সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর
পৃথিবীতে মানুষ অনেক কিছুর মুখাপেক্ষী, যেগুলো ছাড়া তার জীবনযাপন সম্ভব নয়। যেমন অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থান ইত্যাদি। এগুলো মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। এ প্রয়োজন পূরণে মানুষ সর্বদা সচেষ্ট থাকে। শিক্ষা-দীক্ষা, জান-মালের নিরাপত্তা, শিল্পোন্নয়ন প্রভৃতিও জীবনের অনিবার্য প্রয়োজন, যা পূরণ করা ছাড়া স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব নয়।
এ সকল প্রয়োজন অপরিহার্য হওয়ার বিষয়টি মানুষের কাছে স্পষ্ট এবং এর সমাধানে দল মত নির্বিশেষে সবাই তৎপর। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব সমস্যা সমাধানে অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে, যেখানে শত-সহস্র লোক সদা কর্মব্যস্ত রয়েছেন।
কিন্তু মানুষের জীবনে অন্য একটি বিষয় এসব থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতি একেবারে ভ্রূক্ষেপ করা হয় না। তা হল- মানুষ সত্যিকার অর্থে মানুষ হওয়া।
এ বিষয়ের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বুঝার জন্য আমাদের প্রথমে জানতে হবে মানুষের পরিচয় কী এবং পৃথিবীতে মানব অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা কী।
মানুষের মধ্যে সৃষ্টিগতভাবে দু’ধরনের স্বভাব রয়েছে। (১) পশুত্বের স্বভাব (২) রূহানিয়াতের স্বভাব। প্রতিটির নিজস্ব চাহিদা রয়েছে।
মানুষের প্রাণী সত্তার প্রয়োজন
প্রাণী হওয়ার কারণে অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষেরও খাদ্য, পানীয় ও বাসস্থানের প্রয়োজন হয়। আনন্দ-বিনোদন ও অন্যান্য চাহিদা পূরণের প্রয়োজন হয়, কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, এগুলো মানুষের প্রাণী-ধর্মের চাহিদা। এক্ষেত্রে সে অন্যান্য প্রাণীর মতোই। পার্থক্য শুধু এই যে, অন্য সকল প্রাণী নিকৃষ্ট পদ্ধতিতে তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করে। আর মানুষ করে তুলনামূলক উন্নত পদ্ধতিতে।
মানুষের রূহানী প্রয়োজন
জৈবিক প্রয়োজন ছাড়াও মানুষের রূহানী কিছু চাহিদা ও প্রয়োজন রয়েছে। যেমন, ইবাদতবন্দেগী করা, উত্তম গুণাবলি অর্জন করা, সততা, সত্যবাদিতা, শিষ্টাচার, ভদ্রতা, ইনসাফ, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা অর্জন করা ইত্যাদি। এ সকল খোদায়ী গুণ শুধু মানুষের মাঝেই প্রকাশিত হতে পারে। তাই মানুষকে নিছক ‘সভ্য প্রাণী’ মনে করে জৈবিক চাহিদাকেই তার একমাত্র প্রয়োজন গণ্য করা এবং পৃথিবীতে খেলাফতের যে সুমহান দায়িত্ব তার উপর অর্পিত তা থেকে গাফেল থাকা মানব-সত্তার প্রতি বড় ধরনের জুলুম।
এই রূহানী চাহিদা পূরণে অবহেলা আমাদের অন্য সকল ক্ষেত্রে মারাত্মক খারাপ প্রভাব ফেলেছে । এ কারণে নানা কষ্ট-ক্লেশ ও চিন্তা-পেরেশানী আমাদের জীবনকে বিষাদময় করে তুলেছে। ধোঁকা-প্রতারণা, মিথ্যা-দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ, দুর্বলের উপর সবলের আক্রোশ ইত্যাদি সমাজ-জীবনের দূরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এর একমাত্র কারণ হল, মানুষের রূহানী গুণাবলির উন্মেষ ঘটানোর এবং মানুষকে মানুষ বানানোর চিন্তাভাবনা না করা।
মন্দ স্বভাবের মূল
অনেকেই মিথ্যা-প্রতারণা, সুদ-ঘুষ ইত্যাদিকে অত্যন্ত ঘৃণা করেন এবং মনেপ্রাণে এ সবের অবসান কামনা করেন। কিন্তু তারা জানেন না যে, এগুলো আসল রোগ নয়, রোগের উপসর্গ বা রোগজাত বিকার, আসল রোগ হল রূহ বিনষ্ট হওয়া।
দেহের রক্ত-দূষণের কারণে যেমন চামড়ার উপর খুজলি পাচড়া দেখা দেয়, এ-ও তেমনি। তাই এর সঠিক চিকিৎসা হল, রোগীকে রক্ত শোধনকারী ওষুধ খাওয়ানো।
