Jumadal Akhirah 1428   ||   July 2007

পূর্বসূরী
আজমীরের জ্যোতির প্লাবন

Zahir Uddin Babar

ভারতবর্ষে ইসলামের যাত্রা সূচিত হয় হিজরী প্রথম শতক থেকে। এদেশে ইসলাম প্রচারের বিভিন্ন সূত্র থাকলেও এক্ষেত্রে মুসলিম দরবেশ ও বুযুর্গানে দ্বীনের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তাদের ইখলাস, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং নিরলস প্রয়াসের ফলে এ ভূ-খণ্ডের মানুষ ইসলামের মহান সম্পদ লাভে ধন্য হয়েছে। প্রথম শতক থেকে অষ্টম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ইসলাম প্রচারের গতি ছিল অনেকটা শ্লথ। ফলে গোটা ভারতবর্ষ কুফর, শিরক ও মূতিপূজায় ছেয়ে গিয়েছিল। একত্ববাদের কথা বিস্মৃত হয়ে বহুত্ববাদকে মানুষ আঁকড়ে ধরেছিল। কুফরির এই জমাট অন্ধকারের ধাঁধায় পড়ে তারা ছিল উদ্ভ্রান্ত। মুসলিম উম্মাহর সেই নাজুর মুহূর্তে এই ভূ-খণ্ডে আগমন করেন মহান সাধক, আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট, চিশতিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ.। তিনি মূলত ভারতবর্ষের লোক নন। সাবে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত মধ্য এশিয়ার সিজিস্তানে তাঁর জন্ম। কিন্তু এতদঞ্চলে ইসলামের প্রচার প্রসারে তাঁর অবদান চির ভাস্বর। সুদূর আরবে প্রজ্জ্বলিত ইসলামের আলোক বিন্দুটি আরব-লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে হিমালয়ের পাদদেশে প্রোজ্জ্বল জ্যোতি ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে তাঁর নামটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পথহারা মানুষদের আলোর দিশা দেওয়া, মানবতার বিকাশ, আধ্যাত্মিকতার চর্চা ও চারিত্রিক উৎকর্ষের জন্য তিনি ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে আছেন।

খাজা সাইয়্যেদ মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ.-এর জন্ম ১১৪১ সালে। পিতা গিয়াসুদ্দীন হাসান চিশতী এবং মাতা সাইয়্যেদা মাহে নূর উভয়েই ছিলেন আল্লাহওয়ালা। পারিবারিক ঐতিহ্যে বেড়ে উঠা মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ. বাল্যকাল থেকেই ছিলেন বহুমুখী গুণের অধিকারী। প্রখর মেধা, নিরলস প্রচেষ্টা আর শিক্ষকদের সুদৃষ্টির কারণে অল্প বয়সেই তিনি পুঁথিগত বিদ্যার দ্বার অতিক্রম করেন।

বাল্যকালেই তিনি মাতাপিতার স্নেহশীতল ছায়া থেকে বঞ্চিত হন। অল্পদিনের ব্যবধানে বাবা-মায়ের মৃত্যু এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিরূপ চিত্র তাঁকে অনেকটা অন্তঃর্মুখী মানুষে রূপান্তরিত করে। তাঁর সমাজে বিরাজমান মানবতা লঙ্ঘন, পাশবিকতার স্ফুরণ এবং আত্মিক বিকারগ্রস্ততা তাঁকে সামাজিক জীবনাচরণ থেকে কিছুটা দূরে ঠেলে দেয়। খাজা উসমান হারুনী রাহ.-এর কাছে দীক্ষা লাভ করে তিনি আধ্যাত্মিক জগতে অবগাহন করেন। আধ্যাত্মিক রাহবার ও মুর্শিদের ইঙ্গিতে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ. ১১৯১ সালে ৫৬ বছর বয়সে পাড়ি জমান ভারতবর্ষে।

প্রথমে তিনি আজমীরে এসে অবস্থান করেন। ভারতবর্ষে সবেমাত্র মুসলিম শাসনের সূচনা। মুসলমানদের জন্য মুক্ত স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম পালন এবং প্রচার ও প্রসারের পরিবেশ তখনও ভালোভাবে তৈরি হয়নি। এজন্য প্রথম দিকে তাঁকে পড়তে হয় নানান প্রতিকূলতার মধ্যে। বর্ণ হিন্দুরা তাঁর সামনে আবির্ভূত হয় বিরাটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে। কুতুবুদ্দীন আইবেক, মুহাম্মাদ ঘোরী প্রমুখ মুসলিম শাসকরা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে এ সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থা সামাল দেওয়ার পর তিনি আত্মনিয়োগ করেন দ্বীন প্রচারে। হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে তাঁর প্রচেষ্টায় ইসলামকে একটি বিজয়ী শক্তি হিসেবে দাঁড় করতে সক্ষম হন তিনি। দিল্লীতে তাঁর হাতে বহু অমুসলিম ইসলামের সুধা পান করেন। আজমীর থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চিশতীয়া তরীকার। ভারতবর্ষে সর্বাধিক ব্যাপৃত ও বহুল প্রচলিত তরীকা এটাই।

