Muharram 1432   ||   December 2010

চাঁদের বুকে কলঙ্ক: আমাদের সিলেটে জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথা

Mawlana Abdullah Bin Sayeed Jalalabadi

মুসলিম বালকদের বাল্যশিক্ষা বইয়ে আছে-আলইসলামু হক্কুন ওয়াল কুফরু বাতিলুন, আলইসলামু নুরুন ওয়াল কুফরু যুলমাতুন।

অর্থাৎ ইসলাম সত্য আর কুফর মিথ্যা, ইসলাম আলো আর কুফর অন্ধকার।

মানবজাতির সৃষ্টি ও শ্রেণীভেদ সংক্রান্ত শিক্ষাই উক্ত বাণীর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আল্লাহ তাআলা বলেন্ত(তরজমা) হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে একটি মাত্র পুরুষও একটি মাত্র নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা যাতে একে অপরকে চিনতে পার সেজন্য বিভিন্ন জাতি-গোত্রে বিভক্ত করেছি। নিঃসন্দেহে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক তাকওয়ার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর ইলম ও খবর রাখেন।

পাবনার কবি আবদুল হাশেম এ বক্তব্যের চমৎকার অনুবাদ করেছেন নহে-আশরাফ আছে যার শুধু বংশের পরিচয়। সেই আশরাফ জীবন যাহার পুণ্যকর্মময়।

সূরা নিসায় বলা হয়েছে : (তরজমা) হে মানবজাতি! তোমাদের সেই প্রতিপালককে (আল্লাহকে) ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক অভিন্ন ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তার মধ্য থেকেই তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর সেই যুগলদম্পতি থেকে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য নারীপুরুষ। পক্ষান্তরে সনাতনধর্ম তথা হিন্দু ধর্মের মানবসৃষ্টি সংক্রান্ত বর্ণনা হচ্ছে-মানবজাতি সৃষ্টিগতভাবেই বৈষম্যের শিকার। মনুস্মৃতিমতে ব্রহ্মার শির থেকে সৃষ্টি হয়েছে ব্রাহ্মণের, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়ের, উরু থেকে শুদ্রের এবং পা থেকে বৈশ্য তথা নীচ জাতির লোকদের। সুতরাং প্রথমোক্ত ব্রাহ্মণরা অপর সকল শ্রেণীর মানুষের নমষ্য ও পূজনীয়। বিশেষত বৈশ্যরা তো সকলের সেবা যত্ন ও পায়রবী করেই জীবন কাটাবে।

এটা যে একান্তই চতুর ব্রাহ্মণদের স্বার্থকেন্দ্রিক প্রচারণা, ধর্মের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই, তা সামান্য চিন্তা করলেই ধরা পড়ে। তাদের এ চাতুর্য যেন কোনোদিন কেউ আঁচ করতে না পারে তাই তাদের শাস্ত্রীয় বিধান হচ্ছে- কোনো শূদ্রের কানে যদি বেদবাণী বা রামায়ণ (রামরচিত) ঢুকে গিয়ে থাকে তাহলে  এ অপরাধে ফুটন্ত শীসা ঢেলে তার কান চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে। আর তার স্থান হবে রৌরব নরকে। পক্ষান্তরে সত্য ধর্ম ইসলামের প্রথম বাণীই হল, ইকরা-পড়। পড় তোমার সেই প্রভুর নামে,যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পড়, তোমার রব সম্মানিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।-সূরা আলাক : ১-৫

হাদীস শরীফে আছে, ইলম অন্বেষণ প্রত্যেকটি মুসলমানের জন্য ফরয। এখানে বর্ণবংশের কোনোই পার্থক্য নেই।

আল্লামা কবি ইকবাল মুসলমানদের সাম্যের নমুনা বর্ণনা করেন্তআইনে জংগ মে জব আগিয়া ওয়াক্তে নামায/একহি সফ মে খাড়ে হো গায়ে মাহমূদ ও আয়ায।

অর্থাৎ হচ্ছে লড়াই রক্তক্ষয়ী এসে গেল ওয়াক্তে নামায/এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেল সুলতান মাহমূদ ও ভৃত্য আয়ায।

