হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মতের দুআ
কুরআন মজীদে পূর্ববর্তী অনেক নবী রাসূলের জীবনকথা বর্ণিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে জীবনের নানা ঘটনায় নানা সংগ্রামে-সংকটে তাদের দুআ ও মুনাজাতের বিশেষ ভাষা ইতিহাস বর্ণনার ন্যায় উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু কুরআন মজীদ সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি নাযিল হয়েছে, এজন্য তাঁর প্রার্থনা ও মুনাজাত বর্ণনার ভাষায় ভিন্নতা রয়েছে। তাঁর অধিকাংশ দুআই আল্লাহ পাক তাঁকে ওহীর মাধ্যমে সরাসরি শিক্ষা দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো দুআর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, মুমিন মুত্তাকীগণ এভাবে দুআ করে, এই পরিস্থিতিতে এই ভাষায় প্রার্থনা করে এবং ধৈর্য্যধারণ করে বিনয়াবনত হয়। এগুলিও পরোক্ষভাবে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুনাজাত। কারণ তিনি পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মুমিন ও মুত্তাকী। সুতরাং যে প্রার্থনা সৎ, নেককার, মুমিন ও মুত্তাকীদের, সে প্রার্থনা অবশ্যই সর্বাগ্রে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের প্রথম সূরায় হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মতকে সমগ্র জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। এ দুআর গুরুত্বের কারণে এর পূর্ববর্তী স্বীকার্য ও করণীয় বিষয়গুলোও স্পষ্টরূপে আলোচিত হয়েছে।
প্রথমেই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে সকল সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা, জীবনদাতা, পালনকর্তা ও মৃত্যুদাতা হিসেবে মুখে ও মনেপ্রাণে স্বীকার করতে হবে এবং এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে, সকল প্রশংসার মালিক একমাত্র তিনিই। তিনি পরম দয়ালু, মৃত্যুপরবর্তী কর্মফল দিবসের মালিক। এরপর বলা হয়েছে, আমরা সকলে যেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করি এবং একমাত্র তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। অতঃপর আল্লাহ তাআলা আমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রার্থিত বিষয় ও প্রার্থনার ভাষ্য শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, আমরা যেন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব মাহাত্ম ও সপ্রশংস মহিমা ঘোষণা করে তাঁর নিকট বিনয়াবনত চিত্তে সকাতর প্রার্থনা নিবেদন করে বলি-
الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَۙ۵ صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ ،غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَ لَا الضَّآلِّیْنَ.
‘(হে আল্লাহ!) আমাদেরকে আপনি সরল পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথ, যাদেরকে আপনি অনুগ্রহ দান করেছেন, যারা ক্রোধ-নিপতিত নয়, পথভ্রষ্টও নয়।-সূরা ফাতিহা : ৫-৭
এই দুআ পাঠ করার পর আমীন বলা সুন্নত। আমীন অর্থ, যে আল্লাহ আপনি কবুল করুন। হযরত আবু হুরাইরা রা. ও হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَ لَا الضَّآلِّیْنَ পাঠ করার পর আমীন বলতেন।-মুসনাদে আহমাদ; আবু দাউদ; তিরমিযী
قال الترمذي : هذا حديث حسن
দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা
সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ রাখতে হবে। বিশেষ করে হজ্বের অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করার সময় গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধিক পরিমাণে আল্লাহ পাকের যিকির করতে হবে। অতঃপর অত্যন্ত বিনয়াবনত হয়ে আল্লাহ পাকের নিকট দুআ করতে হবে। কারণ এটি দুআ কবুলের সময়। শুধু দুনিয়াবী বিষয়ে প্রার্থনা করলে চলবে না; বরং উভয় জগতের কল্যাণের জন্য দুআ করতে হবে। এ জন্য আল্লাহ পাক সেই সকল মুমিনকে সফলকাম বলে প্রশংসা করেছেন, যারা সর্বাবস্থায় বিশেষ করে হজ্বের কাজগুলো সমাপ্ত করার পর উভয় জাহানের কল্যাণ কামনা করে প্রার্থনা করে-
رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنْیَا حَسَنَةً وَّ فِی الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ.
হে আমাদের রব! আমাদেরকে ইহকালে কল্যাণ দিন এবং পরকালেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।-সূরা বাকারা : ২০১
এই দুআয় দুনিয়া ও আখিরাতের সব ধরনের কল্যাণ লাভ করার এবং পরকারে সর্বপ্রকার অকল্যাণ থেকে আত্মরক্ষার প্রার্থনা করা হয়। ইহকালীন কল্যাণের মধ্যে জাগতিক সব প্রার্থিত বিষয় শামিল রয়েছে। যেমন মানসিক শান্তি, সুপ্রশস্ত নিবাস, উত্তম ও সুদর্শন জীবনসাথী, জীবিকার প্রাচুর্য, উপকারী ইলম ও সুখকর প্রশংসা ইত্যাদি।
পরকালের কল্যাণের মধ্যে রয়েছে সব রকম ভীতিকর বিষয় থেকে মুক্তি, হিসাব সহজ হওয়া এবং আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ পুরস্কার জান্নাত লাভ করা। জাহান্নাম থেকে নাজাতের প্রার্থনা রয়েছে যে সব কাজ দ্বারা জাহান্নামে অগ্নিদগ্ধ হতে হবে, সেসব গুনাহ, পাপ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ থেকে দুনিয়ায় বেঁচে থাকার সামর্থ্য লাভ করা।
হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুআ সর্বদা পাঠ করতেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা পাঠ করতেন-
اَللّهُمَّ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنْیَا حَسَنَةً وَّ فِی الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ.