মিথ্যা-প্রতারণা, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি রোগের সঠিক চিকিৎসার জন্য মানুষের রূহ ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করাই হল একমাত্র পথ। বলাবাহুল্য, এই চিকিৎসার জন্য আম্বিয়ায়ে কেরাম ও তাঁদের আদর্শবাহী রাহবারগণের শিক্ষা ও নির্দেশনার কোনো বিকল্প নেই।
পশ্চিমা গোষ্ঠীর সভ্যতার মাপকাঠি
বর্তমান সময়ে অনেক মানুষকে ইউরোপ-আমেরিকার সভ্যতা ও ভদ্রতায় প্রভাবিত হতে দেখা যায়। কিন্তু একটু নির্মোহভাবে ভাবলে দেখা যাবে, তাদের এই ভদ্রতা ও নৈতিকতা আত্মিক প্রেরণাজাত নয়, এটি একটি ব্যবসায়িক চরিত্র। যে দোকানী সততা ও বিশ্বস্ততাকে শুধু এজন্য তার ব্যবসায়িক নীতি হিসেবে গ্রহণ করে যে, এগুলো তার ব্যবসায়িক উন্নতির পক্ষে সহায়ক, দেখা যায়, এরা কখনো বিশ্বস্ততার মুখোশের আড়ালে অবৈধ মুনাফার সুযোগ পেলে তা গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। অনুরূপভাবে পশ্চিমাদের সভ্য চরিত্রও এ ধরনের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির প্রতিফলন। এজন্য স্বার্থ ও সভ্যতার দ্বন্দে তাদেরকে সর্বদাই পরাজিত হতে দেখা যায়। মুখে ন্যয়-নিষ্ঠা, সাম্য ও সম্প্রীতির কথা বললেও বাস্তবে এসবের প্রতিফলন শুধু ওই ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে যেখানে তাদের স্বার্থ জড়িত থাকে। অন্যথায় এই সুশীল সজ্জন লোকেরাই চরম বর্বর ও নির্মম হয়ে উঠতেও দ্বিধাবোধ করেন না। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অনেকেই গরীব রাষ্ট্রগুলোতে পাশ্চাত্যের দান-দক্ষিণার কথা খুব গর্বভরে প্রচার করে থাকেন। অথচ বাস্তবতা হল, এই দেশগুলিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারই এ সকল দান-দক্ষিণার অন্যতম উদ্দেশ্য। না হয় যারা হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আনবিক বোমা মেরে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ সংহার করতে পারে, তাদের সঙ্গে সভ্যতা ও মানবতার কী সম্পর্ক? মোটকথা পাশ্চাত্যে ভদ্রতা ও নৈতিকতার যে সকল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তা নিছক ব্যবসায়ী মানসিকতাপ্রসূত। চরিত্র ও নৈতিকতার এই পর্যায়টি আমাদের উদ্দেশ্য নয়, আমাদের উদ্দেশ্য হল, সেই আখলাক চরিত্র গঠন করা, যার ভিত্তি কোনো ব্যক্তিগত বা জাতীয় স্বার্থের উপর হবে না, বরং তা হবে আল্লাহর ভয় ও রূহের পরিশুদ্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যার মাধ্যমে মানুষের রূহানিয়াত পূর্ণতা লাভ করবে। মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারবে। আর এ মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের কর্মপন্থাই একমাত্র পথ।
নবীদের কর্মপদ্ধতি
মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি ও চারিত্রিক উৎকর্ষের লক্ষ্যে নবীগণের কর্মপদ্ধতি মৌলিকভাবে অভিন্ন ছিল। সকল নবীই মানুষকে দু’টি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করতে চেয়েছেন। এক. আল্লাহর সাথে বান্দার জীবন্ত সম্পর্ক। দুই. মৃত্যুপরবর্তী হিসাব-নিকাশের ইয়াকীন ও বিশ্বাস।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক এবং আখেরাতে বিশ্বাস
আল্লাহকে এক জানা এবং মৃত্যুর পরের শাস্তি ও পুরস্কারকে শুধু একটি আকীদার মতো মেনে নেওয়া যথেষ্ট নয়, এ ধরনের বিশ্বাস এখনো পৃথিবীর ৯৫% মানুষ পোষণ করে থাকে, কিন্তু শুধু এই মেনে নেওয়া জীবনের উপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না এবং চরিত্রগঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় না। তাই নবীগণ মানুষকে শুধু মৌখিক স্বীকারোক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং তারা আল্লাহর সঙ্গে বান্দার জীবন্ত সম্পর্ক স্থাপন করতে এবং আখেরাতের ইয়াকীন মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করতে সচেষ্ট ছিলেন, যে ইয়াকীন ও বিশ্বাস মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছায়াপাত করবে এবং জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আনবে।