ইসলামের এই সাম্য নীতিই যুগে যুগে বঞ্চনাপীড়িত মানুষকে ইসলামের দিকে আকর্ষণ করেছে। ইসলামের প্রথম প্রভাতেই তাই হযরত আম্মার, খুবাইব, সুমাইয়া, বিলাল প্রমুখ সাহাবী-       সাহাবিয়্যা তাঁদের কুরায়শ মনিবদের রক্তচক্ষু ও প্রাণান্তকর নির্যাতনকে উপেক্ষা করে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন।

যারা ইসলামের এ মহান আদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেনি, ইসলামী মূল্যবোধ তাদের অন্তরে বাসা বুনতে পারেনি তারা এখনো জাহিলিয়াতের মূল্যবোধের উপর অটল রয়েছে। সিলেটের সমাজ ও আভিজাত্য সূত্রসমূহের গবেষক হারুন আকবরের ভাষায়-উচ্চবর্ণের ধর্মান্তরিত হিন্দু অভিজাত পরিবার যারা মুসলমান হলেন তারা যে ফূল দিয়ে মূর্তি পূজা করতেন সে ফুল হাতে নিয়েই মসজিদে প্রবেশ করলেন। সাবেকি আভিজাত্য সাথেই থাকল। শূদ্রকে বুকে টেনে নেওয়ার সাহস হল না। ধর্ম-বিশ্বাসের পরিবর্তন ছাড়া ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব তাদেরকে প্রভাবিত করেনি। শ্রেণী-ঐতিহ্য বজায় রেখে হিন্দু ব্রাহ্মণ মুসলমান অভিজাতরূপী শোষকই থেকে গেলেন।

সামন্ত শ্রেণীর হিন্দু অভিজাত ছাড়াও মোগল-পাঠানরা দীর্ঘকাল এদেশ শাসন করেছেন। সেই শাসক ও তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সিপাহসালার বখশী, চৌথ আদায়কারী, তহশীলদার, কাযী (বিচারক) প্রভৃতি প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এমনকি তাদের পাইক পিয়াদারাও এদেশবাসীর তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। কারণ তারা এদেশ জয় করে এদেশের সাধারণ  নাগরিকদের প্রজা বানিয়ে দীর্ঘকাল শাসন্তশোষণ করেছেন। পরবর্তীতে যে বিজাতীয় বণিক শ্রেণী বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এদেশবাসী প্রজাসাধারণের মালিক মূখতার বনে গিয়েছিল সেই ইংরেজ শাসকদের আনুগত্য প্রদর্শন করে যারা এদেশীয় আমজনতার প্রতি বেঈমানী করেছিল তারাও আভিজাত্যের দাবীদার। অথচ আযাদী সংগ্রামে লিপ্ত এ দেশবাসীর প্রতি তখন তাদের চরম নিগ্রহ নির্যাতন চলছিল। সেই বিবেচনায় ঐ শ্রেণীর লোকেরা স্বাধীনতার আলো-হাওয়ায় বড় হওয়া প্রজন্মের কাছে রীতিমতো গাদ্দার; বরং তার চাইতেও ঘৃণিত লোক। কিন্তু নির্লজ্জের মতো তারাও আভিজাত্যের দাবিদার।

সেই তথাকথিত অভিজাতরা ছাড়াও তাদের দেখাদেখি নকল সৈয়দ, দেওয়ান, চৌধুরী, খান প্রভৃতি উপাধিধারী প্রচুর অভিজাতের উদ্ভব হয়েছে।

এদেশে ইসলামী প্রচারে যারা বিরাট অবদান রেখেছেন, বিশেষত হযরত শাহজালাল রা.-এর সাথে আগত ৩৬০ আউলিয়ার বংশধরগণ বা তাদের মাযারের খাদেম-সেবায়েত হওয়ার সূত্রেও অনেকে আভিজাত্যের দাবিদার। তাঁরাও এদেশের আদি অধিবাসীদেরকে অনেক ছোট করে দেখেন এবং নিজেদেরকে শাহ নামে অভিহিত করেন। অথচ চিন্তা করেন না যে, বৈষম্য-জর্জরিত এদেশের আদি অধিবাসীদেরকে তাঁদের পূর্বপুরুষরাই ইসলামের সাম্যের সৌন্দর্য প্রদর্শন করেই ইসলামে দীক্ষিত করেছিলেন। তাই নিজেদেরকে শাহ বা বাদশাহ বানিয়ে এদেশবাসী নাগরিকদেরকে তাদের রায়ত বা প্রজা ভাবার কোনই যুক্তি নেই। এটা ইসলামের সাম্যের নীতিকে বিসর্জন দেওয়ারই নামান্তর।   তাদের সেই পূর্বপুরুষ ওলি আউলিয়াদের উত্তরাধিকারী বলে দাবি করার কোনই অধিকার নেই। মাযারসমূহের নিয়ায-নযর ভোগ করে আরাম-আয়েশের জীবন অতিবাহিত করলেও ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও আমল-আখলাকের বিকাশ সাধনের ব্যাপারে তাদের অবদান একেবারেই শূন্যের কোঠায়।

