চলে গেলেন হাফেজ ফয়জুর রহমান
দেশের খ্যাতনামা হাফেজে কুরআন, হাজার হাজার হাফেজে কুরআনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিক্ষক উস্তাদুল হুফ্ফাজ হযরত আলহাজ্ব হাফেজ ফয়জুর রহমান ছাহেব গত ২১ রবীউল আউয়াল মোতাবেক ১০ এপ্রিল ২০০৭ ইং ইংরেজি মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুরে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁকে মিরপুরেই দাফন করা হয়েছে। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি জামেয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মিরপুর ঢাকা-এর হেফজ বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
সর্বমোট ৫২ বছর তিনি বিভিন্ন মাদরাসায় হিফজ বিভাগের শিক্ষকতা করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর ছাত্ররা ছড়িয়ে রয়েছেন। তিনি স্ত্রী, ৩ ছেলে, ৪ মেয়ে, ২ ভাইসহ অসংখ্য ছাত্র ও ভক্ত রেখে গেছেন। কয়েকবার হজ্ব ও ওমরা আদায় করেছেন। পবিত্র কুরআনের হিফজ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাঁর বিরাট অবদান রয়েছে।
হযরত হাফেজ ফয়জুর রহমান রহ. ১৯৩২ ইংরেজি সনে শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা থানার সিড্যা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উত্তর ডামুড্যা হাফেজিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৪৯ সনে পবিত্র কুরআন শরীফ হিফজ সমাপন করেন। তাঁর হেফজে কুরআনের প্রধান উস্তাদ ছিলেন হযরত মাওলানা হাফেজ আজিজুর রহমান ছাহেব রহ.। ১৯৫৪ সনে তিনি ডামুড্যা হামিদিয়া সিনিয়র মাদরাসা থেকে জামাতে হাফতম পাশ করেন।
ঢাকা জেলার সাভার থানার নরসিংহপুর আদর্শ ফুরকানিয়া হাফেজিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে ১৯৫৫ সনে তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। ১৯৫৭ সন পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা সম্প্রসারণে অবদান রেখেছেন। মসজিদের ইমাম ও খতীব হিসেবেও তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৫৭ সনে ঢাকার লালবাগ থানার ঢাকেশ্বরী এলাকায় মোমিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত ফুরকানিয়া আজিজিয়া হাফিজিয়া মাদরাসার পরিচালক ও প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ১৯৬১ সন পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেছেন। এ মাদরাসাটি লালবাগ মাদরাসার মুরব্বীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত। হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, হযরত মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, হযরত মাওলানা মুফতী দ্বীন মোহাম্মদ খান রহ. প্রমুখ এ মাদরাসার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
প্রখ্যাত বুযুর্গ হযরত মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর আহ্বানে হযরত হাফেজ ফয়জুর রহমান রহ. ১৯৬১ইং সনে ফরিদাবাদ ইমদাদুল উলূম মাদরাসার হেফজ বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১০ বছর তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেন। ফরিদাবাদ মাদরাসায় থাকাকালীন তিনি উপমহাদেশের বহু খ্যাতিমান উলামা মাশায়েখ ও বুযুর্গগণের সাথে পরিচিত হন। এ সময় তিনি প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস ও পীর কামেল হাফেজুল হাদীস আল্লামা আবদুল্লাহ দরখাস্তী রহ.-এর হাতে বাইআত হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক কায়েম করেন। হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর আওলাদে রাসূল ফেদায়ে মিল্লাত আল্লামা সাইয়েদ আসআদ মাদানী রহ.-এর সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক কায়েম করেন। আল্লামা সাইয়েদ আসআদ মাদানী রহ.-এর বাংলাদেশের দ্বীনী এক সফরে মরহুমের পরিবারের সদস্যরা তার কাছে বাইআত হন।
হাফেজ ফয়জুর রহমান রহ. ১৯৭২-৭৪ইং পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জের মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসার হিফজ বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭৪ সনে যোগদান করেন মিরপুর জামেয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদরাসায়। ১৯৮৪ সন পর্যন্ত হিফজ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৫ সনে তিনি আমিন বাজার মদীনাতুল উলূম মাদরাসার পরিচালক ও প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯২ সন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। জামেয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদের সম্মানিত মুহতামিম হযরত আলহাজ্ব মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী রহ.-এর বিশেষ আহ্বানে ১৯৯২ সনে তিনি পুনরায় জামেয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদে যোগদান করেন এবং ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত হেফজ বিভাগের প্রধান হিসেবে সেখানে নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সময় আরো বহু মাদরাসায় পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হুফফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশনেরও অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও পরীক্ষক ছিলেন তিনি।
১৯৫২ থেকে ১৯৭০ সন পর্যন্ত ফরিদাবাদ ইমদাদুল উলূমে অবস্থানের সুবাদে তিনি বহু প্রথিতযশা, প্রতিভাসম্পন্ন ও আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ উলামায়ে কেরামকে দেখার ও কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাদের প্রত্যক্ষ সাহচর্য লাভের সুযোগ পেয়েছেন। যুগশ্রেষ্ট মুহাদ্দিস আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রহ., প্রতিভাসম্পন্ন আলেম-লেখক মাওলানা নুর আহমাদ আজমী রহ., জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক পরিচালক মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী, শায়খ মাওলানা ইসহাক গাজী রহ., মাওলানা রিজাউল করীম ইসলামাবাদী, মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী, মাওলানা শওকত আলী খুলনাভী রহ.কে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। এছাড়াও স্বাক্ষাৎ করেছেন পাকিস্তান জমিয়তের আল্লামা মুফতী মাহমুদ রহ., আল্লামা গোলাম গাউস হাজারভী রহ. এর সঙ্গে। উলামায়ে কেরামের অর্ধশতক কালের ইতিহাসের তিনি সাক্ষী ছিলেন। অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় তিনি পবিত্র কুরআনের খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের হিফজ শিক্ষার ইতিহাসে হযরত হাফেজ ফয়জুর রহমানের নাম বহুকাল পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তাঁর অগণিত শাগরিদদের মাধ্যমে তার কবরে সওয়াব পৌঁছতে থাকবে। আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমাদের দুআ, আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দান করুন। তাঁর শোক-সন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক সমবেদনা।