সেই ঋণের কথা, জীবনকে যা সমৃদ্ধ করে!
কঠিন একটি প্রশ্ন, জীবনকে যারা ভালোবাসে তাদের কাছে; আলোর সিঁড়ি বেয়ে জীবনের পরম সত্যে যারা পৌঁছতে চায় তাদের কাছে এবং জীবনকে যারা প্রজ্বলিত প্রদীপরূপে গড়ে তোলে নতুন নতুন প্রদীপকে প্রজ্বলিত করার জন্য, তাদের কাছে!
প্রশ্নটি হলো— ধনের ঋণ, দুধের ঋণ ও জ্ঞানের ঋণ, এ তিনটি ঋণের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? ঋণ জীবনকে জর্জরিত করে, না জীবনকে সমৃদ্ধ করে? ঋণ কি শোধ করার জন্য, না কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য, ঋণদাতার প্রতি?
হয়ত এ প্রশ্ন তোমার জীবনে এই প্রথম, তবে বিশ্বাস করো, এ প্রশ্নের নিভুর্ল উত্তরের মধ্যেই রয়েছে জীবনের পরম সফলতা এবং যিন্দেগির আসল কামিয়াবি!
ঐ যে দূরে আকাশ দেখো, সেই আকাশের আড়াল থেকে আসা আলোর একটি রেখা একদিন আমার সামনে তুলে ধরেছিলো এই কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর!
তখন থেকে জীবন আমাকে শুধু আলো দান করে এবং অন্ধকার থেকে দূরে রাখে! তখন থেকে জীবন আমাকে সত্যের পথে পরিচালিত করে এবং মিথ্যা থেকে দূরে রাখে! তখন থেকে জীবন আমাকে শুধু সুবাস দান করে ফুলের পাপড়ির মত! আর তখন থেকে জীবনকে আমি ভালোবাসতে শিখেছি, যেমন ভালোবাসে চাঁদ তার জোসনাকে; ফুলের পাপড়ি তার সুবাসকে এবং পথিক পথের ধূলিকণাকে!
সেই আলোর রেখা থেকে আমি জেনেছিলাম, ধনের ঋণ জীবনকে শুধু জর্জরিত করে, দুধের ঋণ জীবনকে পরিপুষ্ট করে আর জ্ঞানের ঋণ জীবনকে করে সমৃদ্ধ! সুতরাং...!
***
একটি শিশু! পৃথিবীর আলোতে যখন চোখ মেলে, পৃথিবীর বাতাসে যখন শ্বাস নেয় তখন কার কাছ থেকে প্রথম ঋণ গ্রহণ করে? মায়ের কাছ থেকে! দুধের ঋণ! প্রতিদিন ফোঁটা ফোঁটা ঋণ গ্রহণ করে শিশু তার জীবনকে পরিপুষ্ট করে! যত গ্রহণ করে তত পরিপুষ্ট হয়, দেহে ও মস্তিষ্কে!
পৃথিবীর প্রতিটি শিশু মায়ের কাছ থেকে দুধের ঋণ গ্রহণ করে! এ ঋণ আমিও গ্রহণ করেছি, তুমিও। দুধের ঋণ থেকে, আমীর-গরীব, আমরা কেউ মুক্ত নই। ৷
মা কি কখনো বলেছেন, দুধের ঋণের কথা! কখনো বলেছেন, ঋণ পরিশোধের কথা! বলেননি! মায়েরা বলেন না! মায়েরা তো মনেও রাখেন না !
কিন্তু যিনি সৃষ্টি করেছেন মায়ের বুকে দুধের ঝর্ণা, তিনি চান, সন্তান যেন আজীবন মনে রাখে দুধের ঋণ এবং সে জন্য মায়ের প্রতি হয় কৃতজ্ঞ। তাহলে সে নিজেই পরম সৌভাগ্য লাভ করে, জান্নাতে দুধের ঝর্ণার অধিকারী হয়!