পক্ষান্তরে ওলি-আওলিয়ার প্রকৃত উত্তরসূরী তাঁরা অত্যন্ত সাধারণ মুসলমানকেও সম্মান ও মর্যাদার পাত্র মনে করতেন। হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ হোসায়ন আহমদ মাদানী রাহ. বলতেন, কোনো চামার (চর্মকার) ও ভাঙ্গী (মেথর)ও যদি কালিমা-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করে ইসলামে দাখিল হয় তাহলে সেও আমার শ্রদ্ধেয় নানাজান (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মেহমান। তাঁর সম্মান ও খিদমত করা মেযবান পরিবারের সন্তান হিসেবে আমার ধর্মীয় ও নৈতিক কর্তব্য।

একটি ঐতিহাসিক সত্য হল, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর শের শাহ আমলে সৃষ্ট চৌধুরী পদবি ব্যবহার অচল ও অযৌক্তিক। এটা যেহেতু পেশাভিত্তিক শব্দ, তাই সেই পেশা যাদের নেই তারা এই উপাধি ব্যবহার করতে পারেন না। যেমন একজন জেনারেল বা হাকীম (চিকিৎসক) এর সন্তান নিজেকে জেনারেল বা হাকীম বলে পরিচয় দেওয়া যায় না। তেমনি যারা চৌর্য (ট্যাক্স) আদায়ের পেশায় নেই তারাও চৌধুরী বলে পরিচয় দিতে পারেন না। কিন্তু আশ্চর্য, ৫/৭শ বা হাজার বছর পূর্বে যাদের পূর্বপুরুষরা মুফতী পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, বিচারকর্ম বা ফতওয়ার সাথে সম্পর্কহীন হয়েও আজ পর্যন্ত নিজেদের পরিচয় স্বরূপ মুফতী শব্দ ব্যবহার করে আসছেন।

পাল ও সেন রাজাদের তুলনায় খিলজী, পাঠান, মোঘল শাসনাধীন প্রজারা অপেক্ষাকৃত শান্তি ও সহানুভূতিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করলেও এবং ঐ মুসলিম বিজেতাদের কারো কারো চরিত্রে ন্যায়পরায়ণতা ও ঔদার্য্যের পরিচয় পাওয়া গেলেও তাঁরা ইসলামের প্রচারপ্রসারে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি। অবশ্য হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মের পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের তাঁরা প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। কিন্তু তারপরও স্বীকার করতে হয় যে, তাদের সবার কর্ম ও জীবন পূর্ণ ইসলামী অনুশাসনের অধীন ছিল না। সুতরাং তাঁদের নিযুক্ত চৌথ আদায়কারী (চৌধুরী), দেওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা) বা অন্যান্য রাজকর্মচারীগণও যে আদর্শস্থানীয় ছিলেন না তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রজাসাধারণের তুলনায় তাঁরা অভিজাত বলেই গণ্য হতেন এবং তাঁদের মধ্যে অনেকে জনহিতকর কার্যাবলির দ্বারা প্রচুর প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। কিন্তু এজন্য তাঁরা সাধারণ প্রজাদের ছোট মনে করবেন, ইসলামে তার অবকাশ কোথায়? কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রায়ত বা প্রজাদেরকে কার্যত তারা গোলাম ও মানবেতর প্রাণীতে পরিণত করেছিলেন।

হিন্দু জমিদারদের মতো মুসলিম জমিদার বা দেওয়ান ও চৌধুরীদের বাড়ির পাশ দিয়ে জুতা পায়ে বা ছাতা মাথায় দিয়ে গমনাগমন ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাওয়া বা কোনো উৎসব উপলক্ষে গমনকারী প্রজা যতই জ্ঞানী গুণী হোন না কেন চেয়ারে বসার অনুমতি তাদের জন্য স্বীকৃত ছিল না। পিতৃবয়েসী প্রজাদেরকেও তুই তুকারী সম্বোধন করাকে তারা তাদের জন্মগত অধিকার বিবেচনা করতেন। এগুলো যে অমানবিক ও ইসলামী চেতনা-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী তা আজ কে না জানে!

