব ও সুন্নাহ্য় বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ সে বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা কেবল এতটুকু বিশ্বাস অর্জন করেছে যে, এই সমগ্র বিশ্বজগতের একজন মহান সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন।
যেমন দেখা যায়, অনেক দার্শনিক বা প্রকৃতিবিজ্ঞানী সৃষ্টির আদি কারণরূপে একজন মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন; কিন্তু তারা সৃষ্টিকর্তার রুবুবিয়্যাত তথা প্রতিপালকত্ব ও কতৃর্ত্বের প্রতি, তাঁর ইলাহিয়্যাত ও উপাস্যত্বের প্রতি, তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলগণের প্রতি এবং তাঁর অবতীর্ণ দ্বীন ও শরীয়তের প্রতি ঈমান রাখে না। এমনিভাবে মুশরিক জাতি ও বাতিল ধর্মাবলম্বীগণ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও মহত্ত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখে, কিন্তু তাঁর সিফাত ও রুবুবিয়্যাত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে বিভিন্ন প্রকার শিরকী ও কুফরী বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে। তারা সৃষ্টিকর্তার অসংখ্য গুণাবলির মধ্য থেকে কেবল কুদরত ও ক্ষমতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং ইচ্ছাময়তা ইত্যাদির ব্যাপারে ঝাপসা ও অস্পষ্ট ধারণা রাখে। কিন্তু তারা আল্লাহ তাআলার ঐসব গুণাবলি সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না, যার দ্বারা আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভয়, ভক্তি ও ভালবাসা তৈরি হবে এবং যার দ্বারা তারা আল্লাহর সঙ্গে শিরকী ও কুফরী অচরণ থেকে বাঁচবে এবং তাঁর নাফরমানী করাকে ভয় পাবে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
وَ مَا يُؤْمِنُ اَكْثَرُهُمْ بِاللهِ اِلَّا وَ هُمْ مُّشْرِكُوْنَ.
তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই এমন যে, তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখলেও তা এভাবে যে, তাঁর সঙ্গে শরীক করে। —সূরা ইউসুফ (১২ ) : ১০৬
তো আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে এ ধরনের অসম্পূর্ণ জ্ঞান এবং শিরক ও কুফর-মিশ্রিত ঈমান আখেরাতে মুক্তির জন্য মোটেও যথেষ্ঠ নয়। বরং এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার প্রেরিত নবী ও রাসূলের শিক্ষাকে এবং তাঁদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাব ও শরীয়তকে গ্রহণ না করার কারণে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহ তাআলাকে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও তারা চিরজাহান্নামী হবে।
দ্বিতীয় স্তর
আল্লাহ সম্পর্কে ঐসকল সাধারণ মুমিনদের ইলম ও ঈমান, যারা কোনো প্রকার দলীল-প্রমাণ না জেনে শুধু পূর্বপুরুষদের অনুকরণে কিংবা অন্যান্য মুমিনদের অনুকরণে আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাত ও ইলাহিয়্যাতের প্রতি এবং তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনে। এব্যাপারে যাদের পুঁজি কেবল সহজাত সমঝ-বুঝ এবং সাধারণভাবে সুপ্রসিদ্ধ ও সুবিদিত আকীদা-বিশ্বাস। ইলাহী সিফাত সম্বন্ধে যাদের জ্ঞান বিস্তারিত নয় এবং দলীল-প্রমাণভিত্তিক নয়।
ইলাহী সিফাতের ব্যাপারে সৃষ্টিজাগতিক যেসব প্রমাণ ও নিদর্শনাবলি রয়েছে এবং কুরআন ও সুন্নাহ্য় যেসব দলীল-প্রমাণ বর্ণিত হয়েছে সেসব সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই।
অর্থাৎ তাওহীদের আকীদার প্রতি, নবুওত ও রিসালাতের প্রতি এবং কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি যাদের এজমালী ঈমান রয়েছে, কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ অধ্যয়ন না করার কারণে এসম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান তাদের কাছে নেই। তাদের ইলম ও ঈমান মূলত মুজমাল ও সংক্ষিপ্ত। বিস্তারিত দলীল-প্রমাণ জানা ছাড়া, শুধু অন্য মুমিনদের অনুকরণে ঈমান গ্রহণ করাও মুমিন গণ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট, যদি সেই ঈমান সবধরনের সন্দেহ ও সংশয় থেকে মুক্ত হয় এবং দৃঢ় ও অবিচল বিশ্বাস হয়।
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার তাওহীদের প্রতি এবং খাতামুন নাবিয়্যীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত ও রিসালাতের সত্যতার প্রতি এজমালী ঈমানও চিরস্থায়ী জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য এবং মুমিন গণ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ, যদি এজমালী ঈমানের বিপরীতে কোনো কুফরী আকীদা পোষণ না করে, কিংবা কোনো কুফরী কাজ না করে। তবে বলার অপেক্ষ রাখে না, এ ধরনের এজমালী ঈমান এবং অনুকরণভিত্তিক ঈমান হল ঈমানের ন্যূনতম স্তর। এ ধরনের এজমালী ঈমানওয়ালাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় ও ভালবাসা এবং তাঁর বন্দেগী ও আনুগত্য কামিল মুমিনদের চেয়ে কম থাকে।
তৃতীয় স্তর
আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে এবং তাঁর বিধানাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানের অধিকারী মুমিনদের ইলম ও ঈমান। ইলাহী সিফাত সম্বন্ধে যাদের কাছে বিস্তারিত ও প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান রয়েছে। এব্যাপারে সৃষ্টিজাগতিক নিদর্শনাবলি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণাদি সম্পর্কে যেমন তাদের বিস্তারিত জ্ঞান রয়েছে তেমনি এ ব্যাপারে ইলমে ওহীর বিস্তারিত জ্ঞানও তাদের কাছে রয়েছে। ইলাহী সিফাতসমূহের অনিবার্য দাবিগুলো সম্পর্কেও তারা বিশদভাবে অবগত এবং সেসব দাবি পূরণেও তারা সচেষ্ট। ইলাহী সিফাত সম্পর্কে যেমন তাদের বিস্তারিত জ্ঞান রয়েছে, তেমনি ইলাহী আহকাম ও বিধিনিষেধ সম্পর্কেও বিস্তারিত জ্ঞান রয়েছে। ফলে তাদের মাঝে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি বেশি থাকে এবং তারা আল্লাহ তাআলার বিধিবিধান পালনে বেশি সচেষ্ট হন। এধরনের ইলমধারীদের ব্যাপারে কুরআন মাজীদের এই বাণী অধিক প্রযোজ্য—
اِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمٰٓؤُا.
