কুরআনের আলোকে নেককারদের সোহবত
গুরুত্ব ও ফলাফল
সূরা ফুরকানে আল্লাহ বলেছেন,
وَ یَوْمَ یَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰی یَدَیْهِ یَقُوْلُ یٰلَیْتَنِی اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِیْلًا۲۷ یٰوَیْلَتٰی لَیْتَنِیْ لَمْ اَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِیْلًا۲۸ لَقَدْ اَضَلَّنِیْ عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ اِذْ جَآءَنِیْ ؕ وَ كَانَ الشَّیْطٰنُ لِلْاِنْسَانِ خَذُوْلًا
‘জালেম সেদিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, আফসোস! আমি যদি রাসূলের সঙ্গে পথ ধরতাম। হায় আমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার কাছে উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিচ্যুত করেছিল! শয়তান তো মানুষকে বিপদকালে পরিত্যাগ করেই থাকে।’ -সূরা ফুরকান ২৭-২৯
একদিন হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর মুখে এক মজলিসে এই আয়াতগুলো শুনেছিলাম। ইলেকশনের কয়েকদিন আগে দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ করে এই আয়াতগুলো বলেছিলেন। একজন হলেন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব অন্যজন এয়ার ভাইস মার্শাল আমীনুল ইসলাম। ধানমণ্ডির এক বাসায় মজলিস হয়েছিল।
আল্লাহর এই ওলী খুব সহজ সরল কথা বলতেন। তাঁর মূল কথা একটাই ছিল- “দ্বীনের কাজ কর। দ্বীনের সঙ্গে স¤পৃক্ত থাক এবং সেই দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর।” উপরের আয়াতে বলা হয়েছে জালেম সেদিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করবে।
সে দিনটি কোন দিন
কুরআনে এদিনের কথাই বারবার বলা হয়েছে। সূরা ফাতিহায় এসেছে, ‘হিসাব দিবসের মালিক।’ সেদিন কিয়ামত হবে, হিসাব-নিকাশ হবে। সূরা তাকাসুরে এসেছে, ‘সেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’ অন্য আয়াতে এসেছে, ‘সেদিন তাদের মুখে সিল মেরে দেওয়া হবে।’ যবান কথা বলতে পারবে না। সেদিন আল্লাহর সঙ্গে তাদের হাতগুলো কথা বলবে আর তাদের পা গুলো সাক্ষ্য দিবে। -সূরা ইয়াসীন ৬৫
এ আয়াতে পা সাক্ষ্য দেওয়ার কথা এসেছে। অন্য জায়গায় চোখ, কান ও ত্বকের সাক্ষ্যদানের কথা এসেছে। সূরা হা-মীম সাজদায় বলা হয়েছে, “যেদিন আল্লাহর শত্রুদেরকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে এবং তাদের বিন্যস্ত করা হবে বিভিন্ন দলে, তারা যখন জাহান্নামের কাছে পৌঁছবে তখন তাদের কান, চক্ষু ও ত্বক তাদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। তারা তাদের ত্বককে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা বলবে, যে আল্লাহ সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তার দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে । তোমাদের কান, তোমাদের চক্ষু ও তোমাদের ত্বক তোমাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে না- এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তোমরা তাদের কাছে কোনো কিছু গোপন করতে না। তোমাদের ধারণা ছিল যে, তোমরা যা কর তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না।” -সূরা হা-মীম সাজদা ১৯-২২
