হজ্বের কার্যাদি শেষ হয়েছে, হজ্ব যেন শেষ না হয়
হজ্বযাত্রীগণ হজ্ব আদায়ের সময় আল্লাহর মেহমান ছিলেন। হজ্ব সমাপনের পর যখন নিজ দেশে ফিরেছেন তখন তারা আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধিরূপে ফিরেছেন। নিজ নিজ আবাসভূমিতে তারা ফিরে এসেছেন হজ্ব ও যিয়ারতের প্রভূত বরকত নিয়ে। হারামাইন শরীফাইন, মিনা ও আরাফায় চৌদ্দশ বছর যাবৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খুৎবার যে পুনরাবৃত্তি হয়ে আসছে সেই শিক্ষাকে নতুনভাবে ইয়াদ করে করে তারা ফিরেছেন স্বজাতির জন্য পুরস্কার ও সতর্কতার বারতা নিয়ে। তারা যেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষাকে ইয়াদ করে মূর্তিমান দাওয়াতরূপে নিজ নিজ আবাসভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেছেন।
হাজ্বী ছাহেবানকে ইস্তিকবাল করা একটি উত্তম বরং মাসনূন আমল। খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীন এই আমলটির ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। মুসনাদে আহমদের একটি হাদীসে (হাদীস ৫৩৭১) বলা হয়েছে,
إِذَا لَقِيتَ الْحَاجَّ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ وَصَافِحْهُ، وَمُرْهُ أَنْ يَسْتَغْفِرَ لَكَ قَبْلَ أَنْ يَدْخُلَ بَيْتَهُ، فَإِنَّهُ مَغْفُورٌ لَهُ.
‘তুমি যখন হজ্ব সমাপনকারীর সাক্ষাৎ লাভ করবে তখন তাকে সালাম দিবে, তার সঙ্গে মুসাফাহা করবে এবং তার নিকটে ইস্তিগফারের দুআ প্রার্থনা করবে তার গৃহে প্রবেশের পূর্বেই। কেননা সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করেছে।
প্রতি হজ্বের মওসুমে ইচ্ছা হয়, বিমানবন্দরে গিয়ে হাজ্বী ছাহেবানের ইস্তিকবাল করি। এই পবিত্র আত্মা ও সমুজ্জ্বল চেহারাগুলোর দর্শন লাভ করি এবং যারা নিকটতম সময়ে রবের নৈকট্য ও প্রিয়তম নবীর সান্নিধ্য-সৌভাগ্য লাভ করেছেন তাঁদের নিকট মাগফিরাতের দুআ কামনা করি, যে চেহারাগুলো এখনো মেহেরবান রবের অনুগ্রহ-আভায় সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। উলামা-মাশাইখ, দোস্ত-আহবাব ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কত মানুষ প্রতি বছর হজ্ব করে ফিরে আসেন বিন্তু তাদেরকে ইস্তিকবাল করার সৌভাগ্য হয়ে ওঠে না। তাদের ইস্তিকবালের আরজু আরজুই থেকে যায় এবং মওসুম সমাপ্ত হয়।
কিন্তু এ বছর আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে ২রা মহররম ১৪২৮ হিজরী মোতাবেক ২২ জানুয়ারি ২০০৭ ঈ. সোমবার সন্ধ্যার কিছু আগে বিমানবন্দরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। এদিন মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুম (আদীব হুজুর) ও হাফেজ ইয়াহইয়া জাহাঙ্গীর ছাহেব তাঁদের সঙ্গীদের নিয়ে হজ্বের সফর থেকে ফিরে আসছিলেন। সে এক চিত্তাকর্ষক দৃশ্য ছিল।
যদি সেই হৃদয়-সম্পদের প্রাচুর্য থাকত তাহলে ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী (৭৪৮ হি.) রহ-এর নসীহতের উপর আমল করতাম, যা তিনি তার বিখ্যাত রচনা সিয়ারু আলামিন নুবালায় উল্লেখ করেছেন। আবীদা আসলামী রহ.-এর আলোচনায় যাহাবী রহ. তার নিম্মোক্ত উক্তিটি উদ্বৃত করেছেন যে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শির মোবারকের একটি চুল আমার কাছে থাকবে তা ভূপৃষ্ঠের সমুদয় স্বর্ণ রৌপ্যের মালিক হওয়া থেকেও আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়।’
