ইসলামের নামে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সমিতি সোসাইটি, এনজিও ও ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের বিনিয়োগ পলিসি
একটি পর্যালোচনা
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনীতির উপর ইসলামের নিয়ন্ত্রণ নেই প্রায় শত বছরের বেশি। এরও একশ বছর আগে থেকে পুঁজিবাদের উত্থান। প্রায় ৭০ বছর ধরে বিশ্বে সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র দুটি তন্ত্রের শাসনই সমান সমান অবস্থানে ছিল। ১৯৯১ খৃষ্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র এখন প্রায় পুঁথিগত বিদ্যায় পরিণত হয়েছে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত পুরো বিশ্বে পুঁজিবাদেরই জয়জয়কার। বিশ্ববাসী আজ থেকে প্রায় শত বছরের আগেই ইসলামী অর্থনীতির অভিভাবকত্ব হারিয়েছে। আর ইসলামী অর্থনীতির সফলতা, এর শৌর্যবীর্য হারানোর ইতিহাস তো আরো পুরনো। স্বভাবতই ইসলামী অর্থনীতির অভিভাবকত্বের যুগ পেয়েছে এমন সৌভাগ্যবান কেউ আজ আর নেই । এমনকি উসমানী খেলাফতের শেষ আমলের লোকও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাহলে সহজেই বুঝে আসে যে, বর্তমান বিশ্বের বিকশিত হয়েছে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের পরিম-লে ও ছত্রছায়ায়। সমাজতন্ত্র বিশ্ববাসীর নিকট এক বিকল অর্থনীতিরূপে চিহ্নিত হয়েছে। তাই বলা যায়, আজ যারা অর্থনীতি নিয়ে ভাবছে, তারা পুঁজিবাদী অর্থনীতিরই প্রোডাক্ট।
কথায় আছে, একটি মিথ্যা ১০ বার বললে তা সত্যে পরিণত হয়। অর্থাৎ যারা একে মিথ্যা জানত তারাও ভাবতে থাকে হয়ত এটা সত্যি হবে। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, পুঁজিবাদী অর্থনীতি তার অসারতা সত্ত্বেও দুইশ বছর ধরে মানুষের মন-মস্তিষ্কে কেমন জায়গা করে বসেছে। এজন্যইতো পুঁজিবাদী মতাদর্শের বাইরে ইসলামী অর্থনীতির বিষয়ে কেউ মুখ খুললেই পুঁজিবাদের প্রবক্তারা একে অবাস্তব ও অচল নীতি ভাবতে থাকে। ভাবতে থাকে সনাতন যুগের সেই অর্থনীতি কি এই আধুনিক যুগে সম্ভব? বলছিলাম, বিশ্ববাসীর উপর পুঁজিবাদের দুইশ বছরের শোষণের ফলে মানুষ পুঁজিবাদের জালে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, আখিরাতের ভয় ও সুন্দর জীবনের কামনায় ইসলামী অর্থনীতির বাস্তবায়নের কথা চিন্তা করলেও বাস্তবে তা থেকে যাচ্ছে ওই ধনতন্ত্রের বেড়াজালের ভেতরেই। একথাটি একটু ব্যাখ্যা সাপেক্ষ এবং বর্তমান নিবন্ধে এ বিয়ষটিই পাঠকের সামনে তুলে ধরার ইচ্ছা করছি। আল্লাহ তাআলাই তাওফীক দাতা।
আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ হারাম থেকে বেঁচে থাকতে চায় এবং হালালের উপর চলতে চায়। জনগণের এই ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ইসলামী অর্থনীতির নামে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যেমন ব্যাংক, বীমা থেকে নিয়ে সোসাইটি ও সমিতি ইত্যাদি। এমনকি সুদী ব্যাংকগুলোও ইসলামী ব্রাঞ্চ খুলছে। একই ব্যবস্থাপনায় শুধু শরীয়া বোর্ড করে এবং নেমপ্লেট ও কিছু কাগজপত্রের পরিবর্তন দ্বারাই বনে যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংকিং! এত সহজেই ইসলামী ব্যাংকিং গড়া যায় এটাতো ভাবাই যায় না। যাক এর সব কিছু নেতিবাচক হলেও একটি ইতিবাচক দিকতো এটি বটেই যে, যে যুগে মানুষ ইসলামের লেবেলকেও বাঁকা চোখে দেখছে এমন মুহূর্তে অর্থনৈতিক অঙ্গনে ইসলামপ্রীতির এ জাগরণ মন্দ নয়। আরেকটি ফায়েদা হয়েছে, কায়-কারবারে হালাল-হারামের বিধান জানার আগ্রহ বেড়েছে। ফাতওয়া বিভাগগুলোতে আগের তুলনায় কায়-কারবারসংক্রান্ত ফতওয়ার তলব বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্নকারীদের প্রশ্ন শুনলে অবাক হতে হয়। মনের অজান্তেই প্রশ্ন জাগে, এরা কী ধরনের ইসলাম চায়? এই তো কিছুদিন আগে এক সমিতির প্রধান এসেছিলেন। বলছিলেন, ‘হুজুর আমরা ড. ইউনূসের সুদী ক্ষুদ্রঋণের বিরুদ্ধে ইসলামী শরীয়া মোতাবেক এনজিও গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমাদের প্রকল্পের সবাই দ্বীনদার। আমাদের একটা এমন পদ্ধতি বলে দিন, যেন আমরা গ্রাহকদেরকে টাকা দিয়ে লাভ নিতে পারি।’