আল্লাহর সঙ্গে জীবন্ত সম্পর্কের অর্থ এই যে, বান্দার বিশ্বাস এ পর্যায়ে উন্নীত হবে যে, সর্বাবস্থায় তাঁর মনে হবে আমার প্রতিপালক আমাকে দেখছেন এবং আমি তাঁর সামনে রয়েছি। তিনি আমার সকল কথা শুনছেন, সকল কাজ দেখছেন; ফলে সে সর্বদা আল্লাহর পছন্দনীয় কাজে সচেষ্ট হবে এবং অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকবে। তদ্রূপ যখন মানুষের মধ্যে আখেরাতের বিশ্বাস শক্তিলাভ করবে তখন সে সকল প্রকার গুনাহ ও অন্যায় থেকে এমনভাবে বিরত থাকবে যেমন সাপ-বিচ্ছু ও আগুন থেকে বিরত থাকে। মানুষটি একজন চরিত্রবান মানুষে পরিণত হবে। এটাই হল মানুষকে সত্যিকার মানুষ বানানোর পদ্ধতি।
বলাবাহুল্য, নবীগণের পথেই এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।
জীবন্ত আদর্শ
আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পূর্বে যে নবীগণ দুনিয়াতে আগমন করেছিলেন এবং যে পথ ও পদ্ধতিতে সমাজসংস্কার করেছিলেন; দুঃখের বিষয় হল, তার কোনো বিবরণ পরবর্তীতে সংরক্ষিত থাকেনি। এমনকি তাঁদের অনুসারীদের নিকটও তাদের জীবন ও কর্মের পূর্ণ ইতিহাস বিদ্যমান নেই। একমাত্র আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে এ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাঁর গৃহিত কর্মসূচীর কল্যাণে ঘুনে ধরা সমাজে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। সে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, মানুষকে মানুষ বানানোর মহান মিশন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিশেষ পদ্ধতিতেই বাস্তবায়ন করেছেন।
জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব জাতি অবিচার অনাচার এবং অশ্লীলতা-বেহায়াপনার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। তাদের সংশোধনের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের দাওয়াত দিয়েছেন। যারা তাঁর দাওয়াত কবূল করেছেন এবং তার তত্ত্বাবধানে এ মৌলিক বিষয় দুটি পূর্ণরূপে আত্মস্থ করেছেন তাদের জীবনে আমূল বিপ্লব সাধিত হয়েছে। তারা তাকওয়া, খোদভীতি ও চরিত্র-সুষমায় ফেরেশতাতুল্য হয়েছিলেন।
ইসলামের প্রথম দুই খলিফা হযরত আবু বকর রা. ও হযরত ওমর রা. এর খেলাফতকাল ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। সাম্য-শান্তি ও ইনসাফপূর্ণ শাসনব্যবস্থার এক অনন্য নযীর তারা স্থাপন করেছিলেন, এ সত্য ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তিরাও স্বীকার করেছেন।
১৯৩৬ সালে তৎকালীন ভারতে জাতীয় নির্বাচনের পর যখন প্রথমবারের মতো কংগ্রেস ক্ষমতায় গেল তখন মহাত্মা গান্ধী হরিজন পত্রিকায় কংগ্রেস নেতাদের উদ্দেশ্যে যে উপদেশনামা লেখেন, সেখানে তিনি হযরত আবু বকর রা. ও হযরত ওমর রা.-এর শাসনপদ্ধতি থেকে শিক্ষাগ্রহণের তাগিদ দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় একথা বলেছিলেন যে, ইতিহাসে যেহেতু আর কোনো নমুনা আমি পাইনি তাই এই ব্যক্তিদ্বয়ের দৃষ্টান্তই তোমাদের সামনে তুলে ধরলাম।
মোটকথা, পূর্ববর্তী নবীগণের কর্মপদ্ধতির বিবরণ আমাদের কাছে সংরক্ষিত নেই। কিন্তু একথা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায় যে, মানুষকে সত্যিকার মানুষ বানানোর জন্য তাদের সকলের পথ ও পদ্ধতি অভিন্ন ছিল। আর তা এই যে, আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক স্থাপন এবং আখেরাতের পূর্ণ ইয়াকীন ও বিশ্বাস সৃষ্টি।
