মান্নতের কুরবানী
মান্নতকারী নিজে খেতে পারবে কি?
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد الأنبياء والمرسلين، وعلى آله وأصحابه أجمعين.
أما بعد:
জানা কথা যে, ঈদুল আযহার কুরবানী নফল হোক বা ওয়াজিব তা থেকে কুরবানীদাতার জন্য খাওয়া শুধু জায়েযই নয়; বরং মুস্তাহাব। অপরদিকে ফিকহবিদগণের নিকট এটিও স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত মাসআলা যে, মান্নতের কুরবানী থেকে মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়; বরং তা গরিব-মিসকীনকে সদকা করে দেয়া জরুরি। হানাফী ফকীহগণ তো বটেই ইমাম শাফেয়ী রাহ., ইমাম মালেক রাহ. ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর মতও তা-ই। যেমনটি আল্লামা আইনী রাহ. বলেছেন। তিনি বলেন-
قال (أي القدوري): ويأكل من لحم الأضحية، هذا في غير المنذورة. أما في المنذورة فلا يأكل الناذر، سواء كان معسرا أو موسرا، وبه قالت الثلاثة، وعن أحمد في رواية: يجوز الأكل من المنذورة أيضا.
মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না। মান্নতকারী ধনী হোক বা দরিদ্র। অপর তিন ইমামও (অর্থাৎ ইমাম মালেক রাহ., ইমাম শাফেয়ী রাহ., ইমাম আহমাদ রাহ.) অনুরূপ বলেছেন। ইমাম আহমাদ রাহ. থেকে ভিন্ন একটি মতও রয়েছে। তা হল, মান্নতকারী মান্নতের কুরবানীর গোশত থেকে খেতে পারবে। -আলবিনায়া ১৪/৩৯৩
কিন্তু সম্প্রতি কোনো কোনো মহল থেকে মাযহাবের স্বীকৃত উক্ত মাসআলার বিপরীত একটি বিচ্ছিন্ন বক্তব্য জোরেশোরে প্রচার হতে দেখা যায়। তা হল, কুরবানীর মান্নতের গোশত সাধারণ কুরবানীর মতোই; তা মান্নতকারী খেতে কোনো অসুবিধা নেই। তাঁরা বাদায়েউস সানায়ে-এর একটি বক্তব্যকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। যা মূলত ইমাম কাসানী রাহ.-এর উক্ত বক্তব্যের মাহমিল তথা সঠিক প্রয়োগক্ষেত্র অনুধাবন না করারই অনিবার্য ফল। জানা কথা যে, ‘বাদায়ে’ এ যুগের কোনো কিতাব নয়; বরং তা ষষ্ঠ শতাব্দীর কিতাব। যার পরে সুদীর্ঘ আটটি শতাব্দী গত হয়েছে। উক্ত বক্তব্য পরবর্তী ফকীহগণের সামনেও ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা মান্নতের কুরবানী সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবেই বলে গেছেন, মান্নতকারী মান্নতের কুরবানী থেকে খেতে পারবে না। ফকীহগণের সুবিশাল এ জামাতের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীতে মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া বৈধ বলা কতটা সঠিক কাজ তা ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা উচিত। বিচ্ছিন্ন এ মতটির কারণে প্রায় প্রতি বছরই কুরবানীর সময় এ নিয়ে সাধারণ অনেকের মাঝে একধরনের বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়। দ্বীনী বিষয় নিয়ে এমনটি কিছুতেই কাম্য নয়। বিশেষত যে মাসআলাটি যুগ যুগ থেকেই মীমাংসিত ও স্বীকৃত।
তাই দলীল-প্রমাণের আলোকে মাসআলাটি সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন মনে করছি। যাতে এ নিয়ে কোনো ধরনের সংশয় ও বিভ্রান্তি না থাকে।
মাসআলাটি সম্পর্কে সরাসরি দলীল-প্রমাণের দিকে যাওয়ার পূর্বে মান্নত সম্পর্কে শরীয়তের দিকনির্দেশনামূলক দুয়েকটি মৌলিক কথা উপস্থাপন করা হল। যাতে বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ হয়।
প্রথমেই জানা দরকার, মান্নত দুই প্রকার :
এক. শারীরিক ইবাদতের মান্নত। যেমন নামায, রোযা, ইতিকাফ ইত্যাদি।
উদাহরণস্বরূপ কেউ মান্নত করল, আমার অমুক উদ্দেশ্য পূরণ হলে আমি এক দিন মসজিদে ইতিকাফ করব অথবা দুই রাকাত নফল নামায পড়ব বা দুইটি রোযা রাখব। এভাবে মান্নত করার পর যখন উক্ত উদ্দেশ্য পূরণ হবে তখন তার জন্য ইতিকাফ করা বা নামায পড়া বা রোযা রাখা ওয়াজিব হবে।
দুই. অর্থ ব্যয়সংশ্লিষ্ট ইবাদতের মান্নত। যেমন দান-সদকা, দরিদ্রকে খাবার খাওয়ানো ইত্যাদির মান্নত। আর্থিক ইবাদতের মান্নতের ক্ষেত্রে শরীয়তের মূলনীতি হল, মান্নত পূরণের উদ্দেশ্যে বস্তুটি সদকা করে দেয়া ওয়াজিব। মান্নতের বস্তু থেকে মান্নতকারী নিজে উপকৃত হওয়া বা ভোগ করা জায়েয নয়। এ প্রকারের মান্নত যে সদকাযোগ্য- তা দলীল দ্বারা প্রমাণিত।
সহীহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
النَّذْرُ لَا يُقَدِّمُ شَيْئًا، وَلَا يُؤَخِّرُهُ،وَإِنَّمَا يُسْتَخْرَجُ بِهِ مِنَ الْبَخِيلِ.
মান্নত কোনো কিছুকে না এগিয়ে আনতে পারে, না পিছিয়ে দিতে পারে। তবে এর মাধ্যমে কৃপণ থেকে কিছু (সম্পদ) বের করা হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৩৯
ইমাম খাত্তাবী রাহ. উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখেন-
وقد أجمع المسلمون على وجوب النذر إذا لم يكن معصية، ويؤكده قوله أنه يستخرج به من البخيل فيثبت بذلك وجوب استخراجه من ماله.
মুসলিমগণ এ বিষয়ে একমত যে, মান্নত পূর্ণ করা ওয়াজিব, যদি তা পাপকর্মের না হয়। এ বক্তব্যকে সুদৃঢ় করে হাদীসের পাঠ-
أنه يستخرج به من البخيل
(মান্নত দ্বারা কৃপণ থেকে কিছু সম্পদ বের করা হয়)।
এতে প্রমাণিত হয় যে, মান্নত পূরণার্থে নিজ সম্পদ দিয়ে দেয়া ওয়াজিব। (মাআলিমুস সুনান, খাত্তাবী ৪/৪৯)
সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকার কাসতাল্লানী রাহ. হাদীসের শব্দ يستخرج به এর ব্যাখ্যা করেছেন يتصدق (সদকা করা) দ্বারা। তিনি বলেন-
وإنما (يستخرج به) بالنذر (من البخيل)، لأنه لا يتصدق إلا بعوض يستوفيه أوّلاً... وفي قوله يستخرج دلالة على وجوب الوفاء به.
কৃপণ থেকে মান্নতের সূত্রে সম্পদ বের করা হয়। কারণ সে আগে বিনিময় গ্রহণ না করে সদকা করে না। অর্থাৎ প্রথমে উদ্দেশ্য পূরণ হয় এরপর সে সদকা করে। আর হাদীসের ভাষ্য- يستخرج (সম্পদ বের করা হয়) দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মান্নত পূর্ণ করা আবশ্যক। -ইরশাদুস সারী, কাসতাল্লানী ১৪/১৯
আরো দেখুন : মিরকাতুল মাফাতীহ ৬/৫৪৩
হাদীস ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যা থেকে বোঝা গেল, মান্নত পূরণার্থে মান্নতের বস্তু সদকা করে দেয়া আবশ্যক।
এটা জানা কথা যে, কুরবানী হচ্ছে অর্থ ব্যয় সংশ্লিষ্ঠ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। ফিকহ ফাতাওয়ার বহু কিতাবেই তা উল্লেখ আছে। ইমাম তহাবী রাহ. বলেন-
الأضحية متعلقة بالمال.
কুরবানী আর্থিক ইবাদতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। -মুখতাসারু ইখতিলাফিল উলামা ২/১৭২
ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ. বলেন-
لأنها قربة مالية.
কুরবানী আর্থিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। -তাবয়ীনুল হাকায়েক, যায়লায়ী ৬/৪৭৫
আরও দেখুন : মাবসূত সারাখসী, ১২/৮; আলবিনায়া শরহুল হিদায়া, আইনী ১৪/৩৪৩
আর মান্নতের পশু যে সদকাযোগ্য তা তো সুস্পষ্ট বিষয়। যেমন, ইমাম কাসানী রাহ. (৫৮৭ হি.) বলেন-
ودم النذر دم صدقة.
আর মান্নতের পশু সদকার পশু। -বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৭৭
আরো দেখুন : তাবয়ীনুল হাকায়েক, ৬/৪৮৬; আলবাহরুর রায়েক, ৩/৭১
সাধারণ কুরবানী আর মান্নতের কুরবানীর মূলেই পার্থক্য বিদ্যমান
মান্নতের কুরবানী আর সাধারণ কুরবানীর মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে ইমাম রযিউদ্দীন সারাখসী রাহ. (৫৭১ হি.)-এর নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন-
لأن الشراء موضوع لاستجلاب الملك، والنذر بالأضحية موضوع للإزالة، فكان بينهما مضادة.
(সাধারণ কুরবানীর নিয়তে) পশু ক্রয় হয়ে থাকে মূলত মালিকানা লাভের উদ্দেশ্যে। পক্ষান্তরে কুরবানীর মান্নতের মূলেই রয়েছে মালিকানা রহিতকরণ। তাই এ দুয়ের মাঝে বৈপরীত্য বিদ্যমান।১ -আলমুহীতুর রাযাবী ২/ ১২৫ (মাখতূত, ফয়যুল্লাহ আফিন্দী, ইস্তান্বুল)
একই কথা বলেছেন ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ.। তিনি বলেন-
لأن الشراء موضوع لاستجلاب الملك، والنذر بالأضحية موضوع للإزالة، فكان بينهما مضادة.
-তাবয়ীনুল হাকায়েক ৬/৪৮৩
রযিউদ্দীন সারাখসী রাহ. এবং যায়লায়ী রাহ. উক্ত বক্তব্যে সাধারণ কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় হওয়া আর কুরবানীর মান্নতের উদ্দেশ্যে পশু ক্রয়ের মাঝে মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরেছেন। সাধারণ কুরবানীতে পশু ক্রয়ের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে মালিকানা লাভ করা এবং কুরবানীর পর তার গোশত খাওয়া। পক্ষান্তরে মান্নতের কুরবানী এ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ তা নিজে ভোগ করার জন্য নয়; বরং তার পুরোটাই সদকাযোগ্য। তাই এ দুটির মূলেই বৈপরীত্য বিদ্যমান।
আরও লক্ষ করা দরকার যে, রযিউদ্দীন সারাখসী রাহ. এবং যায়লায়ী রাহ. এখানে সাধারণ কুরবানী এবং نذر بالأضحية (মান্নতের কুরবানী)-এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছেন। نذر بالذبح (জবাইয়ের মান্নত)-এর সাথে نذر بالأضحية (কুরবানীর মান্নত)-এর পার্থক্য তুলে ধরেননি।
সুতরাং যারা বলেন, জবাইয়ের মান্নতের ক্ষেত্রে গোশত সদকাযোগ্য আর কুরবানীর মান্নতের ক্ষেত্রে সদকাযোগ্য নয়- তাদের এ বিশ্লেষণ সঠিক নয়। বরং রযিউদ্দীন সারাখসী রাহ. এবং যায়লায়ী রাহ.-এর أضحية এবং النذر بالأضحية -এর বিশ্লেষণ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, النذر بالأضحية এবং النذر بالذبح -এর মধ্যে বিধানগত কোনো পার্থক্য নেই। বরং দুটোর বিধান এক ও অভিন্ন।
উপরোক্ত বিশ্লেষণ আমাদের মাযহাবের ফকীহগণেরই শুধু নয়; বরং তা অন্য মাযহাবের ফকীহগণ থেকেও রয়েছে। যেমন :
শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহ আবু ইসহাক আশশীরাযী রাহ. বলেন-
وان نذر أضحية معينة زال ملكه عنها.
-আততাম্বীহ ফীল ফিকহিশ শাফেয়ী, ৮১
ফকীহ যাকারিয়া আলআনসারী রাহ. (৯২৬ হি.) বলেন-
لأن ملكه زال عنها بالنذر وصارت وديعة عنده.
-ফাতহুল ওয়াহহাব ২/২৩২
সুতরাং কুরবানীর মান্নতের পশু থেকে মান্নতকারী ভোগ করা বৈধ বলা ঠিক নয়। কারণ এতে করে মান্নতের বস্তু নিজের মালিকানা থেকে বের হওয়া সাব্যস্ত হবে না; বরং নিজের সম্পদ নিজের কাছেই থেকে যাবে এবং সদকার বস্তু নিজে ভোগ করা হবে।
কুরআনের নির্দেশনার আলোকে মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়ার বিধান
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَكُلُوْا مِنْهَا وَ اَطْعِمُوا الْبَآىِٕسَ الْفَقِیْرَ.
আল্লাহর নামে জবাইকৃত পশুর গোশত নিজে খাও, দুঃস্থ-গরীবদের খাওয়াও। -সূরা হজ্জ (২২) : ২৮
সূরা হজ্জের উক্ত আয়াতে কুরবানীর গোশত খেতে নির্দেশ করা হয়েছে।
ইমাম জাসসাস রাহ. বলেন-
وهذه الآية قد انتظمت سائر الهدايا والأضاحي وهي مقتضية لإباحة الأكل منها والندب إلى الصدقة ببعضها.
উক্ত আয়াতটি হজ্জের কুরবানী এবং ঈদুল আযহার কুরবানীর সর্বপ্রকারকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর তা থেকে খাওয়ার অনুমোদন করে এবং কিছু সদকা করা উত্তম সাব্যস্ত করে। -আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/২৩৭
এর পরের আয়াত وَ لْیُوْفُوْا نُذُوْرَهُمْ (আর তারা যেন তাদের মান্নত পূর্ণ করে)-এ আল্লাহ তাআলা মান্নত পূর্ণ করতে নির্দেশ করেছেন।
ইমাম জাসসাস রাহ. বলেন-
وقوله وَ لْیُوْفُوْا نُذُوْرَهُمْ قال ابن عباس: نحر ما نذروا من البدن، وقال مجاهد: كل ما نذر في الحج قال أبو بكر: إن كان التأويل نحر البدن المنذورة، فإن قوله تعالى (عَلٰی مَا رَزَقَهُمْ مِّنْۢ بَهِیْمَةِ الْاَنْعَامِ فَكُلُوْا مِنْهَا ) لم يرد به ما نذر نحره من البدن والهدايا... وقد أمر الله تعالى بالأكل من بهيمة الأنعام المذكور في الآية، فدل على أنه لم يرد النذر واستأنف ذكر النذر وأفاد به معاني أحدها أنه لا يؤكل منه.
জাসসাস রাহ.-এর উপরিউক্ত বক্তব্যের সারকথা হল-
প্রথম আয়াতে যে গোশত খেতে নির্দেশ করা হয়েছে- এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ঐ কুরবানী, যা মান্নতের নয়। বরং তা মান্নতমুক্ত সাধারণ কুরবানী- দমে তামাত্তু, দমে কিরান ও হজে¦র নফল কুরবানী। আর وَلْیُوْفُوْا نُذُوْرَهُمْ দ্বারা উদ্দেশ্য মান্নতের পশু এবং মান্নতের সকল কুরবানী। সুতরাং আগের আয়াতে খেতে নির্দেশ করার পর পরের আয়াতে মান্নতের কথা পৃথকভাবে ব্যক্ত করা- এ কথা প্রমাণ করে যে, মান্নতকারীর জন্য মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয নয়। -আহকামুল কুরআন জাসসাস ৩/২৩৮
জাসসাস রাহ.-এর উক্ত আলোচনায় আরো বিশেষভাবে যে কথাটি লক্ষণীয় তা হল, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে উক্ত আয়াতের তাফসীর উদ্ধৃত করে বলেছেন, এ আয়াতে البدن -এর মান্নতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে; তা থেকে নিজে খেতে পারবে না, বরং সদকা করে দিতে হবে। আর البدن শব্দটি ঈদুল আযহার কুরবানীসহ সর্বপ্রকার কুরবানীকে অন্তর্ভুক্ত করে- তা ইমাম জাসসাস রাহ. সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। যেমন-
وَ الْبُدْنَ جَعَلْنٰهَا لَكُمْ مِّنْ شَعَآىِٕرِ اللّٰهِ لَكُمْ فِیْهَا خَیْرٌ. فهذا عام في سائر البدن من الأضاحي وغيرها.
-শরহু মুখতাসারিত তহাবী, জাসসাস ৭/৩৩৮
সুতরাং ইমাম জাসসাস রাহ.-এর বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হল যে, হজে¦র সময় মান্নত করা হোক বা কুরবানীর সময় মান্নত করা হোক- কোনো মান্নতের কুরবানীর গোশতই মান্নতকারী খেতে পারবে না।
একই কথা বলেছেন ইমাম তহাবী রাহ.। তিনি-
فَكُلُوْا مِنْهَا وَ اَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَ الْمُعْتَرَّ.
[তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। -সূরা হজ¦ (২২) : ৩৬] আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন-
ووجدناهم لا يختلفون في جزاء الصيد والنذور، أن مهدي ذلك لا يأكل منه، وأنه غير داخل في هذه الآية.
আমরা দেখতে পাই, আহলে ইলম এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন না যে, শিকারের জরিমানা দম এবং সকল প্রকারের মান্নতের গোশত মান্নতকারী খেতে পারে না। কেননা এটি এ আয়াতের মর্মভুক্ত নয়। -আহকামুল কুরআন, তহাবী ২/২৯৫
তাফসীরবিদগণের বক্তব্যের আলোকে মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া
وَلْیُوْفُوْا نُذُوْرَهُمْ -এর মধ্যে যে হজ্জের হাদীসহ সবধরনের কুরবানী অন্তর্ভুক্ত এবং তা থেকে মান্নতকারীর খাওয়া জায়েয নয়- তা অন্যান্য তাফসীরবিদদের সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকেও প্রমাণিত।
১. আলজামে লিআহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী রাহ.
قوله تعالى: وَ لْیُوْفُوْا نُذُوْرَهُمْ يدل على وجوب إخراج النذر إن كان دما أو هديا أو غيره، ويدل ذلك على أن النذر لا يجوز أن يأكل منه وفاء بالنذر.
তারা যেন মান্নত পূর্ণ করে- এ বাণী প্রমাণ বহন করে যে, মান্নতের যে কোনো পশু বা মান্নতের হাদী বা মান্নতকৃত অন্য যা কিছু সবই সদকা করে দেয়া আবশ্যক। অনুরূপ প্রমাণ বহন করে যে, মান্নত পূরণার্থে তা থেকে মান্নতকারীর খাওয়া জায়েয নয়। -তাফসীরে কুরতুবী ১২/৩১
আরো দেখুন : তাফসীরে তাবারী ৯/১৪০
উক্ত বক্তব্যে هديا শব্দটি মান্নতের কুরবানীকে শামিল করে। তাছাড়া أو غيره (মান্নতকৃত অন্য যা কিছু সবই) বলার পর আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, ইমাম কুরতুবী রাহ. এখানে মান্নতকারীর জন্য মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া নাজায়েয বলেছেন।
২. আসসিরাজুল মুনীর, খতীব শিরবীনী রাহ.
وَ لْیُوْفُوْا نُذُوْرَهُمْ من الهدايا والضحايا.
তারা যেন তাদের হাদী ও কুরবানীর মান্নত পূর্ণ করে। -আসসিরাজুল মুনীর ২/৫৫০
৩. তাফসীরে জালালাইন
عَلٰی مَا رَزَقَهُمْ مِّنْۢ بَهِیْمَةِ الْاَنْعَامِ الإبل والبقر والغنم التي تنحر في يوم العيد وما بعده من الهدايا والضحايا فَكُلُوْا مِنْهَا إذا كانت مستحبة وَلْیُوْفُوْا بالتخفيف والتشديد نُذُوْرَهُمْ من الهدايا والضحايا.
তারা যেন তাদের হাদী ও কুরবানীর মান্নত পূর্ণ করে। -তাফসীরে জালালাইন, ২৮১
৪. তাইসীরুল বয়ান লিআহকামিল কুরআন, ইবনে নূরুদ্দীন (৮২৫ হি.)
فَكُلُوْا مِنْهَا وَ اَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَ الْمُعْتَرَّ وهذا في هدي التطوع، وأما الهدي الواجب كهدي الجبران وهدي الكفارة والأضحية المنذورة، فلا يجوز الأكل منها.
আর ওয়াজিব হাদী, যেমন জরিমানা দম, কাফফারার দম ও মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয নয়। (দ্র. খ. ৪, পৃ. ২২)
৫. তাফসীরাতে আহমাদিয়াহ, মোল্লা আহমাদ জীবান রাহ. (১১৩০ হি.)
وليوفوا ما نذروا من البدن في الحج و ذبح الهدايا والقرابين، هكذا في التفاسير.
যারা হজ্জে উট যবাই, হাদী জবাই এবং সর্বপ্রকার কুরবানী করার মান্নত করেছে তা যেন পূর্ণ করে। -তাফসীরাতে আহমাদিয়া, পৃষ্ঠা ৫৩৩
সাহাবা ও তাবেয়ীনের আসারের আলোকে মান্নতের পশুর গোশত খাওয়ার বিধান
সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে ব্যাখ্যামুক্তভাবেই প্রমাণিত আছে যে, মান্নতকারী মান্নতের পশুর গোশত খেতে পারবে না। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি আসার উল্লেখ করা হল।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন-
من كل الهدي يؤكل إلاما كان من فداء أو جزاء أو نذر.
সর্বপ্রকার হাদীর গোশত খাওয়া যাবে। তবে ফিদয়া, জাযা ও মান্নতের পশুর গোশত খাওয়া যাবে না। -আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/২৩৭
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
لا يؤكل من جزاء الصيد والنذر، ويؤكل مما سوى ذلك.
শিকারের জরিমানা দম এবং মান্নতের পশুর গোশত খাওয়া যাবে না। এ ছাড়া বাকিগুলোর গোশত খাওয়া যাবে। -সহীহ বুখারী ১/২৩২
বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. বলেন-
جزاء الصيد، والفدية، والنذر لا يأكل منها صاحبها، ويأكل من التطوع والتمتع.
শিকারের জাযা, ফিদইয়ার জাযা ও মান্নতের পশুর গোশত মালিক খেতে পারবে না। সে নফল হাদী ও তামাত্তু হজে¦র কুরবানীর গোশত খেতে পারবে। -তাফসীরে তাবারী ২/২৫০
আতা রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
لا يؤكل من جزاء الصيد، ولا من النذر، ولا من الفدية، ويؤكل مما سوى ذلك.
শিকারের জরিমানা দম থেকে খাওয়া যাবে না, মান্নতের পশু থেকে খাওয়া যাবে না, ফিদইয়ার পশু থেকে খাওয়া যাবে না। এছাড়া বাকি পশু থেকে খাওয়া যাবে। -তাফসীরে তাবারী ২/২৫০
অনুরূপ বলেছেন আলী ইবনে আবী তালিব রা., সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ., আতা রাহ.।
দেখুন : মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ১৩৩৬৫-৬৬; আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/২৩৭, তাফসীরে তাবারী ২/২৫০
সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের উক্ত আসারগুলো থেকে প্রমাণিত যে, মান্নতকারীর জন্য মান্নতের পশুর গোশত খাওয়া জায়েয নয়। এতে কুরবানী বা গায়রে কুরবানীর কোনো পার্থক্য করা হয়নি।
ফিকহ-ফতোয়ার উদ্ধৃতি
এক. আলআজনাস, ইমাম আবুল আব্বাস আননাতিফী রাহ. (৪৪৬ হি.)
কিতাবুল উযহিয়্যাহ-এ তিনি বলেন-
و في نوادر هشام عن محمد إذا نذر ذبح شاة لا يأكل منها الناذر ولو أكل عليه قيمة ما أكل.
হিশাম রাহ. ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. থেকে বর্ণনা করেন, কোনো ব্যক্তি যদি ছাগল জবাইয়ের মান্নত করে তবে তা থেকে মান্নতকারী খেতে পারবে না। যদি খায় তাহলে যে পরিমাণ খেয়েছে, তার মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -আলআজনাস, নাতিফী ১/৫১০)
প্রশ্ন হতে পারে, ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. -এর উক্ত বক্তব্য তো نذر بالذبح অর্থাৎ জবাইয়ের মান্নত সংক্রান্ত, نذر অর্থাৎ কুরবানীর মান্নত সম্পর্কিত নয়।
উত্তরে বলব, ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’র গ্রন্থকার ‘আলআজনাস’- এর বরাতে সরাসরি نذر أن يضحي (কুরবানী করার মান্নত করল) শব্দ-ই ব্যক্ত করেছেন। লক্ষ করুন খুলাসার বক্তব্য-
ولو نذر أن يضحي ولم يسم شيئا يقع على الشاة، ولايأكل الناذر منها، ولو أكل منها فعليه قيمتها في الأجناس، والله أعلم.
কোনো ব্যক্তি যদি কুরবানী করার মান্নত করে, কিন্তু কোন্ ধরনের পশু কুরবানী করবে তা উল্লেখ না করে তবে তাকে একটি ছাগল কুরবানী করতে হবে। আর মান্নতকারী তা থেকে খেতে পারবে না। যদি খায় তবে তাকে এর মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া, ৪/৩২০
ছাহেবে খুলাসা ষষ্ঠ শতাব্দী হিজরীর হানাফী মাযহাবের শীর্ষস্তরের ফকীহ ও ইমাম ছিলেন। যিনি মুজতাহিদ ফীল মাসায়িল ছিলেন। স্পষ্টভাবেই তিনি আজনাস-এর হাওয়ালায় মান্নতের কুরবানী মান্নতকারী খেতে পারবে না ব্যক্ত করেছেন।
অথচ আলআজনাস-এ ইমাম মুহাম্মাদ থেকে আছে إذا نذر ذبح شاة - তিনি نذر ذبح شاة -এর রেওয়ায়েত বিল মা‘না করেছেন। যা দ্বারা ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর উক্ত বক্তব্যের মর্ম ও (প্রয়োগক্ষেত্র) সুস্পষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ তাঁর উক্ত বক্তব্য কুরবানীর মান্নতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এতে আরেকটি বিষয়ও প্রমাণিত হয়ে যায় যে, نذر بالذبح এবং نذر بالأضحية এ দুয়ের মধ্যে বিধানগত দিক বিবেচনায় কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং ছাহেবে খুলাসার বিশ্লেষণ অনুযায়ী ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায় যে, কুরবানীর মান্নতের গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না।
দুই. আন নিহায়া, হুসামুদ্দীন সিগনাকী রাহ. (মৃত্যু ৭১০ হি)
ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর উক্ত বক্তব্য যে কুরবানীর মান্নতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তা হুসামুদ্দীন সিগনাকী রাহ.-এর বক্তব্য থেকেও প্রমাণিত। তিনি বলেন-
وأما في الأضحية المنذورة سواء كانت من الغني أو الفقير فليس لصاحبها أن يأكل، ولا أن يؤكل، لأن سبيلها التصدق، وليس للمتصدق أن يأكل من صدقته، إلى هذا أشار في الذخيرة، وقال إذا نذر ذبح شاة لايأكل منها الناذر، ولو أكل فعليه قيمة ما أكل.
আর মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না। মান্নতকারী চাই ধনী হোক বা দরিদ্র। কেননা মান্নত হয়েই থাকে সদকার উদ্দেশ্যে। আর সদকাকারী নিজ সদকা থেকে খেতে পারে না। এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেই যখীরাতে বলা হয়েছে-
إذا نذر ذبح شاة لايأكل منها الناذر ولو أكل فعليه قيمة ما أكل.
আর আযযাখীরাতুল বুরহানীয়াহ-এর উক্ত বক্তব্য ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এরই বক্তব্য; যা আমরা ইতিপূর্বে আলআজনাসের হাওয়ালায় উল্লেখ করেছি। -আননিহায়া ২/৪৫৩ (মাখতূত, নূর উসমানীয়া)
সিগনাকী রাহ.-এর বক্তব্য থেকেও বোঝা গেল যে, نذر بالذبح এবং نذر بالأضحية এ দুয়ের মধ্যে বিধানগত দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই।
তিন. ফয়যুল মাওলাল কারীম, ইবরাহীম আলকারাকী রাহ. (৯২২ হি.)
আলআজনাসের হাওয়ালায় বলেন-
ولو نذر أن يضحي ولم يسم شيئا يقع على الشاة، ولكن الناذر لا يأكل منها، ولو أكل فعليه قيمتها، كذا في الأجناس.
কোনো ব্যক্তি যদি কুরবানী করার মান্নত করে, কিন্তু কোন্ ধরনের পশু কুরবানী করবে তা উল্লেখ না করে তবে তাকে একটি ছাগল কুরবানী করতে হবে। আর মান্নতকারী তা থেকেখেতে পারবে না। যদি খায় তবে তাকে এর মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -ফয়যুল মাওলাল কারীম আলা আবদিহী ইবরাহীম, পৃষ্ঠা ৩০৪
চার. ‘মাজমাউল আনহুর’, দামাদ আফিন্দী রাহ. (১০৭৮ হি.)
ولو نذر أن يضحي ولم يسم شيئا يقع على الشاة، ولا يأكل الناذر منها، ولو أكل فعليه قيمة ما أكله؛ لأن سبيلها التصدق وليس للمتصدق أن يأكل من صدقته.
-মাজমাউল আনহুর ৪/১৭০
পাঁচ. ফাতাওয়া বাযযাযিয়াহ, ইবনুল বাযযায আলকারদারী রাহ. (৮২৭ হি.)
نذر أن يضحي ولم يسم شيئا، عليه شاة ولا يأكل منها، وإن أكل عليه قيمتها.
-ফাতাওয়া বাযযাযিয়াহ ৬/২৯২
ছয়. ফাতাওয়া হিন্দিয়া, নিযামুদ্দীন আল বুরহানপুরী
نذر أن يضحي ولم يسم شيئا، عليه شاة ولا يأكل منها، وإن أكل عليه قيمتها، كذا في الوجيز للكردري.
-ফাতাওয়া হিন্দিয়া, খ. ৫, পৃ. ২৯৫
উল্লেখ্য যে, উপরিউক্ত বরাতসমূহে نذر أن يضحي শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যা মূলত আল আজনাস থেকেই গৃহিত।
সাত. আততাজরীদ, ইমাম কুদুরী রাহ. (৪২৮ হি.)
আততাজরীদ গ্রন্থে কিরান এবং তামাত্তুর দম অর্থাৎ হজ্জের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয হওয়ার একটি কারণ ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে-
ولأنه دم لم يجب بإيجابه، ولا بأمر الإحرام جنسه، فجاز الأكل منه، كالأضحية، ولأن من جاز له أكل الأضحية جاز له أكل دم المتعة.
এটি অর্থাৎ দমে শোকর এমন দম, যা নিজের উপর ওয়াজিব করে নেয়ার কারণে ওয়াজিব হয়নি এবং ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ করার কারণেও নয়। তাই তা খাওয়া জায়েয আছে। যেমন কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয। -আততাজরীদ ৪/২১৯২
উপরোক্ত বক্তব্যে ইমাম কুদুরী রাহ.-এর-
ولأنه دم لم يجب بإيجابه.
-কথাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি উক্ত বক্তব্যে দমে তামাত্তু ও কিরান কেন খেতে পারবে তার কারণ ব্যক্ত করেছেন এবং উপমা হিসেবে তিনি কুরবানীর কথা তুলে ধরেছেন। আর তা এই যে, এসব কুরবানীর গোশত এজন্য খাওয়া জায়েয, যে ব্যক্তি নিজের উপর তা আবশ্যক করে নেয়নি; বরং নুসুক অর্থাৎ ইবাদত হিসেবে শরীয়ত কর্তৃক তার ওপর ওয়াজিব হয়েছে। যেমনটি কুরবানীর নেসাবের মালিকের উপর ওয়াজিব হয়েছে।
সুতরাং ইমাম কুদুরী রাহ.-এর উক্ত বক্তব্য থেকে খুব সহজেই বুঝে আসে, যে পশুর কুরবানী বান্দার উপর পূর্ব থেকে ওয়াজিব নয়, বরং বান্দা নিজের উপর নিজে ওয়াজিব করে নেয় (যেমন মান্নতের কুরবানী) তার গোশত খাওয়া কুরবানীদাতার জন্য জায়েয নয়; বরং তা সদকা করে দেয়া আবশ্যক।
আট. বাদায়েউস সানায়ে
ইমাম কাসানী রাহ. (৫৮৭ হি.)-এর নিম্নোক্ত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না; বরং তা সদকা করে দিতে হবে। তিনি বলেন-
ولا يجوز له أن يأكل من دم النذر شيئا.
وجملة الكلام فيه أن الدماء نوعان نوع يجوز لصاحب الدم أن يأكل منه وهو دم المتعة والقران والأضحية، وهدي التطوع إذا بلغ محله.
ونوع لايجوز له أن يأكل منه وهو دم النذر والكفارات، وهدي الإحصار وهدي التطوع إذا لم يبلغ محله؛ لأن الدم في النوع الأول دم شكر فكان نسكا، فكان له أن يأكل منه، ودم النذر دم صدقة، وكذا دم الكفارة في معناه؛ لأنه وجب تكفير الذنب.
-বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৭৭
ইমাম কাসানী রাহ.-এর উপরোক্ত বক্তব্যে পশুকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথম প্রকারে তিনি সেসকল পশুর আলোচনা করেছেন, যার গোশত খাওয়া যাবে। সেখানে তিনি দমে তামাত্তু, দমে কিরান, ঈদুল আযহার কুরবানী ও নফল হাদীকে উল্লেখ করেছেন। এর কারণ ব্যক্ত করেছেন যে, এগুলো হল দমে শোকর। এতে এটা স্পষ্ট যে, এর দ্বারা তিনি সাধারণ কুরবানী উদ্দেশ্য করেছেন, মান্নতের কুরবানী উদ্দেশ্য করেননি। কারণ, মান্নতের কুরবানী দমে শোকর নয়। আর যেগুলো দমে শোকর সেগুলো তো নুসুক অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ইবাদত।
পক্ষান্তরে দ্বিতীয়ভাগে তিনি ঐসকল পশুর আলোচনা এনেছেন, যা থেকে পশুর মালিক খেতে পারে না। এ প্রকারে প্রথমেই তিনি মান্নতের পশুর কথা এনেছেন। তাহলে এ থেকে খুব সহজভাবেই বোঝা যায় যে, প্রথম প্রকারে যে কুরবানীর কথা এসেছে তা মান্নতের নয়; বরং মান্নতমুক্ত সাধারণ কুরবানী। আর দ্বিতীয় ভাগে মান্নত দ্বারা সকল প্রকার মান্নতের কুরবানীই অন্তর্ভুক্ত এবং তা সদকাযোগ্য। মান্নতকারীর জন্য তা খাওয়া জায়েয নয়। সুতরাং ইমাম কাসানী রাহ.-এর উপরোক্ত শ্রেণীভাগ দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই মান্নতের কুরবানীর ব্যাপারে শরীয়তের বিধান জানা গেল এবং তাঁর মতও পরিষ্কার হয়ে গেল।
উল্লেখ্য, ইমাম কাসানী রাহ. থেকে কুরবানীর অধ্যায়ে যে মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়ার কথা ব্যক্ত হয়েছে, এর দ্বারা কী উদ্দেশ্য- তার পর্যালোচনা সামনে তুলে ধরা হবে ইনশাআল্লাহ।
নয়. ইমাম শামসুল আইম্মাহ সারাখসী রাহ. (৪৮৩ হি.)
ইমাম সারাখসী রাহ. হজ্জের মান্নতের কুরবানী প্রসঙ্গে যে আলোচনা করেছেন তাতেও প্রমাণিত হয়ে যায় যে, মান্নতের কুরবানী সদকাযোগ্য। মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়।
কারণ, ‘মান্নতের হাদীর গোশত মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়’- এই মাসআলার ‘ইল্লত’ ইমাম সারাখসী রাহ. এই বয়ান করেছেন যে, মান্নতের কারণে মান্নতের পশু আল্লাহর জন্য ‘খাস’ হয়ে গেছে। তাই এই পশুর গোশত সদকা করা জরুরি।
وكل هدي جعله على نفسه من الإبل والبقر والغنم فعليه أن يذبحه بمكة.. وبعد الذبح صار المذبوح لله تعالى خالصا، فالسبيل أن يتصدق بلحمه
পক্ষান্তরে -হজ্জে তামাত্তুর কুরবানী, হজ্জে কিরানের কুরবানী এবং হজে¦র নফল কুরবানী- এইসকল কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতার জন্য খাওয়া জায়েয’- তিনি এই মাসআলার ইল্লত লিখেছেন-এইসকল কুরবানী ঈদুল আযহার কুরবানীর মতো, যাতে গোশত সদকা করা ওয়াজিব হয় না। বরং কেবল পশু যবাই করার দ্বারাই কুরবানীর মাকসাদ হাসিল হয়ে যায়।
এরপর গোশত চাই নিজে খেল বা অন্যদের খাওয়াল, কিংবা সদকা করে দিল। তবে উত্তম হল, এক তৃতীয়াংশ সদকা করবে আর দুই তৃতীয়াংশ নিজের কাজে লাগাবে। সারাখসী রাহ. আরও লিখেছেন যে, এই হুকুমই প্রযোজ্য হবে হজে¦র প্রত্যেক ঐ কুরবানীর ক্ষেত্রে, যেগুলো ঈদুল আযহার কুরবানীর মতো। (দ্রষ্টব্য : আল মাবসূত, সারাখসী ৪/ ১৩৬)
ইমাম সারাখসী রাহ.-এর উপরোক্ত উভয় বক্তব্য থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়; বরং তা সদকা করা ওয়াজিব। কারণ, তা-
كل هدي جعله على نفسه.
-এর অন্তর্ভুক্ত। ঈদুল আযহার সাধারণ কুরবানী খোদ শরীয়ত ওয়াজিব করেছে এবং যেখানে আল্লাহ তাআলার নামে পশু যবাই করার দ্বারাই ইবাদাতে ওয়াজিবা আদায় হয়ে যায়। সারাখসী রাহ.-এর দ্বিতীয় বক্তব্য এই-
ويباح التناول من هدي المتعة، والقران، والتطوع بمنزلة الأضحية، والجواب في الأضحية معلوم، وهو أن الواجب يتأدى بإراقة الدم فإنه يباح التناول منه للمضحي، ولمن شاء المضحي من غني أو فقير، فإن أكل المضحي كلها لم يكن عليه شيء، والأفضل له أن يتصدق بالثلث، ويأكل الثلثين، فكذلك فيما هو في معنى الأضحية من الهدايا.
উপরোক্ত বক্তব্যে লক্ষণীয় বিষয় হল, ইমাম সারাখসী রাহ. তামাত্তু ও কিরান হজে¦র কুরবানী এবং হজে¦র নফল কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয বলেছেন। এগুলোকে কিয়াস করেছেন ঈদুল আযহার কুরবানীর ওপর। তিনি উক্ত বক্তব্যে হজে¦র মান্নতের কুরবানীকে অন্তর্ভুক্ত করেননি। যদি উযহিয়্যার মধ্যে মান্নতের উযহিয়্যাহ অন্তর্ভুক্ত হত তাহলে হজে¦র মান্নতের কুরবানীও بمنزلة الأضحية এবং-
فكذلك فيما هو في معنى الأضحية من الهدايا
-এর অধীনে হয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত। অথচ তা একেবারে অবাস্তব।
যেহেতু তিনি এখানে হজে¦র মান্নতের কুরবানীকে বাদ দিয়েছেন এবং হজে¦র অন্যান্য কুরবানীকে উযহিয়্যার উপর কিয়াস করেছেন, এ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয নয়। কারণ, মান্নতের কুরবানীর গোশত যদি সাধারণ কুরবানীর মতো খাওয়া জায়েয হয় তাহলে بمنزلة الأضحية এবং-
فكذلك فيما هو في معنى الأضحية من الهدايا.
-এ কথাটি অর্থবহ থাকে না।
মোটকথা মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া মান্নতকারীর জন্য যে জায়েয নয়; তা আমাদের ফকীহগণের নিকট একটি স্বীকৃত মাসআলা। কোনো কোনো ফকীহ সুস্পষ্ট ভাষায় তা ব্যক্ত করেছেন। আর কেউ কেউ স্বীকৃত বিষয় হওয়ার কারণে তা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার প্রয়োজন মনে করেননি।
দশ. ফাতাওয়া জহীরিয়া, জহীরুদ্দীন আলবুখারী রাহ. (৬১৯ হি.)
হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ জহীরুদ্দীন আলবুখারী রাহ. ‘কুরবানীর পশু থেকে উপকৃত হওয়া’ অধ্যায়ে বলেন-
الفصل الرابع في الانتفاع بالأضحية: (ح) ولو حلب اللبن من الأضحية قبل الذبح أو جز صوفها يتصدق به ولا ينتفع به، وإذا نذر ذبح شاة لا يأكل منها الناذر، فإن أكل كان عليه قيمته، ولا يعطى جلد الأضحية ولا لحمها، أجرة للذابح والسلاح.
‘চতুর্থ পরিচ্ছেদ : কুরবানীর পশু দ্বারা উপকৃত হওয়া’-
কোনো ব্যক্তি যদি কুরবানীর জন্তু জবাই করার পূর্বে দুধ দোহন করে অথবা তার পশম কেটে নেয়, তবে তা সদকা করে দিতে হবে এবং তা থেকে সে উপকৃত হতে পারবে না। আর যদি বকরি জবাইয়ের মান্নত করে, তাহলে তা থেকে মান্নতকারী খেতে পারবে না। যদি খায়, তাহলে তার মূল্য সদকা করা আবশ্যক হবে। আর কুরবানীর পশুর চামড়া জবাইকারীকে বিনিময়স্বরূপ দেয়া যাবে না। -ফাতাওয়া জহীরিয়া, পৃ. ১৯৩ (মাখতূত, মাকতাবা সুলাইমানিয়া, ইস্তাম্বুল)
লক্ষ করার বিষয় হল, জহীরুদ্দীন বুখারী রাহ. ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর ছাগলের মান্নত সংক্রান্ত বক্তব্যকে-
الفصل الرابع في الانتفاع بالأضحية
-পরিচ্ছদে এনেছেন। এতে বোঝা যায় যে, ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর উক্ত বক্তব্য কুরবানী করার মান্নত হোক বা জবাই করার মান্নত, সব ধরনের মান্নতকে শামিল করে।
এগারো. আযযাখীরাতুল বুরহানীয়া, ইমাম বুরহানুদ্দীন ইবনে মাজাহ রাহ. (৬১৬ হি.)
আলমুহীতুল বুরহানীর গ্রন্থকারের স্বরচিত গ্রন্থ ‘আযযাখীরাতুল বুরহানীয়া’তে মান্নতের কুরবানীর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন-
الفصل الثالث في وجوب الأضحية بالنذر وما هو في معناه :
ذكر الزعفراني في "أضاحيه":أن من قال: لله علي أن أضحي بشاة، فإن كان موسراً، فعليه أن يضحي بشاتين؛ إلا أن يعني به ما يجب عليه؛ وهذا لأن النذر إيجاب ...وإن كان فقيراً فعليه شاة، فإن أيسر كان عليه شاتان؛ ما أوجب بالنذر وما وجب باليسار. وفي نوادر هشام: عن محمد رحمه الله إذا نذر ذبح شاة لا يأكل منها الناذر، ولو أكل فعليه قيمة ما أكل.
-আযযাখীরাতুল বুরহানিয়া ৮/৩১৪
উক্ত বক্তব্যে ইমাম বুরহানুদ্দীন ইবনে মাজাহ রাহ.-
في وجوب الأضحية بالنذر وما هو في معناه.
(মান্নতের দ্বারা কুরবানী আবশ্যক হওয়া এবং এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়) শীর্ষক পরিচ্ছেদে কুরবানীর মান্নতের আলোচনায় ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর মান্নত সংক্রান্ত বক্তব্য-
إذا نذر ذبح شاة لا يأكل منها الناذر، ولو أكل فعليه قيمة ما أكل.
-উদ্ধৃত করেছেন। এটা সুস্পষ্টভাবেই ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর উক্ত কথার মর্ম ও প্রয়োগক্ষেত্রকে স্পষ্ট করে দেয়। অর্থাৎ মাযহাবের ইমাম থেকেই প্রমাণ দেয় যে, হানাফী মাযহাবে কুরবানীর মান্নতের পশুর গোশত খাওয়া মান্নতকারীর জন্য জায়েয নয়। যদি উক্ত বক্তব্য কুরবানীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হত তাহলে ফকীহগণ উক্ত বক্তব্য মান্নতের কুরবানীর প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করতেন না। দ্বিতীয়ত তারা সুস্পষ্ট করে দিতেন যে, এটি কেবল জবাইয়ের মান্নতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কুরবানীর মান্নতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
বারো. তাবয়ীনুল হাকায়েক, ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ. (৭৪৩ হি.)
ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ. কোন্ প্রকার কুরবানীর পশুর গোশত কুরবানীদাতা খেতে পারবে- এ প্রসঙ্গের আলোচনায় বলেন-
وهذا في الأضحية الواجبة والسنة سواء، إذا لم تكن واجبة بالنذر، وإن وجبت بالنذر فليس لصحابها أن يأكل منها شيئا، ولا أن يطعم غيره من الأغنياء، سواء كان الناذر غنيا أو فقيرا؛ لأن سبيلها التصدق، وليس للمتصدق أن يأكل من صدقته، ولا أن يطعم الأغنياء.
এটি (কুরবানীর পশুর গোশত কুরবানীদাতা খেতে পারবে) ওয়াজিব ও নফল কুরবানীর ক্ষেত্রে, যখন কুরবানীটি মান্নতের কারণে আবশ্যক না হয়। যদি মান্নতের কারণে কুরবানীটি ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে মান্নতকারীর জন্য তা থেকে কোনো কিছু খাওয়া এবং ধনী ব্যক্তিকে খাওয়ানো জায়েয নয়। মান্নতকারী চাই ধনী হোক বা দরীদ্র। কেননা মান্নতের খাতই হল সদকার খাত। আর সদকাকারীর জন্য নিজ সদকার বস্তু থেকে খাওয়া এবং ধনীকে খাওয়ানো জায়েয নয়। -তাবয়ীনুল হাকায়েক ৬/৪৮৬
যায়লায়ী রাহ.সহ পূর্বের ও পরের ফকীহগণ ব্যাপকভাবেই ব্যক্ত করেছেন যে, মান্নতের কুরবানীর পশুর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না। কলেবর বৃদ্ধি পাবে বিধায় উদ্ধৃতি হিসাবে শুধু কিতাবের নাম ও খ--পৃষ্ঠা উল্লেখ করা হল। যেমন-
তের. শরহু মুখতাসারিল বেকায়াহ, আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ আশশুমুন্নী রাহ. (৮৭২ হি.), পৃ. ৪৪১ (মাখতূত, মাকতাবা আযহারিয়া)
চৌদ্দ. আলইনায়া, আকমালুদ্দীন বাবারতী রাহ. (৭৮৬ হি.), খ. ৮, পৃ. ৪৩৬
পনের. ফাতাওয়া হিন্দিয়া - খণ্ড. ৫, পৃ. ৩০০
ষোল. আলবিনায়া শরহুল হিদায়া, আল্লামা আইনী রাহ. (৮৫৫ হি.), খ. ১৪, পৃ. ৩৯৩
সতের. তাকমিলাতুল বাহরির রায়েক, হুসাইন আততূরী, খ. ৮, পৃ. ১৭৮
আঠারো. হাশিয়াতুশ শুরুম্বুলালী, খ. ১, পৃ. ২৭০
ঊনিশ. আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রাহ. (১২৫২ হি.)
(قوله ويأكل من لحم الأضحية إلخ) هذا في الأضحية الواجبة والسنة سواء، إذا لم تكن واجبة بالنذر، وإن وجبت به فلا يأكل منها شيئا، ولا يطعم غنيا،سواء كان الناذر غنيا أو فقيرا، لأن سبيلها التصدق، وليس للمتصدق ذلك، ولو أكل فعليه قيمة ما أكل. زيلعي
-রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৭
আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রাহ.-এর উক্ত ইবারত ভালোভাবে লক্ষ করা দরকার। কারণ কোনো কোনো আলোচকের ইবনে আবিদীন শামী রাহ. এর বক্তব্য- কুরবানীর দিনে যদি মান্নতের পশু যবাই করা না হয়; বরং পরে যবাই করা হয় তাহলে ঐ মান্নতের কুরবানীর গোশত সদকা করে দেয়া আবশ্যক- এটি নজরে এসেছে ঠিক-ই, কিন্তু কুরবানীর মান্নতের গোশত যে মান্নতকারী কোনো সময়ই খেতে পারে না- তা হয়ত নজর এড়িয়ে গেছে!
বিশ. ফাতহু বাবিল ইনায়া, মোল্লা আলী কারী রাহ. (১০১৪ হি.) খ. ২, পৃ. ২৭২
একুশ. আওজাযুল মাসালিক, খ. ৯ পৃ. ২৪৭
উপরিউক্ত ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবসমূহের উদ্ধৃতি থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়; বরং তা গরিব মিসকীনকে সদকা করে দেয়া ওয়াজিব। এটি হানাফী ফকীহগণের একটি স্বীকৃত মাসআলা; যাতে কোনো দ্বিমত নেই।
কুরবানীর মান্নত সংক্রান্ত ‘বাদায়েউস সানায়ে’-এর ইবারত ও পর্যালোচনা
পূর্বে আমরা দেখে এসেছি, ইমাম কাসানী রাহ. হজ্বের অধ্যায়ে পশুকে দুই ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে ঐসকল কুরবানীর জন্তুর বিবরণ এনেছেন, যা থেকে কুরবানীদাতা খেতে পারে। তাতে তিনি সাধারণ কুরবানী, তামাত্তু, কিরান ও নফল হাদীকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
আর দ্বিতীয় ভাগে যেসকল কুরবানীর গোশত খাওয়া যাবে না তার বিবরণ এনেছেন। তাতে মান্নতের কুরবানী, কাফফারা এবং হজে¦র জরিমানা দম ইত্যাদি পশুকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এগুলো থেকে না খাওয়ার কারণ ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে, মান্নতের পশু, সদকার পশু এবং কাফফারার পশুও মান্নতের পশুর ন্যায়।
কিন্তু কুরবানীর অধ্যায়ে তিনি পশুকে তিন ভাগ করেছেন এবং সেখানে তাঁর বক্তব্য থেকে কেউ এমন বুঝেছেন যে, মান্নতকারীর জন্য মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয। তাই বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। ইমাম কাসানী রাহ. বলেন-
وجملة الكلام فيه أن الدماء أنواع ثلاثة : نوع يجوز لصاحبه أن يأكل منه بالإجماع، ونوع لا يجوز له أن يأكل منه بالإجماع، ونوع اختلف فيه، الأول دم الأضحية نفلا كان أو واجبا، منذورا كان أو واجبا مبتدأ، والثاني دم الإحصار وجزاء الصيد ودم الكفارة الواجبة بسبب الجناية على الإحرام، كحلق الرأس ولبس المخيط والجماع بعد الوقوف بعرفة وغير ذلك من الجنايات، ودم النذر بالذبح، والثالث دم المتعة والقران، فعندنا يؤكل، وعند الشافعي رحمه الله لا يؤكل.
অর্থ : মোটকথা পশু তিন প্রকার :
এক. যার গোশত সর্বসম্মতিক্রমে কুরবানীকারী খেতে পারবে। তা হল ঈদুল আযহার কুরবানী। চাই তা নফল হোক বা ওয়াজিব, মান্নতের হোক বা প্রথম থেকেই তার উপর ওয়াজিব হোক। তা সর্বসম্মতিক্রমে কুরবানীদাতার জন্য খাওয়া জায়েয।
দুই. যার গোশত সর্বসম্মতিক্রমে কুরবানীকারী খেতে পারবে না।
তিন. মতভেদপূর্ণ। অর্থাৎ কারো মতে খেতে পারবে আর কারো মতে খেতে পারবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩
ইমাম কাসানী রাহ.-এর উক্ত বক্তব্যের প্রয়োগক্ষেত্র বুঝতে না পেরে কেউ কেউ বলেছেন, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কাসানী রাহ.-এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ফকীহগণের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীতে ‘বাদায়ে’-এর উক্ত বক্তব্য থেকে আগপর না ভেবে মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া বৈধ বলে দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। কারণ স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বাদায়ে-এর বক্তব্যের যে অর্থ বোঝা যায়, আসলে উক্ত বক্তব্যের দিকে একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হলে, পাশাপাশি বাদায়ে-এর হজ্বের অধ্যায়ের মান্নত সংক্রান্ত বক্তব্য এবং ফকীহগণের কুরবানীর মান্নত সংক্রান্ত বক্তব্য মিলিয়ে দেখা হলে বাদায়ে-এর উক্ত বক্তব্যের সঠিক ‘মাহমিল’ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই বাদায়ে-এর উক্ত বক্তব্যের সঠিক প্রয়োগক্ষেত্র বোঝার জন্য তার একটু পর্যালোচনায় যাওয়া দরকার মনে করছি।
ইজমা দ্বারা কী উদ্দেশ্য?
ইমাম কাসানী রাহ. উপরিউক্ত বক্তব্যে বলেছেন, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারীও খেতে পারবে। এতে কোনো মতবিরোধ নেই; বরং তা একটি ইজমাঈ মাসআলা।
এখন দেখা যাক, এই ইজমা দ্বারা কী উদ্দেশ্য?
এর দ্বারা কি সাহাবা-তাবেয়ীগণের ইজমা উদ্দেশ্য? তবে তো তা সহীহ নয়। কেননা মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া যাবে- এমন কোনো ইজমার কথা সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে প্রমাণিত নয়। বরং সাহাবা-তাবেয়ীগণের আছার থেকে শুরুতেই আমরা ব্যাখ্যামুক্তভাবে আম বক্তব্য দেখে এসেছি যে, মান্নতের পশুর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না; বরং তা সদকা করে দিতে হবে। তাহলে বোঝা গেল, বাদায়ে-এর بالإجماع কথাটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
তবে কি চার মাযহাবের ইজমা উদ্দেশ্য? এক্ষেত্রেও উক্ত বক্তব্য প্রযোজ্য নয়। কারণ শাফেয়ী মাযহাবের কিতাবাদিতে সুস্পষ্ট বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারে না।
যেমন, আলগায়াহ ওয়াত তাকরীব, আবু শুজা আলআসফাহানী (৫৯৩ হি.)-এ এসেছে-
ولا يأكل المضحي شيئا من الأضحية المنذورة، ويأكل من المتطوع بها.
-আলগায়াহ ওয়াত তাকরীব, পৃ. ৪৩
আরো দেখুন, আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব ৮/৩৯৬
ইমাম আহমাদ রাহ. থেকে মান্নতের পশুর গোশত খাওয়া যাবে না- তা প্রমাণিত আছে। যেমন-
قال: لا يؤكل من النذور، ولا من جزاء الصيد، ويؤكل ما سوى ذلك. قال إسحاق: كما قال، لأن النذور وجزاء الصيد واجبان.
-মাসায়িলুল ইমাম আহমাদ ওয়া ইসহাক ইবনু রাহুয়াহ ২/৩২৫
এ মাসআলায় অন্য মাযহাবের ইমামগণের মতামত আল্লামা আইনী রাহ. এককথায় ব্যক্ত করে দিয়েছেন।
তিনি আলবিনায়া শরহুল হিদায়া-এ লেখেন-
(قال: ويأكل من لحم الأضحية) ش: أي قال القدوري: هذا في غير المنذورة، أما في المنذورة فلا يأكل الناذر، سواء كان معسرا أو موسرا، وبه قالت الثلاثة، وعن أحمد في رواية: يجوز الأكل من المنذورة أيضا.
মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না। মান্নতকারী ধনী হোক বা দরীদ্র। আর এটি অন্য তিন ইমামেরও মত। অর্থাৎ ইমাম মালেক রাহ., ইমাম শাফেয়ী রাহ., ইমাম আহমাদ রাহ.-এর মত। ইমাম আহমাদ থেকে ভিন্ন একটি মতও রয়েছে। তা হল, মান্নতকারী খেতে পারবে। -আলবিনায়া ১৪/৩৯৩
হানাফী মাযহাব
জানা কথা যে, আমাদের মাযহাবের ইমামগণ থেকে এ সম্পর্কিত কোনো ইজমায়ী বক্তব্য প্রমাণিত নয়। বরং ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. থেকে বিপরীত বক্তব্য প্রমাণিত আছে, যা ফকীহগণ কুরবানীর মান্নতের গোশত খেতে পারবে না- এ মর্মে পেশ করেছেন। দ্বিতীয়ত যদি এটি মাযহাবের ইজমায়ী মাসআলাই হত তাহলে অবশ্যই তা মাযহাবের উসূলের কিতাব থেকে বর্ণিত হয়ে মাশায়েখ ও মুতাআখখিরীন ফকীহগণও তা ব্যক্ত করতেন। কিন্তু এমন কোনো কথা আমাদের জানামতে তাদের থেকে প্রমাণিত নয়।
তৃতীয় বিষয় হল, এটি যদি মাযহাবের ইজমায়ী মাসআলা হত তাহলে মুতাআখখিরীন ফকীহগণ মাযহাবের ইজমার বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখাতেন না। অথচ ফিকহ ফতোয়ার বহু কিতাবেই সাবলীলভাবে মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না মর্মে বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে।
ইজমা দ্বারা উদ্দেশ্য
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, ইমাম কাসানী রাহ.-এর এই ইজমার প্রয়োগক্ষেত্র কী? উক্ত মান্নত দ্বারা কোন্ মান্নত উদ্দেশ্য?
ইমাম কাসানী রাহ.-এর নিজের বিশ্লেষণ এবং পরবর্তী ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবাদীর আলোচনা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হল, উক্ত মান্নত দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ ব্যক্তির মান্নত, যার উপর কুরবানী ওয়াজিব। সে নিজের ওয়াজিব কুরবানীটি আদায়ের জন্য মান্নতের শব্দ ব্যবহার করেছে। উদ্দেশ্য ওয়াজিব কুরবানীটিকে অধিক সুদৃঢ় করা। এক্ষেত্রে যেহেতু তার ওয়াজিব কুরবানী আদায়েরই নিয়ত ছিল, পৃথক কোনো কুরবানী নিজের ওপর আবশ্যক করে নেয়া উদ্দেশ্য ছিল না, তাই মান্নতের শব্দ ব্যবহার করা হলেও পৃথক কোনো কুরবানী ওয়াজিব হবে না। সুতরাং যেহেতু এটি প্রকৃত অর্থে মান্নতই নয়; বরং নিজের ওয়াজিব কুরবানী, তাই তার গোশত খেতে কোনো অসুবিধা নেই। আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রাহ. বলেন-
أن الموسر إذا نذر في أيام النحر وقصد الإخبار لم يكن ذلك منه نذرا حقيقة، وإن لزوم الشاة عليه بإيجاب الشرع ...، ومقتضى ذلك أيضا أنه حيث قصد الإخبار له الأكل منها، لأنها لم تلزم بالنذر.
ধনী ব্যক্তি যদি কুরবানীর দিনে কুরবানী করার মান্নত করে আর এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয় তার ওয়াজিব কুরবানীকে ব্যক্ত করা, তবে তা প্রকৃত অর্থে মান্নতই নয়। কারণ তার ওপর ছাগল কুরবানী করা শরীয়ত কর্তৃক এমনিতেই আবশ্যকীয়।
...উক্ত বিশ্লেষণ অনুযায়ী মান্নতকারীর মান্নত দ্বারা যখন নিজের ওয়াজিব কুরবানী উদ্দেশ্য হবে সে ঐ কুরবানী থেকে খেতে পারবে। কেননা তা মান্নতের কারণে আবশ্যক হয়নি। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩২০
ইমাম কাসানী রাহ. বলেন-
ولو نذر أن يضحي بشاة وذلك في أيام النحر وهو موسر فعليه أن يضحي بشاتين عندنا؛ شاة لأجل النذر وشاة بإيجاب الشرع ابتداء، إلا إذا عنى به الإخبار عن الواجب عليه بإيجاب الشرع ابتداء، فلا يلزمه إلا التضحية بشاة واحدة.
কোনো ধনী ব্যক্তি যদি কুরবানীর দিনগুলোতে একটি ছাগল কুরবানী করার মান্নত করে তাহলে আমাদের নিকট তার উপর দুটি ছাগল কুরবানী করা আবশ্যক হবে। একটি ছাগল মান্নতের কারণে আর অপরটি শরীয়তের পক্ষ থেকে নির্ধারিত ওয়াজিব কুরবানী হিসাবে। তবে মান্নতের উক্ত বক্তব্য দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায় করা তাহলে সেক্ষেত্রে একটি ছাগলই আবশ্যক হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৪
উপরিউক্ত বক্তব্য ফিকহ-ফাতাওয়ার বহু কিতাবেই উল্লেখ হয়েছে এবং সকলের নিকটই এ কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয। আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রাহ. বলেন-
وقدمنا أن مفاد كلامهم أن الغني له الأكل من المنذورة إذا قصد بنذره الإخبار عن الواجب عليه.
পূর্বে বলে এসেছি যে, ফকীহগণের বক্তব্যের খোলাসা হল, কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তির জন্য মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয, যদি উক্ত মান্নত দ্বারা উদ্দেশ্য হয় নিজের ওয়াজিব কুরবানীর বিষয় জানান দেওয়া। -৬/৩২৭
ইমাম কাসানী রাহ.-এর ‘বিলইজমা’ কথাটা এক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। এ প্রকারের মান্নতের গোশত খাওয়া জায়েয- তা ফকীহগণের নিকট একটি স্বীকৃত বিষয়। ফিকহ-ফাতাওয়ার কিতাবাদীতে ব্যাপকভাবেই তা উদ্ধৃত হয়েছে। কারণ, এটি শুধুই শব্দগত মান্নত। প্রকৃত অর্থে মান্নত নয়।
আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রাহ. ‘বাদায়ে’-এর উক্ত বক্তব্য এবং ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ.-সহ যারা বলেছেন মান্নতকারী নিজ মান্নতের গোশত খেতে পারবে না- এ দুটি বক্তব্যের মাঝে সমন্বয় করেছেন নিম্নোক্ত আলোচনায়-
وقدمنا أن مفاد كلامهم أن الغني له الأكل من المنذورة، إذا قصد بنذره الإخبار عن الواجب عليه، فالمراد بالنذر في كلام الزيلعي هنا النذر ابتداء.
এ বিষয়ে ফকীহগণের বক্তব্যের খোলাসা কথা হল, ধনী ব্যক্তি তার মান্নতকৃত কুরবানীর গোশত খেতে পারবে, যদি মান্নত দ্বারা তার ওয়াজিব কুরবানী উদ্দেশ্য হয়। আর যায়লায়ী রাহ. যে বলেছেন মান্নতের কুরবানী মান্নতকারী খেতে পারবে না- এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল ঐ কুরবানী, যা আবশ্যকই হয়েছে মান্নতের মাধ্যমে; পূর্ব থেকে ওয়াজিব হয়ে আছে এমনটি নয়। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৭)
আল্লামা শামী রাহ.-এর এ বক্তব্য দ্বারা ইমাম কাসানী রাহ.-এর বক্তব্য- ‘কুরবানীর মান্নতের গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে সর্বসম্মতিক্রমে’- এর প্রয়োগক্ষেত্র সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি মান্নতের কুরবানী বিষয়ক আলোচনা করতে গিয়ে ফিকহবিদগণের এ সম্পর্কিত সব বক্তব্য একত্রিত করে তার খোলাসা ব্যক্ত করেছেন নিম্নের আলোচনায়-
والحاصل أن التي لا يؤكل منها هي المنذورة ابتداء، والتي وجب التصدق بعينها بعد أيام النحر والتي ضحى بها عن الميت بأمره على المختار كما قدمناه عن البزازية. والواجبة على الفقير بالشراء على أحد القولين المارين، والذي ولدته الأضحية كما قدمناه عن الخانية، والمشتركة بين سبعة نوى بعضهم بحصته القضاء عن الماضي كما قدمناه آنفا عن الخانية أيضا، فهذه كلها سبيلها التصدق على الفقير فاغتنم هذا التحرير 6/327.
আতা রাহ.-এর আছার ও পর্যালোচনা
মান্নতকারীর জন্য মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয হওয়ার একটি দলীল প্রদান করা হয় জাসসাস রাহ.-কর্তৃক উদ্ধৃত তাবেয়ী আতা রাহ.-এর নিম্নোক্ত আছার দ্বারা-
وروى نافع عن ابن عمر، كان يفتي في النسك والأضحية ثلث لك ولأهلك وثلث في جيرانك وثلث للمساكين. وقال عبد الملك عن عطاء مثله، قال: وكل شيء من البدن واجبا كان أو تطوعا فهو بهذه المنزلة، إلا ما كان من جزاء صيد أو فدية من صيام، أو صدقة أو نسك، أو نذر مسمى للمساكين.
-আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/২৪৫
তা এভাবে যে, উক্ত বক্তব্যে প্রথমে কুরবানীর গোশত খাওয়া বৈধ বলা হয়েছে। অতঃপর মান্নতের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, ঐ মান্নতের গোশত খাওয়া যাবে না, যা মিসকীনদের উদ্দেশ্যে মান্নত করা হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে প্রথম কথা হল, আতা রাহ.-এর উক্ত আছারকে মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়ার দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা ঠিক নয়। কারণ, জাস্সাস রাহ. উক্ত আছারকে মান্নতের কুরবানীর দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেননি; তিনি বরং উক্ত আছার উল্লেখ করেছেন সাধারণ কুরবানীর গোশত এবং হজে¦র কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতার জন্য কী পরিমাণ খাওয়া মুস্তাহাব আর কী পরিমাণ সদকা করা মুস্তাহাব সে সম্পর্কে। আহকামুল কুরআনের পূর্বাপর আলোচনা পড়া হলে বিষয়টি একদমই পরিষ্কার হয়ে যায়। মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয, নাকি জায়েয নয়? এখানে তিনি তার আদৌ উদ্দেশ্য করেননি।
পক্ষান্তরে জাসসাস রাহ. মান্নত বিষয়ক আলোচনা করেছেন وَلْیُوْفُوْا نُذُوْرَهُمْ -এর অধীনে। সেখানে মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয হবে না বলেছেন। মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া বৈধ হওয়ার কথা যিনি বা যারা বলেন- উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় জাসসাস রাহ.-এর বক্তব্য কেন এড়িয়ে গেলেন আল্লাহ্ই ভালো জানেন।
তাছাড়া খোদ আতা রাহ.-এর আছার পেছনে আমরা উদ্ধৃত করেছি। যাতে তিনি বলেছেন-
لا يؤكل من جزاء الصيد، ولا من النذر، ولا من الفدية، ويؤكل مما سوى ذلك.
শিকারের জরিমানা দম থেকে খাওয়া যাবে না, মান্নতের পশু থেকে খাওয়া যাবে না, ফিদইয়ার পশু থেকে খাওয়া যাবে না। এছাড়া বাকি পশু থেকে খাওয়া যাবে। -তাফসীরে তাবারী ২/২৫০
আর نذر مسمى للمساكين বিষয়ে এখানে আতা রাহ.-এর যে বক্তব্য দ্বারা দলীল পেশ করতে চাচ্ছেন তা মূলত মালেকী মাযহাবের মাসআলা। এটি আমাদের মাযহাবের মাসআলাই নয়। দেখুন : আহকামুল কুরআন, তহাবী ২/২৯৫; আলমুদাওয়ানাহ ১/৪১০; আলজামে লিআহকামিল কুরআন, কুরতুবী ১২/৩১; বিদায়াতুল মুজতাহিদ ২/১৬৯
আমাদের মাযহাবে যে কোনো মান্নতের গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না- তা ইমাম তহাবী রাহ.-এর আহকামুল কুরআনে (২/২৯৫) সুস্পষ্টভাবেই ব্যক্ত হয়েছে।
তৃতীয়ত, আতা রাহ.-এর উক্ত আছারে শুধু উযহিয়্যাহ-এর কথাই বলা হয়েছে তা কিন্তু নয়; বরং তাতে নুসুক অর্থাৎ হজে¦র কুরবানীর কথাও রয়েছে। যদি نذر مسمى للمساكين -এর কথা ঈদুল আযহার কুরবানীর ক্ষেত্রে বলা হয়, তাহলে কিন্তু একই কথা মান্নতের হাদীর ক্ষেত্রেও বলতে হবে। অর্থাৎ হজে¦র মান্নতের কুরবানীর ক্ষেত্রে যদি গরীব-মিসকীনকে সদকা করে দেয়ার কথা উল্লেখ করা না হয়, তাহলে হজে¦র মান্নতের গোশত খাওয়াও জায়েয বলতে হবে। অথচ হজে¦র মান্নতের ক্ষেত্রে এমন কথা কুরবানীর মান্নতের প্রবক্তারাও বলবেন না নিশ্চয়। যদি দুটোর মধ্যে তারা পার্থক্য করেন, তবে কোন্ দলীলের ভিত্তিতে করে থাকেন তা তাদেরকে সুস্পষ্ট করতে হবে।
মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়ার একটি দলীল এ-ও দেয়া হয় যে, মুতূনের কিতাবে মুতলাক (ব্যাখ্যামুক্তভাবেই) কুরবানীর গোশত খাওয়ার কথা এসেছে, যা সাধারণ কুরবানী এবং মান্নতের কুরবানী উভয়টিকেই শামিল করে। যদি মান্নতের কুরবানীর বিধান ভিন্ন হত তাহলে অবশ্যই তা উল্লেখ করা জরুরি ছিল।
বড় অদ্ভুত দলীল! এধরনের দলীলের অসারতা ফিকহ শাস্ত্রজ্ঞদের নিকট একদমই স্পষ্ট। কথা হল, মুতূনের কিতাবে কোনো মাসআলা ব্যাখ্যামুক্ত থাকলেই তা আম ধরে নেয়া ঠিক নয়। কারণ আসহাবে মুতূন কোনো কোনো বিষয় অধিক সুস্পষ্ট ও স্বীকৃত হওয়ার কারণে তা স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনার প্রয়োজনই মনে করেন না। ফলে এ ধরনের বহু মাসআলাই তারা ব্যখ্যামুক্তভাবেই বলে যান। কিন্তু শারেহীনে কেরাম আমাদের মতো তালিবুল ইলমদের জন্য ঠিকই তা স্পষ্ট করে দেন, যেন এ নিয়ে কোনো সংশয় না থাকে। এ মাসআলায়ও তা-ই হয়েছে। আসহাবে মুতূন ব্যাখ্যামুক্তভাবে মাসআলা ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু শারেহীন তাদের বক্তব্যের মাহমিল স্পষ্ট করে দিয়েছেন। যেমন হুসামুদ্দীন সিগনাকী রাহ. আননিহায়া শরহুল হিদায়া’য় লেখেন-
ويأكل من لحم الأضحية و يطعم الأغنياء والفقراء إلى قوله جاز أن يؤكله غنيا، وهذا الذي ذكر في أضحية الغني بدون النذر.
এ বক্তব্যে সিগনাকী রাহ. হেদায়া এবং কুদূরীর বক্তব্যের প্রয়োগক্ষেত্র স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতা নিজে খেতে পারবে, ধনী-গরীব সকলকে খাওয়াতে পারবে। আর গ্রন্থকার ছাহেবে হিদায়া এখানে যে বলেছেন কুরবানীদাতা কুরবানীর গোশত খেতে পারবে- তা ধনী ব্যক্তির ঐ কুরবানী, যা মান্নতের নয়। -আননিহায়া, সিগনাকী ২/৫৪৩ (মাখতূত, নূর উসমানিয়া)
অনুরূপ বলেছেন আকমালুদ্দীন বাবারতী রাহ. আলইনায়া শরহুল হিদায়া (৮/৪৩৬)-এ। তিনি হেদায়ার ইবারত উল্লেখপূর্বক বলেন-
وقال (ويأكل من لحم الأضحية إلخ) الأضحية إما أن تكون منذورة أو لا، فإن كان الثاني فالحكم ما ذكره في الكتاب، وإن كان الأول فليس لصاحبها أن يأكل من لحمها ولا أن يطعم الأغنياء، لأن سبيلها التصدق، وليس للمتصدق أن يأكل من صدقته، ولو أكل فعليه قيمة ما أكل.
বাবারতী রাহ. এখানে পরিষ্কার বলেছেন, কিতাব অর্থাৎ হেদায়ায় (যা মূলত ইমাম কুদূরীর বক্তব্য, আর কুদূরী মুতূনের কিতাবের একটি) যে কুরবানীদাতার জন্য কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয বলা হয়েছে- তা মান্নতমুক্ত কুরবানী প্রসঙ্গে। মান্নতের কথা এখানে বলা হয়নি।
এরপর তিনি নিজ থেকে মান্নতের কুরবানীর প্রসঙ্গ টেনেছেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, মান্নতের কুরবানী থেকে মান্নতকারী খেতে পারবে না।
শরহুন নুকায়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থ জামেউর রুমূয-এ কুহেস্তানী রাহ. এ প্রসঙ্গে অধিক সুস্পষ্ট কথা বলেছেন। তিনি বলেন-
(ويأكل) الغني غير الموجب على نفسه الأضحية كما هو المتبادر (منها) أي من تلك الأضحية فلا يأكل الغني الموجب بالنذر أو غيره، وكذا الفقير الناذر أو المشتري لها، لا الفقير الناوي، كما أشرنا إليه.
-জামেউর রুমূয ৩/৩৬৪
আর ফখরুদ্দীন আফিন্দী রাহ. সংশয়ের কোনো পথই বাকি রাখেননি। তিনি জামেউর রুমূযের উপরোক্ত বক্তব্যের টীকায় বলেন-
كما هو أي كون ضمير يأكل إلى الغني الغير الموجب (المتبادر) إلى الذهن في مقام البيان، لأن الفقير الغير الموجب يأكل بالطريق الأولى، فلا حاجة إلى بيانه، لأن المحتاج إلى البيان ما هو غير ظاهر وهو الغني، فلا حاجة إلى أن يقال ويأكل المضحي غنيا كان أو فقيرا، كما قاله أبو المكارم، (أي من تلك الأضحية) أي التي لم يوجبها الغني على نفسه (أو غيره) أي بغير النذر باللسان كنية الأضحية عند الشراء.
উভয় কিতাবের আলোচনার সার হল সাধারণ কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতা খেতে পারবে। আর মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না। কারণ তা একটি স্বীকৃত বিষয়। আর স্বীকৃত বিষয় ভিন্নভাবে বলার প্রয়োজন পড়ে না। -গাওয়াসুল বাহরাইন, ৩/৩৬৪
সুতরাং মুতূনের কিতাবের ব্যাখ্যামুক্ত এক-দুইটি বক্তব্য দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া আর মুতূনের ব্যাখ্যাকারদের সুস্পষ্ট বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এটা সঠিক ফায়সালা নয়।
এখানে আরেকটি কথা হল মুতূনের ব্যাখ্যামুক্ত বক্তব্য দেখে যদি বলা হয় যে, এতে সাধারণ কুরবানী ও মান্নতের কুরবানী সবই শামিল, তাহলে এ নীতির আলোকে প্রশ্ন দাঁড়ায়- সাহাবা তাবেয়ীনের এক জামাত যে ব্যাখামুক্তভাবে বলেছেন-
لا يؤكل من النذر -মান্নতের গোশত (মান্নতকারী) খেতে পারবে না।
তদ্রূপ ফকীহগণ সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যামুক্তভাবে বলেছেন-
ودم النذر دم صدقة.
মান্নতের পশু সদকার পশু।
لأن سبيلها التصدق.
মান্নতের পশুর খাতই হল সদকার খাত।
إن النذر يقتضي تسليم المنذور بجميع أجزائه.
মান্নতের দাবি হল, মান্নতের পশুর আগাগোড়া (দরিদ্রকে) দিয়ে দেয়া- এসব ব্যাখ্যামুক্ত বক্তব্যের মধ্যে কুরবানীর মান্নত কেন অন্তর্ভুক্ত হবে না? সেখানে ঐ নীতি প্রযোজ্য হলে একই নীতি এখানে কেন প্রযোজ্য হবে না? আর যদি এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্যের কথা কেউ বলতে চান তাহলে কোন্ দলীলের ভিত্তিতে বলবেন তা অবশ্যই স্পষ্ট করতে হবে।
আরেকটি দলীল বলা হয় এই যে, হেদায়া, ফাতহুল কাদীর-এ মান্নতের কুরবানী মান্নতকারী খেতে পারবে না- এমন কোনো কথা উল্লেখ নেই। তদ্রƒপ শরহে বেকায়া, মাজমাউল আনহুর, শরহুত তানবীর-এও উল্লেখ নেই।
এ সম্পর্কে প্রথম কথা হল, এ কিতাবগুলোতে কোনো মাসআলার উল্লেখ না থাকাটাই অনুক্ত ও বিপরীত বিষয়ের জন্য দলীল হল কোন্ যুগ থেকে? এমন কথা তো আমাদের ফকীহগণ বলেননি।
দ্বিতীয়ত এ কয়েকটি কিতাবে যদি কোনো মাসআলার উল্লেখ না থাকে, পক্ষান্তরে অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য এক-দুই কিতাবে নয়, বরং অসংখ্য কিতাবে উল্লেখ থাকে, তবে তা কোন্ নীতিতে বা কোন্ যুক্তিতে পরিত্যাজ্য হবে?
উপরন্তু এখানে যে কিতাবগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো কোনো মুসান্নিফ তো সুস্পষ্টভাবেই উক্ত মাসআলা নিজেই লিখে গেছেন। আসুন দেখে নিই তাদের কলম থেকেই।
বলা হয়েছে মাজমাউল আনহুর-এ নেই। অথচ মাজমাউল আনহুর-এ সুস্পষ্টভাবেই এ মাসআলা উল্লেখ আছে। মাজমাউল আনহুর-এর গ্রন্থকার দামাদ আফিন্দী রাহ. বলেন-
ولو نذر أن يضحي ولم يسم شيئا يقع على الشاة، ولا يأكل الناذر منها، ولو أكل فعليه قيمة ما أكله؛ لأن سبيلها التصدق، وليس للمتصدق أن يأكل من صدقته.
কোনো ব্যক্তি যদি কুরবানী করার মান্নত করে, কিন্তু কোন্ ধরনের পশু কুরবানী করবে- তা উল্লেখ না করে তবে তাকে একটি ছাগল কুরবানী করতে হবে। আর মান্নতকারী তা থেকে খেতে পারবে না। যদি খায় তবে তাকে এর মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -মাজমাউল আনহুর ৪/১৭০
আরেকটি দাবি করা হয়েছে যে, শরহুত তানবীর-এ নেই। এর জবাব হল :
এক. খোদ তানবীরুল আবছারের মুসান্নিফ শামসুদ্দীন তুমুরতাশী রাহ. (১০০৪ হি.)-ই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, মান্নতের কুরবানী মান্নতকারী খেতে পারবে না। তিনি তানবীরুল আবছারের স্বরচিত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মিনাহুল গাফফার’-এ লেখেন-
ويأكل من لحم الأضحية ويؤكل غنيا ويدخر، وندب أن لا ينقص التصدق عن الثلث.
এ অংশের অধীনে লিখেন-
هذا في الأضحية الواجبة والسنة سواء، إذا لم تكن واجبة بالنذر، وإن وجبت بالنذر فليس لصاحبها أن يأكل منها شيئا، وأن لا يطعم غيره من الأغنياء، سواء كان الناذر غنيا أو فقيرا، وليس للمتصدق أن يأكل من صدقته، ولا أن يطعم الأغنياء.
-মিনাহুল গাফফার, পৃষ্ঠা ২৮৪ (মাখতূত ফাযিল আহমাদ কুবেরীলী, ইস্তাম্বুল)
দুই. আদ্দুররুল মুখতার-এ আল্লামা হাসকাফী রাহ. মান্নতের কুরবানী বিষয়ক এ আলোচনা আনেননি ঠিক, কিন্তু স্বয়ং হাসকাফী রাহ. মুলতাকাল আবহুর-এর স্বরচিত শরাহ আদ্দুররুল মুনতাকা-এ লেখেন-
(قوله ويأكل من لحم أضحيته) وهو غني (و) لهذا (يطعم من شاء من غني وفقير وندب أن لا تنقص الصدقة عن الثلث) إذ الجهات ثلاث: إطعام وأكل وادخار، وهذا لو واجبة أو سنة، فلو منذورة تحتم صرف الفقراء.
এখানে তিনি সুস্পষ্টভাবেই লিখেছেন-
وهذا لو واجبة أو سنة فلو منذورة تحتم صرف الفقراء.
-আদ্দুররুল মুনতাকা ৪/১৭৩
দাবি করা হয়েছে যে, হিদায়া গ্রন্থে মান্নতের কুরবানীর গোশত সম্পর্কে উল্লেখ নেই। এক্ষেত্রে কথা হল, হেদায়া গ্রন্থে যদিও সুস্পষ্টভাবে মান্নতের কুরবানীর শিরোনামে উক্ত মাসআলা উল্লেখ হয়নি, কিন্তু এ সম্পর্কে তিনি মৌলিক কথা বলে দিয়েছেন। নিম্নোর ইবারতটি লক্ষ করা হলে তা বুঝে আসে। যেমনটি আমরা ইতিপূর্বে শামসুল আইম্মাহ সারাখসী রাহ.-এর এ সংক্রান্ত বক্তব্যে দেখে এসেছি।
ويجوز الأكل من هدي التطوع والمتعة والقران؛ لأنه دم نسك، فيجوز الأكل منها بمنزلة الأضحية.
-হেদায়া ৩/৮০
আর মাবসূত-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে তাতে মান্নতের কুরবানীর বিধান স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ নেই। এ ব্যাপারে কথা হল, স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ না হলেও পূর্বে হজ্বের কুরবানী সংক্রান্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয নয়।
বলা হয়েছে, ফাতহুল কাদীর-এ উল্লেখ নেই। উত্তরে বলতে হয়, ফাতহুল কাদীর-এ মান্নতের কুরবানী বিষয়ক আলোচনা থাকবে কীভাবে? ইবনুল হুমাম রাহ. তো এ গ্রন্থ পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তিনি ‘কিতাবুল ওকালা’-এর একটা অংশ পর্যন্ত লিখেছেন। কিতাবুল উযহিয়্যাহ তো এরও অনেক পরে। এরপর তো তিনি আল্লাহ তাআলার ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর রহমতের ছায়ায় চলে গেছেন।
আর বাযলুল মাজহুদ-এ কেবলমাত্র বাদায়ের উক্ত বক্তব্য উল্লেখ করার উপর ভিত্তি করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া যে, সাহারানপুরী রাহ.-এর নিকটও সহীহ মত হল, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে- একদমই ঠিক নয়। কেননা উক্ত বক্তব্য তিনি মান্নত বিষয়ক কুরবানীর বিধান আলোচনার উদ্দেশ্যে উদ্ধৃতই করেননি; যা ঐ আলোচনাটির পূর্বাপর পড়া হলে স্পষ্ট হয়ে যায়। উক্ত বক্তব্য এনেছেন কুরবানীর গোশত কী পরিমাণ খাওয়া মুস্তাহাব, কী পরিমাণ সদকা করা মুস্তাহাব সে উদ্দেশ্যে।
এছাড়া বাদায়ের বক্তব্যের মর্ম হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর মতো ফকীহের নিকট সুস্পষ্ট থাকাটাই খুব স্বাভাবিক কথা। এর স্বপক্ষে একটি প্রমাণ হল, শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ., যিনি বাযলুল মাজহুদ গ্রন্থ রচনায় সাহারানপুরী রাহ.-এর ‘সহযোগী’ ছিলেন। তিনি আওজাযুল মাসালিক-এ সুস্পষ্টভাবেই লিখেছেন যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী খেতে পারবে না; তা সদকা করে দেয়া আবশ্যক। -আওজাযুল মাসালিক ৯/২৪৭
শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. বাযলুল মাজহুদ-এর টীকা লিখেছেন। যদি সাহারানপুরী রাহ.-এর কুরবানীর মান্নতের ক্ষেত্রে ভিন্নমতই থাকত তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি টীকাতে তার খ-ন করতেন অথবা তার নিজস্ব একটি মত হিসাবে তা স্পষ্ট করে দিতেন।
দ্বিতীয়ত হযরত সাহারানপুরী রাহ. বাদায়ের উক্ত বক্তব্য মান্নতের কুরবানীর আলোচনার অধীনে উদ্ধৃত করেননি, বরং সাধারণ কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতার জন্য খাওয়ার হুকুম কী- তার অধীনে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ মাসআলায় অন্য মাযহাবের ইমামদের ভিন্নমত রয়েছে। শাফেয়ী মাযহাবে কুরবানীর গোশত থেকে একটি অংশ সদকা করে দেয়া আবশ্যক। তা উদ্ধৃত করতেই মূলত ঐ বক্তব্য এনেছেন।
জামেয়া মাযাহেরে উলূমের ফতোয়া
হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর এ মাসআলায় মাওকিফ কী? অনুরূপ মাযাহেরে উলূম-এর মাওকিফ কী- তা জানতে জামেয়া মাযাহেরে উলূম-এ আমরা একটি ইস্তিফতা করেছিলাম।
জামেয়া মাযাহেরে উলূম উক্ত ইস্তিফতার উত্তরে বলেন-
এক. মান্নতের কুরবানী থেকে মান্নতকারীর জন্য খাওয়া জায়েয নয়; পুরো গোশত সদকা করে দেয়া জরুরি। যেমনটি ব্যাপকভাবে ফিকহের কিতাবাদীতে উল্লেখ হয়েছে এবং আমাদের আকাবিরদের ফতোয়াও রয়েছে। জামেয়া মাযাহেরে উলূমের ফতোয়াও ঠিক এমন-ই।
দুই. এ প্রসঙ্গে হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর স্পষ্ট কোনো মত পাওয়া যায়নি।
আর বাযলুল মাজহুদে বাদায়েউস সানায়ে-এর বরাতে যে ইবারত উল্লেখ করা হয়েছে তা হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর চূড়ান্ত মত আখ্যা দেয়া যায় না। কারণ প্রথমত উক্ত ইবারতকে যে প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে তা হল- কুরবানীর গোশত আপাদমস্তক পুরোটাই কুরবানীদাতার জন্য রেখে দেয়া জায়েয, না তা থেকে কিছু অংশ সদকা করা আবশ্যক? শাফেয়ী মাযহাবে কিছু সদকা করা আবশ্যক। কিন্তু কী পরিমাণ সদকা করা আবশ্যক- সে ব্যাপারে তাদের একাধিক মত রয়েছে। আর হানাফী মাযহাবে একটা অংশ সদকা করা মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। যেহেতু বাদায়েউস সানায়ে-এর উক্ত ইবারত থেকে শাফেয়ী মাযহাবের বিপরীতে ব্যাপকভাবে সর্বপ্রকার কুরবানীর গোশত সদকা করা মুস্তাহাব হবার বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে বোঝা যায়, তাই তিনি এ দৃষ্টিকোণ থেকে বাদায়ে-এর উক্ত ইবারতকে উদ্ধৃত করেছেন। হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর উদ্দেশ্য যদি সেটি হয়ে থাকে, তবে তা থেকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যে- হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর নিকট মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয- তা ঠিক নয়। যদিও উক্ত বিশ্লেষণটি সম্ভাবনা পর্যায়ের। কিন্তু إذا جاء الاحتمال بطل الاستدلال -এর জন্য যথেষ্ট।
দ্বিতীয়ত, এ মাসআলায় যদি হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর রায় ফিকহের কিতাবাদী এবং অন্যান্য আকাবিরদের মত থেকে ভিন্ন হত তাহলে হযরত শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. অবশ্যই এ ব্যাপারে টীকা ইত্যাদিতে দ্রষ্টব্য যুক্ত করতেন। কেননা হযরত শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর ইলমী-আমলী জানেশীন ও ওয়ারিছ ছিলেন। যিনি বাযলুল মাজহুদ গ্রন্থ রচনায় হযরত সাহারানপুরীর সহযোগী ছিলেন। পরবর্তীতে হযরত শায়খুল হাদীস রাহ. বাযলুল মাজহুদের ওপর টীকাও লিখেছেন। উক্ত টীকাতে অন্তত এ সম্পর্কে কোনো নোট বা দ্রষ্টব্য পাঠকের সামনে তুলে ধরতেন। কিন্তু হযরত শায়েখ রাহ. বাযলুল মাজহুদের হাশিয়াতেও নয়, তদ্রƒপ অন্য কোনো কিতাবেও এ সম্পর্কে কোনো সতর্কতা বা দ্রষ্টব্য উল্লেখ করেন নাই। আর এটি একটু দূরবর্তী সম্ভাবনার বিষয়ই মনে হয় যে, জুমহুর ফুকাহা ও আকাবিরীনের মতের বিপরীত হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর উক্ত রায় সম্পর্কে হযরত শায়খুল হাদীস রাহ. অবগত থাকবেন না! বা অবগত থেকেও এ সম্পর্কে কোনো আলোচনা করবেন না।
সুতরাং এসকল করীনা ও ইঙ্গিত থেকে এটাই স্পষ্ট যে, এ মাসআলায় হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহগণের সাথেই। (জামেয়া মাযাহেরে উলূমের ফতোয়া থেকে অনূদিত। ২-১২-১৪৪৩ হি.-এর মূল ফতোয়াটি আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে)
আরেকটি দলীল বলা হয়, দরিদ্র ব্যক্তি কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করলে তা মান্নতের হুকুমে হয়ে যায়। আর মান্নতের হুকুমে হওয়া সত্ত্বেও তার জন্য এ কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া মান্নতকারীর জন্য জায়েয।
এ কথার উত্তরের জন্য ফাতাওয়া ছয়রাফিয়াহ-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করে দেয়াই যথেষ্ট মনে করছি। তাতে বলা হয়েছে-
سئل القاضي بديع الدين عن الفقير إذا اشترى شاة للأضحية حتى يصير واجبة للأضحية، كما ذكر شيخ الإسلام خواهر زاده، فإذا ضحى هل يحل أكله؟ قال: نعم، بخلاف ما لو نذر بذبح شاة حيث لا يحل، وقال القاضي برهان الدين: لا يحل، لأنه يصير واجبة بالتزامه، فصار كالنذر، حتى لو هلكت أو ضلت سقط، بخلاف حكم آخر، لأنه التزام عليه بالشراء، وليس للإلزام حقيقة النذر، ألا ترى أنه لو شرع في أربع من التطوع يلزمه بإلزامه، ولهذا لو أفسدها يلزمه الركعتان، بخلاف ما لو نذر وقال: لله أن أصلي أربع ركعات، وشرع، ثم أفسدها يلزمه، فصار أربع ركعات، فعلم حقيقة النذر غير والنذر غير، قال القاضي فخر الدين: يحل، لأنه ليس بنذر حقيقة. قلت: قال القاضي بديع الدين في الصحيح والظاهر: لا يصير واجبة للأضحية بنفس الشراء، ما لم يقل اشتريته للأضحية.
দেখুন : ফাতাওয়া ছয়রাফিয়াহ, পৃ. ৭০ (মাখতূত, মাকতাবা জাহেরিয়্যাহ, দামেস্ক)
আশ্চর্যের বিষয় হল, যে মাসআলাটি মূলত ছিল মান্নতের কুরবানী থেকে মান্নতকারীর জন্য খাওয়া নাজায়েয হওয়ার দলীল, উল্টো সেটিকে বানানো হয়েছে জায়েয হবার দলীল।
বিষয়টি খোলাসা করে বলছি। তা হল, আমরা জানি যে, দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করে তাহলে তার উপর উক্ত পশু কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কারণ হিসাবে ফকীহগণ লেখেন, কুরবানীর উদ্দেশ্যে তার পশু ক্রয় মান্নতের ন্যায়। অর্থাৎ যেন সে মান্নত করেছে আমি আল্লাহর জন্য এ ক্রয়কৃত পশুটি কুরবানী করব। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, যেহেতু এটি মান্নতের ন্যায় তাই তার গোশত কি কুরবানীদাতা খেতে পারবে, নাকি মান্নতের মতো হওয়ার কারণে তা সদকা করে দিতে হবে? এক্ষেত্রে কাযী বাদীউদ্দীন রাহ. বলেন, কুরবানীদাতা তা থেকে খেতে পারবে। অপরদিকে কাযী বুরহানুদ্দীন রাহ. বলেন, কুরবানীদাতা তা থেকে খেতে পারবে না। কারণ দরিদ্র ব্যক্তি কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয়ের কারণে তা প্রকৃত মান্নততুল্য হয়ে গেছে। তাই তা থেকে সে খেতে পারবে না। এর উত্তরে কাযী বদীউদ্দীন রাহ. বলেন, একটি হল মান্নত আর আরেকটি হল মান্নতের মতো হওয়া; দুটো এক নয়। মান্নতের মতো হওয়া সেটা যেহেতু প্রকৃত মান্নত নয়, তাই তা থেকে খেতে অসুবিধা নেই।
ছয়রাফিয়ার উক্ত বিশ্লেষণ থেকে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কুরবানীর মান্নত করা হলে তা থেকে মান্নতকারীর জন্য খাওয়া কারও নিকটই জায়েয নয়। কাযী বাদীউদ্দীন রাহ.-এর নিকটও নয়। বরং তা মতবিরোধের ঊর্ধ্বের মাসআলা। মতবিরোধ হয়েছে শুধু মান্নততূল্য কুরবানী নিয়ে। এর অর্থ হল, মান্নতের কুরবানীর গোশত দ্ব্যর্থহীনভাবেই মান্নতকারীর জন্য খাওয়া নাজায়েয। আরও উল্লেখ্য, ছয়রাফিয়া এ যুগের কিতাব নয়; বরং এটি ‘বাদায়ে’-এর কাছাকাছি যুগের কিতাব।
মান্নতের কুরবানীর গোশত সদকা করা আবশ্যক- তা কি সর্বপ্রথম যায়লায়ী রাহ. বলেছেন?
মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া যাবে- যিনি বা যারা একথা বলে থাকেন, তারা এ মাসআলায় কোনো কোনো কথা একেবারেই ধারণাপ্রসূত বলেছেন। তন্মধ্যে একটি কথা হল, মান্নতের কুরবানীর গোশত সদকা করে দেয়া জরুরি- এমন কথা নাকি সর্বপ্রথম ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ. বলেছেন! (যিনি ৮ম শতাব্দী হিজরীর ফকীহ ছিলেন।) এরপর নাকি কোনো কোনো শারেহ ও টীকাকার তাঁর অনুসরণ করেছেন।
উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ ধারণাপ্রসূত। যায়লায়ী রাহ.-এর পূর্বের কিতাবাদী ভালোভাবে না দেখেই এমনটি বলে দেয়া হয়েছে। আমাদের উপরিউক্ত উদ্ধৃতিসমূহ থেকে বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। পেছনে ছাহেবুল খুলাসা, ছাহেবুল মুহীত, এবং ছাহেবুন নেহায়া-এর স্পষ্ট ইবারত পেশ করা হয়েছে। এ তিনজনই ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ.-এর আগের ফকীহ। তাছাড়া মূল মাসআলাটির প্রমাণ ইমাম মুহাম্মাদ রাহ., ইমাম জাসসাস রাহ., ইমাম কুদূরী রাহ., ইমাম সারাখসী রাহ. এবং ইমাম কাসানী রাহ.-এর বরাতেও দেখানো হয়েছে। এখানে এ ওযর-আপত্তি চলতে পারে না যে, তাদের কাছে মাখতূত ছিল না। কারণ এ মাসআলা যায়লায়ী রাহ.-এর কিতাব তাবয়ীনুল হাকায়েক-এর আগে মুদ্রিত কিতাবাদীতেই বহু যুগ ধরে উল্লেখ আছে। ফিকহ-ফতোয়ার কাজের সাথে যুক্ত প্রায় সকলের কাছেই খুলাছাতুল ফাতাওয়া, আহকামুল কুরআন জাসসাস, মাবসূত ইত্যাদি কিতাবাদী রয়েছে। এর পরও একথা বলা যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত সদকা করা আবশ্যক- এমন কথা সর্বপ্রথম ৮ম শতাব্দী থেকে সূচনা হয়েছে- তা মেনে নেয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে যে, যায়লায়ী রাহ.-এর অনুসরণে ‘কোনো কোনো’ শারেহ ও টীকাকার এমন কথা লিখেছেন।
এখানে কোনো কোনো শারেহ ও টীকাকারের কথা বলা হয়েছে; অথচ কুরবানীর মান্নতের গোশত সদকা করে দেওয়া আবশ্যক- এটি কোনো কোনো শারেহ ও টীকাকারের কথা নয়; বরং অধিকাংশ শারেহ ও টীকাকারই তা লিখেছেন। যেমনটি আমরা কিছু কিতাবের হাওয়ালায় পূর্বে উদ্ধৃত করেছি। আর যারা লিখেননি তারা স্বীকৃত মাসআলা হওয়ার কারণে তা লেখার প্রয়োজনই বোধ করেননি।
এখানে সবচে দুঃখজনক যে বিষয়টি ঘটেছে তা হল, যায়লায়ী রাহ. থেকে নিয়ে পরবর্তী ফকীহগণের ওপর ঢালাওভাবে ‘ইশতিবাহ’-এর একটি এলযাম দেয়া হয়েছে। এবং দাবি করা হয়েছে যে, যায়লায়ী রাহ. থেকে নিয়ে পরবর্তী ফকীহগণ যারা মান্নতের কুরবানীর গোশত সদকা করে দেয়া আবশ্যক বলেছেন- তাঁরা মূলত যবাই-এর মান্নতের সাথে কুরবানীর মান্নতকে গুলিয়ে ফেলেছেন!
ফকীহগণের সুবিশাল এ জামাতের ব্যাপারে এবং আমাদের আকাবির ফকীহ ও মুফতীগণের ফতোয়ার সামনে এমন একটি মন্তব্য করার পূর্বে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও ভাবার দরকার ছিল যে, বিষয়টি কি এ মনীষীগণ গুলিয়ে ফেলেছেন, না নতুন মতের আবিষ্কারকগণ?
একাধিক মাসআলায় দেখা গিয়েছে, ফকীহগণের বক্তব্য খুঁজে না পাওয়াতে নতুন মত অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু এ মাসআলাতে বড় আজীব ব্যাপার এটা দেখা যাচ্ছে যে, ফকীহগণের অনেক বক্তব্য নজরে থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করে নতুন মত অবলম্বন করা হয়েছে। মেনে নিলাম, তাঁরা পূর্ববর্তী ফকীহগণের বক্তব্যগুলো দেখেননি। কিন্তু পরবর্তী ফকীহগণের বক্তব্য তো তাদের সামনেই ছিল। রদ্দুল মুহতার, মাজমাউল আনহুর, আদ্দুররুল মুনতাকা-এর মতো হাতের নাগালের কিতাবগুলোর স্পষ্ট বর্ণনাগুলো কীভাবে নজরে এল না? আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে জুমহুর ফুকাহার মাসলাক সঠিকভাবে বোঝার এবং সে অনুযায়ী আমল করার তওফীক নসীব করুন- আমীন!
আকাবির উলামায়ে হিন্দের ফতোয়া
ফাতাওয়া রশীদিয়া
میت کی طرف سے بغیر اس کی وصیت کے اپنے پاس سے بطور تنفل جو قربانی کی جاوے اس میں سے جس قدر کھاوے یا کسی کو دے درست ہے اور جو قربانی نذر مان کر کی جاوے اس سے کھانا نا درست ہے ۔فقط ۔
অর্থাৎ মৃতের ওসিয়ত ব্যতীত নিজ থেকে যদি নফল কুরবানী করে তবে তা থেকে যে পরিমাণ ইচ্ছা নিজে খেতে পারবে, অন্যকেও দিতে পারবে। আর কুরবানী যদি মান্নতের হয়ে থাকে তবে কুরবানীদাতার জন্য তা থেকে খাওয়া জায়েয নয়। -ফাতাওয়া রশীদিয়া, পৃ. ৪৫২২
ইমদাদুল ফাতাওয়া
سوال: اضحیہ منذورہ سے ناذر کو کھانا اور غنی کو کھلانا جائز ہے یا نہیں ؟ بظاہر تو اراقت دم سے نذر کا ایفا ہو گیا ، اب لحم کا مثل اضحیہ مطلقہ کے حکم ہونا چاہئے ، جو تحقیق ہو ارشاد فرمائیں ۔
الجواب: ۔۔۔ ان روایات سے ثابت ہوا کہ اضحیہ منذورہ سے نہ خود ناذر کو کھانا جائز ہے اور نہ غنی کو کھلانا جائز ہے۔
প্রশ্ন : মান্নতের কুরবানীর গোশত মান্নতকারী কি নিজে খেতে এবং ধনীকে খাওয়াতে পারবে? বাহ্যত বোঝা যায়, জবাইয়ের দ্বারাই মান্নত আদায় হয়ে গেছে; তাই তার গোশত সাধারণ কুরবানীর মতোই হয়ে যাওয়ার কথা।
উত্তর : (এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত থানভী রাহ. ফিকহের কিতাবের বিভিন্ন ইবারত উল্লেখ করে বলেন) এসকল বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হল যে, মান্নতের কুরবানী থেকে মান্নতকারী নিজেরও খাওয়া জায়েয নয়, তদ্রƒপ ধনীকে খাওয়ানোও জায়েয নয়। -ইমদাদুল ফাতাওয়া ৩/৫৬৩
আরেক প্রশ্নের উত্তরে হযরত থানভী রাহ. বলেন-
اس روایت سے معلوم ہوا کہ جب زبان سے نذر کرلے اس کا کھانا تو خود جائز نہیں اور جو نذر نہ کی ہو گو مثل نذر کے اس پر واجب ہو گیا ہو اس کا کھانا جائز ہے کما یدل علیہ قولہ غیر موسع الحال۔
-ইমদাদুল ফাতাওয়া ৩/৫৬৩
এ উত্তরটিতেও একই কথা বলা হয়েছে।
ফাতাওয়া নেযামিয়া
اضحیہ منذورہ اور غیر منذورہ میں دوسرا فرق یہ ہے کہ نذر کے قربانی کے گوشت کو ناذر کے لئے صدقہ کرنا ضروری ہے خود کھانا اس میں سے جائز نہیں ، غیر منذور قربانی کے گوشت کو فقراء پر صدقہ کرنا ضروری نہیں بلکہ خود بھی اس کو کھا سکتا ہے۔
মান্নতের কুরবানী এবং মান্নতবিহীন কুরবানীর মধ্যে দ্বিতীয় পার্থক্য হল এই যে, মান্নতের কুরবানীর গোশত সদকা করে দেয়া জরুরি। মান্নতকারীর জন্য তা থেকে খাওয়া জায়েয নয়। মান্নতবিহীন কুরবানীর গোশত দরিদ্রকে সদকা করে দেয়া জরুরি নয়; বরং নিজেও খেতে পারবে। -ফাতাওয়া নেযামিয়া ১/৩৪০
ফাতাওয়া উসমানী
نذر کی قربانی کا گوشت کھانا جائز نہیں ، اگر غلطی سے کھا لیا تو جتنا گوشت کھایا ہے اس کی قیمت کا صدقہ کیا جائے ۔
অর্থাৎ মান্নতের কুরবানীর গোশত (মান্নতকারীর জন্য) খাওয়া জায়েয নয়। যদি ভুলক্রমে মান্নতকারী খায় তবে যে পরিমাণ গোশত খাবে তার মূল্য সদকা করে দেবে। -ফাতাওয়া উসমানী ২/৫০২
আশা করি, এ কয়টি উদ্ধৃতি দ্বারাই আকাবিরে উলামায়ে হিন্দের ফতোয়াও স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রবন্ধটি কিছুটা দীর্ঘ হয়ে গেল। বিষয়গুলো স্পষ্ট করার জন্য তা দরকারও ছিল। ফিকহের তালিবুল ইলম ভাইয়েরা প্রবন্ধটি গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে দেখতে পাবেন যে, আলোচ্য মাসআলাটি (মান্নতের কুরবানীর গোশত খাওয়া মান্নতকারীর জন্য জায়েয নয়; বরং পুরো গোশত সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব) ফিকহে হানাফীর স্বতঃসিদ্ধ মাসআলা, যা শরীয়তের বহু দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এতে দ্বিমতের ধারা একেবারেই নতুন। এর বয়স সর্বোচ্চ চল্লিশ বছর। তাই এ নতুন মতের কারণে ফিকহ-ফতোয়ার তালিবুল ইলমদের বিভ্রান্ত হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
هذا، وصلى الله تعالى على سيدنا ونبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.
ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহর দান
মাওলানা শিব্বীর আহমদ
ভাষা- যার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি, কথা বলি, আদেশ-উপদেশ দিই, সংবাদ সরবরাহ করি, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করি, কখনোবা ঝগড়া-তর্কেও জড়াই। এ ভাষা এতটাই সর্বজনীন, এখানে ছোট-বড় ধনী-গরীবের কোনো ভেদাভেদ নেই। মানুষ মাত্রই যেমন রক্ত-মাংসের অধিকারী হয়, প্রতিটি মানুষ তেমনি নিজ নিজ ভাষায় কথাও বলতে পারে। জন্মের পর থেকে একটি শিশু যেভাবে ধীরে ধীরে নানা ধাপ পেরিয়ে হাঁটতে শেখে, দৌড়াতে শেখে, একটা সময় জীবন-জীবিকার যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে শেখে, তেমনি নানা ধাপ পেরিয়েই সে নিজের ভাষাকে আয়ত্ত করে।
সন্দেহ নেই, এ ভাষা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক অনন্য নিআমত। এ নিআমত এতটাই ছড়ানো যে, তা কেবল আশরাফুল মাখলুকাত মানুষই নয়, বরং বুনো পশুপাখি আর কীটপতঙ্গরাও তা ভোগ করে। পাখিদের কিচিরমিচির আমরা শুনি, পশুদের নানা রকম আওয়াজও শুনি, আবার পিঁপড়ের মতো অনেক কিছুর আওয়াজই আমাদের কানে পৌঁছে না। পবিত্র কুরআনের বর্ণনা, নবী সুলাইমান আলাইহিস সালাম এক পিঁপড়ের কথা শুনেছিলেন। পিঁপড়েটি নিজ দলের অন্য পিঁপড়েদের গর্তে ঢুকে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছিল। তিনি পশুপাখির ভাষা বুঝতেন। সাধারণভাবে আমরা না বুঝলেও তিনি বুঝতেন। এটা ছিল তাঁর মুজেযা। পিঁপড়ের কথা শোনা আর পাখির সঙ্গে আলাপচারিতার ঘটনা পবিত্র কুরআনে স্পষ্টই বর্ণিত হয়েছে।
আমরা যারা মানুষ, আমাদের ভাষায় কত ভিন্নতা! আরবী, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, তুর্কি-সহ আরও কত ভাষা। আবার এলাকাভেদে একই ভাষায় নানা রকম পরিবর্তন দেখা যায়। যোগ হয় নানান আঞ্চলিকতা। এভাবে কত বিচিত্র ভাষায় যে মানুষ কথা বলে, এর সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো কখনোই আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হবে না। এ ভিন্নতা হিসেব করার সাধ্য একমাত্র আল্লাহ তাআলারই রয়েছে। ছোট-বড় দৃশ্য-অদৃশ্য কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়। তিনি সর্বজ্ঞানী।
কিন্তু মানুষ যে এত বিচিত্র ভাষায় কথা বলে, নিজের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করে, অথচ সকল মানুষ তো একই আদমের বংশধর। সকলে একই ধরনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অধিকারী। তবুও তাদের কথায় এত ভিন্নতা। পবিত্র কুরআনের বর্ণনানুসারে, আল্লাহ তাআলা এক আদম থেকে প্রথমে তাঁর স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন, এরপর তাদের দুজন থেকে অনেক নারী-পুরুষ সৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিয়েছেন পৃথিবীজুড়ে। বিস্তীর্ণ এ পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা মানুষের মুখের ভাষার এ বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা- এও আল্লাহ তাআলারই সৃষ্টি।
মানুষের ভাষার এ বৈচিত্র্য এখানেই শেষ নয়। জাতিগত কিংবা এলাকাভিত্তিক এ বৈচিত্র্যের চেয়েও অবাককরা বিষয় মানুষের ভাষার ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য। একেকটি ভাষায় হয়তো কোটি কোটি মানুষ কথা বলে। কিন্তু কোটি কোটি সংখ্যক মানুষের ভাষার উচ্চারণেও রয়েছে স্বকীয়তা। একজনের আওয়াজের সঙ্গে অন্যজনের আওয়াজের মিল নেই। কণ্ঠস্বর ভিন্ন। চেহারা যেমন আলাদা, কণ্ঠস্বরও আলাদা। শত কোটি মানুষের শত কোটি কণ্ঠস্বর। ভাষা এক, আঞ্চলিকতাও এক, তবুও একেকজনের উচ্চারণ একেকরকম। একই বাবা-মায়ের সন্তান যারা, এমনকি যারা জমজ, তাদের উচ্চারণেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সহযোগিতায় মানুষ শব্দ উচ্চারণ করে, কথা বলে, সেসব অঙ্গ তো সবার একইরকম। তা সত্ত্বেও উচ্চারণে এত ভিন্নতা! কারও গলার স্বর মোটা, কারোরটা চিকন, কারও গলা কর্কশ, কারও স্বর কোমল। এ ভিন্নতা ও স্বকীয়তার পেছনে আমাদের শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোনো প্রভাব নেই। কোনোরূপ দখল নেই জন্মদাতা বাবা ও মায়েরও। এ কেবলই মহান আল্লাহর কারিশমা, আল্লাহ পাকের সৃষ্টির বৈচিত্র্য।
এ উচ্চারণ ও কণ্ঠস্বর দিয়ে আমরা ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করি। পর্দার আড়াল থেকেও গলার আওয়াজ শুনে আমরা কাউকে চিনে নিতে পারি। পরিচয় লাভের এ পদ্ধতি আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানা ক্ষেত্রেই কাজে লাগাই। বিশেষত যাদের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল, কারও পরিচয় পাওয়ার জন্য গলার স্বরই তাদের প্রধান ভরসা। বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের মুখের ভাষার এ বৈচিত্র্যটাও আমাদের জন্য মহান মালিকের এক বিশেষ দান।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা-
وَ مِنْ اٰیٰتِهٖ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اخْتِلَافُ اَلْسِنَتِكُمْ وَ اَلْوَانِكُمْ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیٰتٍ لِّلْعٰلِمِیْنَ.
তাঁর অন্যতম নিদর্শন আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের ভিন্নতা। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্যে রয়েছে বহু নিদর্শন। -সূরা রূম (৩০) : ২২
আমাদের গলার আওয়াজ, মুখের ভাষা- আমাদের স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এ এমন আর কী! কিন্তু একটু ভাবলেই আল্লাহ পাকের মহান দরবারে কৃতজ্ঞতায় আমাদের মাথা নুইয়ে পড়তে বাধ্য হবে- সাধারণ এ গলার আওয়াজের মধ্যে অসাধারণ কী বৈচিত্র্য তিনি লুকিয়ে রেখেছেন। আর কথা বলা ও নিজের ভাব প্রকাশ করার যে যোগ্যতা তিনি আমভাবে সকলকে দিয়েছেন, তাও কি তুচ্ছ কোনো বিষয়? সূরা রহমানে আল্লাহ তাআলা নিজের দয়ার পরিচয় দিয়েছেন এভাবে-
اَلرَّحْمٰنُ،عَلَّمَ الْقُرْاٰنَ،خَلَقَ الْاِنْسَانَ،عَلَّمَهُ الْبَیَانَ...
সীমাহীন মেহেরবান (আল্লাহ)। তিনি কুরআন শিখিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাকে ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন। ... [আয়াত ১-৪]
যারা বাকপ্রতিবন্ধী, কথা বলতে পারে না, কিংবা সুস্থ-স্বাভাবিক কেউ যখন গলা বা জিহ্বার কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে সাময়িকভাবে কথা বলতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন বোঝা যায়- এ নিআমতের গুরুত্ব! সাধারণভাবে সকলকেই তিনি দান করেছেন এ নিআমত। আল্লাহ তাআলার যেসব নিআমত সকলের মাঝে ছড়ানো, সেগুলোর প্রায় সবই এমন যে, আমরা ওসবকে খুবই তুচ্ছ জ্ঞান করি। এজন্যেও যে আমাদের শোকর আদায় করা প্রয়োজন- তা আমরা ভুলেই যাই। এরপর জীবনে চলার পথে যখন কোনোভাবে একটু আঁচর লাগে সেসব নিআমতের কোথাও, তখন আমরা কিছুটা টের পাই- আল্লাহর নিআমতের অসীমতা।
আরেকটি কথা, আমাদের জীবনধারণের জন্য যে নিআমত যতটা বেশি জরুরি, আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তা ততটাই ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর আমরাও সেসব নিআমত থেকে যেন ততটাই উদাসীন। উদাহরণস্বরূপ আমরা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস আলো বাতাস পানি ইত্যাদির কথা স্মরণ করতে পারি। আর নিআমত বললে আমরা সাধারণত যা বুঝি, তা অনেকাংশেই আমাদের জীবনধারণের জন্য আবশ্যকীয় কোনো বিষয় নয়। আহকামুল হাকিমীন মহান আল্লাহর হিকমতের দাবিও এটাই- তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে তিনি কম মানুষকেই দিয়ে থাকেন, সবাইকে এর সব দেন না।
আমরা কথা বলছিলাম আমাদের মুখের ভাষার ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য নিয়ে। বিষয়টি আমাদের অনেকের দৃষ্টিতে হয়তো অতি সামান্য, কিন্তু আল্লাহ তাআলা সঙ্গত কারণেই একে উল্লেখ করেছেন তাঁর শক্তির অন্যতম নিদর্শন বলে। তাও কীভাবে? সূরা রূমের উপরোক্ত আয়াতের প্রথমাংশে উল্লেখ করা হয়েছে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির কথা। এরপর একই বাক্যে বলেছেন ভাষা ও রঙের ভিন্নতার কথা। আসমান-জমিন যে আল্লাহ তাআলার কত বড় সৃষ্টি- তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! এ তো সকলের কাছেই এক স্বীকৃত বিষয়- আল্লাহ তাআলা আকাশসমূহের স্রষ্টা, পৃথিবীর স্রষ্টা, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবকিছুরই স্রষ্টা। আরবের যে মুশরিকরা শত শত মূর্তির উপাসনা করত, তারাও কি একক সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলাকে অস্বীকার করতে পারত? পারত না। পবিত্র কুরআনেই লক্ষ করুন-
وَ لَىِٕنْ سَاَلْتَهُمْ مَّنْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ لَیَقُوْلُنَّ اللهُ.
যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর- কে আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তবে অবশ্যই তারা বলবে- আল্লাহ! -সূরা লুকমান (৩১) : ২৫
আমাদের সমাজে যারা তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজারী, তারাও তো সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহকেই মানে। আকাশ-জমিন-পৃথিবী ইত্যাদি- আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিগুণের এসব প্রকাশ তাঁর জন্য যদিও খুবই তুচ্ছ বিষয়, কিন্তু আমাদের চোখে এর প্রতিটিই অতি বিশাল। এতটাই বিশাল, আমরা এসবের কোনো সীমা-পরিসীমা আয়ত্ত করতে পারি না। আল্লাহ তাআলার কুদরতের প্রসঙ্গে প্রথমেই আমাদের সামনে আসে এ বিশাল আকাশ-জমিন, চাঁদ-সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টির কথা। স্বতঃসিদ্ধ এ বিষয়টির সঙ্গেই তিনি নিজের কুদরতের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন আমাদের ভাষা ও রঙের ভিন্নতার কথা। এ নিআমত যেহেতু সর্বব্যাপী, অতি সাধারণ, তাই আমরাও একে তুচ্ছই মনে করি। সূরা রূমের এ আয়াতটিতে আমাদের জন্যে তাই চিন্তার অনেক উপকরণ রয়েছে। যে বিষয়টিকে আমরা নিতান্তই তুচ্ছ মনে করছি, আসলে তা মোটেও সামান্য কোনো বিষয় নয়। কোনো মানুষের পক্ষে কি সম্ভব ছিল এ বৈচিত্র্যের আয়োজন? মোটেও নয়। বরং বলা যায়, ভাষার এ বৈচিত্র্যও আসমান-জমিনের সৃষ্টির চেয়ে কম জটিল নয়। আল্লাহ তাআলার কাছে তো কোনোটাই কঠিন নয়। তাঁর ঘোষণা সুস্পষ্ট-
وَسِعَ كُرْسِیُّهُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ وَ لَا یَـُٔوْدُهٗ حِفْظُهُمَا.
তাঁর কুরসী আকাশসমূহ ও পৃথিবীব্যাপী। এ দুয়ের সংরক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করতে পারে না। -সূরা বাকারা (২) : ২৫৫
কিন্তু আমরা যেমন আকাশকে বিশাল মনে করি, পৃথিবীকে বিশাল মনে করি, এসবের সৃষ্টিকে মহাশক্তির অধিকারী সত্তার কুদরত মনে করি, আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে তুচ্ছ এ গলার আওয়াজ আর মুখের ভাষার ভিন্নতাও সে একই মহাশক্তিধর সত্তার কুদরত। অন্য কারও পক্ষে তা সম্ভব ছিল না কখনোই। সূরা রূমের আয়াতটিতে আমাদের এ শিক্ষাই দেয়া হয়েছে।
আর তিনি যেহেতু মহাশক্তিধর, তাঁর শক্তির প্রকাশ আমরা দেখতে পাই যেদিকে চোখ মেলি সেদিকেই, যেখানে যাই সেখানেই, এমনকি আমাদের নিজেদের দেহ ও অস্তিত্বের মধ্যেও, এসব দেখার পর আর সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না- তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। মাথার উপরের বিশাল আকাশ আর ক্ষুদ্র মানুষের অতি ক্ষুদ্র মুখে উচ্চারিত বিচিত্র কণ্ঠস্বর তাঁরই সৃষ্টি, তাঁরই শক্তি ও কুদরতেরই দুটি নিদর্শন।
আমাদের দেখা-অদেখা যত বিশাল ও অতি বিশাল অস্তিত্ব, যত ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র কণা, সবকিছু তাঁরই সৃষ্টি। তিনি অদ্বিতীয় স্রষ্টা। আবার তিনি হাকীম- অতি প্রজ্ঞাবান। অসীম হিকমত ও প্রজ্ঞার অধিকারী তিনি। সঙ্গত কারণেই তাঁর কোনো সৃষ্টিই অর্থহীন হতে পারে না। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা-
وَ مَا خَلَقْنَا السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ وَ مَا بَیْنَهُمَاۤ اِلَّا بِالْحَقِّ.
আমি আকাশসমূহ, পৃথিবী ও এ দুয়ের মাঝে যা রয়েছে তা যথাযথ কারণ ছাড়া সৃষ্টি করিনি। -সূরা হিজর (১৫) : ৮৫
আমাদের ভাষার ভিন্নতা, কণ্ঠস্বরের ভিন্নতা- আল্লাহ তাআলার এ সূক্ষ্ম বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টি নিয়েও ভাবতে হবে আমাদের। এতে আমরা কিছুটা কল্পনা করতে পারব আল্লাহ তাআলার দয়া ও কুদরতের অসীমতা। আর আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহের অনুভূতি আমাদের মন-মানসে যতটা থাকবে, আমরা ততটাই তাঁর দেয়া নিআমতগুলোর সঠিক ব্যবহার করে তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারব। তাঁর অসীম কুদরতের কথা আমরা যত বেশি কল্পনা করব, তাঁর কোনো বিধান লঙ্ঘন করতে ততটাই কেঁপে উঠবে আমাদের বুক। তাঁর সীমাহীন দয়া ও কুদরতের এ কল্পনা আমাদেরকে তাঁর সত্যিকার বান্দা হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে বহু দূর।