নিশ্চয়ই আল্লাহকে তো তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে কেবল তারাই ভয় করে, যারা জ্ঞানের অধিকারী। —সূরা ফাতির (৩৫) : ২৮
চতুর্থ স্তর
আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে এবং তাঁর বিধানাবলি সম্পর্কে নবী ও রাসূলগণের ইলম ও ঈমান। বস্তুত নবী ও রাসূলগণের ইলম ও ঈমানই সবচেয়ে পূর্ণ ও সমৃদ্ধ। ফলে আল্লাহ তাআলার প্রতি তাঁদের ভক্তি ও ভালবাসা এবং তাকওয়া ও ভয়-ভীতি সবচেয়ে বেশি। আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীতে, তাঁর যিকির ও শোকরগুযারিতে এবং তাঁর ইতাআত ও আনুগত্যে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি অগ্রসর। কেননা নবুওতপ্রাপ্তির আগে ও পরে সর্ব অবস্থায় তাদের কলব ও হৃদয় এবং আখলাক ও চরিত্র থাকে নিষ্কলুষ ও পূত-পবিত্র। তাঁরা একদিকে যেমন সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি এবং গভীর ও সূক্ষ্ম চিন্তার অধিকারী, তেমনি তারা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে লাভ করেন ইলমে ইয়াকীন। ফলে আল্লাহ সম্পর্কে তাঁদের ইলম ও ঈমান সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং সর্বাধিক ইয়াকিনী ও প্রত্যয়দীপ্ত। আল্লাহ তাআলার প্রতি তাঁরা সর্বাধিক সমর্পিত ও নিবেদিত। বনু আদমের সরদার, খাতামুন নাবিয়্যীন মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মহান সাহাবীগণ, যাদের ঈমান নবী ও রাসূলগণের পর সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ, তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেন—
إِنَّ أَتْقَاكُمْ وَأَعْلَمَكُمْ بِاللهِ أَنَا.
নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি তাকওয়ার অধিকারী এবং আল্লাহ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানের অধিকারী হলাম আমি। —সহীহ বুখারী, হাদীস ২০
ঈমানে মুজমাল ও ঈমানে মুফাসসালের পরিচয়
‘মুজমাল’ মানে সংক্ষিপ্ত আর ‘মুফাসসাল’ মানে বিস্তারিত। দ্বীনুল ইসলামের পরিভাষায় ঈমানের সারকথা হল, আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে দ্বীনের যত আকীদা-বিশ্বাস, আহকাম ও বিধিবিধান পৌঁছিয়েছেন এবং ইহজগৎ ও পরজগৎ সংক্রান্ত, ঊর্ধ্বজগৎ ও নিম্নজগৎ সংক্রান্ত যত বার্তা ও সংবাদ দিয়েছেন তা কেবল তাঁর উপর আস্থার ভিত্তিতে সত্য বলে মানা এবং তাঁর প্রতি অনুগত থাকার অঙ্গিকার ব্যক্ত করা। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, দ্বীনী আকায়েদ ও আহকামের ফিরিস্তি অনেক বিস্তৃত এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখবার ও সত্যসংবাদের সংখ্যাও প্রচুর। ফলে বিস্তারিতভাবে সবকিছু সবার পক্ষে জানা সম্ভব নয়, সহজও নয়, প্রয়োজনও নেই, ফলে সবকিছু সবার জানা জরুরি নয় এবং আল্লাহ তাআলা তা ফরযও করেননি। কারণ আল্লাহ তাআলা কোনো বান্দার প্রতি তার সাধ্যাতীত কোনো বিষয় আরোপ করেন না—
لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا.
তাই সবকিছু সবার জন্য জানা ফরয নয়। তবে কারো মুমিন হওয়ার জন্য জরুরি হল, মহান আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব স্বীকার করার পর তাঁর পরিপূর্ণ একত্বে বিশ্বাস করা; একমাত্র তাঁকেই সত্য ‘রব’ ও মাবুদ বলে মানা, রুবুবিয়্যত ও উলূহিয়াতের বিষয়ে তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা। এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি কথা ও সংবাদকে সত্য বলে বিশ্বাস করে আনুগত্য করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা। একে বলা হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এজমালী ঈমান বা ঈমানে মুজমাল।
আর একথা সর্বস্বীকৃত যে, কারো মুমিন ও মুসলিম হওয়ার জন্য এবং আখেরাতে নাজাতের জন্য এই মুজমাল ঈমানটুকুও যথেষ্ঠ। এই এজমালী ঈমানের স্বীকারোক্তিই একজন মুমিন বান্দা কালিামায়ে তায়্যিবাহ—
لَا إلهَ إلاَّ اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُولُ الله.
—এর মাধ্যমে কিংবা কালিামায়ে শাহাদাত—
أَشْهَدُ أَن لّا إلَهَ إلاَّ اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ.