দুধের ঋণ শোধ করা যায় না! পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তশালী, সবচেয়ে প্রতাপশালী মানুষটিও যদি চায় শৈশবের এক ফোঁটা দুধের ঋণ শোধ করতে, পারবে না!
আমরা কেউ পারবো না! যা পারবো তা হলো, দুধের ঋণ মনে রেখে মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে! মায়ের কদম ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফোঁটা ফোঁটা দুধের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে!
মা তাতে খুশী হন! কেন! সেও তোমারই জন্য! কারণ মা জানেন, কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে সন্তান সৌভাগ্যবান হয়! মা জানেন, তাঁর কদম ছুঁয়ে ছুঁয়ে সন্তান জান্নাতের নিকটবর্তী হয়! দুধের প্রতি সন্তানের কৃতজ্ঞতায় মায়ের খুশি, মায়ের সন্তুষ্টি এ জন্য! সন্তানেরই জন্য! কিন্তু ...!
সন্তান যদি বড় হতে হতে ‘ছোট’ হয়ে যায়! বুকের দুধের কথা ভুলে যায়! দুর্ভাগা সন্তান যদি মায়ের দুধের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়, মা কষ্ট পান! মায়ের চোখ থেকে অশ্রম্ন ঝরে! তখন বুক থেকে দুধ ঝরেছে সন্তানের জন্য! এখন চোখ থেকে অশ্রম্ন ঝরে সন্তানেরই জন্য! কারণ মা জানেন, দুধের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে, কদমের ছোঁয়া থেকে দূরে গিয়ে সে তো জান্নাত থেকেই দূরে সরে যায়! সন্তান ভুলে যায়, তার জান্নাত মায়ের পাক কদমের নীচে!
মায়ের কষ্ট এ জন্য! তাঁর চোখের পানি এ জন্য! তাঁর সন্তানের জন্য!
মায়ের বুকে দুধ ছিলো সন্তানকে জীবন দান করার জন্য! এখন মায়ের চোখে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রম্ন হলো দুর্ভাগা সন্তানকে জান্নাতের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য! তখন প্রতিটি দুগ্ধবিন্দুর আকুতি ছিলো, ‘আমার অবোধ সন্তান যেন বেঁচে থাকে!’ এখন প্রতিটি অশ্রুবিন্দুর আকুতি হলো, ‘আমার অবুঝ সন্তান যেন জান্নাতের পথে ফিরে আসে!’
***
মায়ের বুক থেকে দুধের ঋণ নিয়ে একটু যখন বড় হলাম, শুরু হলো নতুন ঋণের নতুন জীবন! বর্ণশিক্ষার ঋণ! পৃথিবীর প্রতিটি শিশু বর্ণশিক্ষার ঋণ গ্রহণ করেই জীবনের পথে অগ্রসর হয়। আমার সৌভাগ্য, বর্ণশিক্ষার ঋণও আমি পেয়েছি মায়েরই কাছে! প্রতিদিন ভোরে চুলার আগুন-ধোঁয়ার মাঝে বসে মা আমাকে শিখিয়েছেন আলিফ বা তা ছা...! হায়, কী স্মৃতিমধুর চুলার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঐ দিনগুলো! তারপর যখন শুরু হলো শিক্ষাজীবন, যখন প্রবেশ ঘটলো ইলমের অঙ্গনে তখন আবার শুরু হলো ঋণগ্রহণের নতুন ধারা! জ্ঞানের ঋণ, ইলমের ঋণ!
এটাও তো আসলে দুধেরই ঋণ! এজন্যই হয়ত দুধের সঙ্গে ইলমের উপমা! মেরাজ রজনীতে এজন্যই হয়ত দুধের পেয়ালা...!
আমার শূন্য জীবনকে জ্ঞানের ঋণে সমৃদ্ধ করেছেন একে একে বহু শিক্ষক! তাঁদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ! কারো ঋণই শোধ করা সম্ভব নয়। সম্ভব শুধু ঋণের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করা!
