মাওলানা আলাউদ্দিন রহ.
একজন সদ্যপ্রয়াত আলোকদূত
দশই মহররম (১৪২৮ হিজরী) সকাল বেলা মোবাইল ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করতেই কান্নার সুর ভেসে এল। শরীয়তপুর জেলার বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন, শত শত আলেমের পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মাওলানা আলাউদ্দীন আর নেই। ফোনটি তাঁরই এক পুত্রের। শোকাবহ হলেও বিশ্বাস করতে হল যে, আমাদের মহীরূহতুল্য পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিটি ইহজগত ছেড়ে চলে গেছেন।
ছিয়ানব্বই পেরিয়ে পরিণত বয়সে তাঁর এই মৃত্যু যদিও অস্বাভাবিক নয়, তবুও একটি ত্যাগী জীবনের এই অবসান আমাদের মধ্যে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। সংবাদটি আমাকে কিছুক্ষণের জন্য নিরুদ্যম করে দিল। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নীরবে নিভৃতে দ্বীনের আলো জ্বেলে সমাজকে আলোকিত করে যাচ্ছেন যেসকল মহান ব্যক্তি মাওলানা আলাউদ্দীন ছিলেন তাঁদেরই একজন। তাঁর অবদানগুলি একেকটি আলোর ফোয়ারা হয়ে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে অহর্নিশ।
জন্মেছিলেন বাংলা ১৩২১ সালে। বাংলা আরবী শিক্ষার প্রাথমিক স্তরগুলো উত্তীর্ণ হন নিজ অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বড়কাটারা মাদরাসায় আসেন ১৯৪২ সালে। সেখানে ছয় বছর লেখাপড়া করে মেশকাত শ্রেণী উত্তীর্ণ হন। এখানে তার শিক্ষক ছিলেন বাংলার দুই মহান কৃতী সন্তান মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এবং হাফেজ্জী হুযুর রহ.। এরপর দাওরায়ে হাদীস পড়ার জন্য তার স্নেহশীল উস্তাদ মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীর নির্দেশে ভারতের ঢাভেল মাদরাসায় ভর্তি হন। মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হাদীস শাস্ত্রের কিংবদন্তী পুরুষ মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ.। এখানে দাওরা হাদীসে ভর্তি হয়ে মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী, মাওলানা বদরে আলম মীরাঠী, মাওলানা আব্দুর রহমান প্রমুখের মতো বরেণ্য হাদীস বিশারদগণের নিকট হাদীস পাঠ করে দাওরা হাদীসের সনদ অর্জন করেন। এরপর ১৯৪৯ সালে স্বদেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে এসে দ্বীনি শিক্ষা প্রচারের মহান ব্রতে আত্মনিয়োগ করেন। বিভিন্নস্থানে বিভিন্নভাবে তাঁর উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে অনেক মসজিদ ও মাদরাসা।
তাঁর সব অবদান তুলে ধরা এক্ষুদ্র নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। তাঁর জীবনের সবচে বড় অবদানটি হল শরীয়তপুর জেলার দ্বীনি ইলম ও দ্বীনি আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র আঙ্গারিয়া উসমানিয়া কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা। আঙ্গারিয়া বাজারে দুটি জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠাও তাঁর উজ্জ্বল অবদান।
উসমানিয়া মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পূর্বে মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী—এর ইন্তেকালের সংবাদ এলে মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীর ইচ্ছা অনুযায়ী মাদরাসাটির নাম রাখা হয় উসমানিয়া কওমী মাদরাসা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মাদরাসাটি আজও দ্বীনের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবত মাদরাসাটি পরিচালনার দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করেছিলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৯২ সালে তিনি মুহতামিমের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তার প্রতিষ্ঠিত এ মাদরাসা থেকে ইলমে দ্বীনের আলোয় আলোকিত হয়েছে হাজার হাজার ইলমানুরাগী। শরীয়তপুরে শত শত আলেম তৈরি হন এ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে। যাদের অনেকেই এখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দ্বীনী দায়িত্ব পালন করছেন।
মাওলানা আলাউদ্দীনের জীবনে যে জিনিসটি সবার চোখে প্রশান্তির শীতল পরশ বুলিয়ে দিত তা হল তার নামায। যারাই লক্ষ করেছেন বলেছেন আমরা এভাবে আর কাউকে নামায পড়তে দেখি না। খুশুখুযু তথা বিনয় ও একাগ্রতার এক আশ্চর্য ও হৃদয়গ্রাহী নমুনা ফুটে উঠত তার নামাযে, তাহাজ্জুদ, আওয়াবীন, ইশরাক, চাশত ইত্যাদি নামায ছিল তার নিয়মিত আমল। বার্ধক্যের দুর্বল শরীরেও সব আমল বাদ পড়েনি। পাশাপাশি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও মসজিদে এসে জামাতে আদায করতেন। ইবাদতের নিয়মতান্ত্রিকতা আর একাগ্রতাই ছিলা তার জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। যা একজন মুমিনের জীবনে মহামূল্য ধন।
তার মৃত্যু হয়েছে পরম সৌভাগ্যবানের মতোই। এমন মৃত্যুভাগ্য খুব কম লোকেরই হয়। ফজরের নামাযের আগে তিনি বলে উঠেন ‘এই দেখো কত বড় বড় হুজুর এসেছেন আমার ঘরে, ওনাদের বসতে দাও।’পুত্রবধু একথা শুনে কিছু অনুমান করেন। এরপর যথারীতি নামাযের জন্য উঠে অজু করেন এবং তাহরিমা বেধে নামাযও শুরু করেন। ফজরের ফরজ নামায একরাকাত শেষ করে সেজদায় যেতেই মহামহিম আল্লাহর ডাক এসে পৌঁছল। তিনি আর এগোতে পারলেন না। বুঝে ফেললেন এই তার জীবনের শেষ। কাছের মানুষদের বললেন ‘আমি এখন আর এই দুনিয়ার মানুষ নেই। আমি এখন পরকালের মানুষ।’এভাবেই একটি পবিত্রতার পরশে সুস্থ বিবেকে মহান আল্লাহর দরবারে চলে যান তিনি।
পরের দিন দুপুরে তার সালাতুল জানাযা অনুষ্ঠিত হয়, এতে বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটে। দূরদূরান্ত থেকে তার ছাত্র ও ভক্তরা ছুটে আসে তার জানাযায় অংশ নিতে। এরপর আঙ্গারিয়া উসমানিয়া মাদরাসার মাটিতে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
চিরকাল এ পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকবে না। আমরা প্রত্যেকেই একদিন পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করে মহান আল্লাহর দরবারে চলে যাব। তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য হচ্ছে মরহুম এই মহান ব্যক্তিত্বের মতো সৎকর্ম করে যাওয়া এবং দ্বীনি খেদমতের চেষ্টা করা। অবশেষে আমরা কামনা করি মহান আল্লাহ যেন মাওলানা আলাউদ্দীন রা.কে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন। আমীন!