আদর্শ ও সাম্প্রদায়িকতার সংঘাত
আমাদের অদ্ভূত বিচার-রীতি
মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই। কোনো একটা পক্ষ তাকে গ্রহণ করতে হয়। সত্য কিংবা মিথ্যা, ন্যায় কিংবা অন্যায় কোনো একদিকে তাকে অবশ্যই যেতে হয়। আমরাও যাই এবং কথা-কাজ, সমর্থন-বিরোধিতা ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে পরিষ্কার করি। তাই বলা যায়, নিরঙ্কুশ নিরপেক্ষতা বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই। তাই নিরপেক্ষতা নয়, দেখার বিষয় এই যে, আমরা কোন পক্ষ অবলম্বন করেছি। আদর্শের পক্ষ না সাম্প্রদায়িকতার পক্ষ।
সাম্প্রদায়িকতা বর্তমান সময়ের একটি বহুল উচ্চারিত শব্দ। তবে শব্দটি মাজলুম। বর্তমান প্রচার-প্রচারণার যুগে যে শব্দগুলো সবচেয়ে বেশি অবিচারের শিকার তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাতা একটি। আদর্শ ও আদর্শিক সংগ্রামে রত ব্যক্তিদের দুর্বল করার জন্য সাম্প্রদায়িক চেতনার অনুসারীরাই এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। একটি বিশেষ ধরনের সংকীর্ণতাকে প্রতিরোধ করার জন্য যে শব্দটি ব্যবহার করা যেত তাকে ব্যবহার করা হয় আদর্শের উদার আহবানকে প্রতিহত করার জন্য। এটা যদিও এ শব্দের প্রতি অবিচার, তবে সাম্প্রদায়িক চেতনার অনুসারীরা এ অবিচার করেই যাবেন এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাই এ জাতীয় বিভ্রান্তিজনক ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের সচেতনতা অপরিহার্য।
দুই.
পৃথিবীতে ওহীভিত্তিক আদর্শের বাহক হলেন আম্বিয়ায়ে কেরাম। প্রতি যুগে বিভিন্ন ভূখণ্ডে তাঁরা আদর্শের বাণী প্রচার করেছেন। এই আদর্শ প্রচার করতে গিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে হয়েছে। যেমন, প্রথা-অন্ধ লোকেরা তাদের বিরুদ্ধে প্রথা-বিরোধিতার শ্লোগান তুলেছে। স্বার্থপর মহল স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার অধিকারীরা শুধু এ কারণে যে, এ নবী আমাদের সম্প্রদায়ের নন, তাকে অস্বীকার করেছে। আম্বিয়ায়ে কেরাম এইসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধ-স্রোতে দাঁড়িয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে আসমানী আদর্শের প্রতি তাদের আহ্বান অব্যাহত রেখেছেন। তাদের এ আহ্বানের মূল প্রেরণা ছিল আল্লাহর আনুগত্য এবং মানব জাতির কল্যাণকামিতা। ফলে যাদের হৃদয়ে ন্যায়-নিষ্ঠা রয়েছে এবং সত্য গ্রহণের যোগ্যতা রয়েছে তারা একসময় তাদের নিঃস্বার্থ আহবানকে গ্রহণ করেছেন।নিজেদের জীবনে সে আর্দশের পূর্ণতা প্রতিফলনের সঙ্গে সেই আদর্শের প্রচার-প্রসারে নবীদের অনুগামী হয়েছেন। আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং তাদের অনুসারীদের এই নিঃস্বার্থ প্রয়াসই হল আদর্শের সপক্ষের সংগ্রাম। আল্লাহ বিস্মৃতি বিভিন্ন অমূলক ধ্যান-ধারণা, ভিত্তিহীন রীতি-রেওয়াজ এবং সকল অন্যায় স্বার্থ-চিন্তার বিপরীতে আল্লাহমুখিতা ও আখিরাতের জবাবদিহিতা ভিত্তিক আদর্শ জীবন-যাপনের আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু এই ওহীভিত্তিক আদর্শ গ্রহণের পক্ষে যে বিষয়গুলো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তার অন্যতম হল সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা।
তিন.