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার জনৈক অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে গেলেন। দেখলেন তিনি শুকিয়ে পাখির বাচ্চার মতো হয়ে গেছেন। নবীজী তাকে বললেন, তুমি আল্লাহর কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা কর? তিনি বললেন, জ্বী হ্যাঁ। আমি বলি, ‘ হে আল্লাহ! পরকালে আমার জন্য যে শাস্তি রয়েছে তা আপনি দুনিয়ায় দিয়ে দিন।’ এ কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ! তুমি তা সহ্য করতে পারবে না। তুমি কেন বল না-
اَللّهُمَّ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنْیَا حَسَنَةً وَّ فِی الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে ইহকালে কল্যাণ দিন এবং পরকালেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।-সূরা বাকারা : ২০১
নবীজীর নির্দেশক্রমে সাহাবী এই দুআ করেন এবং রোগমুক্ত হন।-সহীহ মুসলিম
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রুকনে ইয়ামানী ও হজরে আসওয়াদের মধ্যখানে رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنْیَا حَسَنَةً وَّ فِی الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ পাঠ করতে শুনেছেন।
رواه الإمام الشافعي والرواة كلهم صالح وبعضهم فوق بعض.
আরশের উপহার
আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সকল মুমিনের প্রশংসায় বলেছেন, তারা সকলে বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহ পাকের প্রতি, তার ফেরেশতাগণের প্রতি, আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি এবং আল্লাহর সকল নবী-রাসূলের প্রতি। তারা নবী-রাসূলদের মাঝে কাউকে বিশ্বাস ও কাউকে অবিশ্বাস করার ন্যায় পার্থক্য করে না এবং তারা আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করে-
سَمِعْنَا وَ اَطَعْنَا ؗۗ غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَ اِلَیْكَ الْمَصِیْرُ۲۸۵ لَا یُكَلِّفُ اللّٰهُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا ؕ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَ عَلَیْهَا مَا اكْتَسَبَتْ ؕ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَاۤ اِنْ نَّسِیْنَاۤ اَوْ اَخْطَاْنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تَحْمِلْ عَلَیْنَاۤ اِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهٗ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهٖ ۚ وَ اعْفُ عَنَّا ۥ وَ اغْفِرْ لَنَا ۥ وَ ارْحَمْنَا ۥ اَنْتَ مَوْلٰىنَا فَانْصُرْنَا عَلَی الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَ.
আমরা শুনেছি এবং অনুগত হয়েছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার নিকট ক্ষমা চাই। প্রত্যাবর্তন তো আপনারই নিকট।
হে আমাদের প্রতিপালক! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে অপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না।
হে আমাদের রব! আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন আমাদের উপর তেমন দায়িত্ব অর্পণ করবেন না।
হে আমাদের প্রতিপালক! এমন ভার আমাদের উপর অর্পণ করবেন না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের পাপ মোচন করুন, আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনিই আমাদের অভিভাবক। সুতরাং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে বিজয়ী করুন।-সূরা বাকারা : ২৮৫-২৮৬
মুআয ইবনে জাবাল রা. এই দুআগুলি পাঠ করে আমীন বলতেন।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত কোনো রাত্রে পাঠ করবে সে রাত্রে এই দুই আয়াতই তার জন্য যথেষ্ট হবে।-সহীহ বুখারী; মুসলিম
হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত আমাকে আল্লাহ পাকের আরশের নিম্নবর্তী ভাণ্ডার থেকে দান করা হয়েছে, যা ইতিপূর্বে কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি।-মুসনাদে আহমাদ
উকবা ইবনে আমের রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ কর; কেননা আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এর দ্বারা বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন।
হযরত আবু যর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারা এমন দুটি আয়াত দ্বারা খতম করেছেন যেগুলি তিনি আমাকে আরশের নিচের অমূল্য রত্নভা-ার থেকে দান করেছেন। সুতরাং তোমরা নিজেরা এই আয়াতগুলো শেখ এবং তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে শেখাও। কারণ এ দুটি আয়াত সালাত, কুরআন ও দুআ।-মুসতাদরাকে হাকেম
হেদায়েতের উপর অবিচলতার দুআ
সুদৃঢ় ও পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিরা বলেন, কুরআনের সকল আয়াতই আমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে আগত, এর সবগুলিই আমরা বিশ্বাস করি। তারা আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করে আরও বলে-
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَیْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً ۚ اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ۸ رَبَّنَاۤ اِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِیَوْمٍ لَّا رَیْبَ فِیْهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُخْلِفُ الْمِیْعَادَ.
