Jumadal Ula 1428   ||   June 2007

অগ্রগামিতা ও পশ্চাৎপদতা

Mawlana Muhammad Zakaria Abdullah

মানুষ উন্নতি ও অগ্রগতির বিভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। কেউ মনে করেন, অর্থ-বিত্ত হল উন্নতির মানদণ্ড। তাদের বিচারে যে জাতি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যত অগ্রসর তারা ততই উন্নত ও অগ্রগামী, যদিও তাদের এই  অগ্রসরতা অর্জিত হয়েছে অসংখ্য মানুষের রক্ত শোষণ করে। এখানেই শেষ নয়, এই উন্নত জাতি বিত্তের অহমিকায় অন্ধ হয়ে যখন বিভিন্ন অনাচার ও যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হয় তখন এগুলোই হয়ে যায় উন্নত জাতির সংস্কৃতি। আর উন্নতিকামী জাতিগুলো যে উন্নত জাতিগুলোরই অনুসরণ করার চেষ্টা করবে তা তো বলাই বাহুল্য। এখানে এসে অগ্রসরতার দ্বিতীয় মানদণ্ডের সূচনা হয়। মানদণ্ডটির গূঢ় অর্থ উন্নত জাতির অন্ধ অনুকরণ হলেও এর গালভরা নাম প্রগতিশীলতা। প্রগতিশীল চিন্তা, প্রগতিশীল সমাজ, প্রগতিশীল প্রজন্ম ইত্যাকার অসংখ্য শব্দ এখান থেকেই উৎসারিত। যাহোক উন্নতি ও অগ্রগতির বিভিন্ন মানদণ্ডের মাঝে এখানে দুশ্রেণীর মানুষের দুটি মৌলিক মানদণ্ড উল্লেখ করা হল। এগুলোর লাভ-ক্ষতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমরা চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। তবে একথা নিশ্চিতরূপেই বলে দেওয়া যায় যে, এসব মানদণ্ড মানুষের চিন্তা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার ফল।

মানুষের দৃষ্টি ও চিন্তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মানুষ বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিত্তের ঝলকানি দেখে, ক্ষমতার দাপট দেখে এবং বিশ্বময় পরাশক্তিগুলোর শক্তির মহড়া দেখে। এগুলো দেখে মানুষের দুর্বল মন-মানস প্রতিক্রিয়াগ্রস্ত হয় এবং এগুলোকেই উন্নতি ও অগ্রগামিতার মানদণ্ড বলে ভাবতে আরম্ভ করে। এগুলোর অসংখ্য কুফল ও ব্যর্থতা চোখের সামনে থাকলেও প্রতিক্রিয়াশীল অবসন্ন মন সেদিকে তাকাবার শক্তি পায় না।

এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি লাভের পথ মানুষের সামনে খোলা ছিল। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সীমাবদ্ধতা থেকে বের হয়ে এক বিস্তৃত জগতে প্রবেশ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল। মহান আল্লাহ মানুষকে এমন একটি সূত্র দান করেছেন যা ধারণ করে মানুষ এই জ্ঞানের জগতে পৌঁছুতে পারে। সূত্রটির নাম হল ওহী। ওহীর মাধ্যমে মানুষ  এক অজানা জগতের সন্ধান লাভ করে। ওহীর ধারক হলেন আম্বিয়ায়ে কেরাম। তাঁদের মাধ্যমে অন্যদের কাছে ওহীর জ্ঞান পৌঁছয়। আম্বিয়ায়ে কেরাম মানুষের জ্ঞানের সীমানাকে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে দেন। তখন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সীমাবদ্ধতা মানুষের সামনে প্রকট হয়ে ওঠে এবং এই সীমাবদ্ধতাপ্রসূত চিন্তা-ভাবনাগুলোও মানুষের কাছে হাস্যকর মনে হয়, যেমন একজন শিশুর চিন্তা-ভাবনা একজন পরিণত মানুষের কাছে হাস্যকর মনে হয়।

আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এই বাহ্যদর্শন থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করতে চেয়েছেন। হাদীস শরীফে এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। লাভ-লোকসান, হার-জিত, উন্নতি-অগ্রগতির যেসব সংজ্ঞা অজ্ঞ লোকেরা র্নিধারণ করেছে তার বাইরেও যে একটি বিবেচনা রয়েছে তা তিনি বারবার উম্মতের সামনে তুলে ধরেছেন। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি হাদীস পেশ করছি। হাদীসটিতে এসেছে যে, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের নিয়ে সফর করছিলেন। সম্ভবত জিহাদের সফর ছিল। এ ধরনের সফরে মূল বাহিনী থেকে অগ্রগামী একটি ক্ষুদ্র দল থাকে যারা পথঘাট সম্পর্কে এবং শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করে। আবার বাহিনীর পেছনেও দুচার জনের একটি দল থাকে যারা বাহিনীর ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র  সংগ্রহ করে কিংবা দলছুট হওয়া মানুষকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছুতে সাহায্য করে। তো এরকম এক সফরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সঙ্গে ছিলেন। বাহিনীর অগ্রগামী দলটি যথারীতি অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। মূল বাহিনীও নিজ গতিতে চলছিল। হঠাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের দৃষ্টি আর্কষণ করে জিজ্ঞেস করলেন, অগ্রগামী দলের লোকেরা কোথায়? এক সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তারা অগ্রগামী হয়েছে এবং কিছু মানুষ পিছনেও রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশ্নের উদ্দেশ্যই ছিল অগ্রগামিতা ও পশ্চাৎপদতার এক ভিন্ন মানদণ্ড সম্পর্র্কে সাহাবীদের সচেতন করা। তাই তিনি তখন ইরশাদ করলেন; বরং তারাই অগ্রগামী হয়েছে যারা আল্লাহর যিকিরে সদা মগ্ন।

এখানে আমাদের জন্য চিন্তার খোরাক রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদেরকে অগ্রগামী বলেছেন তাদের অগ্রগামিতা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নয়। আল্লাহর যিকরে সদামগ্ন ব্যক্তিদের অগ্রগামিতা সাধারণ দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সাধারণ দৃষ্টিতে তাদেরকেই অগ্রগামী মনে হয় যারা দূরত্ব অতিক্রম করে আগে চলে গেছে। কিন্তু এ তো হল বাহ্যদর্শন। পার্থিব জগতের পদার্গুলো দৃষ্টির সম্মুখ থেকে অপসারিত হওয়ার পর যে সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে সে সত্যের দিকেই মনোযোগী করেছেন। সেই সত্য এই যে, আল্লাহর যিকরে মগ্ন থাকাই হল প্রকৃত অগ্রগামিতা।

আজকের বস্তবাদী যুগে যখন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষ বিভিন্ন বিষয়কে উন্নতি ও অগ্রগতির মানদণ্ড সাব্যস্ত করেছে তখন আমরা ইলমে ওহীর ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, এগুলো প্রকৃত অগ্রগামিতা নয়, প্রকৃত অগ্রগামিতা হল মহান আল্লাহর পরিচয় লাভ করা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর অনুগত থাকা। প্রগতিশীলতার এই হল ইসলামী মানদণ্ড।

অন্ধ মানবশ্রেণী যতই চেঁচামেচি করুক এবং একে যতই প্রতিক্রিয়াশীলতা বলে আখ্যা দিক, যারা এই জ্ঞান-সূত্রের সন্ধান পেয়েছেন তারা ওসবের উত্তরে তাই বলেন যা তাদের পরওয়ারদেগার তাদেরকে শিখিয়েছেন বলুন... এবং আল্লাহ আমাদেরকে পথ দেখানোর পর আমরা পশ্চাতে ফিরে যাব ওই লোকের মতো যাকে শয়তান বনভূমিতে বিপদগামী করে দিয়েছে ফলে সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছোটাছুটি করে? -সূরা আনআম ৭১

কখনই নয়। আমরা কখনো পশ্চাতে যেতে পারি না। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন এবং আমাদের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখুন। আমীন।

 

advertisement