জমিদার ও জমিদারী সংশ্লিষ্ট আরেকটি শ্রেণী ছিল মাজমাদার বা মজুমদার। জমিদারীর আয়ব্যয়ের হিসাব রক্ষণই তাদের কাজ ছিল। আরেকটি শ্রেণী ছিল তালুকদার। তারা কোনো জমিদারের রায়ত নন, সরাসরি সরকারের সাথে তাদের তাআল্লুক বা সম্পর্ক, তাই তারা সরাসরি নিজেদের জমিজমার খাজনা রাজ সরকারে জমা দিতেন। এঁরাও ছোটখাটো জমিদার বলে বিবেচিত হতেন তবে তাদের মর্যাদা জমিদারদের তুলনায় কম এবং সংখ্যায় তারা দেওয়ান বা জমিদারদের তুলনায় অনেক বেশি। এ লেখকের পিতামহ পর্যন্ত বেশ কয়েক পুরুষ জমিজমার বেচাকেনায় নিজেদের ব্যবসা এর স্থানে লিখতেন, তালুকদারী’-গৃহস্থি নয়। আমার পিতামহ মুহাম্মাদ ইছিম ও তাঁর ভাতিজা সিলেটের ঐতিহাসিক গণভোট ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে সিলেট জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি এবং ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রভাবে সিলেট জজকোর্টে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনকারী মাওলানা আবদুর রশীদ (টুকের বাজারী) এর মধ্যকার একটি জমি হস্তান্তর দলিলে (১৯২৪) আমি বংশ ও পেশা পরিচয়ের এ বিবরণটি স্বচক্ষে দেখেছি এবং তা আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। পরিচিতির জন্য বংশপরিচয় নিন্দনীয় কিছু নয়, কিন্তু যখন ঐ পরিচিতিটুকুই অন্যদের হেয়জ্ঞান করার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন তা আপত্তিকর এবং অমানবিক হয়ে উঠে। পুণ্যভূমিক জালালাবাদ সিলেটের জন্য এটি একটি কলংক ও অভিশাপস্বরূপ।

১৯৬২ সালে আমি যখন ঢাকা আলিয়া মাদরাসার ফাযিল প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন দৈনিক পত্রিকাসমূহে সিলেট সংক্রান্ত একটি সংবাদ পড়ে লজ্জা ও ক্ষোভে আমি অত্যন্ত বিমূঢ় হই। সিলেটের একটি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে একজন তালুকদারনিয়োগের প্রতিবাদে একজন চৌধুরীসহশিক্ষক পদত্যাগ করেন। সাথে সাখে আমি আবুল কালাম শামসুদ্দীন সম্পাদিত তদানীন্তন দৈনিক জেহাদপত্রিকায় খোঁড়া আত্মমর্যাদাবোধশিরোনামে একটি পত্র প্রেরণ করি। ঐ বিজ্ঞ সম্পাদক দীর্ঘকাল দৈনিক আজাদের সম্পাদকরূপে দেশব্যাপী সুপরিচিত এবং মাওলানা আকরাম খাঁর সহকর্মীরূপে অত্যন্ত বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি আমার সে পত্রটি শুধু ছাপলেনই না, আমাকে আমার সৎ সাহসও উন্নত চিন্তার জন্য রীতিমতো সামনাসামনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তাতে আমি চৌধুরী, দেওয়ান প্রভৃতি নামের অভিমান ঝেড়ে ফেলে একই সমতল থেকে সকলকে সাম্য ও মৈত্রিয় পরিবেশে যাত্রার পরামর্শ দিয়েছিলাম এবং ওদের অনেক অনাচারের দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছিলাম। অনেক গণ্যমান্য চৌধুরী সাহেবান যাদের কেউ কেউ আমার সহপাঠী ও বন্ধুদের পিতাপিতৃব্য হিসাবে আমারও মুরব্বী স্থানীয় ছিলেন সে পত্রপাঠে রাগে গরগর করেছেন শুনেছি, কিন্তু কেউ তার প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি। একাধিক চৌধুরী শিক্ষক কীভাবে ষড়যন্ত্র করে সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসা থেকে মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকারী মৎসজীবী সমাজের একটি মেধাবী ও খ্যাতিমান ছাত্রকে বের করে দিয়েছিলেন সে পত্রে এর বিবরণও ছিল।