শিক্ষকের ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়, মনে রাখা তো সম্ভব! আমরা মনে রাখি না কেন! আমরা ভুলে যাই কেন এবং অকৃতজ্ঞ হই কেন! তাতে তো আমরাই বঞ্চিত হই! শিক্ষক, ঋণ দান করেন কিছু ফিরে পাওয়ার আশা না করে; সেই ঋণের দান তো তাঁর কাছে ফিরে আসে বহু গুণ হয়ে আল্লাহর পক্ষ হতে! ঋণের দান ভুলে গিয়ে আমরা কেন বঞ্চিত হই! ঋণ দ্বারা সমৃদ্ধ না হয়ে আমরা কেন ঋণের ভারে জর্জরিত হই!
***
রাতের আকাশে অনেক তারা থাকে এবং থাকে জোসনাভরা একটি চাঁদ। দিনের আকাশে থাকে প্রখর আলো দানকারী একটি সূর্য।
আমাদের জীবনে রয়েছে তারাদের আলোর ঋণ! সামান্য সামান্য আলো, তবে সবগুলো মিলে হয় অনেক আলো! তারাদের আলো সামান্য বলে ঋণ ভুলে যেয়ো না এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না। আকাশের অন্ধকারে তারারা মেলা বসায় কেন জানো! প্রতিটি তারা আলোকিত চাঁদের জন্য তোমাকে প্রস্তুত করতে চায়, এ জন্য!
তুমি যদি তারাদের আলোর প্রতি কৃতজ্ঞ হও, তাহলে তুমি পাবে পূর্ণিমার চাঁদ এবং চাঁদের জোসনা! সেই জোসনার শুভ্রতায় তোমার জীবন হবে প্লাবিত।
আমার কথা বিশ্বাস করো, অন্ধকার আকাশের তারাদের যারা ভুলে যায়; তারাদের আলোর প্রতি যারা অকৃতজ্ঞ হয়, আকাশে যদিও চাঁদ থাকে, চাঁদের জোসনা থেকে তারা বঞ্চিত হয়! মেঘের আড়ালে চাঁদ ও তার জোসনা যে ঢাকা পড়ে যায়!
আমার কথা শোনো; তারাদের আলোর ঋণ গ্রহণ করে চাঁদের কাছে যাও। প্রাণভরে চাঁদের জোসনা গ্রহণ করো! চাঁদের জোসনায় জীবন স্নিগ্ধ করো এবং চাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ হও।
চাঁদ এত জোসনা ছড়ায় কী জন্য জানো! নিজের স্নিগ্ধ জোসনা দিয়ে তোমাকে প্রস্তুত করার জন্য, আগামী দিনের প্রখর আলোর সূর্যকে যেন তুমি বরণ করতে পারো, এ জন্য!
চাঁদ তোমাকে বলে, রাতই জীবনের সবটুকু নয়! রাতের পরে রয়েছে রাঙা প্রভাত এবং প্রভাতের রাঙা সূর্য! তুমি প্রস্তুত হও, সূর্যের আলোর জন্য! সূর্যের আলোতে সারাদিন, সন্ধ্যা পর্যন্ত পথ চলার জন্য! তুমি যদি চাঁদের প্রতি, চাঁদের জোসনার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, তখন তুমি পাবে একটি রাঙা সূর্যের মিলন ও আলিঙ্গন! তোমার জীবনে তখন আলোর কোনো অভাব হবে না! শুধু আলো আর আলো! কিন্তু ভুলে যেয়ো না, দিনের আকাশে সূর্যের আলোর জন্য তোমাকে প্রস্তুত করেছে রাতের আকাশের চাঁদ, নিজের জোসনা দিয়ে, স্নিগ্ধতা দিয়ে! মায়া ও মমতার স্পর্শ দিয়ে!
