Safar 1428   ||   March 2007

আমাদের আলকুরআন

কুরআন কারীম জ্ঞানার্জনের প্রতি খুব তাকিদ করেছে। জ্ঞানী ও মূর্খের প্রভেদ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এক জায়গায় ইরশাদ হয়েছে-

هَلْ یَسْتَوِی الَّذِیْنَ یَعْلَمُوْنَ وَ الَّذِیْنَ لَا یَعْلَمُوْنَ

যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি কখনো সমান হতে পারে? -সূরা যুমার ৯

অর্থাৎ তারা কখনো সমান হতে পারে না। জ্ঞানীদের মর্যাদা অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

یَرْفَعِ اللّٰهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ ۙ وَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجٰتٍ

আল্লাহ তাআলা ওই সব মানুষকে অনেক গুণ মর্যাদা দান করেন যারা ঈমান এনেছে এবং ইলমপ্রাপ্ত হয়েছে। -সূরা মুজাদালাহ ১১

কেননা, ইলম ছাড়া আল্লাহকে চেনা যায় না। তাঁর আদেশ নিষেধ, সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টি জানা যায় না। এমনকি ইলম ছাড়া প্রকৃত মানুষও হওয়া যায় না।

জগতের সৃষ্টিকুলের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে মহান আল্লাহ আদেশ করেছেন। কারণ তাহলেই তাঁর অনুপম সৃষ্টিকৌশল জানা থাকবে এবং মহান কুশলী স্রষ্টার পরিচয় লাভ করা সহজ হবে। আল্লাহ বলেন-

اَفَلَا یَنْظُرُوْنَ اِلَی الْاِبِلِ كَیْفَ خُلِقَتْ وَ اِلَی السَّمَآءِ كَیْفَ رُفِعَتْ وَ اِلَی الْجِبَالِ كَیْفَ نُصِبَتْ وَ اِلَی الْاَرْضِ كَیْفَ سُطِحَتْ.

তারা কি দৃষ্টিপাত করে না উটের প্রতি, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? দৃষ্টিপাত করে না আকাশের প্রতি, কীভাবে তাকে উচ্চতা প্রদান করা হয়েছে? দৃষ্টিপাত করে না পর্বতমালার প্রতি, কীভাবে সেগুলোকে স্থাপন করা হয়েছে? দৃষ্টপাত করে না ভূমির প্রতি, কীভাবে তাকে বিছানো হয়েছে? -সূরা গাশিয়াহ ১৭

আরও ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَلْقٰی فِی الْاَرْضِ رَوَاسِیَ اَنْ تَمِیْدَ بِكُمْ وَ اَنْهٰرًا وَّ سُبُلًا لَّعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَۙ وَ عَلٰمٰتٍ ؕ وَ بِالنَّجْمِ هُمْ یَهْتَدُوْنَ

এবং তিনি পৃথিবীতে পর্বতমালা স্থাপন করেছেন যেন তা তোমাদেরকে নিয়ে দুলতে না থাকে এবং তিনি নদ-নদী ও রাস্তাসমূহ বানিয়েছেন যেন গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পার, এবং পথ নির্ণয়কারী চিহ্ন সমূহও। আর তারা নক্ষত্রের সাহায্যেও পথের নির্দেশ পায়। -সূরা নাহল ১৫-১৬ 

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ سِیْرُوْا فِی الْاَرْضِ فَانْظُرُوْا كَیْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلُ.

তোমরা ভূপৃষ্ঠে সফর কর এবং অবলোকন কর কেমন হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম। -সূরা ইউসুফ ১০৯

জ্ঞানের প্রতি কুরআন কারীমের এই অনুরাগের কারণে মুসলিম উম্মাহ তাদের স্বর্ণযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল। ইসলামপূর্ব যুগের পাদ্রী ও অন্যান্য ধর্মগুরুর মতো মুসলিম মনীষীরা জ্ঞানচর্চায় কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা আরোপ করেননি। তাঁরা নিজেরাও জ্ঞানচর্চা করেছেন এবং অন্যদের জ্ঞানচর্চাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। তাদের জ্ঞানচর্চা তাদেরকে আল্লাহমুখী করেছিল এবং নীতিবান ও সভ্য মানুষরূপে পৃথিবীবাসীর নিকটে পরিচিত করেছিল। কিন্তু যখনই মানুষ কুরআনের নির্দেশনা পরিত্যাগ করল এবং কুরআন থেকে দূরে সরে যেতে লাগল তখনই সকল ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অধঃপতন দেখা দিল, এমনকি তাদের জ্ঞানচর্চাও পৃথিবীবাসীর জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিল। তাই কুরআনশূন্য জ্ঞানচর্চা নয়; আমাদের প্রয়োজন কুরআনী রুচি ও বিশ্বাসে উদ্ভাসিত জ্ঞানচর্চা।