গোটা কুরআনে একটিই কথা, ওইদিন আসবে। অতএব তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর। কবে আসবে সে প্রশ্নের প্রয়োজন নেই। প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকাই হল মানুষের কাজ। যখন সময় হবে তখন তা অবশ্যই উপস্থিত হবে। তখন দুনিয়ার জীবন খুব তুচ্ছ মনে হবে। কুরআনে এসেছে, “তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, কিয়ামত কখন হবে? এর বর্ণনার সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক? এর পরম জ্ঞান আপনার পালনকর্তার কাছে রয়েছে। যে একে ভয় করে আপনি তো কেবল তাকে সতর্ক করবেন। যেদিন তারা একে দেখবে সেদিন মনে হবে যেন তারা দুনিয়াতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক সকাল অতিবাহিত
করেছে।” -নাযিআত ৪২-৪৬
অন্যত্র এসেছে ‘তারা বলে, এ ওয়াদা কখন আসবে যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক? -সূরা ইউনুছ ৪৮
অর্থাৎ অবিশ্বাসীরা এসব অবান্তর প্রশ্ন করে আখেরাতকে ভুলে থাকতে চায়। সূরা মুলকের এক আয়াতে এর সুন্দর জবাব আছে যে, (হে নবী) “আপনি বলুন, এর ইলম তো আল্লাহর কাছে রয়েছে। আর আমি তো শুধু স্পষ্টভাবে সর্তককারী”। তাহলে আল্লাহ তাঁর সর্বশ্রেষ্ট ও সর্বশেষ রাসূলকে দিয়ে এ কথা বলিয়েছেন যে, কেয়ামত কবে সংঘটিত হবে তার ইলম একমাত্র আল্লাহর কাছেই আছে। বান্দার কাজ হল কিয়ামতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এ প্রস্তুতি মৃত্যু আসার আগেই নিতে হবে। অন্যথায় আফসোস করতে হবে।
জান্নাতী ও জাহান্নামীদের কথা
জাহান্নামীরা সেদিন কী বলে আফসোস করবে তা কুরআন মজীদে বলা হয়েছে। অন্যদিকে জান্নাতীদের খুশির কথা, কী বলে তারা আনন্দ প্রকাশ করবে তা-ও আল্লাহ বলেছেন। আমাদের হাফেজ্জী হুজুর খুশির কথা বেশি বলতেন। জান্নাতীরা বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের দুঃখ দূর করেছেন। নিশ্চয় আমাদের পালনকর্তা বড় ক্ষমাশীল, বড় গুণগ্রাহী।’ -সূরা ফাতির ৩৪
অর্থাৎ তিনি আমাদের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। সামান্য আমলের বদলে কত নিয়ামত আমাদের দান করেছেন।
হাফেজ্জী হুজুর রহ. একটি আয়াত খুব বেশি বেশি পড়তেন । আয়াতটি হল সূরা আ’রাফের ৪৩ নম্বর আয়াত। জান্নাতীরা বলবে, “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে এ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা কখনো পথ পেতাম না, যদি আল্লাহ আমাদেরকে পথ প্রদর্শন না করতেন। আমাদের প্রতিপালকের রাসূল আমাদের কাছে সত্য কথা নিয়ে এসেছিলেন।...” অর্থাৎ মা’বুদ মেহেরবানী করে আমাদেরকে দ্বীনের উপর চালিয়েছেন। তিনি যদি না চালাতেন তবে আমাদের দ্বীনের উপর চলার সামর্থ্য ছিল না।
কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ জান্নাতীদের আনন্দের কথা প্রকাশ করেছেন। তারা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন ফেরেশতারা তাদেরকে সম্মান জানিয়ে সালাম করবে। জান্নাতীগণ বেহেশতের বিভিন্ন নিয়ামত দেখে বলতে থাকবে- এ কথাটাই তো দুনিয়াতে আলেমরা বলেছিলেন। আল্লাহ আজ তা সত্যে পরিণত করেছেন। সূরা যুমারের শেষ আয়াতগুলোতে এসেছে, ‘যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জান্নাতের নিকটে