—এর মাধ্যমে ব্যক্ত করে থাকে।
তাই কেউ যদি ইসলামের এই কালিমার মর্মের প্রতি ইখলাসের সাথে ঈমান আনে, কিন্তু এরপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ না পায়; কালিমার স্বীকারোক্তির পরই কারো মৃত্যু হয়ে যায়, তবে সে আল্লাহর কাছে মুমিন বলেই গণ্য হবে। এমনকি কেউ যদি সারা জীবন এই এজমালী ঈমানের উপরই থাকে, তবুও সে মুমিন বলেই গণ্য হবে, যদি না সে আল্লাহ তাআলার কোনো কথা কিংবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কথা জানার পর অস্বীকার করে।
তার মানে দ্বীনের সব আকীদা ও বিধান সবার জন্য জানা ফরযে আইন নয়, কিন্তু দ্বীনের প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত কোনো একটি বিষয়কে অস্বীকার করা বা অবিশ্বাস করা কুফর।
তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দ্বীন সম্পর্কে জানার যথেষ্ঠ সুযোগ লাভের পর প্রত্যেক মুমিনের জন্য দ্বীনের কিছু মৌলিক আকীদা ও মৌলিক বিধান সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা ফরযে আইন। এ ধরনের বিষয়াবলির ইলমকে বলা হয় ফরযে আইন ইলম, জরুরিয়্যাতে দ্বীন ও উসূলুদ-দ্বীনের ইলম। এছাড়া প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলির শরয়ী বিধিবিধান জানাও ফরয।
দ্বীনের এমন অনেক মৌলিক আকীদা রয়েছে এবং ফরয বিধান রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে অজ্ঞানতা অর্থাৎ সময় ও সুযোগ লাভের পরও সেসব সম্পর্কে না জানাও বহুত বড় অপরাধ। এধরনের মৌলিক বিষয়াবলিকে আরকানে দ্বীন, ফারায়েযে দ্বীন, উসূলে দ্বীন এবং জরুরিয়্যাতে দ্বীন নামে অভিহিত করা হয়। আকাঈদের মধ্যে এধরনের মৌলিক বিষয় ছয়টি—
১. আল্লাহর তাওহীদের প্রতি ঈমান।
২. আল্লাহর রাসূলগণের প্রতি ঈমান।
৩. আল্লাহর কিতাব ও গ্রন্থসমূহের প্রতি ঈমান।
৪. ফিরিশতাদের প্রতি ঈমান।
৫. আখেরাত ও পুনরুত্থানের উপর ঈমান।
৬. তাকদীরের উপর ঈমান।
এই ছয়টি বিষয়ের কথা কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এবং হাদীসে জিবরীল নামে বিখ্যাত হাদীসটিতে ঈমানের পরিচয়ে এই সাতটি বিষয়ের কথা একসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। এ আকীদাগুলো জরুরিয়্যাতে দ্বীনের প্রথম সারির অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ এগুলো দ্বীনুল ইসলামের আকীদা হওয়া অকাট্য ও সর্বজনবিদিত। এ বিষয়গুলোকে ‘আরকানুল ঈমান’, ‘উসূলুল ঈমান’ অর্থাৎ ঈমানী আকীদার মূল ভিত্তি ও স্তম্ভ বলা হয়।
আল্লাহ সম্পর্কে মৌলিক পাঁচ প্রকার আকীদা
ঈমানের বিষয়াবলির মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান হল, আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে ঈমান ও আকীদা। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন—
الإيمان بضع وستون شعبة، فأفضلها قول لا إله إلا الله.
ঈমানের ষাটোর্ধ্ব শাখা রয়েছে; তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা। —সহীহ বুখারী, হাদীস ৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৫; ফাতহুল বারী ১/৫১-৫২
এখন প্রশ্ন হল, আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে কী কী আকীদা ও বিশ্বাস রাখা জরুরি। তো আল্লাহ তাআলার কালাম কুরআন মাজীদে ও তাঁর রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ্য় আল্লাহ তাআলার যেসব সিফাত ও গুণ বর্ণিত হয়েছে এবং যেসব আকীদা ও বিশ্বাসের কথা বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে মৌলিক পাঁচ প্রকার আকীদা রাখা জরুরি।
তো আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে সেই মৌলিক পাঁচ প্রকার আকীদা এই—
১. আল্লাহ তাআলার নিত্য, চিরস্থায়ী ও অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব বিশ্বাস করা, যার দ্বারা নাস্তিকতা থেকে মুক্তি লাভ হবে।
২. আল্লাহ তাআলা সব দিক থেকে এক অদ্বিতীয়— একথা বিশ্বাস করা। অর্থাৎ তিনি নিজ সত্তা বা অস্তিত্বের দিক থেকেও এক, গুণ ও বৈশিষ্ট্যাবলির দিক থেকেও এক। ইলাহী কার্যাবলির দিক থেকেও এক এবং ইলাহিয়্যাত তথা ইবাদত লাভের অধিকারের ক্ষেত্রেও এক-অদ্বিতীয়।
এই আকীদার দ্বারা সব ধরনের শিরক থেকে মুক্তি লাভ হবে।
৩. মাখলূকের সমশ্রেণিতা ও সাদৃশ্য হতে তাঁর পবিত্রতা বিশ্বাস করা। এই বিশ্বাস দ্বারা ‘তাশবীহ’ ও সাদৃশ্যায়ন থেকে মুক্তি লাভ হবে।
৪. তিনি সৃষ্টিকর্তা ও অস্তিত্বদাতা, যিনি জগতের সবকিছুকে নিজ ইচ্ছা ও হুকুমে নাস্তি (অনস্তিত্ব) থেকে অস্তিত্বে এনেছেন— এই কথা বিশ্বাস করা। এই আকীদার দ্বারা জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে বস্তুবাদী ও কার্যকারণবাদী কুফরি মতবাদ থেকে মুক্তি লাভ হবে।
৫. যা কিছুকে তিনি অস্তিত্ব দান করেন এমন সবকিছুকে তিনি নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিপালন করেন, পরিচালনা করেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন— এই কথা বিশ্বাস করা। এই আকীদার দ্বারা জগৎ সম্পর্কে প্রকৃতিবাদী কুফরী মতবাদ থেকে এবং রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে শিরক থেকে মুক্তি লাভ হবে।
কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ তাআলার যত সিফাত এবং সিফাতী যত নাম বর্ণিত হয়েছে তা থেকে উপরোক্ত পাঁচ প্রকার আকীদাই প্রমাণীত হয়। আর তাই ইমাম আবু আব্দিল্লাহ হুসাইন হালীমী রাহ. (ওফাত : ৪০৩ হি.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আলমিনহাজ ফী শুয়াবিল ঈমান’-এ আল্লাহ তাআলা সংক্রান্তু আকীদাসমূহকে এবং কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত আল্লাহ তাআলার গুণাবলিকে উপরোক্ত পাঁচটি শিরোনামের অধীনে মৌলিক পাঁচ ভাগে আলোচনা করেছেন। তিনি আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে যে মৌলিক পাঁচ প্রকার আকীদার কথা বর্ণনা করেছেন তা প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম বায়হাকী রাহ. (ওফাত : ৪৫৮ হি.) এবং প্রসিদ্ধ মুফাসসির ইমাম কুরতুবী রাহ. (ওফাত : ৬৭১ হি.)-সহ আরো অনেকেই গ্রহণ করেছেন এবং ‘আলআসমা ওয়াস সিফাত’ বিষয়ক নিজ নিজ গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন।
তবে মনে রাখতে হবে, উপরোক্ত পাঁচ প্রকার আকীদা হল, আকীদার মৌলিক পাঁচটি বিষয় বা শিরোনাম, ফলে প্রত্যেকটি আকীদারই বিভিন্ন অংশ ও শাখা-প্রশাখা রয়েছে, যা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। এখানে আমরা কেবল পাঁচটি শিরোনাম উল্লেখ করেই ক্ষ্যন্ত করছি।
ঈমানের সর্বব্যাপী সুসংক্ষিপ্ত কালিমা
দ্বীনুল ইসলামে তাওহীদের সুসংক্ষিপ্ত ও ব্যাপক অর্থসমৃদ্ধ কালিমা হল—
لَا إلهَ إلاَّ اللهُ.
