কোমল ব্যবহার
একটি বিলুপ্তপ্রায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “জান্নাতে এমন অপূর্ব কিছু বালাখানা থাকবে, যার ভিতর থেকে বাহিরের এবং বাহির থেকে ভিতরের দৃশ্য দেখা যাবে”। আবু মুসা আশআরী রা. প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ এই বালাখানাগুলো কাদের জন্য? নবীজি উত্তর দিলেন, “যারা কোমল ভাষায় কথা বলে, খাদ্যহীনকে খাদ্য দান করে এবং গভীর রাতে মানুষ যখন গভীর নিদ্রায় বিভোর, তখন আল্লাহর সামনে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকে।” -মুসনাদে আহমদ হাদীস ১৭৩
অন্য হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নম্র কথা সদকার সমতুল্য এবং নামাযের দিকে প্রতিটি পদক্ষেপ একেক সদকার সমতুল্য। -মুসনাদে আহমদ ২/২১৩
অন্য হাদীসে এসেছে, যারা নম্রতা বজায় রাখে এবং মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকে, জাহান্নামের জন্য তাদেরকে হারাম করে দেওয়া হয়েছে। -মুসনাদে আহমদ ১/৪১৫
এখানে তিনটি হাদীস পেশ করা হয়েছে। এই হাদীসগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। তবে যে বিষয়টি তিনটি হাদীসেই রয়েছে তা হল অন্যের সঙ্গে কোমল ভাষায় কথা বলা এবং নম্র আচরণ করা। এই গুণটি মানুষকে একটি ব্যাতিক্রমী মাহাত্ম প্রদান করে এবং চারপাশের মানুষ তাকে ভালোবাসতে অনেকগুলো আরম্ভ করে। আমাদের সমাজে কোমল ভাষায় কথা বলাকে ভদ্রতার অংশ গণ্য করা হয়। তবে এ ভদ্রতাটুকু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। ইসলামী শিক্ষার সফলতা হল, ইসলাম এই বিষয়টিকে দু’চার ক্ষেত্রে আচরিত ভদ্রতা হিসেবে দেখতে চায়নি; বরং একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যরূপে মানব স্বভাবের অংশ বানিয়ে দিতে চেয়েছে। সকল স্বার্থচিন্তার উর্ধ্বে ওঠে মুসলমান সবার সঙ্গেই কোমল আচরণ করবে। যার কাছে কোনো প্রয়োজন আছে তার সঙ্গেও, যার কাছে প্রয়োজন নেই তার সঙ্গেও। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী লোকদের সঙ্গেও, অধীন ও দুর্বল শ্রেণীর সঙ্গেও। কেননা মুসলমানদের সুন্দর ব্যবহার পার্থিব স্বার্থচিন্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না; বরং তা নিয়ন্ত্রিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণা দ্বারা। উপরের হাদীসগুলোতে এ কথাটি পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখিত হয়েছে। আমরা যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বোত্তম আদর্শরূপে বিশ্বাস করে থাকি তাই আমাদের উচিত তার শিক্ষা পরিপূর্ণ আস্থা ও ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করা। অন্যথায় আমাদের চারিত্রিক দৈন্য কখনো ঘুচবে না এবং আমাদের আচার-আচরণ থেকে ইসলামী বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাবে না। বর্তমান সময়ে ভদ্রতার যে নিয়মগুলো রয়েছে শুধু সেগুলো দ্বারা আমাদের আচার-আচারণ সংশোধিত হবে এমন ভাবাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি। আমাদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে একটি পরিচিত শব্দ হল; “লোকাল বাস” ঢাকার বাসিন্দাদের বিরাট এক অংশ এই বাসের নিয়মিত যাত্রী। এ বাসগুলোতে যে দৃশ্য সবসময় দেখা যায় তা হল যাত্রী ও কন্ট্রাক্টারের বচসা। বাসের কন্ট্রাকটাররা সব সাধু একথা বলছি না। তাহলে তো ওরা আর কন্ট্রাকটারী করত না। কিন্তু বিনা দোষেও যে ওরা অহরহ খারাপ ব্যবহার পেয়ে থাকে তা কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। লোকাল বাসে কী পরিমাণ ভিড় হয় তা ভুক্তভোগীরা সবাই জানে। এত মানুষের চেহারা মনে রাখা বেচারা কন্ট্রাকটারের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা লোকাল বাসের যাত্রীরা তার উপর এই কঠিন দায়িত্বটাই চাপিয়ে দেই। যদি সে কারো চেহারা ভুলে যায় এবং তার কাছে দ্বিতীয়বার ভাড়া চায় তখন সে হুংকার দিয়ে বলে ওঠে-ভাড়া কয়বার দিব। অনেককে দেখেছি, এই অবস্থায় চুপচাপ বসে থাকে। কোনো উত্তর দেয় না। কন্ট্রাকটর বুঝতে পারে না সে ভাড়া দিয়েছে কি দেয়নি। তখন সে আবার ভাড়া দাবি করে এবং আবার। এক পর্যায়ে যাত্রী লোকটা চরমভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং গালিগালাজ শুরু করে। অথচ ব্যাপারটা এমন কঠিন কিছু ছিল না, বলে দিলেই চলত যে, ভাড়া দিয়েছি। তা না করে যা করা হল একে সুন্দর আচরণ বলা যায় না। এটাই হল রুক্ষতা। হাদীস শরীফে একে নিষেধ করা হয়েছে।
আরেকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি, বর্তমান যুগটা হল মোবাইলের যুগ। এখন মোবাইলবিহীন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যারা মসজিদে নামায পড়তে আসেন তাদের অনেকের কাছেও মোবাইল আছে। এ জন্য যেকোনো মসজিদের দেওয়ালে একটি বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়। নামাযের সময় মোবাইল ফোন বন্ধ রাখুন। মসজিদে আগত মুসল্লীরা মোবাইল বন্ধ করেই নামায শুরু করেন। কিন্তু কখনো কেউ হয়ত ভুলে গেল এবং দুর্ভাগ্যক্রমে তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হয় তা সহজেই অনুমেয়। এক্ষেত্রে নামায শেষ হওয়ার পর সাধারণত যা হতে দেখা যায় তা খুবই দুঃখজনক। আমরা তাকে অনেক বেশি শাস্তি দিয়ে ফেলি। নামাযের সালাম ফিরানোর সাথে সাথে সবাই তার দিকে অদ্ভুদ বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকাতে থাকে। কেউ কেউ তো সবার সামনেই তাকে বকাঝকা করতে থাকে। কটুক্তি এবং কটাক্ষও চলতে থাকে। সব মিলিয়ে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করা হয় যেন সে এইমাত্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধটি সংঘটিত করেছে। বলাবাহুল্য, এই আচরণ মোটেই ঠিক নয়। তবে যারা নামাযে মোবাইল বন্ধ রাখতে অবহেলা করে তাদেরকে সতর্ক করতে হবে। কিন্তু তা নরম ভাষায় হওয়া চাই মসজিদের ভিতর আরও একটি দৃশ্য দেখা যায়। তা হল, কোনো মুসল্লী হয়তো ফরয নামায শেষ করে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তার কোনো প্রয়োজন রয়েছে কিংবা তিনি বাসায় গিয়ে সুন্নত পড়বেন। এবং তার পিছনেও কোনো মাসবুক নেই। তারপরও দেখা যায়, পিছনের কাতারে কেউ কেউ খামোখাই চিৎকার শুরু করে-পাগল নাকি। মসজিদ থেকে বের হওয়ার জন্য এত অস্থির হয়েছেন কেন? মসজিদে থাকতে ভালো লাগে না? ইত্যাদি। একজন নামাযী মানুষের সঙ্গে এই রুক্ষ্ম আচরণ কতটুকু উচিত হল? তাকে বের হওয়ার জায়গা করে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যেত। তা না করে যা করা হল হাদীস শরীফের ভাষায় একেই বলে রুক্ষ্মতা। এটা অবশ্যই পরিচয় করতে হবে। যেহেতু জামাতের নামাযে অনেক ধরনের লোক যাকে তাই-ফরজ নামাযের পর সাথে সাথে সুন্নতের নিয়ত না করে কিছুক্ষণ বিলম্ব করা উচিত, যাতে সামনের কারও প্রয়োজন হলে পিছনে যেতে পারে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও আদর্শ সকল যুগের সকল মানুষের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু বর্তমানে যে সময়টা আমরা অতিক্রম করছি, এ সময় রাসূলের একেকটি আদর্শ আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন। রাসূলের একটি মাত্র আদর্শের প্রশিক্ষণ নিয়েই আমরা যারা দুৎসহ জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি তারা মুক্ত বাতাসে নিৎস্বাস ফেলতে পারি।
আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার সূত্রপাত হয় কথা ও আচরণ থেকে। আমাদের কথা যদি সংযত হয়, শালীন ও মার্জিত হয়, নম্র ও নমনীয় হয়, তাহলে অবাঞ্ছিত অনেক জটিলতা থেকে মুক্ত থাকা যাবে। শেষ কথা হল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের জীবনী ও সীরাত নিয়ে অনেকেই অনেকভাবে চর্চা করেছেন। সীরাত-চর্চার অনেক পদ্ধতি যুগে যুগে নবী-প্রেমিকরা আবিস্কার করেছেন। আসুন আমরা সীরাত-চর্চার সর্বোত্তম পন্থাটি অবলম্বন করি। রাসূলের জীবনকে নিজেদের জীবনের জীবন্ত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করি। আমাদের জীবন-গ্রন্থের একেকটি পাতায় রাসূলের জীবনের একেকটি আদর্শের জীবন্ত রূপ তুলে ধরি।