পৌঁছবে এবং জান্নাতের দরজাসমূহ তাদের জন্য খুলে দেওয়া হবে এবং রক্ষী ফেরেশতাগণ বলতে থাকবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখে থাক এবং সদাসর্বদা বসবাসের জন্য জান্নাতে প্রবেশ কর। জান্নাতীরা বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাঁর ওয়াদা পূরণ করেছেন এবং আমাদের এই ভূমির অধিকারী করেছেন, আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা বসবাস করব। আমলকারীদের পুরস্কার কতইনা চমৎকার! এবং আপনি ফেরেশতাদেরকে দেখবেন, আরশের চারপার্শ্বে সমবেত হয়ে তাদের পালনকর্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছে। তাদের মাঝে ন্যায়বিচার করা হবে এবং বলা হবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের।” অর্থ্যাৎ সেখানে শুধু আল্লাহর হামদ ও প্রশংসার কথাই শোনা যাবে।
আল্লাহ তাআলা জান্নাতীদের আনন্দের চিত্র তুলে ধরেছেন, যাতে ঈমানদারগণ তা পড়ে, শুনে, বুঝে অন্তরে তার ছবি এঁকে নেয়। এতো গেল জান্নাতীদের কথা। অন্যদিকে জাহান্নামীদের অবস্থা কী হবে? সেখানে শুধু চিৎকার ও আর্তনাদ, কিন্তু সবই নিষ্ফল। তাদের আফসোস, তাদের চিৎকার কোনো কিছুই অপসারণ করা হবে না । ইরশাদ হয়েছে, “সেখানে তারা চিৎকার করবে এবং সেখানে তারা কিছুই শুনতে পাবে না।” -সূরা আম্বিয়া ১০০
জাহান্নামীরা কোনো সুস্বাদু বস্তু আস্বাদন করবে না। তাদের ঠাণ্ডা পানি নসীব হবে না। তাদেরকে উত্তপ্ত পানি দেওয়া হবে এবং পুঁজ দেওয়া হবে। সূরা নাবায় এই শাস্তির কথা জানানো হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয় জাহান্নাম প্রতীক্ষায় থাকবে। সীমালঙ্ঘনকারীদের আশ্রয়স্থলরূপে। তারা তথায় সুদীর্ঘকাল অবস্থান করবে। সেখানে তারা কোনো শীতবস্ত্র ও পানীয় আস্বাদন করবে না। তবে তাদের ফুটন্ত পানি ও পুঁজ দেওয়া হবে। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “জাহান্নামীরা জান্নাতীদের ডেকে বলবে, আমাদের সামান্য পানি দান কর অথবা আল্লাহ তোমাদের যে রিযিক দিয়েছেন তা থেকে কিছু দাও। জান্নাতীরা বলবে, আল্লাহ এই উভয় বস্তু কাফেরদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। -সূরা আ‘রাফ ৫০
দুনিয়াতে মানুষ যত খুশি আল্লাহর নিয়ামত ভোগ করুক, ঠাণ্ডা পানি পান করুক, আখেরাতে জাহান্নামীদের জন্য এগুলো হারাম করে দেওয়া হবে। এভাবে পুরো কুরআন মজীদে জান্নাত ও জাহান্নামের অবস্থা আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন। যাতে মানুষ আখেরাতকে স্মরণ করে, আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আখেরাতের ইয়াদ এবং আখেরাতের প্রস্তুতির জন্য আল্লাহ-ওয়ালাদের সাহচর্য গ্রহণ করতে হবে এবং মন্দ লোকদের সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হবে।
আমি বলছিলাম হাফেজ্জী হুজুরের কথা। তাঁর কাছে দুজন এয়ার ভাইস মার্শাল উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাদেরকে ধমক দিয়ে বললেন, আমার সহযোগিতা করুন। না হয় কিয়ামতের দিন আফসোস করবেন। এই দেখেন আল্লাহ কুরআনে কী বলেছেন- “জালেম সেদিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, আফসোস! আমি যদি রাসূলের সাথে পথ ধরতাম। হায় আমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার কাছে উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল। শয়তান তো মানুষকে (বিপদকালে) পরিত্যাগ করে।” -সূরা ফুরকান ২৭-২৯
