বাংলা নবববর্ষ ও তা উদযাপনের পদ্ধতি
যে প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই
প্রতি বছরের মতো এবারও উদযাপিত হয়েছে বাংলা নববর্ষ। রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রা, আর তরুণ-তরুণীদের অবাধ-অসংযত মেলামেশা হল, এ উৎসবের কিছু মৌলিক উপকরণ। পত্র-পত্রিকায় এবং রেডিও টিভিতে এ উৎসবকে বাঙালীর প্রাণের উৎসব বলে প্রচার করা হয়। আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দিনকে বরণ করা নাকি বাঙ্গালী জাতির আবহমান কালের সংস্কৃতি। কিন্তু ইতিহাস সন্ধানে দেখা যায়, বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস যত পুরানো এ উৎসবের ইতিহাস ঠিক ততখানি নতুন। তিন চার শ’ বছর আগের হিন্দু জমিদারদের চৈত্র-সংক্রান্তি উদযাপন আর প্রজা সাধারণের কাছ থেকে খাজনা উসূলকে কেন্দ্র করে যেসব আয়োজন অনুষ্ঠান হত সেগুলোকে এ উৎসবের প্রাচীন রূপ ধরে নিয়ে এতে প্রাচীনত্বের ছাপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ প্রচেষ্টা যে ন্যায়সঙ্গত বিচারে একেবারে তর্কাতীত নয় তা বোধ করি বাঙ্গালী সংস্কৃতির সোল এজেন্টরাও অনুভব করে থাকেন।
আজকাল যেভাবে নববর্ষ উদযাপন করা হয় পঞ্চাশ বছর আগেও এসবের কোনো বালাই ছিল না। উনিশ শতক এবং বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কবি সাহিত্যিকদের রচনায় বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিষয়টি চোখে পড়ে না। না কবিতায়, না গল্পে-উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথ ষাট বছর বয়সে লিখেছেন- “এসো হে বৈশাখ...” এর আগ পর্যন্ত তিনিও এদিকে মনোযোগ দেওয়ার ফুরসত পাননি। সত্যিই, বাঙালীর বর্ষবরণ-উৎসব সেকালের কবি-সাহিত্যিকদের কাছে শুধু অবহেলাই পেয়েছে!
রমনার বটমূলে যে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তার সূচনা ১৯৬৪ সালে। অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ ১৩৭১। মঙ্গল শোভাযাত্রা যুক্ত হয়েছে আরও পরে, ১৯৮৬ সালে। যশোরের একটি সংগঠন প্রথম এটা শুরু করে। পরে এর দেখাদেখি ঢাকা ও অন্যান্য শহরেও তা ছড়িয়ে পড়ে। আর নাচ-গান ও তরুণ-তরুণীর অসংযত মেলামেশা পাশ্চাত্য সভ্যতা ও আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে এখন যতটা পুষ্টি লাভ করেছে তা যে এ ভূখণ্ডের আদি ও স্বীকৃত সংস্কৃতি ছিল না তা কোনো ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিই অস্বীকার করবেন না। এখানে মূল প্রশ্নটাই এই যে, বাংলা নববর্ষের শুরুতে বাঙ্গালী সংস্কৃতির কথা খুব জোরে সোরে বলা হলেও এতে সত্যিকার বাঙ্গালী সংস্কৃতির কতটুকু বহিঃপ্রকাশ ঘটে? এ অঞ্চলের সংখাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম। ইসলামী সংস্কৃতি এ জাতির শত বছরের সংস্কৃতি। আলিম-উলামা ও বুযুর্গানে দ্বীনের চোখের পানিতে এ অঞ্চলের ভূমি সিক্ত ও সজীব। একটি জাতির আবহমান কালের আচরিত সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে গুটিকতক লোকের নির্বাচিত কিছু আচার-অনুষ্ঠানকে গোটা জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া কতখানি যুক্তিযুক্ত এবং জাতির পক্ষেও তা কতখানি মর্যাদাকর তা আমাদের ভেবে দেখা উচিত।
আরেকটি বিষয় রয়েছে, যা ছোট হলেও উপেক্ষা করার মতো নয়। বিষয়টি এই যে, আমাদের দেশে সরকারিভাবে যে দিনকে ১লা বৈশাখ ঘোষণা করা হয় এদেশের অনেক বনেদী হিন্দু তার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন না। তারা তাদের নিজস্ব পঞ্জিকা অনুসারে ১লা বৈশাখ গণনা করেন এবং সেদিনই যাবতীয় আয়োজন অনুষ্ঠান করে থাকেন। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে তাদের তিথি ও লগ্ন বিষয়ক ধর্মীয় বিশ্বাস। তারা এ দিনটিকে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই উদযাপন করে থাকেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি রির্পোট প্রকাশিত হয়েছে। কৌতুকের বিষয় এই যে, এ সব কিছু সত্ত্বেও দেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী নববর্ষ-উৎসবকে হিন্দু-মুসলিম উভয় জাতির সম্মিলিত উৎসব বলে প্রচার করে থাকেন। এসব প্রচার-প্রচারণায় তাদের উদ্দেশ্য কী তা সচেতন মানুষের অজানা থাকার কথা নয়। তাই তাদের কথাবর্তায় বিভ্রান্ত না হয়ে আমাদের ভেবে দেখা উচিত যে, বর্তমানে ১লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যা কিছু ঘটে থাকে তা আমাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না।