সিলেটে এই অভিশাপটি এতই ব্যাপক যে, চৌধুরী, অচৌধুরী পরিবারে বিয়ে-শাদি পর্যন্ত ছিল একটি অকল্পনীয় ব্যাপার। কেননা, অচৌধুরী মানেই ছিল চাষাভূষা। সিলেট জেলার সাথে সাথে বরাক উপত্যকার অন্য জেলা মানে বৃহত্তর কাছাড় জেলা (আসাম) বর্তমানের করিমগঞ্জ, সিলেটের হাইলাকান্দি জেলাসমূহেও এ মারাত্মক রোগটি ছিল। তাই সে এলাকার এক জমিদার-নন্দিনী তার চাইতে অনেক অগ্রসর জনৈক বিখ্যাত লেখক ও পুলিশের আইজি স্থানীয় স্বামীকে নির্দ্বিধায় চাষীপুত্র বলে সম্বোধন করে বারবার প্রহৃত হয়েছেন। অথচ ঐ মহিলার পিতা পিডব্লিউডির একজন সুপারিন্টেন্ড ইঞ্জিনিয়ারের বেশি কিছু ছিলেন না। কেবল উন্নাসিকতার কারণে শেষ পর্যন্ত দুই দুইটি বিবাহিতা মেয়ের বর্তমানে শেষ জীবনে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

অথচ এই উপাধি ছাড়াও যে মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হওয়া যায় তার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ভালুয়াগাছের হাজী কেরামত আলী, বানিয়াচঙ্গের খান সাহেব নূরুল হোসেন, সেলবরষের আবদুল খালিক আহমাদ, টুকের বাজার হায়দরাবাদের দানবীর হাজী আবদুস সাত্তার ওরফে মুতালিব হাজী, চুয়াল্লিশ পরগণার ইমাম উল্লাহ এবং বিশ্বনাথের দানবীর হাজী রাগিব আলী ও মৌলবী নূরুল হক, করাচির বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন’-এর সম্পাদক আলতাফ হোসেন, জৈন্তা নিজপাটবাসী বাহরুল উলূম  মোহাম্মাদ হোসেন, জকিগঞ্জের এমএ হক ঐসব খেতাব ছাড়াই নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধি ও মেধার বলে উচ্চতম সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। পাঠানটোলার মাওলানা আবদুল করীম সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও আলজালাল সম্পাদক শেখঘাটের শেখ সিকান্দার আলীও এরূপ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তারা কোনো লকব-উপাধি ছাড়াই তাদের দান দক্ষিণা ও জনসেবার মাধ্যমে যে সম্মান অর্জন করেছেন তা কোনো সৈয়দ-মোঘল-পাঠান চৌধুরী দেওয়ান লকবধারীর চাইতে কোনো অংশেই কম নয়; বরং অনেক বেশি।

সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত হিন্দুসমাজ থেকে আগত এ জাতিভেদ ও বর্ণপ্রথা খাসিয়া, মণিপুরী ও প্রতিবেশী সমাজের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট লোকদের ইসলাম গ্রহণে বড় বাধা হয়ে দেখা দেয়। নতুবা আজ বনজ ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় তথা মেঘালয় রাজ্য এমনকি মণিপুর রাজ্যও বাংলাদেশের অন্তর্র্ভুক্ত থাকত।

মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর চেষ্টায় কিছু মণিপুরী পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছিল। মাওলানা আবদুর রহমান সিংকাপনী প্রমুখ খাসিয়াদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তারা তাদের দাওয়াতে আকৃষ্টও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে একটি শর্ত আরোপ করে। তারা সিলেটের মুসলিম সমতলবাসী সমাজপতিদের কাছে প্রশ্ন রাখে, আমাদের পাহাড়ি উপজাতিদের ছেলেদের কাছে আপনারা আপনাদের মেয়ে দেবেন না, কিন্তু আপনাদের সর্দারদের ছেলেদের কাছে আমাদের সর্দারদের মেয়েরা কি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে? ইসলামী সাম্যমৈত্রীর সবক সম্পর্কে অজ্ঞ ও বৃহত্তর ইসলামী স্বার্থ সম্পর্কে অসচেতন মুসলিম সমাজপতিরা তাদেরকে তাদের এ যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। ফলে আমাদের মহান ইসলাম প্রচারকগণের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। আজ থেকে ৭০/৮০ বা একশ বছর পূর্বে তা যতটুকু সত্য ছিল আজো তা ততটুকুই সত্য। হিন্দুসমাজ থেকে আগত জাতিভেদ বর্ণভেদের এ কুপ্রথা না থাকলে আজ দেশের মানচিত্র অবশ্য অবশ্যই অন্যরকম হত।