রাসূল যখন ছিলেন তখন যারা রাসূলের দাওয়াত গ্রহণ করেনি তারা যেমন আফসোস করবে তদ্রƒপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর রাসূলের আদর্শের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদেরও একই অবস্থা হবে।
হাফেজ্জী হুজুর রহ. এই আয়াতটি তাদেরকে শোনালেন। আয়াতে দু‘টি কথা আছে। একটি হল রাসূলের পথ পরিত্যাগ করা, আর অপরটি হল মন্দ লোকের কথায় প্রভাবিত হওয়া। যারা মন্দ লোকের কথায় প্রভাবিত হয় তারা আখেরাতে আফসোস করবে- হায়! আমি তো সঠিক পথে চলতে আরম্ভ আরম্ভ কিন্তু “অমুক” আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। এ অমুকটা কে? সে মানুষও হতে পারে আবার সিস্টেমও হতে পারে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেই,- আপনার ছেলেকে মাদরাসায় দিয়েছেন। পরিবেশ বলবে, ছেলেকে মাদরাসায় দিয়েছেন? খাবে কী? উপার্জন করবে কী? একথা আত্মীয়-স্বজন
বলবে। পরিবেশ বলবে। আরও অনেকে বলবে। কিছুদিন আগে প্রথম আলোর গোল টেবিল বৈঠক হল। সেখানে বলা হল, ‘কওমী মাদরাসার সিলেবাস নেই!’ কী আশ্চর্ষের কথা। সিলেবাস ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানগুলো চলে কীভাবে। দারুল উলূম দেওবন্দের কারিকুলাম সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট। তা-ই এই মাদরাসাগুলো অনুসরণ করে। কিন্তু প্রথম আলো বলল, কওমী মাদরাসার সিলেবাস নেই। খবরটি পড়ে আমার খুব দুঃখ হল। ওই বৈঠকে দুইজন নামজাদা লোকের মন্তব্য দেখলাম। দু’জনের একজন আমার সহপাঠী, অন্যজন আমার পরিচিত। প্রথম জন শাহ আব্দুল হান্নান, ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে বিখ্যাত। উনি আমার সহপাঠী। ঢাকা কলেজে এক সাথে পড়েছি। তার রোল নম্বর ছিল ১০০। সে জন্য আমরা এখনও তাকে ‘সেঞ্চুরি’ বলি। এখন বিরাট প-িত। ইসলামের উপর অনেক কথা বলেন। মাশাআল্লাহ দ্বীনের উপর চলেন। দাড়ি আছে। ইনি কওমী মাদরাসার ব্যাপারে এই মন্তব্য করেননি, তবে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। অন্যজনের নাম বলব না। তো কওমী মাদরাসার সিলেবাস নেই, এটা কেমন কথা? কেউ যদি বলে, আপনার চোখ নেই, আপনার হাত নেই কিংবা বলল, আপনার কোনো কাম নেই! কী জবাব দেবেন? এ কথাই বলবেন যে, এর সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। পাগল ছাড়া এমন কথা কেউ বলে না। এভাবে দ্বীনের ব্যাপারে, দ্বীন শিক্ষার ব্যাপারে বিভিন্নজনে বিভিন্ন কথা বলে। মানুষকে দ্বীনের ব্যাপারে অনাগ্রহী করে। এরা সবাই হল কুরআনের সেই ‘অমুক’ -যাদের অনুসারীরা কিয়ামতের দিন আফসোস করে বলবে, হায়! আমি যদি তার অনুসরণ না করতাম!
প্রসঙ্গত আরেকটি কথা বলি। মাদরাসায় ছেলে দিতে এসে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনাদের হেফজ খানায় ইংরেজী- বাংলা নেই? তাহলে আমার বাচ্চাটাকে এখানে ভর্তি করতাম। আমি তো একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্তনার কথা বলি। কিন্তু আমার দ্বিতীয় বেটা আরিফুর রহমান সোজা বলে দেয়-জ্বী না, এখানে এগুলো নেই। আমাকে বলে, ‘আব্বা, আপনি আমাকে ধমক দিবেন না। যারা মনে করে শুধু কুরআন পড়লে ছেলে ঠকে যাবে তাদের ছেলের সীনায় কুরআন থাকে না।’ তাহলে বাচ্চাকে ঠকায় তার বাবা-মা। কিয়ামতের দিন এরূপ বাবা-মায়ের জন্য সন্তানরা আল্লাহর কাছে দ্বিগুণ আযাব প্রার্থনা করবে।