‘হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর আপনি আমাদের অন্তরকে সত্য লঙ্ঘনকারী করবেন না এবং আপনার নিকট থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনিই মহাদাতা। হে আমাদের রব! আপনি মানবজাতিকে একদিন একত্রে সমাবেশ করবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ নির্ধারিত সময়ের ব্যতিক্রম করেন না।’-সূরা আল ইমরান : ৮-৯
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি কোনো বস্তু হারানোর পর দ্বিতীয় আয়াতখানি পাঠ করে এ দুআটি পড়ে-
يا جامع الناس ليوم لا ريب فيه إجمع بيني وبين مالي، إنك على كل شيء قدير.
رواه ابن النجار في تاريخه.
তবে সে ওই হারানো জিনিস ফিরে পায়।
গুনাহ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির দুআ
কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহভীরু মুত্তাকীদের পরিচয় প্রদান করা হয়েছে। এক স্থানে বলা হয়েছে, তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র জীবন এবং আল্লাহ পাকের পূর্ণ সন্তুষ্টি। তাকওয়া অবলম্বনকারী তারাই, যারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, আল্লাহ পাকের অনুগত, আল্লাহর পথে ব্যয়কারী এবং ঊষাকালে আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। যারা আল্লাহ পাকের নিকট বলে-
رَبَّنَاۤ اِنَّنَاۤ اٰمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَ قِنَا عَذَابَ النَّارِ.
‘হে আমাদের পালনকর্তা আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আপনি আমাদের পাপ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।’-সূরা আল ইমরান : ১৬
সংকটকালে রব্বানীদের দুআ
উহুদ যুদ্ধে সত্তরজন মুসলিমের শাহাদত লাভ এবং অনেকের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে কোনো কোনো মুসলমানের মন দুর্বল হয়ে পড়ে। আল্লাহ পাক সকলের মনে সাহস সঞ্চার এবং করণীয় ও বর্জনীয় নির্ধারণের উদ্দেশ্যে বলেন, বিভিন্ন যুগে বহু নবী যুদ্ধ করেছেন। তাদের সঙ্গে অনেক আল্লাহওয়ালা ছিল। আল্লাহর পথে তাদের কখনও বিপর্যয় ঘটলে তারা হীনবল হয়নি, দুর্বল হয়নি এবং নতও হয়নি। কঠিনতর পরিস্থিতিতেও তারা ধৈর্যধারণ করেছে। তখন এ আল্লাহওয়ালাদের একমাত্র প্রার্থনা ছিল-
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَ اِسْرَافَنَا فِیْۤ اَمْرِنَا وَ ثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَ انْصُرْنَا عَلَی الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَ
হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের পাপ এবং আমাদের কার্যে সীমালঙ্ঘন ক্ষমা করুন, আমাদের পা সুদৃঢ় রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।’-সূরা আল ইমরান : ১৪৭
ভয়-ভীতির সময়ের দুআ
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের পনের তারিখ উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর মুশরিকরা একে অপরকে ভর্ৎসনা দিতে থাকে যে, তোমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারনি। তোমরা তাদের শক্তি-সামর্থ্য ধ্বংস করেছ, তাদেরকে হত্যা ও আহত করেছ, কিন্তু তাদেরকে সমূলে উৎপাটিত করতে পারনি। অতএব পুনরায় মদীনায় আক্রমণ করতে হবে।
হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে এ কথা জানতে পেরে পরদিন ষোলই শাওয়াল রবিবার সকালে হুকুম দিলেন, গতকাল যারা উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছিলে তাদেরকে পুনরায় প্রস্তুত হয়ে শত্রট্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। অথচ তখন সকলেই ছিলেন ক্লান্ত, আহত ও অবসন্ন। তৎসত্ত্বেও সকলেই বিপুল উদ্দীপনাসহ প্রস্তুত হয়ে শত্রট্টবাহিনীকে পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে রওয়ানা হন। তারা মদীনা থেকে আট মাইল দক্ষিণে অবস্থিত ‘হামরাউল আসাদ’ নামক জায়গায় অবস্থান করেন। এ সংবাদ জানতে পেরে মুশরিকদের যুদ্ধের খায়েশ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তখন তারা মুসলিমদেরকে ভীতি প্রদর্শনের এক কুটকৌশল অবলম্বন করে। তাদের পাশ দিয়ে আবদুল কায়েস গোত্রের একটি কাফেলা মদীনায় আসছিল। এ কাফেলার লোকদেরকে ওরা বলল, তোমরা মুসলিমদেরকে এ খবর পৌঁছাবে যে, আমরা এক বিশাল অস্ত্রসজ্জিত বাহিনী মুসলিমদেরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য প্রস্তুত হয়েছি। অচিরেই তাদের উপর হামলা চালাব। তারা এ সংবাদ পৌঁছানোমাত্র সকল মুসলমান অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে একমাত্র আল্লাহ পাকের প্রতি নির্ভরতা প্রকাশ করে বলেন-
حَسْبُنَا اللّٰهُ وَ نِعْمَ الْوَكِیْلُ
আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক।’-সূরা আল ইমরান : ১৭৩