নবীগণের ধারাবাহিকতায় সবশেষে প্রেরিত হয়েছেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর দ্বীনের নাম ইসলাম। ইসলামের অনুসারীরা মুসলিম নামে পরিচিত। ইসলাম আরবী শব্দ। এর অর্থ হল অনুগত হওয়া। আর মুসলিম অর্থ অনুগত। কোনো সাম্প্রদায়িক প্রেরণা নয়; বরং আল্লাহর আনুগত্য কেন্দ্রিক আদর্শিক প্রেরণাই হল এ দ্বীনের মূল বুনিয়াদ। তাই এ ধর্মে ভাষা, বর্ণ গোত্র ও ভূখণ্ডগত কোনো ভেদাভেদ নেই। শুধু আদর্শের পথে অগ্রগামিতার মাধ্যেমেই এ ধর্মে সম্মান ও মর্যাদার আসন নির্ধারিত হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন—
اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللّٰهِ اَتْقٰىكُم.
‘আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাশালী সে যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে খোদাভীরু।’ —সূরা হুজুরাত ১৩
বিদায় হজ্বের ভাষণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘খোদাভীতি ছাড়া অন্য কিছুর মাধ্যমে আজমের উপর আরবের, কালোর উপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হবে না।’
চার.
সব যুগে সকল নবীর আহ্বানই আদর্শ কেন্দ্রিক ছিল। এটা ঠিক যে, কোনো কোনো নবীকে আল্লাহ শুধু তার বংশ ও জাতির জন্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তাই তাঁর দাওয়াতও তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তারা তাদের জাতিকে সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা দিয়েছেন; বরং তারা আদর্শের দাওয়াতই দিয়েছেন। সকল নবীর শিক্ষাই এই ছিল যে, তোমাদের প্রতি যে নবী প্রেরিত হয়েছেন তাঁর অনুসরণ করবে এবং আল্লাহর সকল নবীর প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস এবং ভক্তি ও শ্রদ্ধা পোষণ করবে।
হযরত ঈসা আ. ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর পূর্ববর্তী নবী। তাই ঈসা আ.-এর দাওয়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন-সংবাদ দান করা। কুরআন মজীদের সূরা মুহাম্মাদে এসেছে যে, ঈসা আ. তাঁর উম্মতকে বলেছেন, ‘হে বনী ইসরাইল, আমি তোমাদের প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। আমার পূর্বে যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে অর্থাৎ তাওরাত, আমি তাকে সত্য বলি এবং আমার পরে যে নবী আসবেন, যার নাম হল আহমদ, আমি তাঁর আগমনের সুসংবাদ প্রদান করি।’ কিন্তু কালের বিবর্তনে যখন নবীদের অনুসারীরা আসমানী আদর্শ থেকে দূরে সরে গেল তখন তাদের মধ্য থেকে আদর্শিক চেতনাও বিলুপ্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা জন্ম নিল। তাদের আদর্শিক দৈন্যের অবস্থা এই দাড়াল যে, যে দ্বীন তাদেরকে কুফর, শিরক ও বিভিন্ন ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস পরিহার করার শিক্ষা দিয়েছিল তারা তাকে বিকৃত করে কুফর ও শিরককেই ধর্মের অংশ সাব্যস্ত করল। আর সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার প্রকাশ এভাবে ঘটল যে, যে দ্বীন তাদেরকে সকল নবী রাসূলের প্রতি, বিশেষত শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস এবং ভক্তি ও মহব্বতের শিক্ষা দিয়েছিল সে দ্বীনের মহৎ শিক্ষাগুলোকে বিকৃত করে নবী-রাসূলদের অসম্মান ও অমর্যাদা এবং তাদের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকেই ধর্মের শিক্ষা বলে প্রচার করা হল। এভাবেই নবীদের শিক্ষা ও আদর্শ তাদের অনুসারী হওয়ার দাবিদার লোকদের মাধ্যমেই নির্মমভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেল এবং ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটল।
পাঁচ.
আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষবারের মতো সেই আদর্শের দাওয়াত নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর আনীত শরীয়ত সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এই প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন যে—
اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.
‘আমি এই উপদেশ নাযিল করেছি এবং আমিই তা সংরক্ষণ করব। —সূরা হিজর ৯
মহান আল্লাহর এই প্রতিশ্রম্নতির সত্যতা আমরা সচক্ষে অবলোকন করছি। ইসলামী আদর্শের মূল সূত্র কুরআন ও সুন্নাহ অবিকল পূর্বের অবস্থায় বিদ্যমান। কুরআন ও সুন্নাহর পূর্ণ সংরক্ষণের পাশাপাশি এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ‘ফিকহে ইসলামী’ নামক যে বিশাল শাস্ত্র তৈরি হয়েছে তা মানুষকে জীবনের সকল অঙ্গনে ইসলামী আদর্শের উপর বিদ্যমান থাকা সহজ করে দিয়েছে। এভাবে ইসলামের আদর্শ সংরক্ষিত ও অনুসরণযোগ্যরূপে বিদ্যমান রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম ও তাদের অনুসারীদের মতো ইসলাম কেবল একটি সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে পর্যবসিত না হওয়ার অন্যতম কারণ হল ইসলামী আদর্শের বিদ্যমানতা। কেননা, আদর্শ সংরক্ষিত না থাকলে সাম্প্রদায়িকতা এসে বাসা বাধে এবং সাম্প্রদায়িক পরিচয়টিই মূল পরিচয় হয়ে দাড়ায়।
ইসলাম যে একটি আদর্শের নাম তার একটি বড় দলীল এই যে, ইসলাম ওই আদর্শের সকল ধারক-বাহককে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। শুধু স্মরণ করে তাই নয়, পূর্ববর্তী সকল নবীর প্রতি ঈমান রাখা এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও মুহাব্বত পোষণ করা মুসলিম জাতির ঈমান ও ইসলামের অঙ্গ। মুসলিম জাতি একথাও বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যত আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তা হক ছিল এবং যে সময় তা অবতীর্ণ হয়েছে সে সময়ের জন্য এবং যে জাতির জন্য অবতীর্ণ হয়েছিল সে জাতির জন্য তা হিদায়েতের মিনার ছিল। ইহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অকল্পনীয় জুলুম-অত্যাচার ভোগ করার পরও মুসলিম জাতি হযরত মূসা আ. এবং হযরত ঈসা আ.কে আল্লাহর নবী বলেই বিশ্বাস করে। তাঁদের প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল, মুসলিমগণ সেগুলোকে আসমানী কিতাব বলেই বিশ্বাস করেন। এই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি মুসলিমগণ ধারণ করেন না যে, মুসা আ. হলেন ইহুদীদের নবী আর ঈসা আ. হলেন খৃষ্টানদের নবী। তাওরাত ইহুদীদের কিতাব আর ইঞ্জিল খৃষ্টানদের কিতাব। আমরা এগুলোকে স্বীকৃতি দেব কেন? বরং মুসলিমগণ মুসা আ. ও ঈসা আ.কে আল্লাহর নবী হিসেবে এবং তাওরাত-ইঞ্জিলকে আসমানী কিতাব হিসেবে বিশ্বাস করেন। তবে এ কথাও তারা বিশ্বাস করেন যে, বর্তমানে বাইবেল নামে যা প্রচলিত আছে তা সেই তাওরাত-ইঞ্জিল নয়, যা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছিলেন। ইহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায় এই আসমানী কিতাব দু’টিকে বিকৃত করে ফেলেছে। আর এ বিশ্বাসও তারা পোষণ করেন সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে নয়; বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ভিত্তিতেই।
