প্রশ্নোত্তর
[আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের সর্বশেষ শিরোনাম প্রশ্নোত্তর। এর অধীনে প্রত্যেক সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ তিন থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। সংক্ষেপের জন্য প্রশ্নকারীর নাম-পরিচয় অনুল্লেখ থাকবে।]
প্রশ্ন ৬১ : হাউজে কাউসারের কথা অনেক শুনেছি। কুরআন শরীফে আলকাউসার নামে একটি সূরাও আছে। সে আলকাউসার দ্বারা কি হাউজে কাউসার বোঝানোই উদ্দেশ্য? হাউজে কাউসার কী?
উত্তর : আলকাউসার (الكوثر) শব্দের অর্থ ‘প্রচুর পরিমাণ, প্রভূত কল্যাণ’ ইত্যাদি। আরবি ভাষায় কোনো ক্ষেত্রে প্রচুর সংখ্যক এবং অনেক ভালো কিছুর সমষ্টি বোঝাতে কাউসার শব্দ ব্যবহার করা হয়, যেমন স্তুপীকৃত বস্তু, অনেক সম্পদ, এমনকি দানশীল ব্যক্তিকেও কাউসার বলে।
আবার জান্নাতের একটি বিশেষ নদীর নামও কাউসার, যা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করা হয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে—
الكَوْثَرُ نَهْرٌ فِي الجَنَّةِ، حَافَّتَاهُ مِنْ ذَهَبٍ، وَمَجْرَاهُ عَلَى الدُّرِّ اليَاقُوتِ، تُرْبَتُهُ أَطْيَبُ مِنَ المِسْكِ، وَمَاؤُهُ أَحْلَى مِنَ العَسَلِ، وَأَبْيَضُ مِنَ الثَّلْجِ.
هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ.
অর্থাৎ কাউসার জান্নাতের একটি নদী, যার দুই তীর স্বর্ণের, যা মুক্তা ও ইয়াকুতের উপর দিয়ে প্রবাহিত, যার মাটি মেশকের চেয়েও সুগন্ধময়, যার পানি মধুর চেয়েও মিষ্টি এবং বরফের চেয়েও সাদা। —জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৬১
কিয়ামতের দিন জান্নাতের সেই কাউসার নামক নদীর পানি প্রবাহিত হয়ে হাশরের মাঠে একটি হাউজে জমা হবে। সেই হাউজটি হল হাউজে কাউসার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের মধ্যে যারা তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে চলবে, তারা এখান থেকে পানি পান করে পরিতৃপ্ত হবে।
এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আনাস রা. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে বসে ছিলেন। হঠাৎ তিনি কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। কিছুক্ষণ পরে মাথা তুলে মুচকি হাসলেন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কেন হেসেছেন?
তিনি বললেন, এইমাত্র আমার উপর একটি সূরা নাযিল হয়েছে। তারপরে তিনি সূরা কাউসার তিলাওয়াত করলেন। তখন আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান, কাউসার কী?
আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।
তিনি বললেন—
فَإِنَّهُ نَهْرٌ وَعَدَنِيهِ رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ، عَلَيْهِ خَيْرٌ كَثِيرٌ، هُوَ حَوْضٌ تَرِدُ عَلَيْهِ أُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، آنِيَتُهُ عَدَدُ النُّجُومِ، فَيُخْتَلَجُ الْعَبْدُ مِنْهُمْ، فَأَقُولُ: رَبِّ، إِنَّهُ مِنْ أُمَّتِي فَيَقُولُ: مَا تَدْرِي مَا أَحْدَثَتْ بَعْدَكَ.