হাদীস শরীফে এ দুআটির অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, হযরত ইবরাহীম আ.কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তখন তাঁর সর্বশেষ কথা ছিল ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকীল।’-সহীহ বুখারী
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চিন্তা বৃদ্ধি পেলে তিনি মাথায় ও দাড়িতে হাত বুলাতেন। অতঃপর লম্বা নিশ্বাস নিতেন এবং حسبي الله ونعم الوكيل পাঠ করতেন। হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, حسبي الله ونعم الوكيل এ দুআটি সকল ভীতিকর বিষয় থেকে নিরাপত্তা দেয়।
বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণের দুআ
আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে ইরশাদ করেছেন, আমি মুমিনদেরকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফলফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। এরূপ কঠিন পরীক্ষার সময়ও যারা ধৈর্য ধারণ করবে তাদের জন্য শুভ সংবাদ। তাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অশেষ দয়া বর্ষিত হয় এবং এরাই সৎপথে পরিচালিত। ধৈর্যশীল তারাই যাদের উপর বিপদ আপতিত হলে বলে-
اِنَّا لِلّٰهِ وَ اِنَّاۤ اِلَیْهِ رٰجِعُوْنَ
‘আমরা সকলে তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তার দিকেই আমরা প্রত্যাবর্তনকারী।’-সূরা বাকারা : ১৫৬
বিপদে আপদে এই দুআ পাঠ করার অনেক ফযীলত রয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে কোনো বান্দা বিপদগ্রস্ত হয়ে যদি পাঠ করে-
اِنَّا لِلّٰهِ وَ اِنَّاۤ اِلَیْهِ رٰجِعُوْنَ، اللهم اجرني في مصيبتي واخلف لي خيرا منها
তবে আল্লাহ তাআলা তাকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করেন এবং মুসীবতের পরিবর্তে উত্তম বদলা দান করেন। উম্মুল মুমিনীন বলেন, আমার স্বামী আবু সালামা মারা যাওয়ার পর আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথামতো আমল করেছি। পরবর্তীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে বিবাহের মাধ্যমে আল্লাহ পাক আমাকে উত্তম বদলা দান করেন।
হযরত আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মালাকুল মাওত! তুমি কি আমার বান্দার সন্তানের জান কবজ করেছ? তুমি কি তার নয়নের মণি ও কলিজার টুকরা কে কবজ করেছ? ফেরেশতা বলেন, হ্যাঁ। আল্লাহ পাক বলেন, আমার বান্দা কী বলেছে? মালাকুল মাওত বলেন, সে আপনার প্রশংসা করেছে এবং اِنَّا لِلّٰهِ وَ اِنَّاۤ اِلَیْهِ رٰجِعُوْنَ পাঠ করেছে। আল্লাহ তাআলা তখন বলেন, জান্নাতে তার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ কর এবং সে গৃহের নাম রাখ বাইতুল হামদ।-জামে তিরমিযী; মুসনাদে আহমাদ
হুসাইন ইবনে আলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, কোনো মুসলিম নর-নারী বিপদগ্রস্ত হওয়ার অনেকদিন পর বিপদের কথা স্মরণ করে যদি اِنَّا لِلّٰهِ وَ اِنَّاۤ اِلَیْهِ رٰجِعُوْنَ পড়ে তবে আল্লাহ পাক তাকে বিপদের দিন পাঠ করার সমান সওয়াব দান করবেন।
জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের দুআ
আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আকাশম-লি ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শনাবলি রয়েছে জ্ঞানী লোকদের জন্য। জ্ঞানী তারাই যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় এক কথায় সর্বাবস্থা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে এবং যারা আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করে-
رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلًا ۚ سُبْحٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ۱۹۱ رَبَّنَاۤ اِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ اَخْزَیْتَهٗ ؕ وَ مَا لِلظّٰلِمِیْنَ مِنْ اَنْصَارٍ۱۹۲ رَبَّنَاۤ اِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِیًا یُّنَادِیْ لِلْاِیْمَانِ اَنْ اٰمِنُوْا بِرَبِّكُمْ فَاٰمَنَّا ۖۗ رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَ كَفِّرْ عَنَّا سَیِّاٰتِنَا وَ تَوَفَّنَا مَعَ الْاَبْرَارِۚ۱۹۳ رَبَّنَا وَ اٰتِنَا مَا وَعَدْتَّنَا عَلٰی رُسُلِكَ وَ لَا تُخْزِنَا یَوْمَ الْقِیٰمَةِ ؕ اِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِیْعَادَ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এই সকল বস্তু অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র। আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি কাউকেও অগ্নিতে নিক্ষেপ করলে তাকে তো নিশ্চয় লাঞ্ছিত করলেন এবং জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের রব! আমরা এক আহ্বানকারীকে ঈমানের দিকে এ আহ্বান করতে শুনেছি যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আন। সুতরাং আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব! আপনি আমাদের পাপ ক্ষমা করুন, আমাদের মন্দ কার্যগুলি দূরীভূত করুন এবং আমাদেরকে সৎকর্ম পরায়ণদের সহগামী করে মৃত্যু দান করুন।
হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার রাসূলদের মাধ্যমে আমাদেরকে যে সওয়াব ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা আমাদেরকে দিন এবং কিয়ামতের দিন আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন না। নিশ্চয় আপনি প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না।’-সূরা আল ইমরান : ১৯১-১৯২
আল্লাহ পাক এ সকল জ্ঞানী লোকের প্রার্থনায় সাড়া দেন। তিনি তখন বলেন, আমি তোমাদের মধ্যে কর্মে বিনিষ্ট কোনো নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না।
মুনাজাতের এ আয়াত দুটি পাঠ করার অনেক ফযীলত রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ রাতে এই আয়াতগুলি পাঠ করতেন। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের তৃতীয় প্রহরে শয্যা ত্যাগ করে আকাশের দিকে দৃষ্টি উত্তোলন করে এ আয়াতগুলো পাঠ করেন। অতঃপর ভালোভাবে অযু করে তাহাজ্জুদ আদায় করেন।-সহীহ বুখারী
পিতামাতার জন্য দুআ
আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকল উম্মতকে পিতামাতার জন্য দুআ করতে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে হুকুম দিয়েছেন, সকলে যেন পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে। আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন, পিতামারত উভয়ে বা কোনো একজন বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে বিরক্তি, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, ক্রোধ ও ঘৃণাসূচক কোনো কথা বলা যাবে না এবং তাদেরকে ধমক দেওয়া যাবে না। তাদের সঙ্গে সর্বদা সম্মানসূচক নম্র কথা বলতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, পিতামাতার প্রতি মমতাবশে নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করবে এবং সর্বদা তাদের জন্য আল্লাহ পাকের নিকট এই প্রার্থনা করবে-
رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমার পিতামাতার প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন।’-সূরা বনী ইসরাইল : ২৪
এরূপ গুরুত্ব সহকারে মাতাপিতার খেদমত ও তাদের জন্য দুআ করার নির্দেশ থাকার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মাতাপিতা উভয়কে বা কোনো একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পাওয়ার পর তাদের খেদমত করে জান্নাত লাভ করতে পারল না সে অতিশয় হতভাগা।-মুসনাদে আহমাদ
হিজরতের দুআ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্তির পর তের বছর মক্কায় অবস্থান করেন। তিনি আল্লাহ পাকের হুকুমে রবীউল আউয়াল মাসের শুরুর দিকে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। হিজরতের পূর্ব মুহূর্তে আল্লাহ পাক তাকে এ প্রার্থনা করতে বলেন-
رَبِّ اَدْخِلْنِیْ مُدْخَلَ صِدْقٍ وَّ اَخْرِجْنِیْ مُخْرَجَ صِدْقٍ وَّ اجْعَلْ لِّیْ مِنْ لَّدُنْكَ سُلْطٰنًا نَّصِیْرًا
‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে দাখিল করুন কল্যাণের সঙ্গে এবং আমাকে নিষ্ক্রান্ত করাবেন কল্যাণের সঙ্গে এবং আপনার নিকট থেকে আমাকে দান করুন সাহায্যকারী শক্তি।’-সূরা বনী ইসরাইল : ৮০
আল্লাহর মহাত্ম বর্ণনা
আল্লাহ তাআলা সূরা বনী ইসরাইলের সর্বশেষ আয়াতে সকল মুমিনকে আরও একটি দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ قُلِ الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِیْ لَمْ یَتَّخِذْ وَلَدًا وَّ لَمْ یَكُنْ لَّهٗ شَرِیْكٌ فِی الْمُلْكِ وَ لَمْ یَكُنْ لَّهٗ وَلِیٌّ مِّنَ الذُّلِّ وَ كَبِّرْهُ تَكْبِیْرًا
‘বল, সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই, যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেন না, তাঁর রাজত্বে কোনো অংশীদার নেই এবং যিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তার অভিভাবক প্রয়োজন হতে পারে। সুতরাং সসম্ভ্রমে তার মাহাত্ম ঘোষণা কর।-সূরা বনী ইসরাইল : ১১১
এই আয়াতটিই তওয়াত শরীফের শেষ আয়াত ছিল।
জ্ঞান বৃদ্ধির দুআ
এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিম্নোক্ত দুআটি করতে বলেন-
رَبِّ زِدْنِیْ عِلْمًا
হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।’-সূরা ত্বহা : ১৪
জ্ঞান বৃদ্ধির দুআ একটি সর্বব্যাপী ও বহুবিস্তীর্ণ প্রার্থনা। সুতরাং এ দুআর মধ্যে অর্জিত ইলম স্মরণে থাকার, অজানা ইলম জ্ঞানায়ত্ব হওয়ার এবং সর্ববিষয়ে কল্যাণকর বোধ জাগ্রত হওয়ার প্রার্থনা অধিভুক্ত রয়েছে। এ জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাকের মহান দরবারে এ দুআ অধিক হারে করতেন।
ফয়সালা প্রার্থনা