সূরা আহযাবে এসেছে- কাফেররা বলবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের কথা মেনেছিলাম। অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের পালনকর্তা, তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে আপনার মহা লা’নতে নিমজ্জিত করুন।’ -সূরা আহযাব ৬৭-৬৮
কিয়ামতের দিনের কথা দুনিয়াতেই জানিয়ে আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করেছেন। অতএব আমাদের সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। মূল কথা ছিল, নেককারদের সাহচর্য গ্রহণ করা এবং বদকারদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা। এ প্রসঙ্গে থানভী রহ.-এর হায়াতুল মুসলিমীন থেকে একটি অংশ উদ্ধৃতি করে আলোচনা শেষ করছি।
থানভী রহ.-এর ‘হায়াতুল মুসলিমীন’-এর সপ্তম বাব। “নেক লোকদের সোহবত অবলম্বন কর। ভালো ভালো নসীহতের কথা শিখিবার জন্য, স্বভাব-চরিত্র ভালো করিবার জন্য, আমল-আখলাক দুরস্ত করিবার জন্য বুযুর্গদের সঙ্গে সংশ্রব রাখা একান্ত দরকার। এইভাবে যে সকল লোক বড় বড় বুযুর্গ, পূর্বকালীন ধর্ম-জীবনে, কর্ম-জীবনে আদর্শ হইয়া গিয়াছেন, মরিয়াও অমর হইয়া আছেন কিতাবে তাহাদের জীবন-চরিত পাঠ করিয়া বা শুনিয়া তাদের মতো হওয়াও আবশ্যক। কেননা তাহাদের নিকট বসিয়া তাহাদের মূল্যবান উপদেশ শুনিয়া, তাহাদের সোহবতের বরকত হাসিল করিতে পারিলে যত উপকার হইত ইহাতে ততটা উপকার না হইলেও (খেয়াল করেন, কাছে বসার উপকার বেশি আর মৃত যারা তাদের কিতাবাদি পড়ে ততটা উপকার না হইলেও) আমল আখলাক দুরস্ত হওয়ার জন্য অনেকখানি সাহায্য পাওয়া যাইবে। মানুষকে আল্লাহ তাআলা এইরূপে সৃষ্টি করিয়াছেন যে, ভালো হোক আর মন্দ হোক, অন্যের দেখাদেখি মানুষ অতিশীঘ্র অনেক কিছু শিখিয়া ফেলিতে পারে। সুতরাং সৎসংসর্গ অত্যাবশ্যক ও গ্রহণযোগ্য। কুসংসর্গ, বিষবৎ পরিত্যাজ্য।
সৎসংসর্গ অর্থ এই যে, এমন লোকের সাথে উঠাবসা করিবে যাহারা আবশ্যক পরিমাণ দ্বীনী ইলম শিক্ষা করিয়াছেন। আকীদা মজবুত করিয়াছেন। শিরক ও বিদআত হইতে, দুনিয়াদারী ও সন্দেজনক বিষয়টি হইতে বাঁচিয়া থাকেন। যারা রোযা, নামায শরীয়তের অন্যান্য আহকাম ঠিকমতো পালন করেন, লোকের সাথে দেনা-পাওনা পরিষ্কার রাখেন, শরীয়তের মাসআলা অনুযায়ী কায়কায়বার করেন, হালাল, হারাম চিনিয়া মানিয়া চলেন, স্বভাব চরিত্র ভালো করেন, সকলের সাথে নম্র ব্যবহার করেন, নিজেকে ক্ষুদ্রাতি থেকে ক্ষুদ্র বলিয়া মনে করেন, কাহাকেও কোনো কষ্ট দেন না, কাহাকেও কটু কথা বলেন না, কাহারও প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেন না, গরীব- মিসকীনকে ঘৃণা করেন না। তাহাদের হৃদয় সর্বদা সৎগুণাবলি দ্বারা পরিপূর্ণ, তাহারা আল্লাহর ভয়ে সর্বদাই ভীত। দুনিয়ার লোভ-লালসা হইতে তাহারা ম্ক্তু, দ্বীন ঈমানের মোকাবেলায় ধন-সম্পত্তি, মান-সম্ভ্রম, প্রতিপত্তি কোনো কিছুর পরোয়া করেন না। আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার যিন্দেগীর মূল্য তাহাদের নিকট কিছুই নাই। সর্বাবস্থায় তাহারা সবর এবং শুকর করিয়া থাকেন, যাহাদের মধ্যে উক্ত গুণ পাওয়া যাইবে তাহাদের সংসর্গ পরশ পাথর তুল্য। ইহাকেই বলে সোহবতে সালেহ বা সৎসংসর্গ।