দেখুন, লোকটি ইসলামী শরীয়া পন্থায় এনজিও গড়তে চায় বটে, কিন্তু পুঁজিবাদী সুদী তরীকা ছাড়তে নারাজ। তার জিজ্ঞাসার মূল হল, পুঁজিবাদী সুদী তরীকাকে কীভাবে গ্রহণ করা যায় এর হীলা বলে দিন। হারাম খাওয়ার ছুতা বাতলে দিন।
আরেক সমিতির পরিচালকবৃন্দ ফতওয়া বিভাগে একটি প্রশ্ন দিয়ে বলল, ‘হুজুর আমাদের সমিতিটি সম্পূর্ণ শরীয়া মোতাবেক পরিচালিত। আমাদের কিছু বিনিয়োগের পদ্ধতি এখানে উল্লেখিত আছে।’
পদ্ধতিগুলো পড়ে দেখলাম, গ্রাহক পণ্য নিতে চায় না, নগদ টাকা নিতে চায়। কিন্তু সমিতি তার কাছে সরাসরি টাকা না দিয়ে সমিতির একটি ফ্রিজ বিক্রি করে তার কাছ থেকে কম দামে ক্রয় করে নিয়েছে। এতে ক্লায়ন্ট নগদ অর্থও পেয়ে গেল আর সমিতিও অর্থ দিয়ে লাভ নিতে পারল। এর কাছাকাছি আরো দুএকটি পদ্ধতি উল্লেখ আছে ওই প্রশ্নপত্রে। এগুলো দেখে আমি বললাম, আপনাদের এসকল কারবার তো জায়েয হয়নি। এতে অর্জিত লাভ হালাল হবে না। একথা বলতেই একজন চটে গেলেন। বললেন, এখানে আমরা টাকার পরিবর্তে অতিরিক্ত নেইনি, বরং পণ্যের পরিবর্তে নিয়েছি। মাসআলা আলোচনা করার পর তাদের বুঝে আসল। এবার যা বলল সেটাই আপনাদের শোনাব।
বললেন, হুজুর! তাহলে যারা নগদ ঋণ নিতে চায় তাদের কাছে কিস্তিতে সমিতি কী উপায়ে লাভজনক বিনিয়োগ করতে পারে, এর পন্থা বলে দিন।’
পূর্বের প্রশ্নকারীর মত এ সমিতির পরিচালকবৃন্দের ধরন একই! হালাল খেতে চাই, কিন্তু পুঁজিবাদী সুদী নিয়ম থেকে বেরুতে চাই না। এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে অহরহ ফতওয়া বিভাগগুলোর।
আবার অনেকে অনভিজ্ঞ আলেমদের থেকে কিছু কিছু হীলা জেনে নিয়ে সদস্যদের সান্ত¡নার মধ্য দিয়ে সেই পুঁজিবাদী হারাম তরীকাগুলোকেই জিইয়ে রেখেছে। নিম্নে এ ধরনের ছুতা অবলম্বনে হারাম কারবারগুলোর কিছু নুমনা তুলে ধরছি। যেন আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে এ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করেন।
এক. ঋণ দিয়ে ফরম বিক্রির নামে মুনাফা অর্জন
বিনা সুদে ঋণ প্রদান করা হবে, তবে এক মাসে প্রতি দশ হাজার টাকার ঋণের জন্য প্রকল্প থেকে একটি একশ টাকার ফরম কিনতে হবে। এখন কেউ যদি দশ হাজার টাকা ৫ মাসের জন্য নিতে চায় তবে তাকে ৫০০ টাকা দিয়ে মোট পাঁচটি ফরম নিতে হবে। অর্থাৎ মাসে ১% হারে বা বছরে ১২% হারে ঋণ প্রদান করে ফরম গ্রহণের ছুতায় সুদ নেওয়া হচ্ছে। এখানে দাতা-গ্রহীতা সকলেরই জানা আছে যে, এ অতিরিক্ত টাকার আদান-প্রদান শুধু ঋণের কারণেই হয়েছে। আর ফিক্হের প্রসিদ্ধ মৌলনীতি রইল- ‘ঋণ যে প্রফিট নিয়ে আসে তা সুদ।’
এখানে ফরমের মূল্য ১০০ টাকা ধরা হয়েছে। কোনো কোনো প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ বাড়লে বেশি দামের ফরম নিতে হয়, যা অন্য কারণেও নাজায়েয। যাক ফরমের ছুতায় অর্জিত লাভ প্রকল্পের জন্য সুষ্পষ্ট হারাম। জেনে রাখা প্রয়োজন যে, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি হালাল উপায়ে ঋণ দিতে চায় এবং দাপ্তরিক কোনো শৃঙ্খলার জন্য ফরম পূরণের পদ্ধতি করে তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এই ফরম দ্বারা লাভ কমানো উদ্দেশ্য না থাকতে হবে। তাই ফরমের শুধু খরচমূল্যই নিতে পারবে-এর বেশি নয়। ফরমের খরচমূল্যের অতিরিক্ত নিলেই তা সুদে পরিণত হবে। -মুয়াত্তা মালেক ২৮২-২৮৩; সুনানে কুবরা বাইহাকী ৫/৩৪৯-৩৫১; মিরকাত শরহে মিশকাত ৬/৮২; আওজাযুল মাসালিক ১১/২৭৫; আননুতাফ ফিল ফাতাওয়া ২৯৬; আলমুগনী ৪/২১১
দুই. অর্থ গ্রাহকের নিকট অবিক্রিত পণ্য বিক্রয়ের ছুতা অবলম্বন করে মুনাফা অর্জন
যায়েদের ১ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। সে এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এসে তার নগদ টাকার চাহিদা ব্যক্ত করল। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানালো, আমরা নগদ টাকা দেই না। আমরা পণ্যের উপর বিনিয়োগ করি। বেশ তো আমার টাকা প্রয়োজন। আপনারা যেভাবে দিতে চান দেন। আমি টাকা পেলেই চলে। তো কত পার্সেন্ট দিতে হবে যদি ৬ মাসের জন্য নিতে চাই? প্রতিষ্ঠান ১০% দাবি করল। এ বৈঠকে বসেই প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটারটা গ্রাহকের নিকট ১ লক্ষ দশ হাজার টাকা দামে ৬ মাস পর মূল্য আদায়ের শর্তে বিক্রি করল। গ্রাহক যায়েদ ওই বৈঠকেই প্রতিষ্ঠানের নিকট কম্পিউটারটি বিক্রি করে দিল ১ লক্ষ টাকা দিয়ে। অত:পর এক লক্ষ টাকা নিয়ে বেরিয়ে আসল। অর্থাৎ তিনি ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ৬ মাসের জন্য ১ লক্ষ টাকা ঋণ পেলেন। আর প্রতিষ্ঠানও এতে লাভবান হল।