আল্লাহ পাক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন, কাফের সম্প্রদায় যদি আপনার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আপনি বলে দিন, আমি তোমাদেরকে যথাযথভাবে জানিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদেরকে যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা অবশ্যই আপতিত হবে। তবে আমি জানি না তা অত্যসন্ন, না দূরস্থিত। শাস্তি বিলম্বিত হওয়ার দ্বারা শাস্তি সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। হয়তো বিলম্বিত হওয়াও তোমাদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এরূপ বিভিন্নভাবে বোঝানোর পরও যখন তারা হেদায়াত কবুল করেনি তখন আল্লাহ পাকের অনুমতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রার্থনা করেন-
رَبِّ احْكُمْ بِالْحَقِّ ؕ وَ رَبُّنَا الرَّحْمٰنُ الْمُسْتَعَانُ عَلٰی مَا تَصِفُوْنَ
হে আমার প্রতিপালক! আপনি ন্যায়ের সঙ্গে ফয়সালা করে দিন। আমাদের প্রতিপালক তো দয়াময়। তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে একমাত্র সহায়স্থল তিনিই।’-সূরা আম্বিয়া : ১১২
অর্থাৎ সত্যকে মিথ্যার উপর, আলোকে অন্ধকারের উপর বিজয় দান করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুআ আল্লাহ পাক কবুল করেন। বদর যুদ্ধের দিন সত্য মিথ্যা মীমাংসা হয়।
আযাব থেকে নাজাত পাওয়ার দুআ
কাফের সম্প্রদায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঠাট্টা করে তাদের উপর শাস্তি কখন আসবে? আল্লাহ তাকে বলেন, ওদের দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনে আপনি দুঃখিত ও মনক্ষুণ্ন হবেন না; বরং তাদের দুর্ব্যবহারের জবাব সদ্ব্যবহার দ্বারা দেবেন। আর আপনি নিশ্চি বিশ্বাস রাখবেন, যে শাস্তির ওয়াদা তাদেরকে দেওয়া হয়েছে তা সত্তর হোক বিলম্বে হোক অবশ্যই তাদের উপর আসবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাকের নিকট তখন এ দুআ করেন-
رَّبِّ اِمَّا تُرِیَنِّیْ مَا یُوْعَدُوْنَ
‘হে আমার প্রতিপালক! যে শাস্তির বিষয়ে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হচ্ছে তা যদি আপনি আমাকে দেখাতে চান, তবে হে আমার প্রতিপালক, আপনি আমাকে জালিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করবেন না।’-সূরা মুমিনুন : ৯৩-৯৪
অর্থাৎ সে ভয়াবহ আযাব যদি আমার জীবদ্দশায় অবতীর্ণ হয় তবে আমাকে সে আযাব থেকে নিরাপদ রাখবেন।
যদিও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপরাধীদের শাস্তির অন্তর্ভুক্ত কখনো হবেন না। তৎসত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় বিনয়াবনত হয়ে এরূপ প্রার্থনা করেছেন।
এর দ্বারা সকল মুসলিমকে এ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, সকলকে সর্বদা আল্লাহ পাকের আযাবের ব্যাপারে এরূপ ভীত সন্ত্রস্ত থাকতে হবে।
আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হুকুম দেন যে, তাদের প্রতি শাস্তি না আসা পর্যন্ত আপনি তাদের মন্দ আচরণের মুকাবিলা করুন উত্তম ব্যবহার দ্বারা।
رَّبِّ اَعُوْذُ بِكَ مِنْ هَمَزٰتِ الشَّیٰطِیْنِ
হে আমার প্রতিপালক! আপি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি শয়তানের প্ররোচনা থেকে। হে আমার রব! আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার কোনো বিষয়ে শয়তানের উপস্থিতি থেকে।’-সূরা মুমিনুন : ৯৭-৯৮
মুমিনদের দুআ
অপরাধীদের জাহান্নামে নিক্ষেপের পর তারা আর্তস্বর উঠিয়ে শাস্তি থেকে বের হওয়ার প্রার্থনা করবে। আল্লাহ পাক বলবেন, আমার নেককার বান্দাগণকে নিয়ে তোমরা এতো ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করতে যে, তোমরা আমার কথা বিস্মৃত হয়েছিলে। ফলে তোমাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়েছে। আর পুণ্যবান ও সৎকর্ম পরায়ণ বান্দাদেরকে আমি আজ পুরস্কৃত করেছি। পৃথিবীতে সৎকর্ম পরায়ণ বান্দাদের প্রার্থনা ছিল-
رَبَّنَاۤ اٰمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَ ارْحَمْنَا وَ اَنْتَ خَیْرُ الرّٰحِمِیْنَ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও আমাদের প্রতি দয়া করুন। দয়ালুদের মধ্যে আপনিই তো সর্বোৎকৃষ্ট দয়ালু।’-সূরা মুমিনুন : ১০৯
আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ করে বলেন, হে নবী! আপনি ও আপনার অনুসারীগণ সর্বদা এই দুআ করুন-
رَّبِّ اغْفِرْ وَ ارْحَمْ وَ اَنْتَ خَیْرُ الرّٰحِمِیْنَ
‘ হে আমার প্রতিপালক! ক্ষমা করুন ও দয়া করুন। দয়ালুদের মধ্যে আপনিই তো শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’-সূরা মুমিনুন : ১১৮
জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তির দুআ