কিছু ব্যতিক্রম

দেওয়ান ও চৌধুরীরা নিজেদের মর্যাদা জ্ঞানে অত্যন্ত টনটনে। কথাটি আমার নয়, সিলেট গেজেটিয়ার প্রণেতা এসএনএইচ রিযভীর। তার কথার সত্যতার একটি প্রমাণ ইতিপূর্বেই পাঠক পেয়েছেন। সিলেটের আমজনতা অহরহই সে প্রমাণ পেয়ে থাকেন। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রমী আত্মসচেতন এমন চৌধুরীও রয়েছেন। হারুন আকবরের ভাষায় এরা প্রাচীন চৌধুরী পরিবারের পলায়নী মনোভাবের সন্তান। তিনি লিখেন চৌধুরী খেতাবের লেজেগোবরে ও তেলেসমাতি ব্যবহার দৃষ্টে সাবেক চৌধুরী পরিবারের অনেক উচ্চ শিক্ষিত বহুল পরিচিত পণ্ডিত ও বিদ্বান ব্যক্তিগণ নামের সঙ্গে চৌধুরী লিখতে এখন লজ্জাবোধ করেন বা লেখেন না। যেমন খান বাহাদুর মোহাম্মাদ মাহমুদ, মাওলানা আবদুল মুছাব্বির (অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও ইলেকশন কমিশনার শফিউর রহমানের মাতামহ), মাওলানা সাখাওতুল আম্বিয়া, রসসাহিত্যিক মতীনউদ্দীন আহমদ প্রমুখ চৌধুরীসন্তানগণ এটা লেখা ত্যাগ করেছিলেন। বর্তমানে সাবেক শিক্ষাসচিব হেদায়াত আহমদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর সেগুফতা বখত এবং জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মাদ আজরফসহ অনেকেই আর চৌধুরী লিখতে উৎসাহ বোধ করেন না। (আভিজাত্যে সিলেটী সমাজ, পৃষ্ঠা : ৫৪, ২য় সং ২০১০)

বাংলাদেশের সাবেক উপসচিব আফতাবুদ্দীন আহমদ ম্যাজিষ্ট্রেট পদ লাভ করেই চৌধুরী শব্দ ব্যবহার ত্যাগ করলে তার বিক্ষুব্ধে আত্মীয়স্বজনরা তার বিরুদ্ধে পঞ্চায়তী সালিশে বসেছিলেন। তিনি তাদেরকে জবাব দিয়েছিলেন, আমার ম্যাজিষ্ট্রেট পদবীটি সাবেক চৌধুরী পদবী থেকে অনেক বড় তাই ওটা লিখে নিজেকে আমি আর ছোট করতে চাই না।

গণভোটকালে সিলেট জেলা মুসলিম লীগ নেতা মাওলানা আবদুর রশীদ টুকের বাজারীর ঘনিষ্ট সহকর্মী ঘোপালের মাওলানা মছদ্দর আলীকেও আমরা কোনোদিন নামের সাথে  চৌধুরী শব্দ ব্যবহার করতে দেখিনি। তিনি বিবাহও করেছিলেন অচৌধুরী পরিবারে। কৌড়িয়ার মাওলানা আব্বাস আলীর কন্যা এবং শায়খে কৌড়িয়া মাওলানা আবদুল করীম সাহেবের বোনকে তিনি বিবাহ করেছিলেন। এ জাতীয় দৃষ্টান্ত খুব বেশি না থাকলেও সকল দেওয়ান ও চৌধুরীই যে আত্মগর্বিত ও অহঙ্কারী ছিলেন না এটা তারই উজ্জ্বল প্রমাণ।

 

 

advertisement