শিক্ষার নামে!
সরকারি কারিকুলাম ও টেক্সট বোর্ড প্রণীত ইন্টারের ‘ENGLISH FOR TODAY’ নামক ইংরেজি পাঠ্যবইটি হাতে নিয়েছিলাম। পাতা উল্টাতে উল্টাতে চৌদ্দ নাম্বার ইউনিটের লেসন ওয়ানে প্রিয় নবীজীর নাম দেখে কৌতুহল হল। ১৭৮ পৃষ্ঠায় লিখিত ওই অনুচ্ছেদটি পড়ে তো আমি হতবাক। ‘The Prophet Mohammad (sm) equated one literate non-believer with ten illiterate believers’. কোনো কোনো নোট বইয়ে এ বাক্যটির সাথে আরও সংযুক্ত করা হয়েছে ‘Although he himself was not literate.’ believer শব্দটির অর্থ বিশ্বাসী, সহজ কথায় মুমিন বা ঈমানদার। পুরো বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায়- ‘মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষিত কাফিরকে দশজন নিরক্ষর মুমিনের সমান বিবেচনা করেন। যদিও তিনি নিজে নিরক্ষর ছিলেন।’ শিক্ষার গুরুত্ব বয়ান করতে গিয়ে উপরোক্ত কথায় মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য ও মিশন ঈমানের মহান দৌলতকে অতি স্পষ্ট ও জঘন্যভাবে খাটো করা হয়েছে। আর এ জালিয়াতি করা হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে! কেননা, এমন কথা না হাদীসে আছে আর না এমন অবাস্তব কথা তার বাণী হতে পারে। উল্লেখ্য, ইসলাম শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের যে গুরুত্ব দিয়েছে পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম তা দেয়নি। তাই ইসলামী সভ্যতা যুগে যুগে শিক্ষা ও পাণ্ডিত্যের যে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছে ইতিহাসে তার নজির দুর্লভ। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃত ইলম হল যা মানুষকে তার খালিক ও মালিক আল্লাহর সঙ্গেজুড়ে দেয় এবং যা ইনসানকে ইনসানিয়াত শেখায়। এই ইলম যার আছে সে নিরক্ষর হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে ‘জালিহ’ বা মূর্খ নয়। অন্যদিকে কারও যদি অক্ষরজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে জগতের সকল শাস্ত্রের জ্ঞান থাকে কিন্তু আল্লাহ পরিচয় ও ইনসানিয়তের জ্ঞান তার না থাকে তবে সে জগদ্বাসীদের কাছে পণ্ডিত বিবেচিত হলেও আল্লাহর কাছে খালিছ জাহিল বা মূর্খ হিসেবে পরিগণিত। এ কথার অর্থ এই নয় যে, আমরা জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শিতাকে খাটো করে দেখছি বরং উদ্দেশ্য হল, প্রকৃত জ্ঞানের ব্যাপারে যে ব্যাপক অবহেলা সে সম্পর্কে সচেতন করা। এজন্য সারা জীবন জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য অর্জনে মত্ত থেকে মৃত্যুর আগে ঈমানের দৌলত হতে বঞ্চিত হলে এত জ্ঞান, এত পাণ্ডিত্য সবই বৃথা। তার চেয়ে গ্রামের নিরক্ষর মুমিন অনেক অনেক উত্তম। তৎকালীন আরব যাকে আবুল হাকাম (জ্ঞানের পিতা) অভিধায়ে অভিষিক্ত করেছে, ঈমানের অভাবে তার নাম হয়েছে আবু জাহল (মূর্খতার পিতা)। হাদীসে এসেছে, দুনিয়াতে অতি সম্মানী ও শক্তিশালী ব্যক্তিটি কিয়ামত দিবসে আল্লাহর কাছে মাছির ডানার চাইতেও মূল্যহীন হবে। -বুখারী ৪৭২৯
তারা কারা?- কুরআনে আল্লাহই বলেছেন,
اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا بِاٰیٰتِ رَبِّهِمْ وَ لِقَآىِٕهٖ فَحَبِطَتْ اَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِیْمُ لَهُمْ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ وَزْنًا۱۰۵ ذٰلِكَ جَزَآؤُهُمْ جَهَنَّمُ بِمَا كَفَرُوْا وَ اتَّخَذُوْۤا اٰیٰتِیْ وَ رُسُلِیْ هُزُوًا
‘এমন লোক- যারা স্বীয় রবের নির্দেশনাবলী ও তাঁর সম্মুখীন হওয়াকে অস্বীকার করে। ফলে তাদের কৃতকর্ম সমূহ নিষ্ফল হয়ে যায়। সুতরাং কিয়ামতের দিন (হিসাবের পাল্লায়) আমি তাদের জন্য কোনো ওজন স্থির করব না। তাদের প্রতিফল জাহান্নাম কারণ তারা কুফর করেছে এবং আমার নির্দেশনাবলী ও রাসূলগণকে বিদ্রƒপের পাত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে।’ -সূরা কাহাফ ১০৫-১০৬
ভেবেছিলাম ইলম অর্জনের যে গুরুত্ব কুরআন দিয়েছে এবং জ্ঞান-সাধনার যে মহাত্ব হাদীসের ভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে সেসব বাদ দিয়ে ঈমান ও বিশ্বাসকে খাটো করার এ চতুর জালিয়াতিটি অতি উৎসাহিত কোনো শিক্ষাবিদই সংযোজন করেছেন। কিন্তু আর্টিকেলের শেষে ‘UNESCO, Thinkers on Education’ লিখাটি দেখে বুঝতে পারি এ ‘প্রত্যাদেশ’ অনেক উপর থেকেই এসেছে। ইউনেস্কো এ কাজ করতে পারে- এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, আশ্চর্য হই গ্রন্থ প্রণয়ন ও সম্পাদনার দায়িত্বপ্রাপ্ত এ দেশী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের এ ‘প্রত্যাদেশ’ গ্রহণের সরলতা দেখে!
বইয়ের একই ইউনিটে লেসন টু অর্থাৎ ১৮০ পৃষ্ঠায় আরেকটি জাল ও ভিত্তিহীন কথাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ‘হাদীস’ হিসেবে লিখা হয়েছে। ‘The ink of the scholar is holier then blood of the martyr-Hadith’ (জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও বেশি পবিত্র-হাদীস)। হাদীস বিশারদরা প্রায় সকলেই একমত যে, একথাটি হাদীস নয়। পাঠক শুনে বিস্মিত হবেন যে, এমন দুটি স্পষ্ট জাল বর্ণনায় ‘সমৃদ্ধ’ বইটি মাদরাসা বোর্ডের আলিম শ্রেণীরও পাঠ্য বই। আমাদের অসচেতনতার কারণে এমন অনেক কিছুকেই শিক্ষার নামে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি ও মাদারাসায় আমাদের আগামী প্রজন্মকে গলাধঃকরণ করানো হচ্ছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যেমন দ্রুত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঠিক পদক্ষেপ প্রয়োজন তেমনি আলেম-উলামা ও বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি দক্ষ টাস্কফোর্স গঠনও জরুরি। এ ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে নব প্রজন্ম তত বেশি নিরাপদ থাকবে।