যাহাবী রহ. বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওয়াফাতের মাত্র পঞ্চাশ বছর পর এই ইমাম উপরোক্ত কথাটি বলেছেন। তাহলে আমরা যারা আজ কত শত বছর পরের সময়ে অবস্থান করছি তাদের হৃদয় জগতে কীরূপ আলোড়ন উঠবে যদি আমরা তাঁর কোনো একটি চুল মুবারক হাতে পাই এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পারি যে, এটি তাঁরই। কিংবা যদি পাই তাঁর ব্যবহৃত জুতার একটি ফিতা, অথবা তাঁর কর্তিত নখের কিছু টুকরা, অথবা যে পেয়ালায় তিনি পানি পান করেছেন তার একটি ভগ্নাংশ। কোনো ঐশ্বর্য্যশালী যদি তার বিপুল বিত্ত শুধু এই সম্পদ অর্জনের জন্য ব্যয় করে তাহলে কি তুমি তাকে অপচয়কারী বলবে কিংবা বলবে নির্বোধ? অসম্ভব। তাহলে তোমার সম্পদটুকু সেই মসজিদের যিয়ারতের জন্য ব্যয় কর। যার নির্মাণে তিনি শরীক হয়েছিলেন নিজ হাতে। তাঁর শহরে মুবারকে তাঁর হুজরার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তাঁকে সালাম করার জন্য, তার উহুদের দর্শন-সৌভাগ্য লাভের জন্য, যে উহুদকে তিনি ভালবাসতেন। তাঁর উপবেশনের স্থান, তাঁর সেই ‘জান্নাতের বাগানখানির’ সাহচর্য লাভের জন্য তোমার সম্পদ ব্যয় কর।
‘তুমি তো মুমিন হিসেবেই গণ্য হবে না, যদি এই সরতাজ তোমার কাছে তোমার আত্মা ও সত্ত্বা, তোমার সন্তান ও সম্পদ এবং অন্য সকল মানুষ থেকে প্রিয় না হয়ে থাকেন।’
‘সেই সম্মানিত পাথরে চুম্বন করে ধন্য হোন, যা অবতীর্ণ হয়েছে জান্নাত থেকে এবং আপনার ওষ্ঠদ্বয় সেই স্থানটির স্পর্শ লাভ করুক, যে স্থানটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ লাভ করেছে। আপনার সম্পদ মোবারক হোক। এ পথে ব্যয়িত হওয়ার চেয়ে আর তো কোনো গর্বের পথ নেই। ’
‘ছাবিত বুনানী রহ. যখন সাহাবী আনাস ইবনে মালিক রা.কে দেখতেন তখন তাঁর হস্ত মুবারক চুম্বন করতেন এবং বলতেন, ‘এই হাতটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাত স্পর্শ করেছে।’ আমাদের যখন এই সৌভাগ্য হয়নি তাহলে আমরা হাজরে আসওয়াদের ব্যাপারে ভাবতে পারি যে, এই সম্মানিত পাথর ভূমিতে আল্লাহর নিদর্শন, যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুম্বন করেছেন। যদি হজ্বের সৌভাগ্য আমার না হয় তবে যখন হাজ্বীগণ হজ্ব সমাপন শেষে ফিরে আসেন তখন তাঁদের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হোন এবং তাদের মুখে চুম্বন করুন। কেননা এই মুখতো সেই পাথরে চুম্বন করেছে যে পাথর আমার প্রিয়তমের স্পর্শ-সৌভাগ্যে ধন্য।” -সিয়ারু আলামীন নুবালা ১/৮৬
মাওলানা ইয়াহইয়া জাহাঙ্গীর সাহেব তাঁর বন্ধুর ইজাযত নিয়ে রোখসত হলেন এবং আমার প্রতি আদীব হুজুরের অনুগ্রহ হল। তিনি আমাকে তাঁর সহযাত্রী করলেন এবং বললেন, ‘আপনার সঙ্গে একান্ত একটু সময় কাটাই।’ তাঁর কথা শুনতে লাগলাম এবং প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আমিও নানা কথা জিজ্ঞেস করতে থাকলাম। আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া যে, কলম-কাগজ সঙ্গেই ছিল। তাঁর কথাগুলো নোট করতে লাগলাম। তাঁর এই অনুভব-অনুভূতিগুলো পাঠক যেহেতু তার নিকট থেকে শুনতেই পছন্দ করবেন তাই তাদেরকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে তার সফরনামাটি আসা পর্যন্ত। এর আশ্বাস তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন হজ্বের সফরে যাওয়ার আগেই।
