তীজা দাহম চেহলাম প্রসঙ্গ
এক শ্রেণীর মানুষকে দেখা যায়, তাদের আত্মীয়-স্বজন মারা গেল, তারা তার ছওয়াব রেছানীর জন্য তিনদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে এবং তৃতীয় দিন এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আয়োজন করে থাকে অনেক এলাকায় কুলখানী বলা হয়। বড় বড় ডেগে খানা পাকানো হয় এবং পাড়া-পড়শি, ধনী-গরীব সবাইকে দাওয়াত করে ভোজ-অনুষ্ঠান করা হয়। এরপর মৃত্যুর দশম দিন, বিশতম দিন এবং চল্লিশতম দিনেও এ আয়োজন করা হয়। ছাড়া প্রতি বছর মৃতের মৃত্যুদিবস উদযাপন করা হয়। মৃতকে উপলক্ষ করে এসব অনুষ্ঠান ইসলামের শিক্ষা নয়। আলেমগণ বলেছেন, এভাবে তৃতীয়, দশম, বিশতম ও চল্লিশতম দিনকে এসব আয়োজনের জন্য নির্ধারিত করা এবং সেই নির্ধারিত দিনে দাওয়াতপ্রথার মাধ্যমেই ঈসালে সওয়াব করা অপরিহার্য মনে করার মধ্যে রিয়াকারীর প্রবল সম্ভাবনা থাকে। কেননা, যারা এসব আয়োজন করেন তারা যদি নিজের অন্তরকে প্রশ্ন করেন যে, এভাবে আয়োজন না করে এই অর্থটুকু গরীব- মিসকীনকে চুপে চুপে দান করে দেই তাহলে দেখা যাবে অন্তর এতে সায় দিচ্ছে না। অন্তর বলছে, একটু আয়োজন না করলে লোকে নিন্দা করে বলবে, অমুকের বাপ মরে গেল কিন্তু সে তার ঈসালে ছওয়াবটাও করল না। তাহলে ভাবুন মানুষের নিন্দা থেকে বাঁচার জন্য কিংবা মানুষের কাছে ভালো থাকার জন্য যে কাজ করা হল তাতে রিয়া আসল কি না? আর রিয়াযুক্ত কোনো কাজ যে আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না এবং এর কোনো সওয়াব পাওয়া যায় না তা তো বলাই বাহুল্য। আমলকারী যখন নিজেই তার আমলের সওয়াব পেল না তো মৃতের কাছে সে সওয়াব পৌঁছবে কীভাবে?
হক্বানী উলামা ও ঈসালে ছওয়াব
বিজ্ঞ ও হক্বানী আলেমগণ বলেন, ইসালে ছওয়াবের জন্য শরীয়ত যেহেতু কোনো দিন-তারিখ নির্ধারণ করে দেয়নি তাই দিন-তারিখ নির্ধারণ ছাড়া যখনই সুযোগ হয় মৃতের জন্য নফল সদকা করুন এবং লোক দেখানো মনোবৃত্তি পরিহার করে ইখলাসের সঙ্গে দান করুন। এক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয়ের প্রতিও লক্ষ রাখতে হবে। তা এই যে,
১. মীরাস বা মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তি, যা সকল ওয়ারিশের সম্মিলিত সম্পদ, তা থেকে ওয়ারিশদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি ছাড়া খরচ করা যাবে না।
২. ওয়ারিশদের মধ্যে কেউ নাবালিগ থাকলে তার অংশ থেকে অনুমতিক্রমেও খরচ করা যাবে না। কেননা, নাবালিগের অনুমতি গ্রহণযোগ্য নয়।
৩. ইসালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করার ইচ্ছা আছে তা ফকীর মিসকীনকে চুপে চুপে দিয়ে দেওয়া ভালো। যাতে তারা এ অর্থ দিয়ে তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। ঈসালে ছওয়াবের জন্য খাবার দাবারেরই আয়োজন করতে হবে এরূপ কোনো বাধ্যবাধকতা শরীয়তে নেই।
৪. কেউ যদি তার ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে কিছু দান করতে চায় তাহলে এতেও কোনো বাধা নেই।
৫. ঈসালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত শুধু মৃত্যুর সময়ই করতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই; বরং সারা জীবন যখনই সময় সুযোগ হয় তখনই ইসালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে হালাল সম্পদ থেকে দান-সদকা করা যাবে।
৬. দান-সদকা ছাড়া অন্যান্য ইবাদত যথা নফল নামায, নফল রোযা, দরূদ পাঠ, ইস্তিগফার ইত্যাদির মাধ্যমেও ঈসালে ছওয়াব করা যাবে। অর্থাৎ এ ইবাদতগুলো করে দু’আ করবে যে, আল্লাহ এর ছওয়াব অমুকের আমলনামায় পৌঁছে দিন।
৭. সব ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, একাজগুলো যেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়, লোক-দেখানোর জন্য না হয়। এভাবে করলে তা শরীয়তসম্মত হবে এবং ইনশাআল্লাহ এতে মৃত ব্যক্তির উপকার হবে। অন্য দিকে এ প্রবন্ধের শুরুতে যে রীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার নিয়ম-কানুন ও শর্ত-শারায়েতগুলো যেহেতু শরীয়তে নেই তাই তা বিদআত। এতে ছওয়াবের পরিবর্তে গোনাহর আশঙ্কা রয়েছে।
একটি মওজু বর্ণনা থেকে প্রমাণ গ্রহণের চেষ্টা
তীজার ব্যাপারে রেজভীদের একটি দলীলের কথা মনে পড়ে গেল। তারা বলে থাকে, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহেবযাদা হযরত ইবরাহীম রা. মৃত্যুবরণ করলে তৃতীয় দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধের উপর ফাতিহা পড়েছিলেন।’ এই বর্ণনাটি হাদীসের কোনো কিতাবে পাওয়া যায় না। এটি একটি বানানো কথা। তাদেরকে এর সূত্র জিজ্ঞেস করলে তারা কিছু বলতে পারে না কিন্তু সাধারণ মানুষের মাঝে তা বর্ণনা করে থাকে।
হক্বের উপর থাকার একমাত্র উপায়
আমাদের খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে যে, একমাত্র সুন্নতের অনুসরণই হল সত্যের উপর থাকার উপায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন,
‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নত ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবে অবলম্বন করো।’ -মিশকাতুল মাসাবীহ পৃ. ৩০; আবু দাউদ; তিরমিযী; আহমদ
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে বিচার করা উচিত যে, মৃতকে কেন্দ্র করে উপরোক্ত আয়োজন-অনুষ্ঠান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর খলীফাগণের যুগে ছিল কি না? যদি বলেন, ছিল তবে হাদীস পেশ করুন আর যদি স্বীকার করেন যে, ছিল না তবে কর্তব্য হল খাঁটি মনে তওবা করে এসব রসম রেওয়াজ থেকে নিজেরাও ফিরে আসা এবং অন্যকেও ফেরানো।
(বেরেলভী উলামা-মাশায়ের কে লিয়ে লামহায়ে ফিকরিয়া’ পুস্তিকা থেকে গৃহিত ও অনুদিত)