Jumadal Akhirah 1428   ||   July 2007

জীবিকা
টাকার তোষক, টাকার বালিশ
টাকাই কি তবে ঠিকানা?

Abu Tashrif

দৃশ্য ও খবর পড়ে চমকে উঠেছিল অনেকেই। একজন মানুষ তার ঘরে কাড়ি কাড়ি টাকা, ভরি ভরি স্বর্ণ এভাবে জমা করে রাখতে পারে এর আগে হয়তো কেউ ধারণাই করেনি। সাবেক প্রধান বন কর্মকর্তা ওসমান গণির বাসায় যৌথ বাহিীর তল্লাশি চলাকালে টাকা-পয়সা সঞ্চয় ও রক্ষার কলাকৌশল সম্পর্কে লোকের পূর্ব ধারণা-কল্পনা সব ভেঙ্গে পড়েছিল। বালিশ, তোষকসহ ঘরের কোণাকাঞ্চিতে জমা করে রাখা প্রায় কোটি খানেক টাকা ও বহু ভরি স্বর্ণোদ্ধারের ঘটনা এখন প্রায় লোকগল্পে পরিণত হয়েছে। সন্ধান পাওয়া গেছে আরো বহু টাকা ও স্বর্ণের, কাঠ ও সম্পদের। বলাবাহুল্য, এর সবই ছিল প্রধান বন কর্মকর্তার বৈধ আয়ের হিসাবের বাইরের, অর্থাৎ অবৈধ আয়ের। চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বহু রাজনীকি ও ব্যবসায়ীর দুর্নীতির গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের উঁচু পর্যায়ে অবস্থানকারী একজন আমলার এত বড় দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের চাক্ষুস ঘটনার প্রকাশ সম্ভবত এটাই প্রথম। যথারীতি এরপর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে বন বিভাগের আরো বহু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দুর্নীতির টাকা থেকে নগদ অর্থে ও নানাভাবে উপঢৌকন ও সুবিধা পাওয়া বহু মন্ত্রী-নেতার নামও তার মুখে উচ্চারিত হয়েছে। পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় বন কর্মকর্তার এ ঘটনা ঝড়ের সৃষ্টি করেছে।

দুর্নীতির পাহাড়-পর্বতের নতুন এক মানচিত্র কিছুদিন যাবৎ বাংলাদেশের মানুষের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। বড় বড় নেতা ও দেশ সেবকদের দুর্নীতির পিলে চমকানো সব খবর ও স্বীকৃতির মধ্যে বন কর্মকর্তার এই হাতেনাতে ধরা পড়ার ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা নিশ্চয়ই ভুল হবে না যে, কেবলই বন নয়, সড়ক, পানি, বিদ্যুৎ, ভবন, জ্বালানী, খাদ্যসহ সরকারের গুরুত্বপূণ সব বিভাগেই এ রকম রক্ষকের ভক্ষক হওয়ার অজস্র গল্প বিদ্যমান। পার্থক্য এতটুকুই যে, একজন বালিশ-তোষকসহ ধরা পড়েছে অন্যরা এখনও ধরা পড়েনি। দুর্নীতির সঙ্গে প্রশাসনের নানা স্তরের যুক্ততার এই বিষয়টি নতুন নয়। দুর্নীতি করে গাড়ি-বাড়ি ও নগদ টাকার পাহাড় বানানোর গল্পও তো নতুন নয়। নতুন কেবল টাকা রাখার জন্য বালিশ-তোষকের এ অভূতপূর্ব ব্যবহার এবং ব্যবহৃত সবকিছুসহ ধরা পড়ে যাওয়া। তাই ধরা পড়া বন রক্ষকের ছবি দেখে প্রশাসনের নানাস্তরে যে হাততালির শব্দ উঠেছে সে হাতের আড়ালেও থাকতে পারে বহু টাকা ঘষার শব্দ। বান্দার হক সম্পর্কে সচেতনতা, হালাল আয়ের অপরিহার্যতা এবং আল্লাহর ভয়ের সম্পদ যদি প্রশাসনের লোকদের অন্তরে বদ্ধমূল না থাকে তবে বলা যায়, এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আইনের কঠোর শাসন সেখানে সাময়িক প্রতিরোধকের ভূমিকা পালন করতেই পারে। কিন্তু এ প্রতিরোধককে স্থায়ী করতে হলে অবশ্যই অনন্ত-অসীম জীবনের বিশ্বাস ও জবাবদিহিতার অনুভূতির কোনো বিকল্প নেই। কঠোর আইন ও আল্লাহর ভয়ের অনুপস্থিতি দুর্বলচিত্ত যে কোনো মানুষকেই দুর্নীতির সয়লাবে ভাসিয়ে নিতে পারে। ঘরের ভেতরের প্ররোচণাসহ চারপাশের পরিবেশে যদি ভাসিয়ে নেওয়ার উপাদান ও হাতছানি আরো থেকে থাকে তাহলে এ ধরনের গল্পের চরিত্র হতে পূর্ব থেকে ভালো বা মন্দ হওয়ার কোনো অনিবার্যতা থাকে না। অবৈধ আয়ের কোটি কোটি টাকার পাহাড়-পর্বত, বালিশ-তোষকের চিত্র দেখতে না চাইলে এক ওসমান গণিকেই শাস্তি ও গালির টার্গেট না বানিয়ে অনুসন্ধান ও কঠোর আইনের প্রয়োগ আর সর্বাত্মক আল্লাহর ভয় ও পরকালের ভয়ের ব্যাপক জাগরণ ঘটতে পারে।

বন রক্ষকের দুঃখীনি মা গ্রামের বাড়িতে বসে চোখের পানি মুছে বন রক্ষকের পিতার সততা ও পারিবারিক কৃচ্ছতার যে হৃদয়ছোঁয়া ইন্টারভিউ দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, এ লোকের জীবন শুরু হয়েছিল সৎ পরিবারে সৎভাবে। কিন্তু পরবর্তীতে সে সৎ থাকেনি। অবৈধ কাড়ি কাড়ি টাকার মধ্যেই তার জীবনের গন্তব্য খুঁজে নিয়েছে। সততার শেকড় থেকেও অৎ বৃক্ষ গড়ে উঠার রহস্যে যদি কেউ হাত না দিতে চায়, তবে টাকার তোষক, টাকার বালিশ দিয়ে বিছানা বানানো আর টাকাকেই ঠিকানা বানানোর চেষ্টা বন্ধ করা অসম্ভবই হবে।

 

advertisement