আমার কথা বিশ্বাস করো, চাঁদের প্রতি যারা অকৃতজ্ঞ হয়, জোসনার ঋণ যারা ভুলে যায়, প্রভাতদিগন্তে রাঙা সূর্যের দেখা তারা পায়, তবে সূর্যের মিলন ও আলিঙ্গন থেকে বঞ্চিত হয়। সূর্য তাদের জীবনে আলো ছড়ায় না। এত রোদ, এত আলো, তবু চলার পথটি তারা দেখতে পায় না! অকৃতজ্ঞতার মেঘ তাদের চোখের আলোকে সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখে!
আমার কথা শোনো; চাঁদের ঋণ স্বীকার করে, জোসনার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে ভোরের রাঙা সূর্যকে আলিঙ্গন করো। সূর্যের আলোতে পথ চলো, আলোর উৎসের সন্ধানে! এবং সূর্যের প্রতি কৃতজ্ঞ হও।
আমার কথা বিশ্বাস করো, সূর্যের প্রতি যারা অকৃতজ্ঞ হয়, সূর্য থাকে তাদের জীবনে, তবে সেইসঙ্গে থাকে ‘সূর্যগ্রহণ’! তাই তাদের জীবনে সূর্যের আলো থাকে না! প্রকৃতির অপ্রসন্নতায় সূর্যের আলো থেকে তারা বঞ্চিত হয়। তাদের আর পথ চলা হয় না— সূর্যের আলোর উৎসের সন্ধানে!
***
আঁধার রাতের মুসাফির হে বন্ধু! জ্ঞানের সন্ধানে, ইলমের সাধনায় তোমার আগে আমি পথচলা শুরু করেছি তো, তাই তোমাকে আমি এমন কিছু বলতে পারি, যা তোমার অজানা, যা তোমার জন্য নতুন! যদি বিশ্বাসের সঙ্গে শোনো, যদি উপলব্ধির সঙ্গে গ্রহণ করো এবং হৃদয় দিয়ে বরণ করো, (তাহলে) তারার আলো, চাঁদের জোসনা এবং রাঙা সূর্যের মিলন ও আলিঙ্গনের রহস্য তোমার সামনে উদ্ভাসিত হবে।
দূর অতীতে যখন আমার জীবনে শুরু হলো জ্ঞানের সন্ধান ও ইলমের সাধনা তখন, যিনি বলেছেন ‘পড়ো’ তিনি আমার জীবনের আকাশকে সাজিয়েছেন প্রথমে কিছু তারার আলো দিয়ে! তারপর একটি চাঁদের জোসনা দিয়ে এবং তারপর এক সুন্দর প্রভাতে একটি সূর্যের উদ্ভাস দিয়ে!