পূ্র্ববর্তী নবীগণের প্রতি মুসলিম উম্মাহ কী পরিমাণ শ্রদ্ধা ও মুহাব্বত পোষণ করে তার ছোট্ট একটি দৃষ্টান্ত এই যে, মুসলিমগণ তাদের প্রিয় সন্তানদের নাম তাঁদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখেন। ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব, সুলাইমান, মূসা, হারূন, ঈসা প্রভৃতি নাম মুসলিম নাম হিসেবেই পরিগণিত। মুসলিমগণ পূর্ববর্তী নবীগণের প্রতি এ জন্যই শ্রদ্ধা পোষণ করেন যে, তারা আল্লাহ তাআলার প্রেরিত রাসূল ছিলেন এবং আল্লাহর আনুগত্যের প্রতিই মানুষকে আহ্বান করেছিলেন।
আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন নবুওতের ধারাবাহিকতার সর্বশেষ রাসূল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তাঁর শিক্ষা হল আসমানী শিক্ষা, যা আল্লাহ বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নবীর মাধ্যমে মানবজাতিকে প্রদান করেছেন। এই শিক্ষাকে অনুসরণের মাধ্যমেই পূর্ববর্তী সকল নবীর আদর্শের অনুসারী হওয়া সম্ভব। কিন্তু এই সহজ বিষয়টি বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হল সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা। এ প্রসঙ্গে মদীনার ইহুদ-নাসারার কথা উল্লেখ করা যায়। তারা নবী সা.-এর আবির্ভাবের পূর্বে তাঁর কথা বলেই ইয়াছরিবের অধিবাসীদের শাস্তির ভয় দেখাত, কিন্তু যখন তাঁর আবির্ভাব হল তখন তারা তাঁকে এ জন্য অস্বীকার করে বসল যে, তিনি ইসরাইলী বংশ থেকে আবিভূর্ত হননি! তিনি এসেছেন আরবের কুরাইশ বংশ থেকে! তবে আহলে কিতাবের মধ্যেও কিছু সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতামুক্ত আদর্শ—প্রিয় মানুষ নবীজী সা.-এর প্রতি ঈমান এনেছেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ইহুদী আলিম আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা.-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তারা সংখ্যায় খুব বেশি ছিলেন না। বরাবরের মতো সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির অধিকারী মানুষেরই সংখ্যাধিক্য ছিল। আসমানী ধর্মের পরিচয়দানকারীরা এবং মূর্তিপুজা ইত্যাদিতে নিমজ্জিত আরবের কাফের সম্প্রদায় এই সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকেই ইসলামের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছিল। তখন থেকেই ইসলামের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার সংঘাত আরম্ভ হল। এই সংঘাত ছিল আদর্শ ও সাম্প্রদায়িকতার সংঘাত।
ছয়.