এই পদ্ধতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল, মানুষকে মানুষ বানানোর এটি সবচেয়ে সহজ, সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর পন্থা। এ পদ্ধতিতে মানুষের প্রত্যেকটি মন্দ বৈশিষ্ট্য দূর করার জন্য এবং প্রত্যেকটি সৎগুণ সৃষ্টি করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না। শুধু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও আখেরাতের ইয়াকীন সৃষ্টির চেষ্টাই যথেষ্ট হয়। যখন এই দুই জিনিস কারো মধ্যে চলে আসে তখন জীবনের গতিপথ আপনাআপনি বদলে যায়। মন্দ স্বভাব দূর করা এবং ভালো গুণ সৃষ্টি করার জন্য তখন এটুকু বলাই যথেষ্ট হয় যে, ভাই, এটা মন্দ কাজ। এতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, আর এটা ভালো কাজ, এতে আল্লাহ খুশি হন।
আল্লাহর নবীগণ তাদের কওম থেকে মিথ্যা-প্রতারণা, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি বন্ধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেননি, বরং তাদের সকলের অভিন্ন কর্মপদ্ধতি এটাই ছিল যে, তারা আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক কায়েম করেছেন; তাদের মাঝে খোদাপ্রেম ও আখেরাতের ইয়াকীন সৃষ্টি করেছেন। তারপর তাদের বলেছেন যে, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এই বিধি-নিষেধ রয়েছে। এই কাজে তিনি সন্তুষ্ট হন, আর এই কাজে অসন্তুষ্ট হন। এই কাজে তার কাছে পুরস্কার মিলবে আর এই কাজে শাস্তি ভোগ করতে হবে। শুধু এতটুকু বলে দেওয়াই তাদের কর্মের পরিবর্তন ও সংশোধনের জন্য যথেষ্ট হত।
একটি উদাহরণ, মানুষ বলে থাকে, মদ্যপানের নেশা ছাড়ানো সবচেয়ে কঠিন। আমেরিকার সরকার বেশ কয়েকবার আইন করেও সে দেশের মানুষকে মদ্যপান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এক পর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে তাদেরকে এই মিশন থেকে পিছু হটতে হয়েছে।
পক্ষান্তরে ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বে আরবের ঘরে-ঘরে শরাবের প্রচলন ছিল, উৎসব-অনুষ্টানে এর অবাধ ব্যবহার ছিল। কিন্তু নবী-শিক্ষার বদৌলতে যখন তাদের মাঝে আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের চিন্তা সৃষ্টি হল, তখন তাদের সামগ্রিক কর্মকা-ে এক বিপ্লব দেখা দিল। তাদের যখন বলা হল যে, আল্লাহ তায়ালা মদ হারাম করেছেন তখন প্রতিটি ঘরের মদের মটকা উল্টে ফেলে দেওয়া হল। বর্ণিত আছে, ওই দিন মদীনার গলিতে গলিতে মদের স্রোত বয়ে গিয়েছিল। মোটকথা, কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা নগরী থেকে মদের প্রচলন উঠে গিয়েছিল। পাঠক, এটাই হল নবীওয়ালা পন্থার বৈশিষ্ট্য।
মনুষ্যত্ব বিকাশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট নয়
অনেকের মনে এ ধারণা আসতে পারে যে, ইসলাহ ও সংশোধনের যে কথা উপরে আলোচিত হয়েছে তা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারাই অর্জিত হওয়া সম্ভব। এর জবাবে সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই যে, এটি নিতান্তই ভুল ধারণা। কারণ যে শিক্ষা মানুষকে মানুষ বানায়, তা শুধু নবীদের আনীত সেই শিক্ষা, যা আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক গড়ে দেয় এবং অন্তরে আখেরাতের ইয়াকীন সৃষ্টি করে।
কিন্তু কোটি কোটি টাকা খরচ করে বর্তমান স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক ও আখেরাতের ইয়াকীন কমাচ্ছে বৈ বাড়াচ্ছে না। সেখানে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর যাদের মাঝে এই শিক্ষাব্যবস্থা আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের চিন্তা সৃষ্টি করেছে। অপর দিকে তাদের সংখ্যা অগণিত যারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও সুদ-ঘুষ গ্রহণ করতে, অন্যের হক মারতে, দুর্বলের উপর অত্যাচার করতে, ক্ষুদ্রস্বার্থে মিথ্যাচার করতে শুধু অভ্যস্তই নয় রীতিমতো সিদ্ধহস্ত। এটা নিছক একটা দাবি নয়, বাস্তবতা এর পক্ষে স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয়। তাই এই ধারণা নিতান্তই অমূলক যে, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাই মানুষের চরিত্র-বিনির্মাণে যথেষ্ট।