আমার পরম সৌভাগ্য, তারাদের আলোর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম; তাই চাঁদের সান্নিধ্যসৌভাগ্য লাভ করেছি এবং চাঁদের জোসনায় স্নাত হতে পেরেছি। চাঁদের প্রতি, চাঁদের জোসনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ছিলো, তাই জীবনের প্রভাতদিগন্তে রাঙা সূর্যের উদয় হয়েছিলো এবং সূর্যের আলোতে সূর্যের আলোর উৎসের সন্ধানে আমার পথচলা শুরু হয়েছিলো।
***
আমার জীবনের আকাশে সেই তারারা এখন নেই, তবে সেই ঝিলমিল আলোর পরশ আছে। হারিয়ে যাওয়া তারাদের প্রতি এখনো তাই আমি কৃতজ্ঞ। সেই ঋণে তাই এখনো আমি সমৃদ্ধ।
আমার জীবনের আকাশে সেই জোসনাভরা চাঁদ এখন নেই। অস্ত গিয়েছে ‘মৃত্তিকার আড়ালে’! তবে মৃত্তিকার আড়াল থেকেও সেই চাঁদের জোসনার স্নিগ্ধ পরশ আছে আমার জীবনে। তাই অস্ত যাওয়া চাঁদের প্রতি এখনো আমি কৃতজ্ঞ। সেই ঋণে জীবন আমার এখনো সমৃদ্ধ।
এমনকি যে সূর্যটির সঙ্গে এক সুন্দর প্রভাতে আমার মিলন হলো, আলিঙ্গন হলো এবং পথচলা শুরু হলো আলোর উৎসের সন্ধানে সেই সূর্যটিও এখন নেই আমার জীবনের আকাশে। ধীরে ধীরে কখন যেন অস্ত গিয়েছে সন্ধ্যার দিগন্তে। তবে সমস্ত আলো রেখে গিয়েছে জীবনের আকাশে আমার পথচলার জন্য। অস্ত যাওয়া সূর্যটির প্রতি তাই এখনো আমি কৃতজ্ঞ। সেই ঋণে জীবন আমার এখনো সমৃদ্ধ।
হে নিভে যাওয়া তারার দল! ‘অদৃশ্য’ তোমাদের প্রতি করুণা করুন। তোমাদের আমি ভুলিনি! ঝিলমিল আলোর জন্য তোমাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ!
আমার জীবনের আকাশ থেকে অস্ত যাওয়া হে জোসনাভরা চাঁদ! মৃত্তিকার আড়ালে তুমি অস্ত গিয়েছো! তবু... তবু তোমার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ— আমার জীবনকে জোসনার বন্যায় প্লাবিত করার জন্য। অদৃশ্যের কাছে আমার কামনা, মৃত্তিকার আড়ালে তুমি চাঁদের মতোই উজ্জ্বল থাকো।
আমার জীবনের রাঙা প্রভাতের হে রাঙা সূর্য! সন্ধ্যার দিগন্তে তুমি অস্ত গিয়েছো; তবু হৃদয়ের গভীরে এখনো তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আজীবন তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো আমার জীবনে রেখে যাওয়া তোমার বিপুল আলোর জন্য। অদৃশ্যের কাছে প্রার্থনা, তোমার আলো কখনো যেন ‘অস্ত’ না যায়। ‘অদৃশ্য’ তোমার জন্য যেন ‘দৃশ্য’রূপে হন উদ্ভাসিত! অনন্তলোকে আলোর উদ্যানে, ঝর্ণার তীরে তোমার সঙ্গে হয় যেন আবার মিলন, আবার আলিঙ্গন!
***
অদৃশ্যের অশেষ করুণার কথা চিন্তা করে সত্যি আমি আপ্লুত! সেই দূর অতীতে আমার জীবনের আকাশে যদি চাঁদের উদয় না হতো, চাঁদের জোসনায় জীবন যদি প্লাবিত না হতো! জীবন তাহলে কেমন হতো! অমাবশ্যার অন্ধকার ছাড়া আর কী হতো!
তাই চাঁদের কাছে আমার আলাদা করে একটি ঋণ আছে, তারাদের চেয়ে বেশী! এমনকি প্রভাতদিগন্তের রাঙা সূর্যটির চেয়ে বেশী! এই চাঁদের জোসনা যদি না হতো, ভোরের রাঙা সূর্যের সঙ্গে আমার মিলন ও আলিঙ্গন কীভাবে হতো!
আমার জীবনের চাঁদই আমাকে পথ দেখিয়েছে জীবনের সূর্যের দিকে! এ জন্যই সম্ভব হয়েছে আমার জীবনে চাঁদ ও সূর্যের মিলন! ভোরের আকাশে চাঁদ ও সূর্যের মিলন কখনো কি তুমি দেখোনি! আমার জীবনের আকাশেও ছিলো সেই রকম মিলন চাঁদের ও সূর্যের! এটা যাদের জীবনে ঘটে তারা বড় ভাগ্যবান! তবে বিশ্বাস করি, এ ভাগ্য যোগ্যতার অর্জন নয়, অদৃশ্যের দয়া ও করুণার দান!