এটা এমন এক নদী, যার প্রতিশ্রম্নতি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, তাতে বিপুল কল্যাণ রয়েছে। এটা এমন এক হাওজ, কিয়ামতের দিন আমার উম্মত যার পাশে একত্র হবে। তার পেয়ালা সংখ্যা তারকারাজির সমান। কোনো কোনো বান্দাকে সেখান থেকে পান করতে বাধা দেওয়া হবে। তখন আমি বলব, হে আল্লাহ! এরা আমার উম্মত।
তিনি বলবেন, আপনি জানেন না, আপনার পরে তারা কী করেছে! —সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪০০।
এ সম্পর্কে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের অন্যান্য কিতাবে আরও অনেক হাদীস রয়েছে।
সূরা কাউসারে ‘কাউসার’ শব্দের অর্থ যদি করা হয় ‘প্রভূত কল্যাণ’, তবে ‘জান্নাতের কাউসার নামক নদী ও হাশরের মাঠের হাউজে কাউসার’- তার অন্তভুর্ক্ত হয়ে যায়। (তাফসীরে তবারী ২৪/৬৭৯, ৬৮৫; তাফসীরে কুরতুবী ২০/২১৬-২১৮; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৮৮৭-৮৯০; মাআরিফুল কুরআন ৮/১১০৫-১১০৬)
প্রশ্ন ৬২ : সূরা ফাতেহায় غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ -এর তাফসীরে ইহুদীদের কথা এবং وَ لَا الضَّآلِّیْنَ -এর তাফসীরে খ্রিস্টানদের কথা বলা হয়। অথচ তারা উভয় দলই তো আল্লাহ তাআলার অভিশাপপ্রাপ্ত এবং পথভ্রষ্ট। তাহলে এভাবে দুই শব্দে দুই দলকে নির্দিষ্ট করা হয় কেন?
উত্তর : হাঁ, তারা উভয় দলই আল্লাহ তাআলার অভিশাপপ্রাপ্ত এবং বিপথগামী। তবে ইহুদীদের প্রতি আল্লাহ তাআলার গযব ও অভিশাপের কথা খোদ কুরআনে বারংবার বলা হয়েছে এবং তারা এ হিসাবেই বেশি পরিচিত। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
قُلْ هَلْ اُنَبِّئُكُمْ بِشَرٍّ مِّنْ ذٰلِكَ مَثُوْبَةً عِنْدَ اللهِ مَنْ لَّعَنَهُ اللهُ وَ غَضِبَ عَلَیْهِ وَ جَعَلَ مِنْهُمُ الْقِرَدَةَ وَ الْخَنَازِیْرَ وَ عَبَدَ الطَّاغُوْتَ اُولٰٓىِٕكَ شَرٌّ مَّكَانًا وَّ اَضَلُّ عَنْ سَوَآءِ السَّبِیْلِ.
(হে নবী! তাদেরকে) বল, আমি কি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, (তোমরা যে বিষয়কে খারাপ মনে করছ) আল্লাহর কাছে তার চেয়ে মন্দ পরিণাম কার হবে? (তারা) ওইসকল লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন, যাদের প্রতি ক্রোধ বর্ষণ করেছেন, যাদের মধ্যে কতককে বানর ও শূকর বানিয়ে দিয়েছেন এবং যারা শয়তানের পূজা করেছে। তারাই নিকৃষ্ট ঠিকানার অধিকারী এবং তারা সরল পথ থেকে অত্যধিক বিচ্যুত। —সূরা মায়েদা (৫) : ৬০
এছাড়া আরও অনেক আয়াতে তাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার গযব ও নবীগণের লানতের কথা এসেছে।
অন্যদিকে খ্রিস্টানরা তাদের উপযুর্পরি বিপথগামিতার কারণে বেশি পরিচিত। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে—
قُلْ یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ لَا تَغْلُوْا فِیْ دِیْنِكُمْ غَیْرَ الْحَقِّ وَ لَا تَتَّبِعُوْۤا اَهْوَآءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوْا مِنْ قَبْلُ وَ اَضَلُّوْا كَثِیْرًا وَّ ضَلُّوْا عَنْ سَوَآءِ السَّبِیْلِ.
(এবং তাদেরকে এটাও) বলে দাও যে, হে কিতাবীগণ! নিজেদের দ্বীন নিয়ে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না এবং এমন সব লোকের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না, পূর্বে যারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অপর বহু লোককেও পথভ্রষ্ট করেছে এবং তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। —সূরা মায়েদা (৫) : ৭৭
তাছাড়া হযরত আদী ইবনে হাতিম রা.-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ -এর ক্ষেত্রে ইহুদীদের এবং الضَّآلِّیْنَ -এর ক্ষেত্রে খ্রিস্টানদের কথা বর্ণিত হয়েছে। (দ্রষ্টব্য, জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৫৩-২৯৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯৩৮১) আরও দেখুন, তাফসীরে তবারী ১/১৮৫-১৯৫; তাফসীরে কুরতুবী ১/১৪৯-১৫০