একথা সুস্পষ্ট যে, এই লেনদেনে কোনো পক্ষেরই ক্রয়-বিক্রয় উদ্দেশ্য নয়। বরং উভয় পক্ষের উদ্দেশ্য হল ১ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকার আদান-প্রদান। এটাও সুস্পষ্ট সুদ। এখানে সুদী কারবারকে বৈধরূপ দেওয়ার জন্য শরীয়তের স্বীকৃত বাকিতে বিক্রি (বাইয়ে মুআজ্জাল)এর সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়েছে মাত্র। মূলত এ কারবারটি হল, ভাষায় ‘বাইয়ে ঈনা’ আবার এটি বাইয়ে ঈনার ওই পদ্ধতি যা সকল ইমামের নিকট হারাম। এ ছাড়া বাইয়ে ঈনার কিছু পদ্ধতি এমন আছে যা মাকরূহ পর্যায়ের। এ বিষয়ে কিছু মতানৈক্যও আছে। কিন্তু সুবিধাভোগীরা এই হুকুমকে উপরোক্ত হারাম পদ্ধতির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করে থাকে, যা সম্পূর্ণ ভুল। বরং উপরোক্ত পদ্ধতির হুকুম হল, তা সকলের মতেই নাজায়েয।
তিন. অর্থ গ্রহণকারীর নিকট তৃতীয় ব্যক্তির জন্য ছুতা অবলম্বনে মুনাফা অর্জন
বাইয়ে ঈনার আরেকটি হারাম পদ্ধতি, যা কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবলম্বন করে থাকে। তা এই যে, ঋণ নিতে আগ্রহী ব্যক্তিকে বলল, আমরা সুদী পন্থায় ঋণ দেব না। বরং কিছু দ্রব্য অমুক দোকান থেকে নিয়ে আপনার কাছে বাকিতে বিক্রি করব। এরপর আপনি ওই পণ্য দোকানীর নিকট বিক্রি করে প্রয়োজনীয় টাকা ক্যাশ করে নিতে পারেন। যেমন, বাকেরের ৫০ হাজার টাকার প্রয়োজন। সে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে চুক্তি করল যে, ১ বছরের জন্য ৫০ হাজার টাকা নিলে ৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। এখন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের পরিচিত এক দোকানে গিয়ে দোকানী শাকেরের হাতে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বলল, তোমার দোকানের তাকের এই মালগুলো আমি কিনে নিলাম। দোকানী কিন্তু আগে থেকেই জানে যে, এই লোক অমুক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে। এরা মাল নেওয়ার জর্য আসেনি বরং এ মাল তার কাছেই থাকবে; এমনকি তাক থেকে নামানোরও প্রয়োজন হবে না। এরপর ৫০ হাজার টাকার ওই মাল কোম্পানির প্রতিনিধি বাকেরের নিকট এক বছরের মেয়াদে ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিল। বাকেরের প্রয়োজন টাকার। সে তো মুদি মাল নিবে না। তাই তাকে আগেই জানানো হয়েছে, তুমি মাল ক্রয়ের পর তা আবার দোকানী শাকেরের নিকট ৫০ হাজারের পরিবর্তে বিক্রি করে দিবে। এতে তুমি ৫০ হাজার নগদ অর্থ পেয়ে গেলে আর প্রতিষ্ঠান পণ্যের উপর টাকা বিনিয়োগ করে ৫ হাজার টাকা লাভবান হল।
এ কারবারও সুস্পষ্ট হারাম। এ কারবারের সাথে জড়িত সকলে ভালোভাবে জানে যে, সুদী লোনকে বৈধতার রূপ দেওয়ার জন্য পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের ছুতা অবলম্বন করা হয়েছে মাত্র। এখানে পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় বা আদান-প্রদান উদ্দেশ্য নয়।
প্রকাশ থাকে যে, এ কারবারকে বৈধতার রূপ দেওয়ার জন্য অনেকে দোকানের মাল পৃথক করে থাকে, যেন মাল হস্তগত হওয়ার শর্তটি পাওয়া যায়। কিন্তু এরপরও কারবারটি হালাল হয় না। কারণ, ক্রয় বিক্রয়ের শব্দ, মাল পৃথক করা-এ সবই ক্রয়ের বাহ্যিক শর্ত, যেগুলোর পাশাপাশি ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্য থাকাও বিক্রি সহীহ হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত। প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে যেহেতু ক্রয়-বিক্রয়ের পরও পণ্য যার কাছে ছিল তার কাছেই থেকে যাচ্ছে। তাহলে বুঝা গেল, এ ক্ষেত্রে শুধু ক্রয়-বিক্রয়ের অভিনয় করা হয়েছে কিন্তু উদ্দেশ্য ও ফলাফলের দৃষ্টিতে এটি আসলে ক্রয়-বিক্রয় নয়।
