Jumadal Ula 1428   ||   June 2007

নবীজীর স্নিগ্ধ হাসি

রহমতের বৃষ্টি এল

একবার মদীনায় ও তার আশেপাশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। খরা ও অনাবৃষ্টিতে পশু পাখি পর্যন্ত অস্থির হয়ে উঠল। একদিন জুমার সময় যখন নবী করীম সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন, তখন এক সাহাবী দাড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, খরায় সব গাছপালা শুকিয়ে গেছে, উট-ঘোড়া দানাপানি না পেয়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে, মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাই আপনি দুআ করুন, আল্লাহ যেন আমাদের বৃষ্টি দান করেন। নবীজী সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে দুআ করলেন-ইয়া আল্লাহ, বৃষ্টি দাও, ইয়া আল্লাহ, বৃষ্টি দাও। মদীনায় সিল নামে একটি পাহাড় ছিল। নবীজীর দুআর সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের পিছন থেকে এক খণ্ড মেঘ ভেসে এল এবং সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে দেখতেই চারদিক অন্ধকার হয়ে এল এবং নবীজী মিম্বর থেকে অবতরণের আগেই রহমতের বৃষ্টি আরম্ভ হল। বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। এদিন পুরোদিন বৃষ্টি হল এবং একে একে সাতদিন পর্যন্ত অবিরাম বৃষ্টি হল। পরবর্তী জুমায় আবার এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, পানির স্রোতে সব কিছু ভেসে যাচ্ছে। মাটির ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে পড়ছে। এবার দুআ করুন, যেন বৃষ্টি বন্ধ হয়। নবীজী মুচকি হাসলেন এবং দুআ করলেন। দুআটির বাংলা অর্থ- ইয়া আল্লাহ, আমাদের চারপাশে বৃষ্টি দিন, পাহাড়-টিলা, নদী-নালা এবং বৃক্ষের গোড়ায় বৃষ্টি দিন। আর আমাদের উপর থেকে বৃষ্টি সরিয়ে দিন। সঙ্গে সঙ্গে আকাশের মেঘমালা চারদিকে সরে গেল এবং মদীনার আকাশ একদম মেঘমুক্ত হয়ে গেল। -সহীহ বুখারী হা. ১০১৩, ১০২১

এরা দুজন পিতা-পুত্র

যায়েদ ইবনে হারিছা হলেন নবীজীর একজন বিশিষ্ট সাহাবী। তার পুত্র হলেন উসামা ইবনে যায়েদ। নবীজী দুজনকেই খুব ভালোবাসতেন। যায়েদ রা. প্রথমে কৃতদাস ছিলেন। নবীজী তাকে আযাদ করে দেন। সাম্যের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আপন সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। আর তার পুত্র উসামাকে ভালোবাসতেন হাসান-হুসাইনের মতো।

যায়েদ রা. ছিলেন ফর্সা আর উসামা ছিলেন কালো। তাই দুষ্ট কাফিররা তাদেরকে বিভিন্ন কট কথা বলত। আর বলত, তোমরা দুজন পিতা-পুত্র নও। কাফিরদের এই মিথ্যা অপবাদে নবীজী খুব কষ্ট পেতেন। কিন্তু একদিন তিনি খুব আনন্দচিত্তে হুজরায় এলেন। তাঁর চেহারা আনন্দে ঝলমল করছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রা.কে বললেন, জান আয়েশা, আজ কী হয়েছে? যায়েদ ও উসামা চাদর গায়ে ঘুমিয়ে ছিল, শুধু তাদের দুজোড়া পা চাদরের বাইরে ছিল। এমন সময় মিদলাজ গোত্রের মুজায়যিয় নামক ব্যক্তি তাদের পা দেখে বলল, ইন্না হাযিহিল আকদাম বজুহা মিন বাজ। অথাৎ এরা দুজন পিতা-পুত্র।