সুন্দর মজলিসের কথা

সবাই সুন্দরকে ভালোবাসে। গোলাপ ফুল খুব সুন্দর। তাই মানুষ তাকে ভালোবাসে। গোলাপ ফুলের ঘ্রাণ কত মিষ্টি। তাই মানুষ তা পছন্দ করে। আমার কাজকর্মগুলোও যদি গোলাপের মতো সুন্দর হয় তাহলে কেমন হয় ?

আজ বলব সুন্দর মজলিসের কথা। কজন মানুষ মিলিত হয়ে যখন আলাপ আলোচনায় মগ্ন হয় তখন তাকে বলে মজলিস। মজলিসের কিছু নিয়ম কানুন আছে, যেগুলো মেনে চললে মজলিসটি হয়ে উঠে গোলাপ ফুলের মতো সুন্দর।

তাই কিছু নিয়ম জেনে নেওয়া যাক।

* মজলিসে শামিল হওয়ার সময় উপস্থিত মানুষদেরকে সালাম করা এবং মজলিস থেকে বিদায় গ্রহণের সময়ও সালাম দেওয়া।          

* মজলিসে আদব-লেহাজ বজায় রাখা। যেখানে স্থান পাওয়া যায় সেখানেই বসা, অন্য মানুষকে কষ্ট না দেওয়া।

* মজলিসে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা।

* কোনো একজন কথা বলতে থাকলে তার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা।

* আগে বড়দেরকে কথা বলতে দেওয়া এবং তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা।

* মজলিসটি যেন আল্লাহ তাআলার স্মরণ ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ পাঠ থেকে শূন্য না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা।

* মজলিস শেষে দুআ পড়া। এই দুআটিকে কাফফারাতুল মজলিস বলা হয়। অর্থাৎ মজলিসে কোনো অনুচিত কিংবা গুনাহের কথা হয়ে থাকলে তা আল্লাহ তাআলা এই দুআর বরকতে ক্ষমা করে দিবেন। দুআটি এই

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ،أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ.

দুআটির মর্মার্থ হল, ইয়া আল্লাহ, আপনি পবিত্র এবং আপনিই প্রশংসার উপযুক্ত। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ছাড়া আর কোনো মাবূদ নেই। আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন করছি।

দুআটি আবু দাউদ, জামে তিরমিযী ও অন্যান্য হাদীসের কিতাবে রয়েছে।

আমাদের নবীজী

আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাণের দুশমনদেরকেও ক্ষমা করেছেন। যে রাতে নবীজী আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আদেশ পেয়ে মদীনায় হিজরত করতে মনস্থ করলেন সে রাতে তাঁকে হত্যা করার জন্য মক্কার বিভিন্ন গোত্রের কিছু দুষ্টলোক তাঁর গৃহ বেষ্টন করে রেখেছিল, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহে নবীজী তাদের সামনে দিয়েই বের হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর যখন আল্লাহ তায়ালা নবীজীকে শক্তি ও ক্ষমতা দান করলেন, মক্কা নগরী বিজিত হল তখন কি তিনি তার প্রাণের দুশমনদের কোনো শাস্তি দিয়েছিলেন? দেননি। তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। নবীজী আল্লাহ তায়ালার আদেশে ইসলামের দুশমনদের সঙ্গে জিহাদ করেছেন কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে কখনো কারও থেকে এতটুকু প্রতিশোধও নেননি। দুশমন ও অসভ্য লোকদের মন্দ ব্যবহার তিনি অম্লান বদনে সহ্য করেছেন এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

আমীনুল উম্মাহ

আমীনুল উম্মাহ অর্থ উম্মাহর বিশ্বস্ত ব্যক্তি। এটি একজন সাহাবীর উপাধি। খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সাহাবীকে এই উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সেই সৌভাগ্যবান সাহাবী হলেন আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা.।

এই উপাধি লাভের পিছনে ছোট্ট একটি ঘটনা ছিল। ঘটনাটি হল, একবার নাজরান অঞ্চলের দুজন পাদ্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসল। কিছুক্ষণ আলোচনার পর তারা আবেদন জানাল, আমাদের সঙ্গে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি প্রেরণ করুন, যিনি ইসলাম সম্পর্কে বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমাদেরকে অবহিত করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের সঙ্গে একজন যথার্থ বিশ্বস্ত ব্যক্তিকেই প্রেরণ করব। রাসূলুল্লাহর একথা শুনে উপস্থিত সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল, রাসূল কাকে প্রেরণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু উবাইদা রা.কে সম্বোধন করে বললেন, আবু উবাইদা উঠুন, এদের সঙ্গে যান।

(رواه ابن أبي شيبة، ورجاله ثقات، أنظر السير : ১২)

অন্য একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, আমীনু হাযিহিল উম্মাহ আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ। এ উম্মতের আমীন বা বিশ্বস্ত ব্যক্তি হলেন আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ।

আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. আরবের বিখ্যাত কুরাইশ বংশের মানুষ ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়ত লাভের প্রথম বছর তিনি ঈমান আনয়ন করেন এবং বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উহুদ যুদ্ধে যখন মুসলমানদের বিপর্যয় ঘটল এবং কাফেররা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আঘাত করল তখন আবু উবাইদা রা. নবীপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এক কাফেরের আঘাতে লৌহ শিরস্ত্রাণের দুটো কড়া নবীজীর পবিত্র চেহারায় বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আবু উবাইদা ছুটে এলেন এবং দাঁত দিয়ে সজোরে কামড়ে ধরে একটানে সেই কড়া নবীজীর চেহারা থেকে খুললেন। কড়া দুটো খুলতে গিয়ে আবু উবাইদা সেদিন দুটি দাত হারিয়ে ছিলেন।

ইসলামের প্রথম খলীফা আবু বকর সিদ্দীক রা. তাঁকে মুসলিম জাহানের খলীফা হওয়ার উপযুক্ত মনে করতেন। এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর যখন খিলাফত প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল তখন তিনি উমর ইবনুল খাত্তাব রা. ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. -এই দুইজনের নাম প্রস্তাব করেছিলেন।

আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর খিলাফতকালে রাষ্ট্রীয় তহবিলের দায়িত্ব তাঁর উপরই ন্যস্ত ছিল। ১৩ হিজরীতে খলীফা তাঁকে শাম অঞ্চলের আমীররূপে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু এই সমৃদ্ধ জনপদের আমীর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জীবনযাত্রা কেমন ছিল তা নিম্নের ঘটনাটি থেকে জানা যায়।

উমর রা. মুসলিম জাহানের খলীফা হওয়ার পর যখন শাম সফরে আসলেন তখন সেখানকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মোলাকাতের সময় বলতে লাগলেন, আমার ভাই আবু উবাইদা কোথায়? উপস্থিত লোকেরা উত্তর দিলেন, তিনি এখনই এসে পড়বেন। কিছুক্ষণ পর আবু উবাইদা রা. উপস্থিত হলেন অতি সাধারণ বেশে। একটি উটের উপর সওয়ার হয়ে। উভয়ের মধ্যে সালাম বিনিময় হল। খলীফা উপস্থিত লোকদের বিদায় দিয়ে আবু উবাইদা রা. এর গৃহপানে রওয়ানা হলেন। আবু উবাইদা রা.-এর কোনো আলীশান প্রাসাদ ছিল না; মর্মর ও মার্বেল পাথরের কারুকাজ, সুপরিসর হলরুম, স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা, উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা ইত্যাদি কিছুই সেখানে ছিল না। অতি সামান্য একটি গৃহ ছিল আমীরের বাসভবন। একটি তরবারী, একটি তীরদান ও একটি হাওদা-এই ছিল সেই গৃহের আসবাবপত্র। খলীফা তাঁর এই দীন হাল দেখে বললেন, ভাই, আপনি কি কিছু  প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র গ্রহণ করতে পারেন না? আবু উবাইদা রা. এর উত্তরে বললেন

يا أمير المؤمنين! إن هذا سيبلغنا المقيل

আমীরুল মুমিনীন কিসের জন্য আয়োজন, অন্তিম শয্যায় শায়িত হওয়া পর্যন্ত এই তো যথেষ্ট।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই মহান সাহাবী ১৮ হিজরীতে ৪৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

 

advertisement