অর্থাৎ এক আল্লাহ ছাড়া ইবাদত ও বন্দেগী লাভের উপযুক্ত আর কেউ নেই বা কোনো কিছুই নেই। এই সংক্ষিপ্ত কালিমার মধ্যেই ইলাহ হওয়ার জন্য যত গুণ ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক এমন সব সিফাতের প্রতিই এজমালী স্বীকৃতি বিদ্যমান রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত কালিমাটির মধ্যেই আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্তা ও গুণাবলি সংক্রান্ত সকল মৌলিক আকীদাই অন্তভুর্ক্ত রয়েছে। উপরে উল্লিখিত পাঁচ প্রকার আকীদাই এই কালিমায়ে তাওহীদের মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে। উপরোক্ত পাঁচ প্রকার আকীদা কীভাবে কালিমায়ে তাওহীদের মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে তা ইমাম আবু আব্দিল্লাহ হুসাইন হালীমী রাহ. (ওফাত : ৪০৩ হি.) সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর সেই ব্যাখ্যা ও আলোচনা প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম বায়হাকী রাহ. তাঁর ‘শুয়াবুল ঈমান’ গ্রন্থে এবং ‘আলআসমা ওয়াস সিফাত’ গ্রন্থেও বর্ণনা করেছেন এবং সমর্থন করেছেন। এই কালিমার অর্থ ও মর্মের ব্যাপ্তি সম্পর্কে কিছু কথা আমরা সামনে ‘ইলাহ’ গুণের ব্যাখ্যায় আলোচনার প্রয়াস পাব ইনাশাআল্লাহ।
সুনির্দিষ্টভাবে যে সিফাতগুলো সম্বন্ধে সকলের জানা ফরয
আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি, আল্লাহ তাআলার সকল সিফাত ও গুণাবলির প্রতি এজমালীভাবে ঈমান থাকা জরুরি। অর্থাৎ এই বিশ্বাস থাকা যে, আল্লাহ তাআলা সকল উৎকৃষ্ট গুণের অধিকারী এবং সকল দোষ-ত্রুটি থেকে চিরপবিত্র। আর বিস্তারিতভাবে তাঁর প্রতিটি গুণ ও গুণবাচক প্রতিটি নাম সম্পর্কে জানা সকলের উপর ফরয নয়। তবে তাঁর মৌলিক কিছু সিফাত ও গুণ রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে জানা সকলের উপর ফরয। সেই মৌলিক সিফাতগুলি কী? সেই সিফাতগুলো হল আল্লাহ তাআলার একত্ব, তাঁর রুবুবিয়্যাত ও প্রতিপালকত্ব, ইলাহিয়্যাত ও উপাস্যত্ব এবং রুবুবিয়্যাত ও ইলাহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যসূচক গুণাবলি। অন্যভাবে বললে, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং ‘ইলাহ’ ও মাবূদ হওয়ার জন্য যেসব সিফাত থাকার আবশ্যকতা ও অপরিহার্যতা সাধারণ যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারাই বোধগম্য। অর্থাৎ যে সিফাতগুলো ছাড়া সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং ‘ইলাহ’ ও মাবূদ হওয়া কল্পনাই করা যায় না এবং যে সিফাতগুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষ শিরক ও কুফরের শিকার হয়, সেসব সিফাত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্য ফরয। এ ধরনের সব সিফাতই কুরআনে কারীমের ‘মুহকাম’ আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং এ ধরনের সিফাতগুলোর আবশ্যকতা বিবেক-বুদ্ধি দ্বারাও সহজে বোধগম্য। যার কারণে এই সিফাতগুলো পরিভাষায় ‘মুহকামাত’ তথা সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বিষয়াবলি এবং ‘জরুরিয়্যাতে দ্বীন’ তথা দ্বীনের সর্বজনবিদিত বিষয়াবলির অন্তর্ভুক্ত।
তো আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাত ও ইলাহিয়্যাতের পরিচয় জানার জন্য যেসব সিফাত সম্পর্কে সকলের জানা জরুরি সেসব সিফাত সম্পর্কে বিভিন্ন যুগের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ নিজ নিজ যুগের ভাষা ও চাহিদা অনুসারে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন এবং সেগুলোর একটা তালিকা পেশ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বিভিন্ন যুগের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আলেমের কয়েকটি কিতাবের শুধু উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি।
১. ইমাম আবু জাফর তবারী রাহ. (ওফাত : ৩১০ হি.)-এর ‘আততাবসীর ফী মায়ালিমিদ দ্বীন’, পৃ. ১২৬-১৩৩।
২. ইমাম ইবনু আব্দিল বার রাহ. (ওফাত : ৪৬৩ হি.)-এর ‘জামিয়ু বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি’ খ. ১, পৃ. ১০-১১।