অনেকে আবার দোকানীকে যে টাকা দেওয়া হয় তা থেকে কিছু কমে তার নিকট মালগুলো পুনরায় বিক্রি করে দেয়। যেমন, পূর্বের দৃষ্টান্তে বাকের দোকানের ওই মাল দোকানী শাকেরের নিকট ২০০ টাকা কমে অর্থাৎ ৪৯,৮০০ টাকায় বিক্রি করে দিল। এ ক্ষেত্রে শাকের পূর্ণ ৫০ হাজার পাবে না। অনেকে মনে করে, এমন করলে কারবার হালাল হয়ে যায়। কিন্তু এতেও কারবারটি বৈধ হয় না। কারণ এ লেনদেনেও যার মাল তার কাছেই থেকে যাচ্ছে। সর্বোপরি এ কারবারেও কারোরই বেচাকেনা উদ্দেশ্য থাকে না। বরং উদ্দেশ্য সুদী লোনের আদান-প্রদান। দোকানীও এ ধরনের কারবারে উৎসাহী থাকে। কারণ কোনো পণ্য বিক্রি না করেও তার কিছু উপার্জন হয়ে যাচ্ছে। -রদ্দুল মুহতার ৫/৩২৬; আলবাহরুর রায়েক ৩/৫৭৫; ফাতহুল কাদীর ৬/৩২৩; কেফায়া ৬/৩২৩; ইলাউস সুনান ১৪/১৭৭
চার. ঋণের পরিবর্তে বৈদেশিক মূদ্রা গ্রহণের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন
শাকিলকে একটি প্রতিষ্ঠান ৫০,০০০ টাকা ঋণ দিয়ে বলল, তুমি ৪৯,০০০ টাকা এক বছর পর ফেরত দিবে। আর অবশিষ্ট এক হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫০ রিয়াল দিবে। এতে দেখা যাবে যে, প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা লাভ হয়ে যাচ্ছে। এ কারবারকে তারা বৈধ মনে করছে। তাদের যুক্তি হল, বৈদেশিক মুদ্রার সাথে কমবেশি করেও ক্রয়-বিক্রয় জায়েয। তাই ১০০০ টাকার পরিবর্তে ৫০-৫৫ রিয়াল নেওয়া যেমনিভাবে জায়েয, তেমনিভাবে ২৫০ রিয়াল নেওয়াও জায়েয হবে; অথচ এভাবেও গৃহীত লাভ হারাম ও সুস্পষ্ট সুদ। এ কারবারটি নাজায়েয হওয়ার মৌলিক দুটি কারণ রয়েছে।
১. এক দেশের মুদ্রার সাথে অন্যদেশের মুদ্রার বাকিতে লেনদেনের জন্য শর্ত হচ্ছে, লেনদেনের দিন উক্ত মুদ্রার বাজারদরের চেয়ে বেশি মূল্যে আদান-প্রদান না করা। উক্ত লেনদেনে এ শর্তের খেলাফ করা হয়েছে। কারণ, এক রিয়ালের বাজারদর প্রায় ২০ টাকা আদান-প্রদানের শর্তে ৪ টাকার পরিবর্তে ১ রিয়াল করে নেওয়া হচ্ছে। ফলে যেখানে ১০০০ টাকায় মাত্র ৫০টি রিয়াল পাওয়া যেত, সেখানে ১০০০ টাকার পরিবর্তে নেওয়া হচ্ছে ২৫০ রিয়াল। এই অতিরিক্ত ২০০ রিয়াল সুদ। -মাজাল্লাতু মাজমায়িল ফিকহিল ইসলামী, ১৮৯৪; বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যা মুআসিরা ১/১৭৮,১৭৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৩৫৪
২. এ ক্ষেত্রে যদিও দেখানো হচ্ছে যে, ১০০০ টাকার বিনিময়ে ২৫০ রিয়াল নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু উক্ত লেনদেনের সাথে জড়িত সকলেই জানে যে, এই অতিরিক্ত রিয়াল ৫০ হাজার টাকার ঋণের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে। শুধু এক হাজারের পরিবর্তে নয়। তাই এ কারবারে যদি ৫০,০০০ টাকা না দিয়ে ১০০০ টাকা দেওয়া হত তবে কোনো পাগলও ২৫০ রিয়াল দিত না। এতেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ কারবারে অতিরিক্ত রিয়াল ঋণের বিনিময় হিসাবেই দেওয়া হয়েছে। আর ঋণ দিয়ে যেকোনো উপায়ে গ্রহীতা থেকে লাভবান হওয়া সম্পূর্ণ হারাম। এ স¤পর্কিত বরাতসমূহ নিম্নে প্রদত্ত হল-
-সুনানে কুবরা বাইহাকী ৫/৩৪৯-৩৫০; আততালখীসুল হাবীর ৩/৩৪; মুয়াত্তা মালেক ২৮৩; মিরকাত ৬/৮২; আনুনুতাফ ফিল ফতওয়া ২৯৬; আলমুগনী ৬/১১৬
পাঁচ. ‘বাইয়ে সালাম’ তথা খরিদের সাদৃশ্য অবলম্বনে ঋণের উপর মুনাফা অর্জন
করীমের ৫০ হাজার ক্যাশ টাকা ৬ মাসের জন্য প্রয়োজন। সে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিকট গিয়ে তার চাহিদা ব্যক্ত করলে প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হল, আমরা সুদী ঋণ দেই না। তবে আপনি একটি কাজ করতে পারেন- ধরুন, বর্তমানে ৪০০ টাকা মণ ধান। এ হিসাবে ৫০ হাজার টাকায় ১২৫ মণ ধান পাওয়া যায়। আপনি ৬ মাস পর ১৩০ মন ধান দিবেন। অর্থাৎ ‘বাইয়ে সালাম’ (আগাম খরিদ), যেখানে মূল্য অগ্রীম পরিশোধ করা হয় এবং পণ্য মেয়াদান্তে আদায় করা হয়। এ চুক্তিতে আপনাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে পারি। তবে ৬ মাস পর আমরা ধান নিব না। বরং ১৩০ মন ধানের মূল্য যা আসে তা নিব।
অনেকে এত লম্বা করেও বলে না। বরং গ্রাহককে বলে, ‘আপনাকে এত মন ধানের উপর টাকা দিলাম। আপনি মেয়াদান্তে এত মন ধানের বাজারদর প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দিবেন।’
এটিও সম্পূর্ণ সুদী কারবার-যেখানে সুদ গ্রহণের জন্য শরীয়তের ‘বাইয়ে সালাম’ (আগাম খরিদ চুক্তি)কে ছুতা হিসাবে অবলম্বন করা হয়েছে মাত্র। কারণ বাইয়ে সালামের শর্তসমূহ এখানে পাওয়া যায় না।