***
আঁধার রাতের মুসাফির হে বন্ধু! তুমিও গ্রহণ করো আমার কৃতজ্ঞতা। তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ গভীর রাতের এই নিঝুম নির্জনতায় একটু সঙ্গ দেয়ার জন্য, মমতার সঙ্গে আমার কথা শোনার জন্য। আমার জীবনের গল্প তো শুধু নিজের জন্য নয়, তোমারও জন্য! তোমার জীবনেও তো আছে ‘আকাশ’, সেই আকাশে আছে তারার আলো, চাঁদের জোসনা ও সূর্যের কিরণ! তোমার জীবনও সমৃদ্ধ হতে পারে যদি কৃতজ্ঞ হতে পারো তারার আলোর প্রতি, চাঁদের জোসনার প্রতি এবং ভোরের রাঙা সূর্যের প্রতি ।
আমার জীবনের প্রভাতদিগন্তে প্রথম কখন সূর্যের উদয় হলো! এবার শোনো সেই গল্প! তার আগে প্রার্থনা করো, সময় যেন ফুরিয়ে না যায়, সময় যেন জীবনের বাগানে অসংখ্য ফুল হয়ে ঝরতে থাকে! আমার তোমার সবার জীবনে সময় যেন শিউলী ফুলের মতো সুবাস ছড়াতে থাকে। জীবনের গল্প ফুরোবার আগে সময় যদি ফুরিয়ে যায় তাহলে তো...!
ফিরে আসি জীবন—আকাশের চাঁদ ও জোসনার কাছে, জীবন প্রভাতের রাঙা সূর্যের কথা বলার জন্য। কারণ চাঁদ ও জোসনাই তো আমাকে পথ দেখিয়েছে জীবনের সূর্যের দিকে!
কখন! যখন আমার জীবনে প্রয়োজন ছিলো বিপুল চিন্তার আলো! চেতনার আলো! এবং চরিত্রের শুভ্রতা ও পবিত্রতার অনিঃশেষ জ্যোতি! যখন প্রয়োজন ছিলো জীবনের অঙ্গনে ‘দূরের আলো’র সঙ্গে ‘কাছের আলো’র মহামিলন, যার আয়োজন করতে পারে শুধু জীবন-প্রভাতের দিগন্তে উদিত রাঙা সূর্য!
***
প্রিয় বন্ধু! তুমি কি আমার ছাত্র! যদি বলো, না! তাহলে তোমার সঙ্গে আমার এখানেই কথা সমাপ্ত! এখান থেকেই তুমি প্রবেশ করতে পারো, তোমার জন্য একটু সামনে যে আলোর ভুবন অপেক্ষা করছে সেই ভুবনে।
যদি বলো, হাঁ, তাহলে একটু অপেক্ষা করো। তোমার সঙ্গে আমার আরো কিছু কথা আছে! রাত অনেক গভীর হয়েছে! রাতের নির্জনতা অনেক নিবিড় হয়েছে! এমন সময় আসমানের দুয়ার খুলে যায়! এমন সময় ডাক আসে, নিবেদনের! সমর্পণের! এর চেয়ে সুন্দর সময় আর কী হতে পারে, সেই পথটি দেখিয়ে দেয়ার জন্য, জীবনকে যা তারার আলোতে, চাঁদের জোসনায় এবং সূর্যের কিরণে আলেকিত করে! এসো, তোমাকে বলি, জীবনের সেই পরম রহস্যের কথাটি! তুমি যদি ইলমের প্রতি পিপাসু হও তাহলে বিশ্বাস করো, অদৃশ্যে যিনি পরম আলো হয়ে বিরাজ করেন, তিনি তোমার জীবনকেও দান করেছেন একটি আকাশ। সেই আকাশকে তিনি রাতের জন্য সাজিয়েছেন বহু তারা দিয়ে এবং একটি চাঁদ দিয়ে। তোমার জীবন-আকাশের সেই তারাগুলোর আলো গ্রহণ করো! কৃতজ্ঞ হও। মিটি মিটি আলো বলে অবজ্ঞা করো না। তারার আলো থেকেও তুমি পেয়েছো কিছু কিছু ঋণ। তাছাড়া তারার মেলা থেকে তুমি পেয়েছো চাঁদের সঙ্গে মিলনের সেতুবন্ধন। চিনতে পেরেছো বন্ধু, তোমার জীবন-আকাশের মিটিমিটি তারাদের!
তুমি চাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ হও। চাঁদের জোসনার কাছে রয়েছে তোমার বিপুল ঋণ। চাঁদ কখনো বলে না, আমার জোসনার ঋণ শোধ করো। কিন্তু তুমি যদি সেই ঋণের কথা মনে রাখো, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে, তাহলে তোমার জীবন-আকাশে রাতের যে চাঁদ তা তোমাকে পৌঁছে দেবে প্রভাতদিগন্তের রাঙা সূর্যটির কাছে, যেখান থেকে তুমি পাবে, শুধু আলো আর আলো; যে আলো জ্ঞানের রাজ্যকে যেমন আলোকিত করে, তেমনি আলোকিত করে চিন্তার রাজ্যকে! যে আলো জীবনের বহিরাঙ্গনকে যেমন আলোকিত করে তেমনি আলোকিত করে জীবনের অন্তরাঙ্গনকেও। চিনতে পেরেছো বন্ধু, তোমার জীবন-আকাশের সেই জোসনাভরা চাঁদ!
জীবন প্রভাতের রাঙা সূর্যের প্রতি কৃতজ্ঞ হও। জীবনের প্রভাত থেকে জীবনের সন্ধ্যা পর্যন্ত সূর্যের বিপুল আলোতেই তো তোমাকে পথ চলতে হবে আলোর উৎসের সন্ধানে! তুমি কি চিনতে পেরেছো বন্ধু, জীবনের রাঙা প্রভাতের সেই রাঙা সূর্যটি!
***
দূর আকাশের আরো দূরের পরম আলোর কাছ থেকে এই যে একটি ‘আলোর কণা’ অর্জন করেছি, সেটা নিজের যোগ্যতায় নয়, পরম আলোরই পরম মমতার কল্যাণে। সেই আলোর কণাটুকুই আজ এই নির্জন রাতে হে বন্ধু! তোমাকে দেখেছি বা দেখিনি, তোমাকে চিনেছি বা চিনিনি, তবু তোমাকে আমি বরণ করেছি, আমার জীবন কাফেলার যাত্রীরূপে, তাই সেই আলোর কণাটুকু তোমার হাতে অর্পণ করছি আনন্দিত চিত্তে! এবং নিশ্চিন্ত হও! এটা আমার পক্ষ হতে কোনো ঋণ নয়, যদি হয়ও, এ ঋণ তোমাকে কখনো শোধ করতে হবে না! নাও, সেই আলোর কণাটি গ্রহণ করো, ‘তারার মিটিমিটি আলো, চাঁদের সর্বপ্লাবী প জোসনা এবং সূর্যের প্রখর কিরণ’ — এরই নাম তোমার জ্ঞানজীবন, চিন্তাজীবন, বহির্জীবন এবং অন্তর্জীবন!
এবার এসো বন্ধু এই সূর্যের কাছে! এই বিপুল আলোর রাজ্যে! এই সূর্য বিপুল আলোর সম্ভার নিয়ে তোমাকে পৌঁছে দেবে ঐ সূর্যের কাছে, যার কখনো অস্ত নেই!
(সৌজন্যে : পশ্চিম দিগন্তে, পূর্ব দিগন্তে। আদীব হুযুর দামাত বারাকাতুহুমের অনুমতিক্রমে)