যাহাদের এই সকল গুণ চিনিবার শক্তি নাই তাহাদের জন্য একটি উপায় হইল,(এই কথাটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকের হুজুর, বুঝব কীভাবে? ভ- পীরদের সম্পর্কে বলে, এমন সুন্দর দাড়ি, এমন পাগড়ি, এমন সুন্দর নূরানী চেহারা, হুজুরের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। হুজুর তাহলে বুঝব কীভাবে) যাহাদের এই সমস্ত গুণ চিনিবার উপায় নাই, তাহাদের জন্য পন্থা এই যে, বর্তমান যামানায় যাহারা নেককার, তাহারা যাহাকে নেককার বলিয়া জানে (এরকম মানুষ তো দুই চার জন ডানে বামে পাওয়া যাবে তাকে জিজ্ঞাসা কর, আলেমদের জিজ্ঞাসা কর। মাদরাসার পরিচালনা কমিটির বড় বড় আলেম তাদের জিজ্ঞাসা কর) বর্তমান যামানায় যাহারা নেককার ধার্মিক তাহারা যাহাদিগকে নেককার বলিয়া মনে করেন, যাহাদের দরবারে ক্ষণিকের জন্য বসিলেও কুচিন্তা, কুভাবনা থেকে মন পবিত্র থাকে সৎ কাজের প্রতি মন ধাবিত হয়, তাহাদিগকে নেককার ও ধার্মিক বলিয়া বিশ্বাস কর, তাহাদের সোহবত সংশ্রব অবলম্বন কর।
(ক) যাহাদেরকে মন্দ কাজ করিতে দেখ মন্দ কথা বলিতে শোন, পারতপক্ষে তুমি তাহাদের সাথে মেলামেশা করিও না। কারণ ইহাতে দ্বীন ঈমান তো বরবাদ হয়, দুনিয়ারও অনেক ক্ষতি হয়, বাধ্য হইয়া অপকর্মে টাকা পয়সা খরচ করিতে হয়। ধোকায় পড়িয়া কাহাকেও দিয়া দিতে হয়, কোনো সময় হাওলাত দিয়া ফেরত পাওয়া যায় না, কোনো সময় সম্মানের লাঘব হইতে পারে, ইত্যাদি মেলা প্রকার দুর্ভাগ্য অর্জিত হয়। তাই কুসংসর্গ সর্বদা পরিত্যাজ্য। (এক নম্বরে বলেছে সৎসংসর্গ গ্রহণীয়। দুই নম্বরে কুসংসর্গ পরিত্যাজ্য। ক্যাটাগরি তিন-) যাহাদের সম্বন্ধে তোমার কোনো জ্ঞান নাই, কোনো ভালো-মন্দ গুণই দেখিতে পাও না, তাহাদের সম্বন্ধে ভালো ধারণা রাখিবে বটে, কিন্তু তাহাদের কাছেও যাইবে না, তাহাদের সঙ্গেও থাকিবে না। মোটকথা এই যে, ঈমান ও ধর্ম-বিশ্বাস দৃঢ় করিবার জন্য, অন্তর স্বচ্ছ ও নির্মল করিবার জন্য সৎসংসর্গ একান্ত দরকার। (এটা হল ৫২ পৃষ্ঠার একটা অংশ) আমি পিছনের দিকের একটা অংশ পড়ে দুআ করব। এই কথাটা হযরত হাফেজ্জী হুজুর বার বার বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন। হাদীস এবং কুরআন থেকে অনেকগুলো কোটেশন দেওয়ার পরে উনি বলেছেন, বুযুর্গনে দ্বীনের সংসর্গে থাকিয়া, দ্বীনের কথা শুনিয়া উত্তম চরিত্র লাভ করা একান্ত প্রয়োজন। উক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহে তা বর্ণিত হইল। এখন দেখাইতে চাই, পূর্বকালীন ধর্ম পরায়ণ বুযুর্গানে দ্বীনের জীবন-চরিত লিখিত গ্রন্থসমূহ পাঠ করা দরকার। তাহাতেও প্রায় সৎসংসর্গের ন্যায়ই উপকার পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, পয়গাম্বরদের ঘটনা হইতে যেসকল পয়গাম্বরের, নূহ আ. হুদ আ. সালেহ আ. ইব্রাহীম আ. লুত আ. শুআইব আ. মূসা আ.