বর্তমান সময়ে সবকিছুকে এক কাতারে দাঁড় করানোর একটা অন্যায় প্রবণতা প্রচলিত আছে। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, আদর্শ ও সাম্প্রদায়িকতা সবকিছুকে এক শ্রেণীভুক্ত করে তাদের মধ্যে সমতা বিধানকে ঔদার্য্য, মহত্ত্ব এবং অসাম্প্রদায়িকতা নামে আখ্যায়িত করা হয়। এটা খুব অদ্ভুত বিচার-রীতি। একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করা যেতে পারে। ধরুন, পরীক্ষার খাতায় একজন সঠিক উত্তর দিল, অন্যজন দিল ভুল উত্তর। এখন কোনো পরীক্ষক যদি উভয়কে সমান নম্বর দেন তবে কি একে ‘নিরপেক্ষতা’ বলা যাবে? অথচ ইসলামের ব্যাপারে অনেকেই উপরোক্ত ধরনের নিরপেক্ষতায় আগ্রহী। বরং অনেক মানুষ আরও এক কাঠি বেড়ে ইসলামের খাতায় শূন্য এবং অন্যদের খাতায় পূর্ণ নম্বর দিয়ে অবিচারকে কানায় কানায় সম্পূর্ণ করতেই তৎপর। এই বিচাররীতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ইসলামের দাওয়াত হল আদর্শের দাওয়াত। ইসলামের সংগ্রাম অন্যায়-অনাচারকে প্রতিহত করার সংগ্রাম। তাই ইসলামের এসব পদক্ষেপকে কখনো ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামে আখ্যায়িত করা যায় না। ইসলামের অনুসারীরা যখন সোচ্চার হন, সংগ্রামে-প্রতিবাদে অগ্রসর হন তখন তা উৎসারিত হয় একটি আদর্শিক প্রেরণা থেকে, সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধি থেকে নয়।
প্রশ্ন হতে পারে, এ দাবি তো সবাই করে থাকে। এর উত্তরের জন্য আমাদের আবার পূর্বের আলোচনায় ফিরে যেতে হবে। আমরা আগেই বলেছি, ইসলামী আদর্শের সূত্রগুলো অবিকৃতরূপে বিদ্যমানতার কথা। এ বৈশিষ্ট্য কি অন্য কোনো জাতি তাদের নিজেদের সম্পর্কে প্রমাণ করতে পারবে? তারা যদি আসমানী আদর্শের ধারক হওয়ার দাবি করেন এবং তাদের ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণাকে আদর্শিক সংগ্রাম বলতে আগ্রহী হন তবে তাদের প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে যে, তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের বিধি-বিধানগুলো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত। কিন্তু এ প্রমাণ পেশ করা কি কোনো জাতির পক্ষে আদৌ সম্ভব? মুসলিম উম্মাহ ছাড়া আর কোনো জাতি কি তাঁদের ধর্মীয় গ্রন্থের ব্যাপারে পূর্ণ আস্থার সঙ্গে এ কথা বলতে সক্ষম যে, এ গ্রন্থ আল্লাহ প্রদত্ত এবং এতে কোনো ধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন, বিকৃতি ও সংযোজন হয়নি? তদ্রূপ পৃথিবীর আর কোনো জাতির পক্ষে কি তাদের নবী বা পথ-প্রদর্শকের জীবন ও শিক্ষাকে অবিচ্ছিন্ন সনদের সঙ্গে বয়ান করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তবে প্রশ্ন হল, উৎসবিহীন একটি মতবাদকে আঁকড়ে ধরে রাখা এবং তা প্রচার-প্রসারের সকল কর্ম-তৎপরতার পিছনে মূল প্রেরণা তাহলে আর কি হতে পারে সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া? প্রচলিত বিচার-রীতিতে অভ্যস্ত চিন্তা হয়ত এসব প্রশ্নে বিচলিতবোধ করতে পারে কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হলে খুব শান্তভাবেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।
আমার মূল কথা ছিল, ইসলামী আদর্শকে পৃথিবীর অন্য সব মতবাদ বিশেষত অন্যান্য ধর্মীয় মতবাদের সঙ্গে এক সাড়িতে দাঁড় করানো অনুচিত। যে ধর্মের সকল সূত্র পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সংরক্ষিত রয়েছে এবং যে ধর্মের শিক্ষা ও আদর্শের মাঝে বিশ্বজনীনতা ও আদর্শবাদিতার সব উপকরণই বিদ্যমান, তাকে অন্যসব মতবাদের সঙ্গে এক সাড়িতে দাড় করানো অবশ্যই অবিচার। এ অবিচারকে কখনো ঔদার্য্য, অসাম্প্রদায়িকতা নামে আখ্যায়িত করা যায় না।
তাই অন্যায় সমতা বিধান নয় আমরা যদি ন্যায়নিষ্ঠ হই তাহলে আমাদেরকে সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যাই বলতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।