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, দয়াময় ও পরম দয়ালু আল্লাহ তাআলার অনুগত বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে। তাদেরকে অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করলে তারা তর্কে অবতীর্ণ হয় না; বরং শান্তি কামনা করে। যারা প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দ-ায়মান হয়ে রাত্রি অতিবাহিত করে, যারা ব্যয় করার সময় অপচয় করে না, কার্পণ্যও করেন, যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে না, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না, যারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং অসার ক্রিয়াকলাপের সম্মুখীন হলে তা পরিহার করে চলে, যারা তাদের একমাত্র রবের নিকট এই প্রার্থনা করে-
رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ اِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত করুন, জাহান্নামের শাস্তি তো নিশ্চিত বিনাশ।’-সূরা ফুরকান : ৬৫
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّةَ اَعْیُنٍ وَّ اجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِیْنَ اِمَامًا
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন, যারা আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর হবে এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শস্বরূপ করুন।’-সূরা ফুরকান : ৭৪
বাহনের আরোহণের দুআ
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, পরাক্রমশালী ও সর্বজ্ঞ আল্লাহই আকাশ ম-লী ও পৃথিবীর স্রষ্টা। যিনি তোমাদের জন্য এমন নৌযান ও চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যার উপর তোমরা আরোহণ কর, যাতে তোমরা এগুলির পৃষ্ঠে স্থির হয়ে বসতে পার। তারপর তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তোমরা এগুলোর উপর স্থির হয়ে বস এবং তখন বল-
سُبْحٰنَ الَّذِیْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَ مَا كُنَّا لَهٗ مُقْرِنِیْنَۙ۱۳ وَ اِنَّاۤ اِلٰی رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ
‘পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি এগুলিকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা এগুলি বশীভূত করতে সমর্থ ছিলাম না। আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব।-সূরা যুখরূফ : ১৩-১৪
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের উদ্দেশ্যে বাহনে পা রাখতেন, তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন। অতঃপর পাঠ করতেন-
سُبْحٰنَ الَّذِیْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَ مَا كُنَّا لَهٗ مُقْرِنِیْنَۙ وَ اِنَّاۤ اِلٰی رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ
অতপর তিনবার আলহামদুলিল্লাহ ও তিনবার আল্লাহু আকবার পাঠ করতেন।
আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার দুআ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন, যদি কাফের সম্প্রদায় আপনার আহ্বানে সাড়া না দেয়; বরং আপনি যে পূর্ণাঙ্গ, পবিত্র ও মহান শরীয়ত নিয়ে এসেছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আপনি বলুন-
حَسْبِیَ اللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ عَلَیْهِ تَوَكَّلْتُ وَ هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِیْمِ
মানুষের বয়স সাধারণত চল্লিশ বছরে উপনীত হওয়ার পর তার জ্ঞানে, বোধশক্তিতে ও আখলাকে পরিপক্কতা সৃষ্টি হয়।
নেককাজের তাওফীক লাভের দুআ
আল্লাহ পাকের ভাগ্যবান বান্দাগণ চল্লিশ বছরে পৌঁছার পর অর্থাৎ জ্ঞানে পক্কতা আসার পর আল্লাহ পাকের মহান দরবারে এই দুআ করেন-
رَبِّ اَوْزِعْنِیْۤ اَنْ اَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِیْۤ اَنْعَمْتَ عَلَیَّ وَ عَلٰی وَالِدَیَّ وَ اَنْ اَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضٰىهُ وَ اَصْلِحْ لِیْ فِیْ ذُرِّیَّتِیْ اِنِّیْ تُبْتُ اِلَیْكَ وَ اِنِّیْ مِنَ الْمُسْلِمِیْنَ
‘ হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন, যাতে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, আমার প্রতি ও আমার পিতামাতার প্রতি আপনি যে অনুগ্রহ করেছেন তার জন্য এবং যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি যা আপনি পছন্দ করেন। আমার জন্য আমার সন্তানদেরকে সৎকর্ম পরায়ণ করুন। আমি আপনারই অভিমুখী হলাম এবং আপনারই নিকট আত্মসমর্পণ করলাম।’-সূরা আহকাফ : ১৫
উল্লেখ্য যে, এ দুআটি যে কোনো বয়সেই করা যায়।
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দুআ