৩. কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী রাহ. (ওফাত : ৫৪৩ হি.)-এর ‘আলআমাদুল আকসা’, খ. ১, পৃ. ২২৮।
৪. ইমাম ইবনুল হুমাম (ওফাত : ৮৬১ হি.)-এর ‘আলমুসায়ারা’ (‘আলমুসামারাহ’ ভাষ্যগ্রন্থসহ), পৃ. ২৯৭-২৯৮।
এছাড়াও প্রত্যেক যুগে ইসলামী আকীদা বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে রচিত কালামশাস্ত্রের গ্রন্থাবলিতে ঐসব সিফাত সম্পর্কেই বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যেগুলো রুবুবিয়্যাত ও ইলাহিয়্যাতের আকীদার মূল ভিত্তি এবং আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভের জন্য সকলের জানা জরুরি।
তো আমরা এখন ঐসব সিফাত ও গুণাবলির তালিকা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ উল্লেখ করব :
আল্লাহ তাআলা সবকিছুর ‘খালিক’ ও সৃষ্টিকর্তা
অর্থাৎ যিনি নিজ ইচ্ছা ও কুদরতে যে কোনো কিছুকে নাস্তি ও শূন্য থেকে অস্তিত্বে আনয়ন করেন। এ অর্থে সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা, তিনি ছাড়া আর কেউ কোনো কিছুকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনতে সক্ষম নয়। জগতে যা কিছু অস্তিত্ব লাভ করে সবকিছুই আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করার কারণেই অস্তিত্ব লাভ করে। আরশ-কুরসি, লওহ-কলম, ফিরিশতা, জ্বিন ও ইনসান, প্রাণীজগৎ, জড়জগৎ ও উদ্ভিদজগৎসহ জানা অজানা সমগ্রজগতের সবকিছু আল্লাহ তাআলারই সৃষ্টি। জগতে বস্তু ছাড়াও অবস্তুগত যত অবস্থা ও বিষয়াদি রয়েছে সবই তিনি সৃষ্টি করেন।
মোটকথা, যা কিছু আমরা দেখি এবং যা কিছু না দেখি, যা কিছু আমরা জানি এবং যা কিছু না জানি সবই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। প্রথম সৃষ্টি যেমন তাঁর পরবর্তী সৃষ্টিও তাঁরই। সৃষ্টি ও অস্তিত্বের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং ভবিষ্যতে যা কিছু অস্তিত্ব লাভ করবে সবকিছুই আল্লাহ তাআলারই সৃষ্টি। তিনি সৃষ্টি না করলে কোনো কিছুই অস্তিত্ব লাভ করে না। কোনো কিছুই দৈবক্রমে বা আপনা-আপনি কিংবা কেবল প্রাকৃতিক নিয়মেই সৃষ্টি হয় না; বরং সকল অস্তিত্বের পেছনেই মহান আল্লাহর গায়েবী কুদরত ও অদৃশ্য শক্তি কার্যকর।
জগতের সকল পদার্থ ও পদার্থের গুণ-বৈশিষ্ট্য, জগতের সকল শক্তি ও ক্ষমতা এবং আসবাব বা প্রাকৃতিক উপায়-উপকরণ সবকিছুই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। তদ্রƒপ পদার্থ ও উপকরণ দ্বারা যে ক্রিয়া ও ফলাফল প্রকাশ পায় তাও সরাসরি আল্লাহ তাআলারই সৃষ্টি। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার হুকুমেই এসব সক্রিয় হয়, আবার আল্লাহর হুকুমেই নিষ্ক্রিয়ও হয়ে যায়। এমনকি জগতের সকল ঘটনা এবং মাখলূকের সকল কর্মকাণ্ডও আল্লাহ তাআলার কুদরতে ও তাঁর হুকুমেই সৃষ্টি হয়। সুতরাং একমাত্র আল্লাহ তাআলাই খালিক ও সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি ছাড়া জগতে যা কিছু দৃশ্য ও অদৃশ্য রয়েছে সবই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি।
আল্লাহ তাআলা সবকিছুর প্রকৃত ‘রব’
‘রব’ মানে পালনকর্তা এবং মালিক ও প্রভু। অর্থাৎ যিনি সমগ্রজগতের সবকিছু লালন-পালন করেন, রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং সবকিছুর উপর যার পূর্ণ ক্ষমতা ও অধিকার রয়েছে।
মহান আল্লাহ যেমন জগতের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা তেমনি জগতের একমাত্র মালিক ও পালনকর্তা। তিনি বিশ্বজগৎকে যেমন অস্তিত্ব দান করেছেন তেমনি সৃষ্টিকুলের প্রত্যেকের স্থিতির জন্য নিজ নিজ উপযোগী ও প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ দান করেছেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টিকে তার বস্তুগত কাঠামো, শক্তি-সামর্থ্য ও বাহ্যিক উপায়-উপকরণ দ্বারা উপকৃত হওয়ার নিয়ম শিক্ষা দান করেছেন। শুধু উপায়-উপকরণ দান করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বা পরবর্তী দায়িত্ব ও ক্ষমতা অন্য কারো হাতে অর্পণ করেননি, বরং প্রতিনিয়ত তিনি সরাসরি প্রতিটি মাখলূককে এবং বিশেষত মানবজাতিকে তারবিয়াত ও প্রতিপালন করে চলেছেন। সুতরাং তিনিই হলেন ‘রব্বুন নাস’ মানুষের প্রতিপালক ও প্রকৃত মালিক। আর তাঁর প্রতিপালন শুধু প্রাণীজগতের সঙ্গেই বিশিষ্ট নয়, বরং জড়জগৎ ও উদ্ভিদজগৎসহ জানা অজানা সমগ্র সৃষ্টিজগৎকেই তিনি আপন রুবুবিয়্যাত দ্বারা বেষ্টন করে আছেন। সুতরাং তিনিই ‘রব্বুল আলামীন’ তথা সমগ্র জগতের প্রতিপালক ও প্রকৃত মালিক।