বাইয়ে সালামে নির্ধারিত মেয়াদান্তে ক্রেতাকে পণ্যই নিতে হবে। পণ্য না নিয়ে তা বিক্রেতার নিকট বিক্রি করে দেওয়া কিংবা অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়া জায়েয নয়।
সর্বোপরি এ কারবারের সাথেও সংশ্লিষ্ট সকলে এ কথা ভালোভাবেই জানে যে, দাতা-গ্রহীতা কারোই পণ্য উদ্দেশ্য নয়, বরং টাকার আদান-প্রদান করে কিছু লাভবান হওয়াই উদ্দেশ্য। -আলমুগনী, ইবনে কুদামা ৪/৩৪১; বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআসিরা ১/১৪০
ছয়. ‘বাই বিল ওফা’র সাদৃশ্য অবলম্বন ঋণের বিনিময়ে মুনাফা অর্জন
শাহেদের ১ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। সে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তার এ চাহিদা ব্যক্ত করল। সে জানে যে, এই প্রতিষ্ঠান ‘করজে হাসানা’ দেয় না। তাই সাথে সাথে বলল, আমার নিকট প্রায় দুই বিঘা পরিমাণ ধানী জমি আছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫ লক্ষ টাকা। সেটার উপর আপনারা আমাকে টাকা দিতে পারেন।
প্রতিষ্ঠানের পরিচালক জানাল, জমিটি আপনি আমাদেরকে এক লক্ষ টাকার পরিবর্তে বিক্রি করে দিন। পরবর্তী সময়ে আপনি যখন আমাদের টাকা ফেরত দিবেন আমরাও আপনার জমি ফেরত দিব। এতে প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত টাকার বদৌলতে দুই বিঘা জমি নিজের মালিকানাধীন জমির মতো ভোগ করতে পারছে। আর ওই ব্যক্তিও টাকা নিয়ে তার চাহিদা পূর্ণ করতে পারল।
এ কারবারও সম্পূর্ণ নাজায়েয। কারণ-
(১) প্রথমত এখানে উভয় পক্ষের কারোরই ক্রয়-বিক্রয় উদ্দেশ্য থাকে না। ফলে বেশি দামের জমি কম দামে সাময়িকভাবে মৌখিক বিক্রি করা হয়। বাস্তবে ক্রয়-বিক্রয় হলে এই দামে বিক্রি করতে আদৌ সম্মত হত না। আবার উল্টোও হয়, কম দামী জমি অনেক বেশি মূল্যে মৌখিক ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। যদি বাস্তবে ক্রয়-বিক্রয় হত তবে সে কখনোই এই দামে ক্রয় করত না। সুতরাং এতে বিক্রি-চুক্তির সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়েছে মাত্র। মূলত তা বিক্রি-চুক্তি নয়।
(২) এটি মূলত জমি কট বা বন্ধক নিয়ে ঋণ প্রদান করার মতোই। কিন্তু এখানে বন্ধক ও ঋণ শব্দ ব্যবহার না করে ক্রয়-বিক্রয় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে; যেন বন্ধকি বস্তু থেকে উপকৃত হওয়া হারাম এ প্রশ্ন থেকে বাঁচা যায়।
(৩) এক্ষেত্রে ক্রয়-বিক্রয় শব্দ ব্যবহার করে ‘বাই বিলওফা’ অর্থাৎ বিক্রিত মাল বিক্রেতার নিকট পুনঃবিক্রির অঙ্গীকারে যে কারবার সংঘটিত হয়-এর সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়েছে। যেন ‘বাই বিলওফা’কে যে সকল ক্ষেত্রে বৈধ বলা হয় সেগুলোর সাথে মিলে এ কারবারকেও বৈধ মনে করা হয়। অথচ ‘বাই বিলওফা’ বৈধ হওয়ার জন্য দুটি জরুরি শর্ত রয়েছে, যেগুলো এখানে অনুপস্থিত। শর্ত দুটি হচ্ছে-
(১) যথাযথ মূল্যে বিক্রি হতে হবে এবং উভয় পক্ষেরই এতে ক্রয়-বিক্রয় এবং মালিকানা হস্তান্তরের উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
(২) বিক্রেতার নিকট পুনঃবিক্রির কথা প্রথম বিক্রির সময় না হতে হবে। প্রথম চুক্তির সময় এ শর্ত উল্লেখ করা হলে সর্বসম্মতিক্রমে তা ক্রয়-বিক্রয় থেকে বেরিয়ে ঋণ ও বন্ধকে পরিণত হবে। ফলে অর্থদাতার জন্য এ জমি থেকে উপকৃত হওয়া সুদ হবে। -রদ্দুল মুহতার ৫/২৭৬; খানিয়া ২/১৬৫; শরহুল মাজাল্লা ২/৬১; জামিউল ফুসূলাইন ১/২৩৬; মাজাল্লাতু মাজমায়িল ফিকহিল ইসলামী ৭/৩/৯-৫৫৭ (কারার ৫৫৭)
সাত. বাইয়ে সালাম তথা আগাম খরিদ এর সাদৃশ্য অবলম্বনে আরেকটি সুদী কারবার
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নগদ অর্থ গ্রহণকারীকে এ শর্তে টাকা দেওয়া হয় যে, ৫০ হাজার টাকা নিলে ৬ মাস পর ৪৯ হাজার টাকা ফেরত দিবে। আর বাকি ১০০০ টাকার পরিবর্তে ১৫ মন ধান দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ৪৯ হাজার টাকাকে ঋণ গণ্য করছে আর ১০০০ টাকার পরিবর্তে ধান নিচ্ছে যা বাইয়ে সালাম যাকে আগাম খরিদ বলা হয়, এই কারবারে গণ্য করছে।