সাহাবা আজমাঈন আল্লাহ তাআলার মনোনীত জামাআত। তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সরাসরি সান্নিধ্যপ্রাপ্ত পুণ্যবান দল। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে তাদের প্রশংসায় বলেছেন, তারা আল্লাহ পাকের প্রতি সন্তুষ্ট, আল্লাহ পাকও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। পরবর্তী যুগ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত তারাই আল্লাহ পাকের সন্তোষভাজন, যারা সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসারী, যারা এ দুআ করে-
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَ لِاِخْوَانِنَا الَّذِیْنَ سَبَقُوْنَا بِالْاِیْمَانِ وَ لَا تَجْعَلْ فِیْ قُلُوْبِنَا غِلًّا لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَاۤ اِنَّكَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রণী আমাদের পূর্ববর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন এবং সমকালীন মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।’-সূরা হাশর : ১০
এ আয়াত থেকে জানা গেল যে, সাহাবায়ে কেরামের মাহাত্ম ও ভালবাসা অন্তরে পোষণ করা এবং তাদের জন্য দুআ করা ঈমানের দাবি।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, শিয়া মতাবলম্বীদের মনে সাহাবায়ে কেরামের প্রতি কোনোরূপ আস্থা নেই। ভক্তি ভালবাসায় তো প্রশ্নই আসে না। তারা সাহাবায়ে কেরামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। অতএব শিয়ারা আল্লাহ পাকের সন্তোষজনক নয়; বরং বিরাগভাজন।
আল্লাহতে সমর্পণ
আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন, আপনি বলুন-
اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ لَا شَرِیْكَ لَهٗ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ
‘আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তাঁর কোনো শরিক নেই। আমি এ কথারই আদিষ্ট হয়েছি এবং আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম।’-সূরা আনআম : ১৬২-১৬৩
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. বয়ানুল কুরআনে বলেছেন, আয়াতের সারনির্যাস এই যে, যেমনিভাবে ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের কোনো শরীক নেই, তেমনি জগতের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণেও আল্লাহ তাআলার কোনো অংশীদার নেই। এ-ই তাওহীদের সমষ্টি। এ কথাই ইসলামের শিক্ষা। আর হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরই আদিষ্ট হয়েছেন। এ কথা দ্বারা সূক্ষ্মভাবে সকলের প্রতি আহ্বান করা হয়েছে যে, নবীর প্রতি যে বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে সে আদেশ সকলের প্রতিই রয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুআখানি পশু কুরবানী করার সময় পাঠ করেছেন-
اِنِّیْ وَجَّهْتُ وَجْهِیَ لِلَّذِیْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ حَنِیْفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِیْنَۚ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ لَا شَرِیْكَ لَهٗ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতখানি দুআ হিসেবে তাহাজ্জুদ নামাযেও পাঠ করতেন। হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রাতের নামাযে) সানা পড়ে আল্লাহু আকবার বলে এ আয়াতখানি পাঠ করতেন।
নবীগণের দুআ-এর সংযুক্তি
হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মনেপ্রাণে কামনা করে যে, কিয়ামতের দিন তাকে পরিপূর্ণ মাপে সওয়াব প্রদান করা হোক, সে যেন তার সকল বৈঠকের শেষে পাঠ করে ...।
মুশরিকরা যা আরোপ করে তা থেকে পবিত্র ও মহান তোমার প্রতিপালক, যিনি সকল ক্ষমতার অধিকারী। শান্তি বর্ষি ত হোক রাসূলদের প্রতি। সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।-তাফসীরে কুরতুবী ১৫/৯২
হযরত সায়ীদ ইবনে আরকাম রা.-এর সূত্রে বর্ণিত অপর এক হাদীসে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর এ আয়াতগুলি তিনবার পাঠ করবে সে পূর্ণমাপে প্রতিদান পাবে।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭/৪৭
পবিত্র কুরআনের তাফসীরকারকগণ এই আয়াতের বিশ্লেষণে একখানি হাদীস এনেছেন। হযরত তালহা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা যখন আমার প্রতি সালাম পেশ করবে তখন সকল রাসূলের প্রতি সালাম পাঠ করবে।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭/৪৬
আল্লাহ তাআলা হাশরের দিন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অনুসারী মুমিন-মুত্তাকীদের অপদস্থ করবেন না। তারা যখন পুলসিরাতের উপর দিয়ে চলতে থাকবে, তখন তাদের সঙ্গে আল্লাহ প্রদত্ত নূর চলতে থাকবে। সেই মুহূর্তে হঠাৎ করে মুনাফিকদের অবস্থা দেখে মুমিনগণ ভীত-শঙ্কিত হয়ে আল্লাহ পাকের নিকট এ প্রার্থনা করবে-
رَبَّنَاۤ اَتْمِمْ لَنَا نُوْرَنَا وَ اغْفِرْ لَنَا اِنَّكَ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ قَدِیْرٌ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’-সূরা তাহরীম : ৮