-এর ঘটনা ইত্যাদি আপনাকে তো এই জন্য বর্ণনা করিতেছি যেন ইহার দ্বারা আপনার দিলকে মজবুত করিতে পারি। অর্থাৎ তাহাদের জীবনী শুনিলে বুঝিবেন যে, যেমন তাহার সত্যপথে মজবুত রহিয়াছেন আল্লাহর সাহায্য পাইয়াছেন, তেমনি আমরাও হকের উপর মজবুত থাকিতে পারিলে, একদিন না একদিন আল্লাহর সাহায্য পাইবই পাইব। এই সাহায্যের কথা আল্লাহ সূরা মুমিনে বলিয়াছেন, আমি নবীদিগকে, ঈমানদারদিগকে দুনিয়াতে সাহায্য করি এবং কিয়ামতের দিন তো সাহায্য করিবই। যেদিন সাক্ষ্যদাতা হইতে ফেরেশতারা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দাঁড়াইবে। এ সমস্ত ঘটনা পড়িয়া শুনিয়া এইরূপে শান্তনা পাওয়া যায় যে, বুযুর্গানে দ্বীন যেমন ধর্মের পথে মজবুত থাকায় আল্লাহর প্রেমিক হইয়াছেন, উচ্চপদ লাভ করিয়াছেন, যাহাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা নিজে বলিয়াছেন, নিশ্চয় ভালো পরিণাম তাহাদের জন্য যাহারা মুত্তাকী, যাহারা পরহেযগার। তেমনি আমরাও যদি ধর্মের পথে মজবুত থাকিতে পারি, তাহলে আল্লাহ তাআলা আমাদিগকে ভালোবাসিবেন, উচ্চপদ প্রদান করিবেন। যেমন আল্লাহ তাআলা স্বয়ং ওয়াদা করিয়াছেন, যাহারা মুত্তাকি পরহেযগার তাহারা মর্যাদায় নাফরমানদের উপরে থাকিবে। হযরত ইবনে মাসউদ রা. বলিয়াছেন, সর্বদার জন্য যে ব্যক্তি কোনো তরীকা অবলম্বন করিতে চায় তাহার উচিত ওই সমস্ত ধর্মপরায়ণ লোকদের তরীকা অবলম্বন করা যাহারা অতীত হইয়া গিয়াছেন। কেননা জীবিত লোকের বিশ্বাস নেই, হয়তো পথভ্রষ্ট হইতে পারে। সুতরাং জীবিত লোকদের তরীকা সেই পর্যন্ত ধরা যায় যে পর্যন্ত সে সঠিক তরীকায় ছিল, আর যাহাদের তরীকা সদা সর্বদা অনুসরণ করা যায় তাহারা হইলেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ। তাহাদের সম্পর্কে হাদীসে রহিয়াছে, তাহাদের তরীকা, স্বভাব-চরিত্র, আচার, ব্যবহার দেখিয়া দেখিয়া নিজের স্বভাব চরিত্র গঠন কর। আচার ব্যবহার গ্রহণ কর। সুতরাং সাহাবীদের ন্যায় চরিত্র গঠন করিতে হইলে তাহাদের জীবন চরিত পাঠ করা একান্ত আবশ্যক। যেমন কুরআন শরীফে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম, ওলামা, আওলিয়া কেরামের ঘটনা উল্লেখ করা হইয়াছে তাহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া চলিবার জন্য, তাহাদের জীবনী স্মরণ করিবার কথাও আল্লাহ পাক পরিষ্কার বলিয়াছেন। তাহাদের হেদায়াতের পথ তোমরা অনুসরণ করিয়া চল। যেমন হাদীসে অনেক মকবুল বান্দার ঘটনা বর্ণনা করা হইয়াছে। প্রায় হাদীসের কিতাবে ‘কিতাবুল কাসাস’ নামক পৃথক অধ্যায় আছে। তাহাতে স্পষ্ট হইয়া যায় যে, আল্লাহর মকবুল বান্দাদের ঘটনাবলি চর্চা করা ভালো বরং অত্যাবশ্যক। তাই বুযুর্গানে দ্বীন এইরূপ সৎ ও পরহেযগারদের জীবন ও চরিত্র সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ লেখেন। আমি এখানে কতগুলো গ্রন্থের নাম লিখিয়াছি। যাহা পাঠ করিলে বা শুনিলে ঈমান তাজা হইবে। হেকায়াতুস সালেহীন, তারিখে হাবীবে ইলাহ, নাশরুততীব, মাগাযিউর রাসূল’ কাসাসুল আম্বিয়া, আনওয়ারুল মুসলিমীন।”
এখানে কতকগুলো কিতাবের নাম দিয়েছে, নিচেই অনুবাদকারী বলছেন, বাংলা ভাষায় কিছু কিতাব লেখা হইয়াছে।’ আমরা আপনাদের বারবার বলে থাকি, একটা কিতাব আমার হাতে। এর নাম হায়াতুল মুসলিমীন কিতাবটার কথা আমাদের হযরত হাফেজ্জী হুজুর বার বার বলতেন, থানভী রহ. এর মাওয়ায়েজগুলো বারবার পড়তে বলতেন, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমলের সৌভাগ্য নসীব করুন।
(আমীন)