প্রকৃত মালিক হওয়ার কারণেই গোটা বিশ্ব জগৎ তাঁর অধীনস্ত, তাঁর আজ্ঞাবহ। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র তাঁর ফরমানের অধীন। নদী-সাগর, বন-বনানী তাঁর বিধানের অনুগত, সমগ্র সৃষ্টিজগতে তাঁরই সৃষ্টি বিধান কার্যকর। মোটকথা জগতে যা কিছু ঘটে আল্লাহর ইচ্ছা ও আদেশে ঘটে। জগতের ছেট-বড় সব কিছু তাঁর ইচ্ছানুযায়ী হয়।
মনে রাখতে হবে, মাখলূকের মাঝে আল্লাহ তাআলার বিধান ও ফয়সালা কয়েক প্রকারের :
এক. তাকবীনী বা সৃষ্টি বিধান, যাতে তাকদীর ও ভাগ্যের বিধানও শামিল রয়েছে।
দুই. হক ও না-হক, সত্য ও মিথ্যা এবং ন্যায় ও অন্যায় সম্পর্কে বিধান ও ফয়সালা।
তিন. শরয়ী আহকাম বা করণীয়-বর্জণীয় সংক্রান্ত বিধান।
চার. জাযাউল আমাল বা কর্মের প্রতিদান সংক্রান্ত বিধান।
সুতরাং মানুষের জীবন-মৃত্যু, রুজি-রোজগার, সুস্থতা-অসুস্থতা, সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য, হেদায়েত-গোমরাহী সবকিছুতে আল্লাহর ফয়সালাই কার্যকর। মানুষের সকল বিষয় আল্লাহ তাআলা কর্তৃত নির্ধারিত তাকদীর ও ভাগ্যের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
এমনিভাবে হক ও না-হক, সত্য ও মিথ্যা এবং ন্যায় ও অন্যায় সম্পর্কে ফয়সালা করার মালিক আল্লাহ তাআলা। সত্য ও মিথ্যা এবং ন্যায় ও অন্যায় সম্পর্কে তাঁর ফয়সালাই চূড়ান্ত। দুনিয়া ও আখেরাতে হক ও বাতিলের ফয়সালা তিনিই করেন। আর তাই তিনি বিভিন্ন যুগে কিতাব ও সহীফা নাযিল করেছেন। এভাবে সর্বশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য ‘আলফুরকান’-রূপে (হক ও বাতিলের চূড়ান্ত ফয়সালাকারীরূপে) সর্বশেষ আসমানীগ্রন্থ আলকুরআন নাযিল করেছেন।
সৃষ্টি বিধান ও তাকদীর বা ভাগ্যের বিধানদানের অধিকার ও ক্ষমতা যেমন আল্লাহ তাআলার, তেমনি করণীয় ও বর্জণীয় সংক্রান্ত বিধানদানের প্রকৃত অধিকার ও ক্ষমতা আল্লাহ তাআলারই। আর এ উদ্দেশ্যেই তিনি নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। কিতাব ও সহীফা নাযিল করেছেন এবং চেতনা-বিশ্বাস, রীতি-নীতি, কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে নীতি ও বিধান দান করেছেন।
সবোর্পরি ভালো ও মন্দ কর্মের প্রতিদানমূলক বিধানের মালিকও একমাত্র আল্লাহ। দুনিয়া ও আখেরাতে কার কী প্রাপ্য তা তিনিই ফয়সালা করেন। দুনিয়া ও আখেরাতে ভালো ও মন্দের প্রতিদানে তাঁর ফয়সালাই চূড়ান্ত। সুতরাং তিনিই مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ কর্মফল দিবসের মালিক ও অধিপতি।
বিধান ও ফয়সালা দানের প্রকৃত মালিক যেহেতু আল্লাহ তাআলা, তাই তিনিই হলেন ‘রব্বুল আরশিল আযীম’—মহান আরশের মালিক ও অধিপতি। তিনিই বিশ্বজগতের প্রকৃত বাদশাহ ও অধিপতি, জগতের সবকিছু একমাত্র তাঁর হুকুমেই চলে।
সারকথা, আল্লাহ তাআলা এই বিশ্বজগতের শুধু স্রষ্টাই নন, বরং তিনি বিশ্বজগতের যুগপৎ সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, নিয়ন্ত্রণকতার্, হাকীম ও বিধানদাতা, বিচারকর্তা এবং সর্বময় ক্ষমতা ও কতৃর্ত্বের মালিক ও অধিপতি; যিনি নিজ ইচ্ছানুযায়ী বিশ্বজগতের সকল ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেন, নিয়ন্ত্রণ করেন, করণীয় ও বর্জণীয় সংক্রান্ত বিধিবিধান জারি করেন এবং সবোর্পরি তিনি আখেরাতে সকলকে বিচারের সম্মুখীন করবেন এবং প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিদান দেবেন। এই ভাব ও মর্মই কুরআনে কারীমের একটি আয়াতে অত্যন্ত সুসংক্ষিপ্ত ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটি এই—
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ .
স্মরণ রেখ, সৃষ্টি ও আদেশদান তাঁরই কাজ। —সূরা আরাফ (০৭) : ৫৪
আমাদের প্রতি সিফাতে রুবুবিয়্যাতের দাবি
উপরের আলোচনা থেকে আমরা অবশ্যই বুঝতে পেরেছি যে, রব্ব গুণের দাবি হল, মানুষ নিজেকে এবং গোটা জগৎকে আল্লাহর বান্দা ও গোলাম বলে বিশ্বাস করবে।
আমাদেরকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও হুকুমেই রাত ও দিন হয়, মেঘ বৃষ্টি বর্ষণ করে, বৃক্ষ ফল দান করে, গাভী দুধ দেয়, তাঁর ইচ্ছা ও হুকুমেই মানুষ ও প্রাণী সন্তান জন্মদান করে, অষুধ আরোগ্য দান করে, ভূমি ফসল উৎপন্ন করে। এসবকিছু কেবল প্রাকৃতিক নিয়মে অপনা আপনি ঘটে না; বরং এসবের পেছনে মহাশক্তি ও মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী আল্লাহ তাআলার গায়েবী শক্তি কার্যকর, সবকিছু তাঁরই ইচ্ছা ও হুকুমের অধীন। মোটকথা জগতের সকল আসবাব ও উপকরণ এবং কার্যকারণ আল্লাহরই সৃষ্টি এবং তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন। এসবের দ্বারা যে ক্রিয়া ও ফলাফল প্রকাশ পায় তা তাঁরই ইচ্ছা ও আদেশে হয়।
ইয়াকীন রাখতে হবে, কাউকে কিছু দেয়া বা না দেয়া, তদ্রƒপ কারো কোনো উপকার বা ক্ষতি করা একমাত্র আল্লাহ তাআলার নিয়ন্ত্রণে। তিনিই প্রাণদানকারী, মৃত্যুদানকারী, রিযিকদানকারী, শেফা দানকারী এবং প্রকৃত কর্মবিধায়ক। তিনিই তার বান্দাদের সাহায্যকারী ও হেফাজতকারী; যিনি মাখলুককে সকল বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করেন। তিনিই শ্রেষ্ঠ উন্মোচনকারী; যিনি বান্দাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ অবারিত করেন, তাদের জন্যে রিযিক ও রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করেন, সকল জটিলতা ও সমস্যার জট তিনিই খোলেন। তিনিই বান্দার হৃদয় ও অন্তদৃর্ষ্টি উন্মুক্ত করেন, যাতে সে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হয়। তিনিই মাখলুককে আপদ-বিপদ থেকে নিরাপত্তা দানকারী এবং আমান ও নিরাপত্তার উপায়-উপকরণ সৃষ্টিকারী। তিনিই তাঁর বান্দাদের ভরসাস্থল। তিনিই তাঁর বান্দাদের প্রকৃত অভিভাবক ও বন্ধু এবং সর্ববিষয়ে তাঁর বান্দাদের জন্যে যথেষ্ট।
একমাত্র তাঁকেই সর্বোচ্চ বিধানদাতা ও শর্তহীন আনুগত্যের হকদার বলে বিশ্বাস করবে এবং একমাত্র তাঁর শরীয়তকে অনুসরণযোগ্য বলে মনে করবে। সর্বোপরি একমাত্র তাঁকেই বিচার দিনের মালিক বলে বিশ্বাস করবে।
মোটকথা, আল্লাহ তাআলার ‘রব্ব’ সিফাতটি অতি ব্যাপক ও গভীর অর্থব্যঞ্জক সিফাত। মাখলূকের অস্তিত্ব ও স্থিতি এবং তাদের লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের সাথে সংশ্লিষ্ট ইলাহী সকল গুণ ও কর্মকেই এই ‘রব’ সিফাতটি বুঝায়। তাই সৃষ্টি করা, রিযিক দান করা, জীবন দান করা, মৃত্যু দেওয়া, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করা, ধ্বংস করা এবং ধ্বংসের পর পুনরায় সৃষ্টি করা, বিপদ দেওয়া এবং বিপদ থেকে মুক্তি দান করা, রোগ দেওয়া এবং রোগ থেকে শেফা দান করা, মাখলূকের কৃতকর্মের বিচার করা, কৃতকর্মের প্রতিদান দেওয়া, পাপ মোচন করা ও অপরাধ ক্ষমা করা, আখেরাতের শস্তি থেকে নাজাত ও মুক্তি দান করা, হেদায়েত দান করা, শরীয়ত দান করা এবং হালাল-হারামের বিধান দান করা ইত্যাদি সব কর্মবাচক গুণ ও বৈশিষ্ট্যই এই ‘রব’ গুণের মধ্যে অন্তভুর্ক্ত রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা একমাত্র সত্য ‘ইলাহ’ ও মাবূদ
‘ইলাহ’ মানে উপাস্য সত্তা, অর্থাৎ যিনি ইবাদত ও উপাসনা লাভের হকদার ও উপযুক্ত।
তো আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে, ইবাদত কাকে বলে? ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ইবাদতের সংজ্ঞা কী?
‘ইবাদত’ দ্বীন ও শরীয়তের একটি বিশেষ পরিভাষা। বস্তুত ইবাদত হল আল্লাহ তাআলার হক ও অধিকার। আল্লাহ তাআলা খালিক ও রব হওয়ার অধিকারে নিজের বড়ত্ব ও মহত্ব প্রকাশের জন্য তাঁর বান্দাদের উপর চরম ভক্তিমূলক কিছু বিশেষ আমল ও কাজকে একান্তভাবে তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদন করাকে আবশ্যক করেছেন এবং অন্য কারো জন্য সেগুলো নিবেদন করাকে শিরক আখ্যা দিয়েছেন। তো আল্লাহ তাআলার প্রতি নিবেদিত সেসব ভক্তিমূলক বিশেষ আমলগুলোকেই মূলত শরীয়তের পরিভাষায় ইবাদত বলা হয়। যেমন, সালাত ও নামায, সওম ও রোযা, হজ্ব, সদকা, সিজদা, তাওয়াফ, নযর-মান্নত, কুরবানী, দুআ, যিকির, নাম জপ করা ইত্যাদি।
এখানে লক্ষণীয়, প্রতিটি ইবাদতের বিশ্বাসগত ভিত্তি হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাতের বিশ্বাস এবং এর লক্ষ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর মাধ্যমে কর্মগতভাবে আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাতের স্বীকৃতি প্রকাশ করা, তাঁর সামনে বান্দার অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব, মুহতাজি ও মুখাপেক্ষিতা এবং চরম হীনতা-দীনতা প্রকাশ করা, তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করা এবং তাঁর গযব ও অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচা, তাঁর অসীম করুণা, দান ও অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা নিবেদন করা, তাঁর প্রতি ভক্তি ও ভালবাসা নিবেদন করা এবং সর্বোপরি তাঁর কাছে সবধরনের হাজত ও প্রয়োজন এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্য প্রার্থনা করা।
