ইসলামী অর্থ-ব্যবস্থার আলোকে বাজেট মূল্যায়ণ
২০০৭-২০০৮ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাব ঘোষণা করা হয়েছে। গত ৭ জুন অর্থ উপদেষ্টা জনাব এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম ৮৭,১৩৭ কোটি টাকার বিশাল বাজেট ঘোষণা করেন। এর মধ্যে অবশ্য বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) দায় বাবদ বরাদ্দ রয়েছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব বা অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা (বিপিসির দায় বাদে)। আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা।
ঘোষিত বাজেটে রাজস্ব প্রাপ্তির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫৭,৩০১ কোটি টাকা। সে হিসাবে বাজেট ঘাটতি দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান, অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন ও কর বহির্ভূত আয় প্রভৃতি খাত থেকে অর্জিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
এবারের বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের জন্য ১৪.০৫%। এর পরই রয়েছে সরকারের গৃহীত ঋণের সুদ আদায় বাবদ বরাদ্দ ১৩.৫%।
বাজেটের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ভোজ্যতেল, মশুর ডাল, পেঁয়াজ, রিকন্ডিশন গাড়ির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার, ক্রেডিট কার্ডের অগ্রিম কর প্রত্যাহার এবং চিনি, কৃষি পাম্প ও কম্পিউটারের কর বৃদ্ধি বা নতুন করে করারোপ। এছাড়া আরো বহু ক্ষেত্রে শুল্ক বৃদ্ধি বা হ্রাস করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় জনগণকে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে তাদের পরমর্শ বা যেকোনো প্রস্তাব তার কার্যালয়ে জানানোর আহ্বান করেছেন। এর জন্য প্রথমে সময় দেওয়া হয়েছিল ১৪ জুন পর্যন্ত, যা ইতোমধ্যেই আরো ৩ দিন বাড়ানো হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেট পুনর্বিবেচনার পর তা চলতি জুন মাসের শেষ সপ্তাহে চূড়ান্ত হয়ে গেজেট আকারে প্রকাশিত হওয়ার কথা। সুতরাং এ লেখা যখন প্রকাশিত হবে তখন দেশে নতুন অর্থবছরের নতুন বাজেট কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে।
সম্ভবত দেশে জরুরি অবস্থা বিদ্যমান থাকায় অন্যান্য বারের মতো বাজেট প্রকাশের পর এটিকে ‘গরীব বান্ধব’ বা ‘গরীব মারার হাতিয়ার’ আখ্যা দিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মিছিল বা বিক্ষোভ হয়নি। বাজেটের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঢালাও মন্তব্যও এবার শোনা যাচ্ছে না। তবে বরাবরের মতো অর্থনীতিবিদগণ, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাজেট বিষয়ে তাদের মূল্যায়ন ব্যক্ত করেছে। সংবাদপত্রগুলোতে বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে মতামত প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিনই।
উপরোক্ত প্রেক্ষাপটেই আলকাউসারের পাতায় ইসলামের দৃষ্টিতে জাতীয় বাজেট নিয়ে কিছু লেখার আহ্বান জানানো হয়েছে শুভানুধ্যায়ী মহল থেকে।
বাজেট মূলত একটি চলমান প্রক্রিয়া। একটি অর্থবছরের কয়েক মাস পেরুলেই পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এরপর জুন মাসে এসে তা চূড়ান্ত হয়। আসন্ন ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটের সঙ্গে পূর্ববর্তী বছরগুলোর বাজেটের তেমন কোনো ফারাক নেই। আসলে তা থাকারও কথা নয়। কারণ একই দৃষ্টিভঙ্গি, উপায়-উপকরণ ও একই নীতিমালার আওতায় এবং সর্বোপরি নির্ধারিত পরামর্শকদের শর্তাবলি ও ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েই আমাদের মতো দেশগুলোর বাজেট প্রীণত ও বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এজন্যেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতার প্রয়াস থাকা সত্ত্বেও সাবেক অর্থউপদেষ্টা ডা. আকবর আলী খানসহ অনেকেই প্রস্তাবিত বাজেটকে গতানুগতিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পরিবর্তন আসলেও রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থা একই রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ সকল বিভাগ তো পূর্বের সনাতন নিয়মেই চলমান। সুতরাং ইসলামী অর্থনীতির আলোকে বাজেট নিয়ে কথা বলার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বাজেটকে আলোচ্য বিষয় করার প্রয়োজন নেই, বরং প্রচলিত বাজেটগুলোর উপাদান এবং আয় ও ব্যয়ের উৎস ও খাতসমূহের সাথে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মিল-অমিল খতিয়ে দেখাই হল এখানে মুখ্য বিষয়।
বাজেট হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের এক বছরের আয় ও ব্যয়ের আর্থিক দলীল। অর্থাৎ আগামী ১ বছরে রাষ্ট্র কোন কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করবে এবং সে টাকার জোগান কীভাবে কোত্থেকে আসবে তার অগ্রিম প্রাক্কলনের নামই হল বাজেট। এ দিক দিয়ে ইসলামের দৃষ্টিতে বাজেটের গুরুত্ব অপরিসীম। আলকুরআনুল কারীমে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম কর্তৃক ধনাঢ্য ব্যক্তি কারূনকে অর্থনৈতিক নির্দেশনা দেওয়ার যে বর্ণনা রয়েছে এবং হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম কর্তৃক ভবিষ্যতের দুর্ভিক্ষের বছরগুলোর জন্য খাদ্যপরিকল্পনার যে বর্ণনা রয়েছে সেগুলো একথারই পরিচায়ক।
দ্রষ্টব্য :
وَ لَا تَجْعَلْ یَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلٰی عُنُقِكَ وَ لَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا
‘তুমি একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হয়ো না এবং একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।’
اِنَّ قَارُوْنَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوْسٰی فَبَغٰی عَلَیْهِمْ ۪ وَ اٰتَیْنٰهُ مِنَ الْكُنُوْزِ مَاۤ اِنَّ مَفَاتِحَهٗ لَتَنُوْٓاُ بِالْعُصْبَةِ اُولِی الْقُوَّةِ
অর্থ : কারূন ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত। এরপর সে তাদের প্রতি বিদ্রোহ ভাবাপন্ন হতে আরম্ভ করল। আমি তাকে এত ধনভাণ্ডার দান করেছিলাম, যার চাবি বহন করা কয়েকজন শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল।’ -সূরা কাসাস : ৭৬
فَمَا حَصَدْتُّمْ فَذَرُوْهُ فِیْ سُنْۢبُلِهٖۤ اِلَّا قَلِیْلًا مِّمَّا تَاْكُلُوْنَ
‘এরপর যা কাটবে, তার মধ্যে যে সামান্য পরিমাণ তোমরা খাবে তা ছাড়া অবশিষ্ট শস্য শীষ সমেত রেখে দেবে’ -সূরা ইউসুফ : ৪৭
প্রচলিত বাজেটগুলো দেখলে প্রথমেই যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হল এতে প্রথমে ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় এরপর চিন্তা করা হয় তা জোগানের উৎস খোঁজার। এ কারণে প্রায় সকল বাজেটই হয়ে থাকে ঘাটতি বাজেট এবং বছর শেষে নতুন বছরের বাজেট উত্থাপনের পূর্বেই অর্থমন্ত্রী বা উপদেষ্টাকে শেষ হতে যাওয়া বছরের বাজেট সংশোধনী পেশ করতে হয় যাতে ব্যয় বাড়লেও আয় অনেক কমে যায়। আসন্ন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটটিও ঘাটতি বাজেট। কারণ এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৭ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা, পক্ষান্তরে রাজস্ব প্রাপ্তি বাবদ আয় ধরা হয়েছে ৫৭ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি থাকছে ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট বাজেটের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি। বাজেট প্রস্তাবে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে, এ অর্থ বৈদেশিক উৎস ও অভ্যন্তরীণ (কর বহির্ভূত) খাত থেকে আসবে। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় এ ধরনের ঘাটতি বাজেটের সুযোগ নেই, কারণ ইসলাম মানুষকে আয় বুঝে ব্যয় করতে শিক্ষা দেয়। আয়ের তুলনায় অধিক ব্যয়ের চিন্তা করলে যেমন অনেক ক্ষেত্রেই তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না, তেমনি এ খরচের জোগান দিতে গিয়ে হতে হয় বিপর্যস্ত, লজ্জিত ও পর্যুদস্ত।
অর্থউপদেষ্টা তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ২০০৬-২০০৭ চলতি অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ২১ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে চলতি অর্থবছরে এপ্রিল পর্যন্ত কর-রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। বৈদেশিক উৎস থেকেও কাক্সিক্ষত সম্পদ পাওয়া যায়নি। এসব কারণে সংশোধিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ২৬ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পুননির্ধারণ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে প্রাক্কলিত অনুন্নয়ন ব্যয় ৪২ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার ২১৮ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪ হাজার ৫০৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ প্রাক্কলিত আয় লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে থাকলেও ব্যয় কিন্তু বেশি হচ্ছে ২২শ কোটি টাকার অধিক। বলাবাহুল্য যে, এ অতিরিক্ত ব্যয় জোগানোর জন্য হয় বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়ে তাদের অসংখ্য শর্তের বেড়াজালে আটকে যেতে হবে নতুবা ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের বোঝা আরো বাড়াতে হবে।
মোটকথা, প্রথমে মোটা অংকের ব্যয়ের হিসাব কষে এরপর নানান উপায়ে তা আয় করার মানসিকতা ইসলাম সমর্থন করে না।
প্রচলিত বাজেট তথা রাষ্ট্রীয় অর্থ-ব্যবস্থায় সরকারের আয়ের মূল উৎস জনগণের উপর আরোপিত কর। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক অনুদান এবং দেশীয় ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে নেওয়া ঋণ দ্বারাও সরকারের অর্থের জোগান হয়ে থাকে। বর্তমান কর-ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই একেকটি পণ্যের জন্য নাগরিকদেরকে কয়েক স্তরে বিভিন্নভাবে ট্যাক্স দিতে হয়। এছাড়া ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের ২৫%-৪৫% আয়কর তো রয়েছেই। বলাবাহুল্য, এ বহুবিধ বিশাল ট্যাক্সগুলোর সিংহভাগের বোঝা বহন করে থাকে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণ। ব্যবসায়িক পণ্যের ট্যাক্সগুলো জনগণ মূল্যবৃদ্ধি ও ভ্যাটের মাধ্যমে সরাসরিই বহন করে থাকে আর ব্যক্তি ও কর্পোরেট খাতের ট্যাক্সসমূহও পরোক্ষভাবে বহন করতে হয় সাধারণ ভোক্তা ও মেহনতি গণমানুষকেই। অর্থাৎ বর্তমান কর-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তিটিকেও তার সামান্য ভরণ-পোষণের জন্য কোনো না কোনোভাবে ট্যাক্স আদায় করতে হয়।
ইসলাম এ ধরনের করারোপকে সমর্থন করে না। বরং সাধারণ জনগণের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা এবং তাদেরকে সম্ভাব্য স্বল্প মূল্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রাপ্তিতে সহযোগিতা করার জন্য ইসলামী সরকার শরীয়ত কর্তৃক নির্দেশিত।
প্রচলিত বাজেটের অর্থ উপার্জনের আরো দু’টি উৎস হল বৈদেশিক অনুদান ও বৈদেশিক ঋণ। এর মধ্যে ঋণের জন্য পরিশোধ করতে হয় সুদ, যা শরীয়তে পরিষ্কার হারাম। আর বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান উভয়টির জন্য দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কী পরিমাণ হুমকি ধমকি শুনতে হয় এবং কত অযাচিত শর্তের গ্যাড়াকলে এদেশের জনগণকে পড়তে হয় তা কারো অজানা নয়। উদাহরণস্বরূপ এবারের বাজেটের কথাই ধরা যাক। প্রস্তাবিত এ বাজেটে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ইচ্ছায় আমদানি শুল্ক কাঠামোতে যে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে তাতে সামান্য কিছু সুবিধার জন্য দেশীয় শিল্প ও অর্থনৈতিক ভিত্তির কী পরিমাণ ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। বিদেশি পণ্য সহজ শর্তে আমদানির সুযোগ দেওয়ায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের লোকজন যে কী দারুন খুশি হয়েছেন তা তো ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
ইসলাম মাথানত করে নিতে হয় এমন যেকোনো অনুদানকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে অনুপ্রেরণা দেয় এবং ঋণ ও অনুদানের রাস্তা পরিহার করে স্বনির্ভর হতে শেখায়। ব্যক্তি পর্যায় থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে স্বনির্ভরতা অর্জনের গাইডও ইসলামে রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে ইসলামী অর্থনীতির আলোকে পরিচালিত রাষ্ট্রের আয়ের উৎস কী হবে এবং প্রচলিত কর-ব্যবস্থা ও বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান ছাড়া রাষ্ট্র চলবে কী দিয়ে?
এ প্রশ্নের জবাবের আগে জানা দরকার যে, ইসলামী ভাবধারা পুষ্ট বাজেটের ব্যয় হবে আরো অনেক কম এবং খরচের খাতগুলোতেও থাকবে বর্তমানে প্রচলিত বাজেট কাঠামো থেকে অনেক ভিন্নতা। যেমন বর্তমানে বাজেটের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি ব্যয় হয় অনুন্নয়ন খাতে আর বাকি এক তৃতীয়াংশের কম বরাদ্ধ থাকে উন্নয়ন খাতেরজন্য, তাও আবার বছর শেষে কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ ২০০৭-২০০৮ এর বাজেটকে নেওয়া যেতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা (বিপিসির দায় বাবদ ৭,৫২৩ কোটি টাকা ছাড়া।) পক্ষান্তরে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬,৯৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেটের বৃহৎ অংশই হল অনুন্নয়ন ব্যয়। তার মধ্যে আবার অর্ধেক পরিমাণ চলে যায় বেতন-ভাতা প্রদান ও সুদ পরিশোধ খাতে। প্রস্তাবিত বাজেটের বিবরণে দেখা যায়, এ দুটি খাতে অনুন্নয়ন ব্যয় বাবদ মোট বরাদ্দের ৪৬.৬০% খরচ করা হবে, যার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে পুরো বাজেটের মোট বরাদ্দের ১৩.৫% রাখা হয়েছে সুদ পরিশোধের জন্য যা এবারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ।
ইসলামী নীতিমালা ও আদর্শ অনুসরণ করলে কিন্তু এখাতের খরচ আরো অনেক কমে যাবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে ইনসাফ ও সাম্য। কারণ ইসলাম সর্বপ্রকার অপচয় ও বেদরকারি খরচ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ দায়িত্বশীলদের নিকট সম্পূর্ণ আমানত, যার একটি পয়সাও অপ্রয়োজনে ও অননুমোদিত খাতে ব্যয় করা সরাসরি দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত।
এবার নমুনাস্বরূপ রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের কিছু অপচয়ের উদাহরণ দেখা যাক-
১. বড় আকারের সরকার
কোনো নিয়ম-নীতি না থাকায় বর্তমানে সরকারপ্রধানগণ তাদের ইচ্ছামতো সরকারের সাইজ দীর্ঘ করে থাকেন। ৬০ এর অধিক সংখ্যার মন্ত্রীসভাও এ দরিদ্র দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। আর তাদের ও তাদের পিএস, এপিএস, পিএ ও এপিএদের বেতন-ভাতা, অফিস, টেলিফোন, বাড়ি-গাড়ি ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের পেছনে গরীব জনগণের ট্যাক্সের কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে তার সঠিক হিসাব কি কখনো করা হবে।
২. আমলাতান্ত্রিক জট
সরকারি কোনো অফিস আদালতে কেউ সামান্য কাজের জন্য কখনো গিয়ে থাকলে তাকে আর এ বিষয়ে বুঝিয়ে বলার দরকার হবে না। একটি কাজের জন্য কত টেবিলে কতদিন যাবৎ ঘুরতে হয় তা ভুক্তভোগীদের অজানা নয়। এর উপরে উৎকোচের ওপেন সিক্রেট বিষয়টি তো রয়েছেই। যেখানে ২ জন লোক যথেষ্ট সেখানে ১০ জন লোক, যেখানে সর্বোচ্চ ২টি স্বাক্ষর যথেষ্ট সেখানে ক্ষেত্র বিশেষে ৪০/৫০টি স্বাক্ষরের নিয়ম শুধু সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাসই তুলছে না, বরং রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির পেছনেও বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।
অথচ মাঝে মাঝেই দেখা যায়, বড় বড় অফিসারদের ওএসডি করে বেকার বসিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। এমনকি কোনো কোনো সরকারের আমলে তো ৫০০ -এর অধিক সচিব, যুগ্ম সচিব ও প্রথম শ্রেণীর অফিসারদের ওএসডি করে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন যাবৎ।
বুঝা যাচ্ছে যে, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য অতিরিক্ত বোঝা। রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স বিমানের কথাই ধরা যাক, সম্প্রতি সেখান থেকে এক চর্তুথাংশেরও বেশি লোক ছাটাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরপরও তো বিমান চলবে। তাহলে বছর বছর ধরে তাদের পিছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হল কোন যুক্তিতে?
প্রচলিত ব্যবস্থার আরেকটি বড় অযৌক্তিক দিক হচ্ছে বেতন বৈষম্য। দেখা যায়, বেতন-ভাতার সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তরের ব্যবধান আকাশ-পাতাল অথচ জিনিসপত্রের দাম কিন্তু সকলের জন্যই সমান। ইসলাম বেতননীতির এ বৈষম্যকে কোনো মতেই সমর্থন করে না। শুধু নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী হওয়ার কারণে কেউ এত কম বেতন পাবে না যা তার সংসারের ন্যূনতম জরুরি খরচাদি পুরো করার জন্যও যথেষ্ট নয়। আবার বড় অফিসার হওয়ার বদৌলতে কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনগণের টাকার বড় অংকের বেতন-ভাতা ও বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করবে এমন সুযোগও ইসলামে নেই। খোদ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং মন্ত্রী-এমপিদেরকে ইসলাম এ অধিকার দেয়নি।
ছোট একটি উদাহরণ এক্ষেত্রে টানা যেতে পারে। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর একদিন মাথায় পুটলি নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে হযরত উমরের সাথে দেখা হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন? বাজারে কাপড় বিক্রি করতে যাচ্ছি, খলীফার উত্তর। তাহলে রাষ্ট্র চলবে কীভাবে? কিন্তু আমার পরিবারের খরচ তো চালাতে হবে। এ কথোপকথনের পর হযরত উমর রা. খলীফাকে নিয়ে গেলেন হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফের রা. নিকট। তিনি সব কিছু শুনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এটুকু সম্পদ নেওয়ার পরামর্শ দিলেন যা কোনো মতে কষ্ট করে খলীফার পরিবারের খরচ বহনে সক্ষম। সাথে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেন, জনগণের সম্পদ থেকে এর অতিরিক্ত আমি আপনাকে নেওয়ার অনুমতি দিতে পারব না।
এ জামানায় আবু বকর রা. ও উমর রা. -এর মত হওয়া যদি সম্ভব না হয় তাই বলে তাঁদের মহান আদর্শ থেকে আলো গ্রহণ করে কমপক্ষে আয়েশী জীবন-যাপন এবং অপচয় পরিহার করাও কি সম্ভব নয়?
একজন ব্যক্তি যত বড় রাষ্ট্রীয় পদেই অধিষ্ঠিত থাকবেন, ইসলামের দৃষ্টিতে তাকে হতে হবে সে পরিমাণ আমানতদার ও নিষ্ঠাবান। বড় পদ যেমন সম্মানের তেমনি দুনিয়া ও আখেরাতে তার জবাবদিহিতাও অনেক। এটি জনগণের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করার সুযোগ, বিভিন্নভাবে তাদের সম্পদ ভোগ করার উপলক্ষ নয়।
৩. প্রসঙ্গ : জাতীয় সংসদ
জাতীয় সংসদের কোরাম সংকট এবং সরকার ও বিরোধী সদস্যদের অযাচিত বাকবিতণ্ডা রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয়ের একটি বড় নজির। আইনসভার সম্মানিত সদস্যদের আইন প্রণয়নের বদলে সংসদে উপস্থিত না হয়ে কোরাম সংকটে ফেলা এবং উপস্থিত হলেও নেতা-নেত্রী বন্দনা ও অযৌক্তিক পক্ষপাতিত্ব ও বিরোধিতায় লিপ্ত থেকে প্রতিদিন জনগণের লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করার বিষয়ে সংবাদপত্রগুলোতে কম লেখালেখি হয়নি।
৪. দামি গাড়ি ও গাড়িবহর
যে দেশের জনগণের বৃহদাংশ চরম দারিদ্র্যের মাঝে বাস করে সে দেশের দায়িত্বশীলগণ এবং সরকারি কর্মকর্র্তাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দামি গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া কেমন অপচয় তা বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। এছাড়া আমাদের সমাজে গাড়িবহর বলে একটি কথা আছে। অমুক সাহেবের গাড়িবহর আসছে, তমুক সাহেবের গাড়িবহর যাচ্ছে। মনে হয় যেন একটি দু’টি গাড়ি দিয়ে এখন আর বড়ত্বের পরিচয় হয় না, বরং প্রয়োজন গাড়িবহর, সাথে থাকতে হবে বহু অধীন লোক ও সমর্থক। তাহলে এত গাড়ির মূল্য, তেল-খরচ, চালক-খরচ ও পরিচালনা ব্যয় কে বহন করবে?
৫. অবহেলা জনিত খরচ
রাষ্ট্রের এমন বহু খরচ হয়ে থাকে যেগুলো পরবর্তীতে শুধু গচ্চা হিসেবেই গণ্য হয়। যেমন কোনো অবকাঠামো নির্মাণ-ত্রুটির কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া, কারো গাফলতি বা দুর্নীতির কারণে কোনো কিছু বেশি মূল্যে খরিদ হওয়া ইত্যাদি। এ সকল অপচয় ইসলাম কোনো মতেই বরদাশত করবে না, বরং এর সম্পূর্ণ জরিমানা বর্তাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাঁধে। এমনিভাবে শুধু জেদাজেদির বশবর্তী হয়ে অপব্যয় করার নজির হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে গত অক্টোবর থেকে জানুয়ারির প্রথম ভাগ পর্যন্ত রাষ্ট্রের খচরগুলোকে, যেখানে শুধু বাতিল হয়ে যাওয়া ইলেকশন বাবদ নির্বাচন কমিশনের খরচ ২শ কোটি টাকার বেশি!
৬. সাজসজ্জা, বিলাসিতা ও আপ্যায়ন
রাষ্ট্রীয় টাকায় কত প্রকারের সাজসজ্জা ও বিলাসিতা হয় এবং বিভিন্ন পার্টিতে কত টাকা আপ্যায়ন ইত্যাদি বাবদ খরচ হয় তার হিসাব জনগণ পর্যন্ত খুব কমই পৌঁছায়। এ দেশের ক্ষমতাবানদের মধ্যে ব্যতিক্রমির রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। তিনি বঙ্গভবনের জন্য আপ্যায়ন বাবদ বরাদ্দের কয়েক লক্ষ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় আতিথেয়তায়ও কমতি করেননি।
এ ধরনের আরো অসংখ্য উদাহরণ রাষ্ট্রীয় অপব্যয়ের নজির হিসেবে পেশ করা যেতে পারে। গভীরভাবে হিসাব করলেই দেখা যাবে, এসকল অপব্যয় রোধ করা সম্ভব হলে রাষ্ট্রের খরচ কতগুণ হ্রাস পায়। খরচ যখন কমবে তখন আয় কম হলেও চলবে। ট্যাক্সের বোঝাও জনগণের উপরে চাপাতে হবে না। আর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা সুদও পরিশোধ করতে হবে না।
আয়ের উৎস
ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আয়ের উৎসগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে সমাজে ইনসাফ ও সাম্য সৃষ্টি হয়, অর্থের সুষম বণ্টন হয় এবং গরীব ও ধনীর ব্যবধান হ্রাস পায়। এ ব্যবস্থায় যে সকল উৎস থেকে সরকারের কোষাগারে অর্থ আসবে সেগুলো হল :
১. উশর
যে সকল জমি উশরী সেগুলোর ফসল যদি সেচের মাধ্যমে উৎপাাদিত হয় তবে সে ফসলের ৫% আর যদি ফসল উৎপাদনে সেচের প্রয়োজন না হয় তাহলে ১০% রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে।
২. খারাজ
উশরী নয় এমন জমিতে সরকার কর্তৃক অর্পিত স্বল্প হারে শুল্ক প্রদেয় হবে; যাকে খারাজ বলা হয়।
৩. জিযিয়া
ইসলামী সরকারের অধীনে বসবাসকারী অমুসলিমদের উপর কোনো উশর আরোপিত হবে না, বরং তাদেরকে প্রত্যেকের সাধ্যানুযায়ী নির্ধারিত হারের শুল্ক দিতে হয়, যাকে বলা হয় জিযিয়া।
৪. যাকাত
ইসলামী সরকারের অন্যতম আয়ের উৎস হল যাকাত। নির্ধারিত নেসাবের মালিক ধনী ব্যক্তিদেরকে তাদের যাকাতযোগ্য সম্পদের ২.৫% প্রদান করতে হয় গরীব-দুঃখীদের জন্য। এছাড়া উট, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদির খামারের মালিকদেরকে নির্ধারিত হারে যাকাত দিতে হয়।
৫. খনিজ সম্পদ
রাষ্ট্রের যেকোনো খনিজ সম্পদের ৫% সরাসরি বাইতুল মালের প্রাপ্য।
৬. গনীমতের শতকরা ৫%
৭. পরিত্যক্ত ও লাওয়ারিশ সম্পদ
৮. বাইতুল মালের জন্য ওয়াকফকৃত সম্পত্তি এবং তা থেকে অর্জিত আয়
৯. স্বেচ্ছায় প্রদত্ত অনুদান
১০. অন্তর্বর্তীকালীন বিশেষ ট্যাক্স
উপরোক্ত উৎসগুলো থেকে অর্জিত আয় যদি কোনো সময় জরুরি খরচাদি পূরণের জন্য যথেষ্ট না হয় তবে সাময়িক ভিত্তিতে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের উপর বিশেষ শুল্ক আরোপের সুযোগ রয়েছে। যেমন কোনো সময় বন্যা, জালোচ্ছ্বাস বা এ ধরনের অন্য কোনো বড় বিপদ দেখা দিলে অথবা কখনো দুর্ভিক্ষ ও মহামারী সৃষ্টি হলে ওই সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। কারণ ইসলামের বিধান হল, গরীব-দুঃখীরা মোটামুটি খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে তাদের প্রতি এতটুকু দায়িত্ব ধনীদের রয়েছে। সুতরাং কোনো সময় যদি সাধারণ নিয়মে অর্জিত সম্পদ যথেষ্ট না হয় তবে সংকটকালীন সময়ে ধনীদের উপর অন্তর্বর্তীকালীন শুল্ক আরোপের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া এ ধরনের ক্ষেত্রে তাদের থেকে সুদবিহীন করজও গ্রহণ করা যেতে পারে।
উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলো ছাড়া সাধারণ জনগণের উপর শুল্ক আরোপের সুযোগ ইসলামী অর্থনীতিতে নেই। এমনকি দরিদ্র অমুসলিম বাসিন্দাদের থেকেও জিযিয়া ও কর আদায়ের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২য় খলীফা হযরত উমর রা. থেকে এবিষয়ে একাধিক বর্ণনা রয়েছে। মোটকথা, বর্তমানের ভ্যাট ও পরোক্ষ ট্যাক্স পদ্ধতি যা সরাসরি ভোক্তা সমাজের উপর অর্পিত হয়ে থাকে তার কোনো সুযোগ ইসলামী অর্থব্যবস্থায় নেই। ২ টাকা, ৫ টাকার সামান্য জিনিস কেনার ক্ষেত্রে এমনকি একটি ট্যাবলেট-ক্যাপসুল খরিদের সময়ও সকলকেই পরিশোধ করতে হয় ভ্যাট-ট্যাক্স। এমনকি যদি লোকটি ভিক্ষুক বা সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তিটিও হয়ে থাকে। অর্থাৎ ট্যাক্স যে শুধু কম প্রয়োজনীয় বা বিলাস দ্রব্যাদির উপর আরোপিত হয় তা নয়; বরং চলতি ব্যবস্থায় খাদ্য, বস্ত্র, পানীয়, বাসস্থান (তৈরির উপকরণাদি), জ্বালানী, ওষুধ-চিকিৎসা ইত্যাদি খাতগুলো যা ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলেরই দরকারি এগুলোর কোনোটিই ট্যাক্সের আওতামুক্ত নয়। তাহলে যেন ট্যাক্স বা বাজেটের জন্যই জনগণ, জনগণের জন্য ট্যাক্স-বাজেট নয়। পক্ষান্তরে ইসলামী নীতিতে বাজেট হবে জনগণের জন্য, সাধারণ দরিদ্র সমাজের দুঃখ, দুর্দশা লাঘব ও সমাজের কল্যাণ সাধনের জন্য। রাষ্ট্রের সকল আয়-সম্বলহীন বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা এবং নিজের আয়-রোজগারে সংসারের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হয় না এমন পরিবার, বৈধ কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে যাওয়া লোকজনের মোটামুটি জীবনধারণ হয় এ পরিমাণ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত সরকারের অপরিহার্য কর্তব্য।
পুঁজিবাদী নীতিতে পরিচালিত অর্থব্যবস্থার বাজেটগুলোতেও দুঃখী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ থাকে। যেমন ২০০৭-০৮-এর জন্য ঘোষিত বাজেটেও বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধী সহায়তা, বিধবা ও দুঃস্থ মহিলাদের জন্য প্রত্যেক ক্ষেত্রে মাসিক ২২০ টাকা করে ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা পূর্বের বছরে ছিল ২০০ টাকা করে। আর এসব ভাতার সুবিধাভোগী নির্ধারণ করা হয়েছে মোট সাড়ে ছাব্বিশ লক্ষ লোক। হিসাব কষলে দেখা যায়, এক্ষেত্রে মোট বরাদ্দ হয়েছে ৭ শত কোটিরও কম টাকা এবং পরিতাপের বিষয় হল তা মোট বাজেটের ১% এরও কম। যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ দরিদ্র এবং জনসংখ্যার ১ তৃতীয়াংশেরও বেশি দারিদ্র্যপীড়িত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে সেখানে উপরোক্ত খাতে বাজেটের ১% এরও কম বরাদ্দ থাকে (তাও এ বছর বৃদ্ধি করার পর) এ বিষয়টিই প্রচলিত পদ্ধতির অর্থব্যবস্থা ও বাজেটের কিছুটা পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম।
ব্যক্তি খাতের ট্যাক্সের চিত্রও বিস্ময়কর। ২০০৬-০৭ অর্থ বছরের করমুক্ত আয়সীমা হল ১,২০,০০০ টাকা যা ২০০৭-০৮ এর প্রস্তাবিত বাজেটে করা হয়েছে ১,৫০,০০০ টাকা। অর্থাৎ কেউ মাসিক ১২,৫০০ টাকা গড়ে আয় করলেই সে ট্যাক্সের আওতায় আসবে। তাকে ঞওঘ নিতে হবে এবং ট্যাক্স রিটার্ন দায়ের করতে হবে। অথচ বর্তমান উচ্চমূল্যের বাজার খরচ, বাসা ভাড়া ও চিকিৎসা খরচাদি আদায় করতে গেলে উক্ত আয় যে কত নগণ্য তা বলাই বাহুল্য।
বাজেট নিয়ে বলার মতো আরো অনেক কিছুই আছে। কারণ বাজেটের সম্পর্ক অর্থনীতির সাথে। একটি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে রয়েছে ইসলামী অর্থনীতির বাস্তবমুখী নির্দেশনা। আলকুরআনুল কারীম, পবিত্র হাদীস-গ্রন্থগুলোর সংশ্লিষ্ট অধ্যায় ও ফিকহে ইসলামী গভীরভাবে অধ্যয়ন করলেই এসব পাওয়া যাবে। ইমাম আবু উবায়দ রচিত ‘কিতাবুল আমওয়াল’, কাজী আবু ইউসুফের ‘কিতাবুল খারাজ, শায়খ আব্দুল হাই ‘কাততানীর আততারাতীবুল ইদারিয়্যাহ’ এবং বর্তমান যুগের ইসলামী অর্থনীতির বিজ্ঞ আলেমে দ্বীনদের কিতাবাদি এ বিষয়ের জন্য পড়া যেতে পারে।