Rabiul Auwal 1428   ||   April 2007

আমেরিকায় আমি কী পেয়েছি আর কী পাইনি?

Mawlana Syed Abul Hasan Ali Nadwi

নিম্নলিখিত বক্তৃতাটি  ১৯৭৭ সালের ১৯শে জুন আই.আই.টি শিকাগোর হারমান হল অডিটোরিয়ামে (আমেরিকা) শিক্ষার্থী  মুসলমানদের এক বিরাট সমাবেশে প্রদত্ত হয়েছিল।

 

হামদ ও সানার পর

মানুষ দুর্লভ

প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবাল তার বিখ্যাত ফারসী দীওয়ান আসরারে খুদীতে মাওলানা রূমীর একটি বিখ্যাত উক্তিকে  উল্লেখ করেছেন। তিনি (মাওলানা রূমী) বলেন,

(অনুবাদ) আমি একজন বুযুর্গকে দেখলাম, প্রদীপ হাতে কিছু খঁুজে বেড়াচ্ছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হযরত আপনি কী খুঁজছেন? তিনি বললেন, জীব জানোয়ার ও চতুষ্পদ জন্তুর ভেতর বাস করে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। এবার আমি মানুষের খেঁাজে বেরিয়েছি। চারপাশের অথর্ব মানুষের ভিড়ে আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছি। আমি একজন শেরে খোদা ও বীর যোদ্ধাকে খঁুজে ফিরছি। আমি তাকে বললাম, হযরত, আপনি এক দুর্লভ বস্তুর সন্ধানে বেরিয়েছেন। আপনি যা খুঁজছেন তা পাবার নয়। বুযুর্গ তখন গম্ভীর মুখে  বললেন, মিঞা এটাই আমার রোগ, যা পাবার নয় তাই আমি খেঁাজ করি।

ভ্রাতৃবৃন্দ, আপনাদের জানা আছে যে, আমি এমএসএর আমন্ত্রণে এখানে এসেছি। কলম্বাসের মতো না হলেও একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এবং এমন একজন মানুষ হিসাবে যিনি ধর্ম সম্পর্কে অল্পবিস্তর পড়াশোনা করেছেন, আমার জন্য এ এক নতুন জগত।  আমি এমএসএর কাছে কৃতজ্ঞ যে, তারা আমাকে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কেবল তাই নয়, তারা আমাকে আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত স্বচক্ষে দেখার ব্যবস্থা করেছেন। এখানকার লোকজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার এবং তাদেরকে লক্ষ করে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই স্বল্প সময়ে এখানকার লোকদের সম্পর্কে  যতটুকু জানা সম্ভব তার সুযোগ করে দেবার জন্য আমি আবারও তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে ক্যলিফোর্নিয়া পর্যন্ত গিয়েছি। কানাডাও সফর করেছি। এই সময়ের মধ্যে তিনচার হাজার মাইল পথ আমি সফর করেছি। সফরের শেষ প্রান্তে এসে আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। এটি আমার সফরের শেষ মনযিল। আপনারা স্বাভাবিকভাবেই আমার সফরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইবেন। যেহেতু আমি এমন একটি দেশের নাগরিক, যে দেশটি এখন পর্যন্ত  অত্যন্ত পশ্চাৎপদ এবং পাশ্চাত্যের তুলনায় কয়েক শতাব্দী পেছনে তাই আপনারা ভাবতে পারেন, আমি আপনাদের সামনে  রসিয়ে রসিয়ে  এখানকার উন্নতি অগ্রগতির কাহিনী শোনাব। কিন্তু এগুলো যেহেতু আপনাদের ঘরের  জিনিস এবং আপনারা আমার তুলনায় অনেক বেশি ওয়াকিবহালম, তাই আমি এর কোনো প্রয়োজন দেখি না।

আমি আপনাদেরকে মাওলানা রূমীর একটি বয়েত শুনিয়েছি, যা আপনাদের অনেকের কাছেই আশার বিপরীত মনে হবে। মাওলানা রূমী এমন এক ভূখণ্ডে (আনাতোলিয়া) বাস করতেন যা উন্নতি, অগ্রগতি সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ  ছিল না; বরং তা একটি সভ্য ও সুসংস্কৃত ভূখণ্ড ছিল। তিনি এমন এক নগরের নাগরিক ছিলেন যেখানে এক বিশাল সাম্রাজ্যের (সালজুকী সাম্রাজ্যের) ভিত্তি স্থাপিত হতে যাচ্ছিল। তিনি ইরানের অন্তর্গত বলখ শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যা সে যুগের সবচে সভ্য দেশ ছিল এবং যাকে প্রাচ্যের  গ্রীস বলাটাই সঙ্গত হবে, যা কাব্যে, সাহিত্যে, দর্শনে বিরাট খ্যাতির জন্ম দিয়েছিল এবং যে দেশটি ইতিহাসের বুকে গভীর ছাপ রেখে গেছে। কিন্তু তারপরও তিনি (মাওলানা রূমী) আপন হৃদয়ের ব্যথা এই কয়েকটি পংক্তির মধ্যে  পেশ করেছেন। অন্যের মুখে হলেও নিজের মনের  অভিব্যক্তিই এই পঙক্তিগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে।  তিনি বুযুর্গের কাহিনী শোনাচ্ছেন, কিন্তু তা মূলত তাঁরই  আত্মকাহিনী। তিনি বলছেন যে, এই বিরাট রৌনকপূর্ণ ও কোলাহলে ভরপুর শহরে আমিই এক দুর্ভাগা মানুষ, যে মানুষের আকৃতি দেখার জন্য হা হুতাস করে। আমি এখানে সব কিছু দেখতে পাই, কিন্তু মানুষ দেখতে পাই না। সমুচ্চ প্রাসাদ, গুলজার শহর, শ্যামল বাগিচা, ঘনবসতিপূর্ণ মহল্লায় খাবারের ছড়াছড়ি, রঙবেরঙের পোশাক, বিচিত্র সভ্যতা-সংস্কৃতির অপূর্ব সমাহার-সব কিছুই স্বস্থানে বর্তমান। কিন্তু প্রকৃত মানুষ চোখে পড়ছে না।

মাওলানা রূমী অপর এক কবিতায় একথাই আরেকটু খুলে বলেছেন, যার মর্মার্থ হল, তোমরা  যাদেরকে মানুষ ভাবছ তারা মানুষ নয়, এরা হল উদর সর্বস্ব প্রাণী, এরা প্রবৃত্তিজাত কামনা বাসনার হাতে বন্দী।

যন্ত্রের প্রাচুর্য    

আমি যদি আপনাদেরকে বলি, অল্প সময়ের ভেতর আমেরিকার যতটুকু দেখা যায় আমি তা দেখেছি। আমি পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত গিয়েছি। আমি এখানে শুধু যন্ত্রের উন্নতি দেখেছি। আপনারা এখানে যে বসন্তের সমাহার দেখছেন, তা বিজ্ঞানের, শিল্প ও কৃষির এবং টেকনোলজির প্রাচুর্য। এসব জ্ঞান তার শিখর প্রদেশে গিয়ে উপনীত হয়েছে। তা মানুষকে যা দিতে পারত, যে আরামআয়েশ ও ভোগবিলাসের উপকরণ সরবরাহ  করতে পারত, তা সে দিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু যেখানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই, যেখানকার শহরগুলো এমন লোকে লোকারণ্য  যে, পথ চলাই দায়, মানুষের সেই অরণ্যে যদি জিজ্ঞেস করা হয় এখানে প্রকৃত মানুষের সংখ্যা কজন, যার বুকে একটি দরদী হৃদয় আছে, যার চোখে সহানুভূতির অশ্রম্ন আছে এবং যার নিজ প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ আছে? এমন মানুষ কজন, যে সভ্যতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়; বরং সে সভ্যতার নিয়ন্ত্রক। যে জীবন দ্বারা শাসিত নয়; বরং জীবনের শাসক? সেই মানুষের সংখ্যা কত, যে তার স্রষ্টাকে চেনে, যার অন্তর তার প্রেম ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণর্, মানবতার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধায় নতজানু, যার জীবন সহজ, সরল ও আড়ম্বরহীন। যে জীবনের প্রকৃত স্বাদ সম্পর্কে  পরিচিত, যে মানুষের ব্যথায় ব্যথিত। জাতিতে জাতিতে হানাহানি, রেষারেষি, সংঘাত সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থপরতা যে পছন্দ করে না, যে কোনো দেশকে  বিপদগ্রস্ত  দেখতে পারে না, যে সকল দেশের উন্নতি কামনা করে এবং নিঃস্বার্থভাবে সব দেশের খেদমত করতে চায়, যে দেবার জন্য  অস্থির, নেবার জন্য নয়, অসহায় ও দুর্ভাগা লোকদের চিন্তায় যে বিনিদ্র রাত কাটায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির দরিদ্র মানুষের কল্পনায় যার ঘুম উড়ে যায়, যে জীবনের লক্ষ্য কেবল এতটুকুই ভাবে না যে, খাও দাও, ফূর্তি কর, যার জীবনের মূলনীতি এই নয় বাবর, মজা লোটো; কেননা দুনিয়া পুনরায় ফিরে আসবে না। যারা মনে করে কোনো মানুষকে খাইয়ে নিজে উপবাসী থাকার মধ্যে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার জন্য হাজারো রকমের মজাদার খাবার উৎসর্গ করা যায়। যাদের  এই নিশ্চিত  বিশ্বাস যে, মনুষ্যত্বের চেয়ে বড় কোনো মর্যাদার বস্তু নেই, যারা হেরে যাবার মধ্যে নিজের জিত ও খোয়ানোর মধ্যে প্রাপ্তি রয়েছে বলে ভাবে।  যারা কেবল  নিজের দেশ গড়বার  মধ্যেই নিমগ্ন নয়; বরং মনুষ্যত্ব বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে, যারা সমগ্র দুনিয়াটাকেই এক ও অবিভাজ্য সত্তা হিসাবে দেখতে চায়, জাতিসংঘের সাময়িক ও প্রদর্শনী সর্বস্ব মঞ্চের উপর নয়; বরং মানবীয় ঐক্যের প্রকৃত মঞ্চের উপর, যে তার জীবনের সূচনা ও পরিণতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং সেদিকেই  তার মনোযোগ নিবদ্ধ, যে মনে করে আমাদের কোনো সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং আমরা পোকামাকড়ের মতো উদরপূর্তি করে জীবন কাটিয়ে মাটিতে মিশে যাব না; বরং আমাদেরকে কোথাও যেতে হবে এবং আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে বিরাট যোগ্যতা ও সামর্থ্য দান করেছেন তার হিসাব দিতে হবে। যে যোগ্যতা প্রাণহীন ও জড় পদার্থের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছে, যা আসমানের অদৃশ্য ও প্রচ্ছন্ন বস্তুসমূহ আয়ত্তে এনেছে, যমীনের ডুরিগুলো গুটিয়ে এনেছে, সুর্যরশ্মিকে বন্দী করেছে, মেধা ও শ্রমের বদৌলতে চাঁদে পেঁৗছেছে। যে এই সূক্ষ্ম বিষয় সম্পর্কে  ওয়াকিবহাল যে, প্রাণহীন জড় পদার্থের  মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটানো এবং জড় পদার্থের সাহায্যে সমগ্র বিশ্বকে পোষ মানানো মানুষের কামাল নয়; বরং মানুষের কামাল হল তার নিজের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটানো। আল্লাহ তাআলা মানুষের কাঠামো সৃষ্টি করে খিলাফতের রাজমুকুট তার মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন। এজন্য মানুষের উন্নতি এটা নয় যে, সে নির্জীব জড় পদার্থের গোলামে পরিণত হবে; বরং মানুষের উন্নতি এই যে, সে জড় পদার্থকে নিজের গোলামে পরিণত করবে। না, না, নিজের গোলাম বানাবে না; বরং আল্লাহর গোলাম বানাবে। সে আল্লাহর ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে তাকে ব্যবহার করবে। এরই নাম খেলাফতে ইলাহিয়া বা আল্লাহর খেলাফত।

স্বর্ণের খাঁচায় বন্দী

যে মানুষ দেশে দেশে রাজত্ব কায়েম করা, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রমাণ করা এবং সকলের মস্তক নিজের সামনে অবনত করাকে নিজের চরম উন্নতি মনে করে না; বরং সে  নিঃস্বার্থভাবে মানবতার খেদমত করতে চায় এবং দুনিয়ার কোনো দেশ, কোনো মানবগোষ্ঠীর, অপর কোনো দেশ ও সমাজের গোলামে পরিণত হওয়াকে কখনো মেনে নিতে পারে না। যে মানুষকে নফসের গোলামী থেকে, শক্তির গোলামী থেকে, সম্পদের গোলামী থেকে, পঁুজির গোলামী থেকে এমনকি জ্ঞান ও বুদ্ধির গোলামী থেকেও বের করতে চায়।

আরবের  সেই বেদুঈন যার শির ইসলামের বদৌলতে গগণচুম্বী হয়ে গিয়েছিল তিনি পারস্য সেনাপতি রুস্তমকে বলেছিলেন, আল্লাহ আমাদেরকে পাঠিয়েছেন যেন আমরা মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে  মুক্ত করে আল্লাহর গোলামীতে ন্যস্ত করি এবং দুনিয়ার সংকীর্ণ কুঠরি থেকে  বের করে দুনিয়ার প্রশস্ত অঙ্গনে এনে দাঁড় করাই। যে রুস্তমের নাম শুনে বীর যোদ্ধাদেরও হৃদকম্পন সৃষ্টি হত তার ভরা দরবারে বেদুঈন এ কথা বলতে পেরেছিল যে, ইসলাম আমাদেরকে এজন্যই এখানে পাঠিয়েছে যেমানুষকে মানুষের গোলামী থেকে বের করে আল্লাহর গোলামীতে  প্রবেশ করাই এবং দুনিয়ার যিন্দানখানা -যার নাম তোমরা রেখেছ পারস্য সাম্রাজ্য-তা থেকে বের করে আমরা তোমাদেরকে দুনিয়ার অন্তহীন প্রশস্ততা ও আযাদীর সঙ্গে পরিচিত করাই। আমরা আমাদের অবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ  হয়ে নয়; বরং তোমাদের অবস্থার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে এখানে এসেছি। তোমাদের ছন্নছাড়া করুণ অবস্থাই আমাদেরকে আরবের মরুভূমি থেকে টেনে বের করে এনেছে। হে হতভাগা পারসিকরা, তোমরা  খাঁচায় বন্দী বুলবুলের ন্যায়, যেখানে তোমরা কিচির মিচির করছ, নেচে গেয়ে মন ভোলাচ্ছ। সে স্বর্ণপিঞ্জর থেকে মুক্ত করে তোমাদেরকে অন্তহীন দিগন্তের মাঝে নিয়ে যেতে চাই। তোমরা তোমাদের অভ্যাসের গোলাম, খেলতামাশার গোলাম, যারা তোমাদেরকে শরাব পান করায় তাদের গোলামতোমরা তোমাদের  গায়ক, কথক ও পাচকদের গোলাম। আমরা কেবল আল্লাহর গোলাম, আমরা তোমাদেরকে ওই অসংখ্য গোলামী থেকে মুক্ত করতে এসেছি। কম্পিউটারও এ গোলামীর সীমা-সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারবে না। কেননা কম্পিউটার তো ভেতরের জগত সম্পর্কে  অবগত নয়, সে কেবল বাইরে যা আছে তাই গুনতে পারবে। কিন্তু যখন শিরা উপশিরায় গোলামীর রক্ত প্রবাহিত হয়, যখন গেলামীই অভ্যাসে পরিণত হয়, যখন গোলামী আযাদীর মুকাবিলায় ভালো মনে হয় তখন সেই গোলামীর পরিসংখ্যান কোনো কম্পিউটারও বের করতে পারবে না। আরবের সেই  বেদুঈন বলেছিল, আমরা তোমাদেরকে ওই সব গোলামী থেকে বের করতে এসেছি, যার সংখ্যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া  আর কেউ জানে না।

আলো একটাই অন্ধকার বেশুমার

স্বাধীনতা একটাই, কিন্তু গেলামী ও পরাধীনতা অসংখ্য। আলো একটাই, কিন্তু অন্ধকার বেশুমার। এজন্যই আপনারা দেখতে পান কুরআন মাজীদে যেখানেই এ প্রসঙ্গ এসেছে, নূর (আলো) শব্দটি একবচন হিসেবেই এসেছে। আল্লাহ ঈমানদারদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকারসমূহ থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান। আরবী ভাষায় কি নূর শব্দের  বহুবচন হয় নাকুরআন মজীদের অঁাচল কি সঙ্কীর্ণ? আসল ব্যপারটি হল, নূর একটাই আর অন্ধকারের সীমা সংখ্যা অগণিত। আলোর উৎস একটাই আর তা হল, আল্লাহর মারিফত। সেখান থেকে যদি আলোক উৎসারিত না হয়, তাহলে হেদায়েতের আলো প্রাপ্তির আর কোনো মাধ্যম নেই। আমরা এই দেশটাকে দেখছি আর ইকবালের কবিতা স্মরণ করছি। ইকবাল এখানে আসেননি কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে তার অধ্যয়ন আমাদের থেকে অনেক বেশি গভীর ছিল। তিনি বলেন, ইউরোপে অনেক আলো, সে আলো জ্ঞান, কৌশল ও নৈপুণ্যের। তবে সত্য হল, সে অতল আঁধার সাগরে আবে হায়াতের ধারা নেই।

যে জাতির দামান আসমানী দান হতে শূন্য তাদের সকল পূর্ণতার পরিসমাপ্তি হল বাষ্প ও বিজলী।

অর্থাৎ পাশ্চাত্য এমন এক আঁধার সাগর যেখানে জীবন সঞ্জীবনী পানির অস্তিত্ব নেই। একটি প্রাচীন রূপকথা আছে যে, অতল সাগরে আবে হায়াত পাওয়া যায়। এজন্য বাদশাহ যুলকারনায়ন হযরত খিযিরকে বলেছিলেন, আমাকে সেই আঁধার সাগরে আবে হায়াতের প্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিন। খিযির হার মেনেছিলেন এবং বলেছিলেন, আমি সেখানে পৌঁছুতে পারব না।  একেই ইকবাল বলেছেন, পাশ্চোত্যে অতল সাগরের ন্যায় অন্ধকার আছে কিন্তু সেখানে আবে হায়াত নেই। যে জাতি আসমানী দান থেকে এবং ঐশী বারিরাশি থেকে মাহরূম হয়ে যায়, নবুওয়তের আঁচল যার হাত থেকে খসে পড়ে, যারা কেবল নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধির উপরই নির্ভর করে, যাদের সকল মেধা, প্রতিভা ও যোগ্যতা কেবল নিষ্প্রাণ জড় পদার্থের উপর ব্যয়িত হয়, যারা মনুষ্য জগতের পরিবর্তে মহাশূন্যকে নিজেদের শ্রম, মেধা ও সাধনার ক্ষেত্র বানায়, তাদের পরিণতি হল, জড় পদার্থ তাদের  অনুগত হয়, কিন্তু তার নিজের প্রবৃত্তি বশীভূত হয় না। সমগ্র জগত বশ মানে, কিন্তু আত্মার জগত বশ মানে না। পাশ্চাত্য তাদের ক্ষেত্র বানিয়েছে বস্তুকে। বস্তুগত উন্নতি অগ্রগতিকে তারা জীবনের পরম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে, আর আল্লাহর চিরন্তন রীতি হল, মানুষ নিজের কর্মপ্রচেষ্টার যে ক্ষেত্রই নির্বাচন করে তিনি তাকে সে ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। মানুষ যে ময়দানে অগ্রসর হতে চায়, আল্লাহ তাকে অগ্রসর হবার সুযোগ দান করেন।  এখন সমস্যা হল ক্ষেত্র নির্বাচন।

খৃস্টধর্ম ছিল ইউরোপের জন্য বেমানান, অনুপযোগী

আপনাদের ভেতর যারা পাশ্চাত্যের ইতিহাস এবং এখানকার সভ্যতাসংস্কৃতির ক্রমধারার ইতিহাস সম্পর্কে অবগত এবং যারা ড্রেপারের বিখ্যাত পুস্তক পড়হভষরপঃ নবঃবিবহ জবষরমরড়হ ধহফ ংপরবহপব পড়েছেন, যারা গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সংঘাত এবং ধর্ম ও বিজ্ঞানের রক্তাক্ত সংঘর্ষের কাহিনী পড়েছেন তাদের জানা আছে যে, যখন এদেশটি খৃস্টধর্ম গ্রহণ করল এবং খৃস্টধর্মের প্রচারকদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও নিরন্তর প্রয়াসের ফলে খৃস্টধর্ম এই ভূখন্ডে পেঁৗছে গেল এরপর আপনাআপনিই এমন অবস্থা সৃষ্টি হল যে, পাশ্চাত্য তার কর্মপ্রচেষ্টার ক্ষেত্র হিসাবে বস্তুকেই গ্রহণ করল। কেননা তারা ধর্মকে তাদের কর্মপ্রয়াসের ক্ষেত্র বানাতে পারত না। খৃস্টধর্মজ্ঞান ও বুদ্ধি থেকে উপকৃত হওয়া এবং জীবনকে সুবিন্যস্ত ও উন্নতির পথে অগ্রসর করতে উৎসাহী করত না; বরং তা তাদেরকে পিছনে নিয়ে যেতে চাইত। এই ভূখণ্ডের জাতিগুলোর স্বভাব ও প্রকৃতি ছিল অস্থির ও বেচাইন। এই অস্থির প্রকৃতি তাদেরকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। কুদরতের গুঢ় রহস্যসমূহ এবং উন্নতির সমূহ সম্ভাবনা তাদের সামনে উঁকি মারছিল। ইউরোপের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে যে তীব্র প্রতিযোগিতা অব্যাহত ছিল তা তাদেরকে এ ভূখণ্ডের সবটুকু প্রাণরস নিংড়ে নিতে এবং ধরার  ধুলিতে ফুল ফোটাতে উদ্বুদ্ধ করছিল। তারা নি®প্রাণ জড় পদার্থকে বাকশক্তি প্রদান করতে চাইছিল।  দুনিয়ার বুকে যে বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এই ছিল যে, তারা তাদের মেধা ও সাধনার এমন এক ক্ষেত্র নির্বাচন করবে যেখানে তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দী  থাকবে না। এ ভূখণ্ডের এটাই ছিল দুর্ভাগ্য; বরং সত্যি বলতে  গোটা মানবতারই দুর্ভাগ্য যে, এই গতির নেশায় উন্মুখ জাতিটির ভাগে খৃস্টধর্ম নসীব হল। বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে  ওয়াকিবহাল কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, পাশ্চাত্যের  স্বভাব প্রকৃতির সবচেয়ে বিপরীত ধর্ম কোনটি? তাহলে তার জওয়াব এটাই হবে যে, তা হল খৃস্টধর্ম। আর যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এজাতির অস্থির প্রকৃতিকে তৃপ্ত করে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার, উপায় উপকরণ ও তা ব্যবহারের লক্ষ্যউদ্দেশ্যের মাঝে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার এবং এর সূত্র  ধরে মানবতার কল্যাণ ও অগ্রগতির নতুন পরিকল্পনা তৈরি করার এবং সমগ্র মানবতাকে সঠিক রাস্তায় দাড় করার যোগ্যতা কোন ধর্মের রয়েছে? তাহলে যে কোনো ইনসাফপসন্দ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ কেবল একটি জওয়াবই দেবেন যে, তা হল ইসলাম।

খৃস্টধর্মমতে মানুষ জন্মগতভাবেই পাপী। জন্মগত পাপের ভারি বোমা  তার মাথাকে নিম্নমুখী করে দিচ্ছে।  তো এই বিশ্বাস নিয়ে, যা একজন খৃস্টান হিসেবে তাকে পোষণ করতেই হবে, সে কীভাবে নিজের প্রতি আস্থাশীল হতে পারে? যে মানুষটি আপাদমস্তক পাপের  কলঙ্কে নিমজ্জিত এবং জন্মগত পাপের লজ্জায়  লজ্জিত সে জগতের চোখে চোখ রেখে কীভাবে কথা বলবে? সে প্রকৃতিক শক্তি ও সম্ভাবনাগুলো-ভূমি থেকে  কীভাবে আহরণ করবে? কীভাবেই বা  অতলান্ত সাগরের বুক চিরে অগ্রসর হবার এবং তারকালোকে পাড়ি জমাবার স্বপ্ন দেখবে?

এ এমনই এক টানাপড়েন যার দৃষ্টান্ত বিশ্বের বুকে পাওয়া যায় না। যেন একটি গাড়িতে দুটো ঘোড়া জুতে দেওয়া হয়েছে। একটি ছুটছে পেছনের দিকে, আরেকটি ছুটতে চাইছে সামনের দিকে। ইউরোপের অবস্থাও এমনই হয়েছিল। এতেও দুটো গরু কিংবা  দুটো ঘোড়া জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এখানকার আবহাওয়া ও পরিবেশের প্রভাবই এমন যে, তাদের স্বভাব প্রকৃতি সামনে অগ্রসর হতে এবং কিছু এটা করতে অস্থির ছিল কিন্তু খৃস্টধর্মের যে ঘোড়া এতে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল তা তাদেরকে পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, সন্নাসবাদ ও বৈরাগ্যবাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। গির্জাধিপতিরা পরিষ্কার বলত যে, মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি জীবন থেকে পালিয়ে যাবার মধ্যেই নিহিত। মানুষ যদি আধ্যাত্মিক উন্নতি চায় তাহলে তাকে পাহাড়ের গুহায় থাকতে হবে, গির্জার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হবে, দাম্পত্য সম্পর্ক একেবারেই ত্যাগ করতে হবে, নারীর মুখ দেখাও উচিত হবে না। আপনারা লেকি লিখিত ইতিহাস ঊঁৎড়ঢ়বধহ সড়ৎধষং নামক গ্রন্থটি পড়লে দেখতে পাবেন, সে সময়কার পাশ্চাত্যের মানুষ জননীর ছায়া দেখলেও দৌড়ে পালাত। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের  দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে যে, মা হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসছে বুকের মানিককে এক নজর দেখবে বলে, আর ওদিকে সন্তান যখন এ কথা জানতে পারছে, তখন সে এভাবে পালাচ্ছে যেভাবে মানুষ ভুতপ্রেত দেখলে পালায়। অবশেষে বেচারী মা কেঁদেকেটে বুক চাপড়ে ফিরে যাচ্ছে। এটা ছিল সেই খৃস্টধর্ম যা ইউরোপ ও আমেরিকার নসীবে পড়েছিল। ফল এই দাঁড়াল যে, ইউরোপ ও আমেরিকা এই ফয়সালা করল যে, যদি উন্নতি করতে হয় তাহলে প্রথমে আমাদেরকে গির্জার গোলামী থেকে মুক্ত হতে হবে এবং ধর্মের কাছ থেকেও ছুটি নিতে হবে। মোটকথা, তারা ধর্মকে বিদায়-সম্ভাষণ জানাল এবং এর থেকে মুক্তিলাভ করল। ইউরোপের উন্নতি তখন থেকে শুরু হল যখন সে খৃস্টধর্মকে জওয়াব দিল এবং একে দূর থেকে সালাম জানাল। এর বিপরীতে মুসলিম অধঃপতনের  ইতিহাস তখন থেকে শুরু হয় যখন থেকে সে ইসলামী আদর্শকে তাকের ওপর উঠিয়ে রাখল।

যন্ত্রের দাস

এ অবস্থা আজ আমেরিকাকে যন্ত্রের দাস বানিয়ে দিয়েছে। আমরা দেখি, আমেরিকার সরকারকে গোটা বিশ্বে মান্য করা হয়। আমেরিকার হাত সমগ্র দুনিয়ার রাজনীতির মাঝে সক্রিয়  দেখা যায়। এ ব্যাপারে কোনো  দেশকেই ব্যতিক্রম ভাবতে পারি না। আজ কোনো দেশই, তা মুসলিম দেশ হোক কিংবা অমুসলিম দেশ, কোনো না কোনোভাবে আমেরিকার গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ। এখানে পরিকল্পনা তৈরি হয় আর আমাদের দেশগুলোতে তা বাস্তবায়িত হয়। আমাদেরই লিডাররা এবং আমাদের প্রশাসনের কর্মকর্তারা সে সব পরিকল্পনা সফল করে তোলেন। আজ আমেরিকা গোটা পৃথিবীকে গোলামে পরিণত করেছে। কিন্তু আমেরিকার নিজের অবস্থা কী? আমেরিকা হয়ে পড়েছে মেশিনের গোলাম, যন্ত্রের দাস। আজ আমেরিকা স্বপ্রণীত জীবন ব্যবস্থার গোলাম, সেসব মেশিন ও যন্ত্রপাতির গোলাম যেগুলো ছাড়া সে তার যিন্দেগীর কল্পনাই করতে পারে না।

এখানে যে বস্তু সবচেয়ে বেশি দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য তা হল প্রকৃত মানুষ, যার সীনার মধ্যে একটি যিন্দা দিল আছে, জাগ্রত ও সজাগ হৃদয় আছে। সে মেশিন নয়। মানুষ আজ এভাবে যান্ত্রিক জীবনের অংশে পরিণত হয়ে গেছে যে, তার কল্পনাও যান্ত্রিক তার অনুভূতিও যান্ত্রিক। তার ভেতর, জড় পদার্থের প্রভাব এসে গেছে। তার ভেতর আজ কান্নাভারাক্রান্ত অবস্থা নেই, কোমলতা নেই, অন্তর্জ্বালা নেই, দয়ামায়া ও স্নেহ-মমতা নেই, নমনীয়তা নেই, চোখের আদ্রতা নেই, দিলের ব্যথা বেদনা ও কোমলতা নেই। এই বাস্তবতাই আমি আমেরিকায় দেখতে পেয়েছি।

অনুবাদ : সৈয়দ মুহাম্মাদ ওমর আলী

 

advertisement