এছাড়াও মনে রাখতে হবে, ‘ইস্তেআনাত’ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার কাছে কোনো বিষয়ে দুআ করা বা সাহায্য প্রার্থনা করা— ইবাদতের স্বতন্ত্র একটি প্রকার এবং অন্য যেকোনো ইবাদতের সঙ্গে এটি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ও সন্নিবিষ্ট। কারণ যে কোনো ইবাদতের মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহ তাআলার গায়েবী সাহায্য প্রার্থনা করে এবং তাঁর পক্ষ থেকে কল্যাণ লাভের আশা রাখে।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, আরবী ভাষায় ‘ইবাদত’ শব্দের আরেকটি আভিধানিক অর্থ, ফরমাবরদারি ও হুকুমের আনুগত্য করা। ইবাদতের এই আভিধানিক অর্থ এবং এর পারিভাষিক অর্থের মাঝে যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পার্থক্যটি হল, পারিভাষিক ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা সরাসরি শিরক এবং সবচেয়ে বড় শিরক। পক্ষান্তরে আনুগত্য ও ফরমাবরদারি মাখলূকেরও হতে পারে। বরং কিছু আনুগত্যের আদেশ তো স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই করেছেন। যেমন নবী-রাসূলগণের আনুগত্য, উলূল আমর (তথা দায়িত্বশীল ও ফকীহ মুজতাহিদগণের) আনুগত্য, পিতা-মাতার আনুগত্য, স্বামীর আনুগত্য ইত্যাদি।
তবে যদি কেউ আল্লাহ তাআলার আহকাম ও বিধানের বিপরীতে কারো জন্য বিধানদানের অধিকার স্বীকার করে কিংবা আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই কাউকে দ্বীন ও শরীয়তের বিধানদানের অধিকারী মনে করে, তবে তা শিরক হিসেবে গণ্য হবে। কারণ আল্লাহ তাআলা হলেন ‘আহকামুল হাকিমীন’—সর্বোচ্চ বিধানদাতা। তাই আল্লাহ তাআলার বিধানের বিপরীতে কারো বিধানদানের অধিকার স্বীকার করা মূলত ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলার ‘রব’ গুণের ক্ষেত্রে শরীক করার নামান্তর। কিন্তু আল্লাহ তাআলার অনুমতি সাপেক্ষে ও তাঁর হুকুমে অন্য কারো হুকুমের অনুগত্য করা শিরক নয়, বরং বাঞ্ছনীয় ও কর্তব্য।
এভাবে ইবাদতের বিশ্বাসগত ও হৃদয়বৃত্তীয় উপাদানসমূহের, এর বাহ্যিক রূপের এবং এর শরয়ী হুকুমের বিশ্লেষণ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, ইবাদত দ্বারা উদ্দেশ্য হল, মানুষের বিশেষ কিছু আমল ও কর্ম, যা কোনো সত্তাকে রব বলে বিশ্বাস করে কিংবা গায়েবী ক্ষমতার মালিক, গায়েবীভাবে হাজত পুরা করার এবং ইষ্ট-অনিষ্ট করার ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করে তাঁর সামনে নিজের অসহায়ত্ব ও মুখাপেক্ষিতা এবং হীনতা-দীনতা প্রকাশের জন্য এবং তাঁকে রাজি-খুশি করার উদ্দেশ্যে করা হয়। (দ্র. তা’বীলাতু আহলিস সুন্নাহ, ইমাম মাদতুরীদী, ৩/২২৬, ৩/২৭০, ৭/২৭, ১০/২২১; আলহুদুদ, ইবনুল ফূরাক, পৃ. ১২৩-১২৪; শরহুল আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, ইবনুল ফূরাক, পৃ. ২১৯-২২০; দ্বীন ও শরীয়ত, মানযূর নূমানী, পৃ. ৫৩)
ইবাদতের উপরোক্ত হাকীকত জানার পর আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহ তাআলা, তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদত ও উপাসনার যোগ্য নয়। কারণ বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো সত্তা তখনই উপাস্য বা ইবাদত লাভের হকদার হতে পারে, যখন তার মধ্যে ইবাদত ও উপাসনা লাভ করার মত গুণ ও সিফাত বিদ্যমান থাকবে। আর সাধারণ যুক্তি-বুদ্ধির দাবি এটাই যে, ইবাদত লাভের উপযুক্ত সত্তা কেবল তিনিই, যিনি প্রকৃত খালিক ও রব্ব এবং সকল উৎকৃষ্ট গুণের অধিকারী এবং সকল দোষ-ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থেকে চিরপবিত্র। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ‘ইলাহ’ ও মাবূদ হওয়ার জন্য খালিক ও রব্ব হওয়া এবং সকল পূর্ণতা ও উৎকৃষ্টগুণের অধিকারী হওয়া অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এভাবে ‘ইলাহ’ সিফাতটি সত্য মাবূদ হওয়ার জন্য আবশ্যক সকল ইলাহী গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ভাব ও মর্ম ধারণ করে।
তাওহীদের সুসংক্ষিপ্ত কালিমা— ‘লা—ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মধ্যে ‘ইলাহ’ গুণের উল্লেখ রয়েছে। এতে প্রথমে ‘লা—ইলাহা’ বলে ঘোষণা করা হয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাখলূকের মধ্যে ইবাদত লাভের কোনো গুণ ও সিফাত বিন্দু পরিমাণেও বিদ্যমান নেই। তারপর ‘ইল্লাল্লাহ’ বলে ঘোষণা করা হয় যে, মাবূদ হওয়ার বা ইবাদত লাভের সমস্ত সিফাত পরিপূর্ণভাবে রয়েছে একমাত্র মহামহিম আল্লাহ তাআলার।
এভাবে এই সংক্ষিপ্ত কালিমার প্রতি ঈমানের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ইলাহ ও মাবূদ হওয়ার ব্যাপারে যেমন ঈমানের প্রকাশ ঘটে তেমনি ইলাহী সমস্ত সিফাত ও গুণাবলির প্রতিও এজমালীভাবে ঈমানের প্রকাশ ঘটে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)