এ কারবারও জায়েয নয়। কারণ, বাজারদর অনুযায়ী ২ মন ধানের মূল্য ১ হাজার টাকা হয়। সেখানে আরো ৮ মন ধান অতিরিক্ত দেওয়া হচ্ছে মূলত ওই ৪৯ হাজার টাকা ঋণের পরিবর্তে। যদি এ ঋণ না দেওয়া হত তবে সে কখনো ১০০০/- টাকার পরিবর্তে ১০ মন ধান দিতে সম্মত হত না। এ ছাড়া প্রদেয় অর্থের আদান-প্রদানের সময়ই ওই অতিরিক্ত বিনিময়ের শর্ত করা হয়। ফলে এই অতিরিক্ত অংশ যে ঋণের বিনিময় তা আরো সুষ্পষ্ট হয়ে যায়। অতিরিক্ত সুদকে বৈধতার রূপ দেওয়ার জন্য এখানে ‘বাইয়ে সালাম’ তথা আগাম খরিদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়েছে। -মুয়াত্তা মালেক ২৮৩; মিরকাত ৬/৮২; আওজাযুল মাসালিক ১১/২৭৫; আন্নুতাফ ফিল ফাতাওয়া ২৯৬; আলমুগনী ৪/২১১
লক্ষ করার বিষয় এই যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির দুইশ বছর শাসনের ফলে মানুষের চিন্তাধারা এমনই বদলে গেছে যে, তারা কিছুতেই নিজেদের চিন্তাচেতনা থেকে সুদকে সরাতে পারছে না। আবার আখেরাতের ভয়ও তাদেরকে দ্বিধান্বিত করছে। ফলে সাময়িক সান্ত্বনার জন্য হলেও তারা সুদকে গ্রহণ করার জন্য শরীয়তের বিভিন্ন কারবারের ছুতা বা সাদৃশ্য অবলম্বন করেই ক্ষান্ত হয়ে যাচ্ছে এবং হারাম ছেড়ে হালালের পথে চলার অবান্তর আশা মনে পুষে চলেছে।
কিছু দিন আগে একটি সমিতির কিছু দায়িত্বশীল এসে বললেন যে, তারা তাদের সমিতিকে সম্পূর্ণ সুদমুক্ত করতে চান। এজন্যই ফতওয়ার শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু যখন ফতওয়াটি প্রদান করা হল তখন তিনি তা পড়ে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন। অবশেষে ওই ফতওয়া রেখেই বিদায় নিচ্ছেন। বললাম, ভাই কি হল! ফতওয়া নিবেন না? বললেন, পরে আবার এসে নিয়ে যাব। এখনো ওই ফতওয়া আমাদের কাছেই আছে। এটা একটি দৃষ্টান্ত, এরূপ দৃষ্টান্ত আরও আছে।
আট. মুদারাবা বিনিয়োগ ও লাভের শতকরা হার উল্লেখ করা হয় কিন্তু মূলত লাভের হিসাব করা ছাড়াই নির্ধারিত অংকের লাভ দিয়ে দেয়।
অনেকে ব্যবসায়ীদের নিকট শুধু এ কথার উপর টাকা দিয়ে দেয় যে, সে এটাকা দিয়ে ব্যবসা করে যা লাভ হবে তার অর্ধেক দিবে। যেহেতু ব্যবসায়ীর অভিজ্ঞতা ভালো তাই তিনি এক লাখ টাকায় মাসে ৮-১০ হাজার টাকা লাভ করে থাকেন। তাই লাভ হিসাবে প্রতি মাসে ১ লক্ষ টাকায় ৪ হাজার টাকা লাভ দিবে।
এখন মাস শেষে ওই এক লক্ষ টাকা দিয়ে কত ব্যবসা হল এর না কোনো হিসাব, না অন্য কোনো কিছু। সুদী কারবারের মতোই মাস শেষে লাখে চার হাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছে। কোথায় ব্যবসার লাভ আর কোথায় পার্সেন্ট হিসাব? এভাবে বহু প্রতিষ্ঠান অর্থের বিনিয়োগ গ্রহণ করে থাকে। অথচ ব্যবসার লাভ থেকে দিলেও অংক নির্দিষ্ট করার কারণে কারবারটি সুদী কারবারে পরিণত হয়ে যায়। এ ছাড়া ব্যবসার নাম করে ব্যবসা করা ছাড়া লাভ হিসাবে একটি অংক দিলেও তা হালাল গণ্য হবে না। তাই বিনিয়োগের আগেই খেয়াল করতে হবে যে, (ক) যার নিকট দিচ্ছে আসলেই কি সে এই টাকা দিয়ে ব্যবসা করবে? (খ) হালাল ব্যবসা করবে? (গ) লাভের হিসাব যথাযথভাবে করবে, নাকি লাভের নামে মাস শেষে ফিক্সড একটা এমাউন্ট দিয়ে দিবে? (ঘ) এ ছাড়া ব্যবসায়ীর ব্যবসা যত ভালোই হোক না কেন অর্থদাতার জন্য নির্দিষ্ট অংকের লাভ দেওয়ার চুক্তি করা যাবে না। কেননা এ চুক্তিই হল সুদী চুক্তি।
প্রসঙ্গত একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তা হল আমি বলতে চাই না যে, ইসলামী ব্যাংকগুলো এই প্রকার কারবারের সাথে জড়িত। কিন্তু তাদের কর্মকা- দেখলে তো তাই মনে হয়। কারণ, ইসলামী ব্যাংকগুলোও জমাগ্রহণের ক্ষেত্রে সুদী ব্যাংকের নীতি ছাড়তে প্রস্তুত নয়। সুদী ব্যাংকগুলো মেয়াদী জমার সুদ যেমন পূর্বেই ঘোষণা করে দেয়, ইসলামী ব্যাংকগুলোও একই পদ্ধতি ও একই ছক এঁকে ওই পরিমাণ লাভ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। অবশ্য কেবল এক জায়গায় পার্থক্য আছে তা হল, ইসলামী ব্যাংকগুলো ছকের নিচে অতি ক্ষুদ্রাকারে ‘প্রাক্কলিত’ লিখে দেয়। ব্যস এটাই ইসলামী বিনিয়োগ আর সুদী বিনিয়োগের মধ্যকার তফাত। এতে কতটুকু শরীয়তসম্মত হয় সেই আলোচনার প্রয়োজন নেই। কারণ ইদানীং ইসলামী ব্যাংকগুলো আরো আধুনিকত্ব শিখে গেছে। এখন তারা ‘প্রাক্কলিত’ লিখার বাড়তি ঝামেলা পছন্দ করছে না। সুদী ব্যাংকগুলো থেকে পিছিয়ে থাকতে চায় না কোনো অংশেই। তাই সুদী ব্যাংকের মতো তারাও ইস্যু করেছে দ্বিগুণ মেয়াদী জমা স্কিম, মিলিয়নার বিলিয়নার স্কিম, কোটিপতি ও লাখপতি স্কিম। এ নীতিটি যে ইসলাম সমর্থিত নয় তা বলাই বাহুল্য।
বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমানের একটি কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন,‘ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রকারান্তরে সুদী কারবারকেই জিইয়ে রেখেছে।’ তাঁর একথার মূল্যায়ন এখানে করতে চাচ্ছি না। তবে এটুকু বলতে চাই যে, ইসলামী ব্যাংকগুলো যদি পুঁজিবাদী নীতিকে অনুসরণ না করে ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক নীতিকে অবলম্বন করত তবে শুধু জনাব সাইফুর রহমান কেন, ভিন্ন পেশার সাধারণ লোকের নিকটও ইসলামী অর্থনীতির সৌরভ ও সুফল প্রস্ফুটিত হত।
নয়. মুরাবাহা বিনিয়োগে মালের রসিদকেই যথেষ্ট মনে করা
‘মুরাবাহা’ পলিসি শরীয়ার মৌলিক বিনিয়োগ পলিসি নয়; বরং এটি একটি বিকল্প ও সাইড পলিসি। কিন্তু আজকাল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ পলিসিকে প্রধান ব্যবসা পলিসির স্থান দিয়ে বসেছে। যাক সে প্রসঙ্গ এখানে নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এই কারবারটি বৈধ হওয়ার জন্য ন্যূনতম যে শর্ত আছে সেগুলোও জেনে-শুনে এড়িয়ে চলতে দেখা যায়। যেমন, অর্থলগ্নীকারীর জন্য মুরাবাহা কারবারে বিক্রিযোগ্য পণ্য নিজের মালিকানায় ও নিজের হস্তগত হওয়া শর্ত। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মালের রশিদ নিয়েই টাকা গ্রাহককে দিয়ে দেয়। যেমন ধরুন গ্রাহক ব্যাংকে একটি ফ্রিজের জন্য গেছে। ব্যাংক বলল, ৪০% আপনি ডাউন পেমেন্ট দিলে আমরা ৬০% অর্থ যোগান দিব। তো আপনি একটি এক লক্ষ টাকা মূল্যের রশিদ বানিয়ে নিয়ে আসেন। সেই রশিদ জমা দিলে আমরা আপনাকে ৬০ হাজার টাকা দিব। এখন ৬০ হাজার টাকা নিয়ে এ ব্যক্তি ফ্রিজ কিনুক বা না কিনুক ব্যাংক এর উপর প্রফিট নিচ্ছে। এখন আমরা কি বলতে পারি না যে, ব্যাংক এখানে ফ্রিজ পণ্যের উপর প্রফিট গ্রহণ করেনি বরং ৬০ হাজার টাকা দিয়ে এর উপর প্রফিট গ্রহণ করেছে। কারণ, ফ্রিজের উপর প্রফিট করেছে তা বলার অবকাশ তো বেরিয়ে আসত তখনই যখন ওই ব্যক্তি বাস্তবেই ওই টাকা দিয়ে ফ্রিজ ক্রয় করত। ব্যাংকের অসংখ্য গ্রাহক তাদের ‘রশিদ’ সিস্টেমের কারণে এ সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকও মালের রশিদকেই পণ্য কেনা মনে করে নিয়েছে। সেহেতু ব্যাংক নিজে বা প্রতিনিধি দিয়ে ক্রয় করা এবং তা হস্তগত করার প্রয়োজনই মনে করে না। আজ ব্যাংকের দেখাদেখি বহু সমিতি ও সোসাইটিতেও এভাবে কারবার হতে দেখা যাচ্ছে। অথচ মুরাবাহা বিক্রিটি সুদমুক্ত হওয়ার জন্য এটিই প্রধান শর্ত। সুদী ব্যাংকগুলো মালের রশিদ না নিয়েই নির্দিষ্ট প্রফিটে টাকা দেয়। বিবেচনার বিষয় হল, রশিদ নেওয়ার দ্বারা রশিদভুক্ত মালের মালিকানা ও কব্জা তথা মাল বুঝে নেওয়ার শর্ত পাওয়া যায় কি না।
এ পর্যন্ত জিদ্দা ফিক্হ একাডেমি এবং হিন্দুস্তান ফিক্হ একাডেমিতে এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে একথা গৃহীত হয়েছে যে, শুধু রশিদ বুঝে নিলে কারবার হালাল হবে না। কারবারকে সুদমুক্ত করতে চাইলে মাল প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় এবং তার হস্তগত হতে হবে। সে সময় ওই মাল নষ্ট হলে প্রতিষ্ঠানের হবে। অন্তত এই ‘রিস্ক’ থাকতে হবে। অন্যথায় কারবার হালাল হবে না। বিশ্বব্যাপী ওলামায়ে কেরামের এই অভিমত ও সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো ঢালাওভাবে মাল না কিনে শুধু রশিদের উপর নির্ভর করেই মুরাবাহা বা বাইয়ে মুআজ্জাল করে থাকে। তাদের কারো কারো থেকে শোনা যায় যে, রশিদ বুঝে নিলেই নাকি কারবারটি হালাল হয়ে যায়। যা সম্পূর্ণ ভুল। বাংকগুলো এসব ক্ষেত্রে মালয়শিয়াকে মডেল মনে করে, কিন্তু তাদের উচিত এসব ক্ষেত্রে শরয়ী দলীলাদিকে মডেল বানানো। ইসলামী অর্থনীতিকে এইভাবে উপস্থাপন করার কারণেই ইসলামী ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে দেশের সেরা সেরা অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য নেতিবাচক। তারা সুদী অর্থনীতির সাথে ইসলামী অর্থনীতির পার্থক্য খুঁজে পান না। আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে এর মূল কারণ হল, আজ আমাদের মধ্যে যে সকল মহৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করতে চান তারাও তাদের অজান্তেই পুঁজিবাদী অর্থনীতির জালের মধ্যেই আটকে আছেন। তাই তাদের চাওয়া ও পাওয়ার সমন্বয় ঘটছে না। তাই