এ ঘটনায় নবীজীর আনন্দিত হওয়ার কারণ এই যে, আরবের কিছু গোত্র কিয়াফায় পারদশীর্ ছিল। কিয়াফা বলা হয় পায়ের ছাপ দেখে কিংবা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখে বংশীয় সম্পর্ক বলতে পারা। আরব দেশে কিয়াফা একটি স্বীকৃত বিষয় ছিল। তাই আরবের লোকেরা কিয়াফাবিদদের কথা মেনে নিত। যেহেতু একজন কিয়াফাবিদ যায়েদ ও উসামার পা দেখে বলল যে, এরা দুজন পিতা-পুত্র। তাই কাফিরদের আর কটুক্তি করার সুযোগ থাকল না। দুজন নিরীহ মুমিন দুষ্ট কাফিরদের অত্যাচার থেকে বেঁচে গেলেন দেখে নবীজীর কোমল হৃদয় আনন্দে ভরে গিয়েছিল।

 

এই ভূখণ্ড জয় না করে যাব না

তাইফ যুদ্ধের ঘটনা। তাইফ হল মক্কার অদূরে অবস্থিত একটি সবুজ শ্যামল জনপদ। এ যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ কাফিরদের একটি কেল্লা অবরোধ করে রেখেছিলেন। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবরোধ তুলে মদীনায় ফিরে যাওয়া সমীচীন মনে করলেন এবং বললেন, আমরা ইনশাআল্লাহ মদীনায় ফিরে যাব। কিন্তু কয়েকজন সাহাবী জিহাদী জযবা নিয়ে বললেন, আমরা এ অঞ্চল জয় না করে যাব না। তাদের একথা শুনে নবীজী বললেন, ঠিক আছে, তাহলে মোকাবিলার জন্য অগ্রসর হও। মুসলমানরা অগ্রসর হলেন। সেদিন কাফিরদের সঙ্গে তাদের প্রচণ্ড লড়াই হল এবং অনেকে আহত হলেন। দিনের শেষে নবীজী আবার বললেন, আগামীকাল আমরা মদীনায় ফিরব ইনশাআল্লাহ। এবার সবাই চুপ করে রইলেন। তাদের চুপ থাকা দেখে নবীজী  মুচকি হাসলেন। সুহীহ বুখারী, হা. ৬০৮৭

এ ঘটনা থেকে বোঝা গেল, জোশের মুহূর্তেও নবীর কথাই মেনে চলা উচিত।

তবুও তিনি রাগান্বিত হলেন না

নবীজী ছিলেন সর্বোত্তম আখলাকের অধিকারী। যারা তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত তিনি তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। আরব দেশের মরুবাসী বেদুঈনরা ছিল রুক্ষ প্রকৃতির মানুষ। নবীজী তাদের কর্কশ ব্যবহার অম্লান বদনে সহ্য করতেন।

একদিন নবীজী বাইরে থেকে ঘরে ফিরছিলেন। তাঁর গায়ে ছিল একটি মোটা পাড় বিশিষ্ট চাদর। নবীজী যখন ঘরের দরজায় পৌঁছলেন, তখন এক বেদুঈন এসে এত জোড়ে চাদর ধরে টান দিল যে, নবীজীর কোমল ঘাড়ে দাগ বসে গেল। এরপর বেদুঈনটি কর্কশ কণ্ঠে বলতে লাগল, হে মুহাম্মাদ, আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছে তা থেকে আমাকে কিছু দাও। নবীজী গেঁয়ো লোকটির এই কর্কশ ভাষা ও রুক্ষ আচরণে মোটেই রাগান্বিত হলেন না; বরং তার দিকে হাসিমুখে তাকালেন এবং তাকে কিছু মাল-সামানা দিয়ে দিলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস; ৬০৮৮

এ ঘটনা থেকে বোঝা গেল যে, সুশিক্ষা ও ভালো পরিবেশের অভাবে যারা ভদ্রতা অর্জন করতে পারেনি তাদের আচরণে রাগান্বিত হওয়া উচিত নয়; বরং তাদের অভদ্রতাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিত। এটাই হল মহানবীর আদর্শ। 

 

advertisement