বর্তমান যুগে এই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কিন্তু তা মানুষের শুধু একটি দিকের চাহিদাই পূরণ করতে সক্ষম মানুষের রূহানী চাহিদা পূরণে এ শিক্ষা কখনো যথেষ্ট নয়। তাই মানুষ যদি এই শিক্ষার পাশাপাশি নববী আখলাক ও নৈতিক গুণাবলি অর্জনে সচেষ্ট হয় তাহলেই কেবল কলেজ-ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষা তাকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে, বরং এ শিক্ষাকে ব্যবহার করে সে ভালো কাজ করতে সক্ষম হবে।
সকলের প্রতি অভিন্ন দাওয়াত
সমাজের সকল ধর্মের শিক্ষিত মানুষের প্রতি আমাদের আহ্বান, উপরোক্ত কথাগুলো একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ভাবুন। তাহলে আপনাদের কাছে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, বৈষয়িক উন্নতি অর্জনে আমরা আমাদের সকল সামর্থ্য ব্যয় করলেও আত্মশুদ্ধি ও নৈতিক গুণাবলি অর্জনে আমরা একেবারেই উদাসীন। ফলাফল এই দাঁড়িয়েছে যে, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র পর্যন্ত আমাদের আয়ত্তে এসে গেলেও আমাদের মন ও প্রবৃত্তিকে আমরা আয়ত্তে আনতে পারিনি। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ জলচর প্রাণীর চেয়েও দ্রুতগতিতে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। পাখির চেয়েও বেশি উচ্চতায় আকাশে উড়ছে। আনবিক বোমার সাহায্যে বিনাশ ও হিংস্রতায় হিংস্র পশুদেরও ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু ইলমে ওহী থেকে রিক্তহস্ত হওয়ার কারণে পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে বসবাস করতে ভুলে গেছে।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, একটু চিন্তা করলেই সুস্থ বিবেকসম্পন্ন যেকোনো মানুষই এ বিষয়ে একমত হবেন যে, বর্তমানে মানবতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল-মানুষ সত্যিকার অর্থে মানুষ হওয়া।
এজন্য মত-পথ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি আমাদের অভিন্ন দাওয়াত এই যে, আপনারা নিজেদের বিশ্বাস ও চরিত্র গঠনে ব্রতী হোন এবং অন্যান্য মানুষের মাঝেও এগুলো আনয়নে সচেষ্ট হোন। কারণ, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস সকল ধর্মেরই মৌলিক বিষয়। এটাই মানবজাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন। অভিজ্ঞতাও এ কথার সাক্ষী যে, এ জন্য আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম আনীত পথই একমাত্র পথ।
মুসলমানদের প্রতি বিশেষ আহবান
মুসলমান ভাইদের প্রতি বিশেষ আহ্বান এই যে, অন্যদের তুলনায় আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। কেননা আমরা বিশ্বাস করি- হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী এবং তাঁর আগমনের মাধ্যমেই নবুওয়তের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য প্রয়োজনীয় হেদায়েত ও পথনির্দেশনা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছে এবং তা পূর্ণাঙ্গরূপে মুসলিম উম্মাহর কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক স্থাপন ও অন্তরে আখেরাতের ভয় সৃষ্টির যে অতুল্য পদ্ধতি তিনি রেখে গেছেন তার বিস্তারিত বিবরণও মুসলিম উম্মাহর কাছে রয়েছে।
এই বিশ্বাস সত্ত্বেও অধঃপতনের এই যুগে আমরা যদি মানবতার কল্যাণে নিবেদিত না হই, আমাদের কাছে রক্ষিত হিদায়াত জগতের মানুষের মাঝে বিলিয়ে না দেই; বরং শুধু নিজেদের পার্থিব উন্নতি সাধনে লিপ্ত থাকি, তাহলে এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কী হতে পারে?
আমাদের আজ ভেবে দেখা উচিৎ, কেন আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। দুনিয়ার ক্ষেত-খামার, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ-সংসার ইত্যাদি জাগতিক কাজকর্মে মগ্ন থাকার জন্য নয়; বরং এক সুমহান দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এসেছে, “তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দিবে আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।” -সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০
আমাদের পূর্বসূরিগণ তাদের জীবনের লক্ষ্য সঠিকভাবে বুঝেছিলেন এবং তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলেন। রূহানিয়াত ও আধ্যাত্মিকতার যে অমূল্য সম্পদ তাদের কাছে ছিল, সমগ্র মানবজাতির মাঝে তা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তারা অমর হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। মহান সাধক খাজা আজমিরী রহ.-এর কথাই ধরুন, আত্মশুদ্ধির ময়দানে তাঁর বিপ্লবী অবদানের জন্য হিন্দুস্তানের বিধর্মীরাও তাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে থাকে। কিন্তু আজ আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন ও মানবতার খেদমত থেকে বিমুখ হয়ে শুধুই পার্থিব ভোগ-বিলাস ও বৈষয়িক উন্নতি সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছি, বলাবাহুল্য আমাদের এই অবহেলার কারণে বিধর্মীরা ইসলামের শীতল ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে, আমরাও বঞ্চিত হয়েছি মর্যাদা ও স্বস্তির জীবন থেকে।
তাই সর্বস্তরের মুসলমানের কাছে আহবান, জীবনের লক্ষ্যকে জানুন এবং তার দিকে ফিরে আসুন। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করুন এবং আখেরাতের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে জীবনের মোড় পরিবর্তন করুন। এরপর এই অধঃপতিত মানবগোষ্ঠীর মাঝে ইনসানিয়াত ও মানবতার বাণী প্রচার করুন। মানব সমাজের প্রতি এটাই হবে সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ।
পরিশেষে আরও একটি কথা আরয করতে চাই, আমাদের শিক্ষিত সমাজের একটি শ্রেণীর ব্যাধি হল- তারা পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার প্রতি দুর্বল, যে মত ও দর্শন পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট, তাই তারা লুফে নিতে প্রস্তুত থাকে। সে ভাইদের নিকট বিনয়ের সাথে আরয করতে চাই, জাগতিক উন্নতি ও বৈষয়িক সমৃদ্ধিতে ইউরোপ-আমেরিকার অগ্রগতি অনস্বীকার্য। কিন্তু রূহানিয়্যাত ও আত্মশুদ্ধির অমূল্য সম্পদ তাদের কাছে নেই। তাই এ ব্যাপারে তাদের পথ-নির্দেশ আশা করা শুধুই দুরাশা।
অতএব আসুন আত্মপরিচয় লাভ করি এবং হীনম্মন্যতার শিকার না হয়ে সামনে অগ্রসর হই। যারা কম্পিউটার, রকেট, স্যাটেলাইটের মতো বিস্ময়কর প্রযুক্তি আমাদের উপহার দিয়েছে, আমরা তাদের আল্লাহ-প্রেম, আখেরাতের ভয় ও মানবতার সম্পদ উপহার দেই।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ লুৎফে রাব্বী
(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)