এ বিষয়ে ভাবতে হলে, পদক্ষেপ নিতে হলে কুরআন হাদীসে বুৎপত্তি আছে এমন বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। আজ দেশে শত শত সোসাইটি, এনজিও ও সমিতি ইসলামী তরীকায় ব্যবসা করতে চায়, কিন্তু তারা উপরোক্ত নয় প্রকারের কোনো একটিকে ইসলামী পলিসি ভেবে বিনিয়োগ করছে এবং শুধু সুদী কারবারই করছে ন; বরং সুদ গ্রহণের জন্য অসৎ হীলা তথা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। যা হারামকে হারাম জেনে করার চেয়ে আরো মারাত্মক গুনাহ। বনী ঈসরাঈলের এক সম্প্রদায়কে এই অসৎ হীলার জন্যই আল্লাহ তাআলা বানররূপে বিকৃত করে দিয়েছিলেন। নাউযুবিল্লাহ।
এ পর্যায়ে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তা হল- এ ধরনের হারাম, নাজায়েয ইত্যাদি হুকুম শুনে অনেকে ঘাবড়ে যায়। অনেকের মুখে এ অভিযোগও শোনা যায় যে, হুজুররা শুধু সমালোচনা করতে জানেন এবং হারাম ও নাজায়েয ফতওয়াই শুধু দিতে জানেন, গঠনমূলক আলোচনা বা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে জানেন না। এমন একটি অভিযোগ ছুড়ে দিয়েই তারা কুরআন হাদীস নির্ভর দলীল ভিত্তিক ফতওয়া ও ফয়সালা থেকে দায়মুক্ত হয়ে যায়। ফলে তা থেকে উপকৃত হওয়া এবং পূর্বের কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করা কিছুই আর সম্ভব হয় না। অথচ গঠনমূলক কাজের দাবিদারদের জন্য এমনটি আদৌ শোভনীয় নয়। অবশ্য তাদের এ কথাকে স্বাগত জানাই যে, একজন মুফতীর দায়িত্ব শুধু নাজায়েয ও হারাম বলে দেওয়া পর্যন্তই শেষ হয়ে যায় না। বরং এ গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি এ থেকে নিষ্কৃতির উপায় ও বিকল্প পন্থা বাতলে দেওয়াই সচেতন মুফতীর দায়িত্ব। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, বিকল্প ব্যবস্থা দেওয়ার গুরুদায়িত্ব এতটাই ব্যাপকতা লাভ করেছে যে, যে কেউ এ বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করতে চলেছে। শরীয়তের দলীলাদি, হুকুমের মূল উৎস, কারণ ও হেকমত এবং শরীয়তের মৌলনীতির খবর নেই-এমন লোকেরাও আজ নিজেদেরকে এ গুরুদায়িত্বের অধিকারী মনে করে বসেছে। ফলে তারা সকল হারাম ও নাজায়েযের বিকল্প দাঁড় করাতে প্রস্তুত। বলুন তো সুদ, জুয়া, মদ-এগুলোরও কী বিকল্প হতে পারে?
এ থেকে একটি নীতি সুস্পষ্ট বুঝে আসে যে, সব জিনিসের বিকল্প হয় না। এখন কোন জিনিসের বিকল্প হয় আর কোনটির বিকল্প হয় না, এটি একটি দীর্ঘ আলোচনা। এখানে শুধু এটুকু বলতে চাই, এ প্রবন্ধে যতগুলো পন্থাকে নাজায়েয ও হারাম বলা হয়েছে, প্রায় সবগুলোর মূল উদ্দেশ্য নগদ অর্থ কিছু মেয়াদের জন্য আদান-প্রদান করে মুনাফা অর্জন করা। এটি শরীয়তসম্মত উদ্দেশ্য নয়। কারণ, ‘রিবান নাসীআ’ যাকে ‘রিবাল কুরআন’ বলা হয় তার উদ্দেশ্য মেয়াদী ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত গ্রহণ করা। এটি সকল সুদ ও হারামের গোড়া। যেহেতু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য বিরান কে ধারণ করে, তাই এর কোনো বিকল্প দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তাই উপরের আলোচনায় দেখেছেন শরীয়তের বিভিন্ন কারবারের নামে যখনই ওই উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেষ্টা করা হয়েছে তখনই তা হীলা ও ছলচাতুরীর রূপ নিয়েছে, বিকল্প হয়নি; বরং ‘বিষের’ বিকল্প ‘ইসলামী বিষ’ হিসাবে অচেতনে আত্মাহুতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বাইয়ে মুআজ্জাল, বাইয়ে সালাম, বাইয়ে মুরাবাহা ইত্যাদি বৈধ বেচাকেনা হওয়া সত্ত্বেও এগুলোর সাথে মিল রেখেও ওই উদ্দেশ্যকে হালাল করা যায়নি। যে বিষয়কে কুরআন শরীফে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেছে তা কি কোনো উপায়ে বৈধ হতে পারে? না, কক্ষনো নয়। এমন উদ্দেশ্য গোড়া থেকে বর্জিত। একে যত ভালো ও বৈধতার রূপই দেওয়া হোক তা কখনো ভালো হবে না। এ উদ্দেশ্য গোড়া থেকেই বাদ দিতে হবে। যারা উপরোক্ত পন্থাগুলো দাঁড় করিয়েছেন তাদের গোড়ার গলদ এই যে, তারা সব জিনিসের বিকল্প দেওয়ার জন্য প্রস্তুত চেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সকলকে দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন এবং সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন