ফিতনা : ২
কৌশলযুক্ত বিয়ের আগে-পরে
তিন তালাকের মাধ্যমে ভেঙ্গে যাওয়া কোনো পারিবারিক বন্ধনকে কি আবার জোড়া দেওয়া যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে পবিত্র কুরআন-হাদীস এবং এতদুভয়ের নির্যাস ইসলামী ফিকহের আলোকে বলা যায়- এ সম্পর্ক জোড়া লাগানোর সহজ, স্বাভাবিক কোনো বিধান ইসলামে নেই। ইদ্দত শেষে তালাকপ্রাপ্তা সেই নারীর যদি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয়, বিবাহের পর সেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যদি পূর্ণ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং তারপর যদি তালাক সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের দাম্পত্য বিচ্ছিন্ন হয় তাহলে আবারো যথারীতি ইদ্দত পালনের পর ওই নারীর সঙ্গে তার পূর্বের স্বামীর বিবাহ সংঘটিত হওয়া বৈধ। এটাই ইসলামের বিধান। তিন তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দাম্পত্য আসলে শেষই হয়ে যায়। এরপর শেষ হয়ে যাওয়া সে সম্পর্ককে পেতে হলে পরবর্তী ঘটনাগুলোর পরই পেতে হবে। অন্যভাবে নয়। এখন পরবর্তী ঘটনাগুলোও ‘যদি’গুলোকে যদি কেউ পরিকল্পিতভাবে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে করিয়ে নিতে চায় বা করিয়ে নেয় তাহলে সেটাকেই বলা হয় ‘হীলা বিবাহ’। আরবী ‘হীলা’ শব্দের অর্থ কৌশল। কৌশলী এ বিবাহটিই আমাদের সমাজ ও মিডিয়ায় ‘হিল্লা বিয়ে’ নামে পরিচিত।
‘হীলা বিবাহ’ বা ‘হিল্লা বিয়ে’ ইসলামের বিধিবদ্ধ কোনো অনুশাসন নয়। এটা এ বিয়ের নাম থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। ইসলামে কৌশলমুক্ত ও কৌশলযুক্ত বিবাহ বলতে কিছু নেই এবং এ ধরনের কৌশলী বিয়ে যিনি করেন এবং করাতে উদ্যোগী হন তাদের ব্যাপারে সহীহ হাদীসে আল্লাহ তাআলার লা’নত বর্ষণের কথাও ঘোষিত হয়েছে। সে হিসেবে হিল্লা বিয়ে করা হচ্ছে কবীরা গুনাহ। এ কবীরা গুনাহে যে পুরুষ যুক্ত হয়ে যায় হাদীসের ভাষায় তাকে ধার করা ‘পাঠা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও এ ধরনের বিবাহ হয়ে যথানিয়মে বিচ্ছিন্ন হলে এই নারীকে যে আগের স্বামী বিয়ে করতে পারেন-এ বিধানটির কোনো তারতম্য এতে ঘটে না। ফলে তালাক কার্যকর করার উপযুক্ত বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ ও মাথাগরম সমাজের কেউ কেউ তিন তালাকের দুর্ঘটনা এক সঙ্গে ঘটিয়ে চোখের পানি, বুকের পানি এক করে আবার পূর্বের দাম্পত্য জীবনে যেতে চাইলে এই অশোভন ও রুচিহীন কৌশলী বিবাহের আশ্রয় নিতে নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে থাকেন। কোনো কোনো এলাকায় বা সমাজে এ ধরনের ঘটনার মাত্রা বেশি পরিমাণে ঘটতে দেখা যায়। এ রকমই বগুড়ার একটি গ্রামের হিল্লা বিয়ের ঘটনা নিয়ে এখন এক শ্রেণীর মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে। হিল্লা বিয়ের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে এর জন্য ফতোয়া, আলেম সমাজ ও ইসলামী অনুশাসনকে দায়ী করে এ ধরনের বিয়ে আইন করে বন্ধের দাবিও উঠেছে। এক সঙ্গে তিন তালাক, হিল্লা বিয়ে এবং জীবনের দুর্ভাগ্যজনক চক্রে বাঁধা পড়ে এভাবে একজন নারীর জীবনে যে ঝড় ও গ্লানি বয়ে যায় তাতে ইসলামী মাসায়েল ও অনুশাসনের সাথে ক্ষীণতর সম্পর্ক রাখা আমাদের দেশের মিডিয়া ও কথিত শিক্ষিত সমাজে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ তর্কাতর্কি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
হিল্লা বিয়ের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে সেটাকে নেতিবাচকভাবে না দেখেই আমরা কথা বলতে পারি। প্রথমে হিল্লা বিয়ের কারণ খুঁজে দেখা যাক। এ নিয়ে আপত্তি উত্থাপনকারীদের কথা হচ্ছে, এটা সামাজিক চাপের কারণে হয়ে থাকে। অতএব আইন করে এটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, সামাজিক চাপ যদি না থাকে আর বিয়ে যদি আরেকটি না হয় তাহলে কি তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী এক সঙ্গে ঘর করতে পারবেন? ইসলামী শরীয়তের আলোকে তো এ প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’ হতে পারে না। তাহলে হিল্লা বিয়েও বন্ধ হবে, এক সঙ্গে ঘর করাও বন্ধ হবে। তালাকদাতা স্বামী বা তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী এটা মেনে নিয়ে কি বাকী জীবন বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করতে সম্মত থাকবেন? তারা সম্মত থাকলে তো এ বিষয়ে কোনো সমস্যাই থাকে না। আর যদি বিচ্ছিন্ন থাকতে তারা সম্মত না হন তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? তিন তালাকও হবে, দ্বিতীয় কোনো ধরনের বিয়েও হবে না এবং এক সঙ্গে ঘর-সংসারও হবে। যে ইসলামী বিধান অনুযায়ী সংসারের সূচনা, অবৈধ ও অনৈতিক যৌনাচার থেকে বেঁচে সুন্দর-সুষ্ঠু দাম্পত্য জীবন অবলম্বনের জন্য যে অনুশাসন ও নীতির আশ্রয় গ্রহণ এতে কি তার কোনো কিছু রক্ষা হয়? নিজেরা আইন করে এটা ঠিক,ওটা বেঠিক বলে দিলেই কি দাম্পত্যের পবিত্রতা বজায় থাকবে? রুচিহীন হিল্লা বিয়ে বন্ধ করার এবং এর জন্য ইসলামী অনুশাসন ‘ফতোয়া’ নিয়ে বিষোদগার করার সময় এ প্রশ্নগুলো সামনে রাখলে উত্তর পেতে সহজ হবে।
আরো আগে থেকে যদি আমরা ভাবতে চেষ্টা করি তাহলে দেখব এর মূল হচ্ছে, শরীয়তের বিধান না মেনে এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়ে দেওয়া। পবিত্র কুরআন-হাদীসে কঠোরভাবে নিষেধ করা হলেও এ ধরনের ‘তিন তালাক’ থেকেই এসব সমস্যার উৎপত্তি। ঠাণ্ডা মাথায় পর্যায়ক্রমে তিন তালাক কার্যকর করার যে বিধান ইসলামে রয়েছে সে বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করলে এ ধরনের সমস্যারই সৃষ্টি হতে পারে না। যেহেতু শরীয়তের দৃষ্টিতে চরম অপছন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও তিন তালাক এক সঙ্গে দিলে তালাক হয়েই যায় এবং চুড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা সম্পন্ন হয় সেজন্য তিন তালাক এক সঙ্গে দেওয়ার দরজা বন্ধ করার আইনী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এটা যেমন মানবিক তেমনি শরীয়তসম্মত একটা পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে। এর মানে তো এবার এটা হতে পারে না যে, আইন করে দিলাম, তিন তালাক এক সঙ্গে দিলেও তালাক হবে না। পাকিস্তান আমলে প্রণীত পারিবারিক আইনে এ ধরনের ধারাই বিদ্যমান। তখন একই সমস্যা ঘুরে ফিরে আসে। মুসলমানদের জন্য বিবাহ নামক বন্ধন ও প্রতিষ্ঠানটি তো ইসলামী শরীয়ত নির্দেশিত একটি বৈধ ও নৈতিক বিষয়। সেক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দেশনা অতিক্রম করে কোনো আইন প্রণয়ন করলে কিংবা প্রণীত সে আইন মানলে যদি দাম্পত্য অক্ষুণ্ণ থাকে তাহলে তো সমস্যা হতো না। আইন করে বা সে আইন মেনে কিংবা বিয়ে না করেও কারো সঙ্গে জীবনকে জড়িয়ে চলে আমি, আপনি লোকচোখ ও সমাজের সংকট হয়তো অতিক্রম করেই গেলাম, সমস্যা হলো না, কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা কোন ধরনের দাম্পত্য হবে সেটাও তো ভেবে দেখতে হবে।
সুতরাং ‘ফতোয়া’ ও আলেম-উলামাদের প্রতি বিষোদগর না করে নারীর জন্য অবমাননাকর ও গানিকর হিল্লা বিয়ে বন্ধ করতে হলে ‘এক সঙ্গে তিন তালাক’ দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারিমূলক আইন ও পদক্ষেপ নেওয়াটাই হবে প্রধান কাজ। এর জন্য মাথা গরম, মূর্খ ও চরম অসংযত মানুষদের সামনে এক সঙ্গে তিন তালাকের বিষয়ে ভীতিকর কিছু আইনী ও বা¯তব পদক্ষেপ গৃহীত হলে এতে ঘর সংসার, নারীর সম্মান-মর্যাদা সুরক্ষিত হতে পারে বলে আমরা মনে করি। একজন বিষ খেয়েছে। পেট থেকে সে বিষ বের করার জন্য তাকে মল খাইয়ে বমি করানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে। ‘মল’ খাওয়ানোর মতো ঘৃণ্য ও বিড়ম্বনাকর বিষয়টি বন্ধ করে দিতে সোচ্চার হয়ে বিষ খাওয়ার দরজা খোলা রাখলে যা হওয়ার তাই হবে। সুতরাং বিষ খেতেই আগে বাধা দিতে হবে। এখানে প্রশ্নটি সমাজ বা আইনের চাপের নয়,নিজের কাছে নিজের স্বচ্ছতার এবং আল্লাহ তাআলার কাছে জবাবদিহিতার। তা না হলে তো এ সমাজে সীমিত পরিসরে হলেও আইনের আশ্রয়ে ও আইনের ভাষায় নারীর দেহ ব্যবসা ও মদের ব্যবসার ‘বৈধতা’ বিদ্যমান। সুদ তো আইনের চোখে ‘বৈধই’ এবং বহুল চর্চিত। এর মানে কি এই যে, ইসলামী অনুশাসনেও এগুলোকে ‘বৈধ’ বলতে হবে?
ইসলামী অনুশাসন, নীতিমালা ও আদর্শের আলোকেই মুসলমানদের দাম্পত্য জীবন-যাপন করা উচিত। এখানে তালাক ও হিল্লা বিয়ের মতো বিষয়গুলোতে ইসলামকে অতিক্রম করার ভাবনা বর্জন করে ইসলাম নির্দেশিত সংযমশীলতা ও ধৈর্য অবলম্বন করেই উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে।
গ্রন্থনা : ওয়ারিস রব্বানী