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ. প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে দূরে থেকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিপ্লবের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর দর্শন ছিল ধর্মকে মানব সেবার প্রেক্ষিতে উপস্থাপন করা। এজন্য তাঁর কাছে ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল দুঃখীর দুঃখ দূরা করা, অসহায়ের অভাব মোচন করা এবং ক্ষুধার্তকে আহার করানো। আল্লাহর দাসত্বের সন্ধান দিয়ে মানবাত্মার মুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই তিনি কাজ করে গেছেন জীবনভর। প্রায় অর্ধ শতাব্দীকল পর্যন্ত দ্বীনের প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে নিরলস শ্রম দিয়ে ৬২৭ হিজরী সনের ৬ রজব ৯০ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান পরপারে। তিনি ইন্তেকাল করেছেন, কিন্তু তাঁর সুবিশাল অবদান রয়ে গেছে অম্লান। এই উপমহাদেশবাসী তাঁর কাছে চিরঋণী। তিনি শুয়ে আছেন ভারতের আজমীরে। কিন্তু বিরাজ করছেন এতদঞ্চলের প্রতিটি মানুষের মনের মুকুরে।

মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ.-এর মতো ওলি-দরবেশরা দূর দেশ থেকে এদেশে ছুটে না এলে আমাদের ভাগ্যে কী নির্ধারণ হত, বলা মুশকিল। তাই আমাদের উচিত তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। তাদের জীবন ও সাধনাকে যথার্থ উপায়ে চর্চা করা ও উপস্থাপন করা। কিন্তু আমরা কি আমাদের সে দায়িত্ব পালন করছি? রবজ মাস এলেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানী পর্যন্ত সর্বত্র রাস্তা-ঘাট ছেয়ে যায় লালসালুতে। এই লালসালুকে কেন্দ্র করে ফকিরবেশী কিছু ধান্ধাকাতর মানুষ টাকা-পয়সা টানার জাল পাতে। ঢোল-তবলা ও অশ্লীল কা-কারখানায় সরব করে তুলে চারদিক। উদ্দেশ্য গরীবে নওয়াজ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ.কে স্মরণ করা। এই মহান সাধককে স্মরণ করার ক্ষেত্রে বিকৃত উপায় অবলম্বন এবং অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার দরুণ সাধারণ মুসলমানদের কাছে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ.-এর আযমত ও তাঁর অসামান্য অবদানের কথা আজ বিস্মৃত হতে চলেছে। কিন্তু এর দায়বোধ আমরা কি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারি? আমরা তাঁর মতো মহান সাধকদেরকে যথার্থ উপায়ে স্মরণ করি না বলেই গাঁজা ফকিরেরা ভুল-বিচ্যুতির বেসাতি চালানোর সুযোগ পাচ্ছে তাঁদের নামে। তারা এদেরকে ব্যবহার করে দীর্ঘ করছে অর্থহীন ভুল কাজের ফিরিস্তি, হাসিল করে নিচ্ছে নিজেদের স্বার্থ। আমাদের তো প্রত্যয় হতে পারে যে, আমরা আমাদের মতো করে স্মরণ করব তাঁকে। তাঁর সুবিশাল অবদানকে। শরীয়তসম্মত উপায়ে তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান এবং তাঁর রূহের দারাজাত বুলন্দির জন্য দুআ করা তো আমাদের জন্য অতি সৌভাগ্যেরও বিষয়।

হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ.সহ মহান ওলী-আউলিয়াদের জীবন ও স্মৃতির প্রতি এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের যে বিশাল ও ব্যাপক শ্রদ্ধা, তার প্রকাশভঙ্গিটির ক্ষেত্রে সঠিক উপায়ে আমরা তেমন কোনো প্রভাব বা চিহ্ন আঁকতে পারি না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এজন্য ওলী-দরবেশদের জীবনকে কারবারী সুফিবাদের ব্যবসার পণ্য হতে দেখেও আমাদের ভূমিকাহীন থাকাটা কতটুকু সঠিক নিশ্চয় এটা ভেবে দেখা উচিত।

 

advertisement