তাই সেসব কথার পরিবর্তে আমি শুধু একটি কথাই পাঠকবৃন্দকে শোনাচ্ছি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, হজ্বের হিফাজতের ব্যাপারে কিছু বলুন। বেশ পীড়াপীড়ির পর তিনি তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে যে কথাটি মোযাকারা করেছেন তার সার সংক্ষেপ আমাকেও শোনালেন। তার মধ্যে একটি কথা এই ছিল যে, হজ্বের কার্যাদি সমাপ্ত হয়েছে কিন্তু হজ্ব শেষ হয়নি। যা বাকি থাকবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। মানুষ সারা জীবন নামায পড়লে নামাযী হয়। জীবনের প্রতি রমযানে রোযা রাখলে রোযার দায়িত্ব পালিত হয়। কিন্তু মানুষ যখন একবার হজ্ব করে তো গোটা জীবনের জন্য হজ্বের দায়িত্ব আদায় হয়। তাহলে এই এক হজ্ব তার গোটা জীবনব্যাপী পরিব্যপ্ত। এই হজ্বই তার গোটা জীবনের আমল। হজ্বের নির্ধারিত কার্যাবলি যদিও সেই নির্ধারিত স্থানগুলোতে সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু হজ্বের শিক্ষাগুলো অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার প্রেম ও দাসত্বের প্রেরণা, সতর্কতা ও পরহেযগারী, অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকা, গুনাহের কাজকর্ম ও ঝগড়া বিবাদ থেকে বেঁচে থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলো তো গোটা জীবনেই পরিব্যাপ্ত। এগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়ার কোশেশ করা হজ্বের সৌভাগ্য লাভকারীগণের অবশ্য কর্তব্য। বলা বাহুল্য, এই প্রচেষ্টার আত্ননিয়োগ করতে পারাই হল হজ্ব কবুল হওয়ার সবচেয়ে বড় আলামত এবং একথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, জান্নাতের ওয়াদা যে কোনো ধরনের হজ্বের উপরে নয়, মকবুল হজ্বের উপরই করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
الْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلَّا الْجَنَّةُ.
অতএব যে পায়ে বাইতুল্লাহর পানে চলেছি, যে হাতে বাইতুল্লাহ স্পর্শ করেছি এবং যে ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করেছি তা যেন আল্লাহ তাআলার মর্জি-বিরুদ্ধ কোনো কাজে ব্যবহৃত না হয়-এই প্রচেষ্টা অবশ্যই জারি রাখতে হবে। প্রিয়তম নবীর পাকভূমির যিয়ারত-সৌভাগ্য লাভ হল এবং তাঁকে সরাসরি সালাম জানানোও নসীব হল তো এবার তাঁর সুন্নত-বিরুদ্ধ কোনো কাজ যেন আমরা না করি।
সর্বশেষ কথা হল আমাদের প্রত্যেকের অবশ্যই এই মানসিকতা হওয়া উচিত যে, হজ্ব সারা জীবন সংরক্ষণ করব কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও হাজী উপাধীর প্রয়োজন যেন বোধ না করি। হযরত মাওলানা সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী রহ. যখন ১২৩৭ হিজরীতে তার বিশাল কাফেলা নিয়ে হজ্ব করলেন তখন আরাফার ময়দানে তাঁর একটি দুআ এই ছিল যে, ইলাহী, এই কাফেলার কেউ যেন হাজ্বী উপাধীতে প্রসিদ্ধ না হয়, যাদের আপনি নিজ অনুগ্রহে হজ্বের সৌভাগ্য দান করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর এই দুআ আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন। সেই হজ্বের পর বিশ বছরের কিছু অধিক সময় অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু সেই কাফেলার কেউ হাজ্বী উপাধীতে প্রসিদ্ধ হননি।
মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বলেছেন, ‘সম্ভবত সাইয়েদ ছাহেব রহ. অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এই দুআ এজন্য করেছিলেন যে, হজ্ব দ্বীনের একটি রুকন ও ফরয আমল। অন্যান্য ফরয আমল যথা নামায আদায়কারীকে যেমন নামাযী নামে, যাকাত আদায়কারীকে যাকাতী নামে এবং রোযা আদায়কারীকে সায়েম বা রোযাদার উপাধীতে প্রসিদ্ধ হতে হয় না, তখন হজ্বের ফরয আমল আদায়কারীকে হাজ্বী নামে কেন প্রসিদ্ধ হতে হবে? -সীরাতে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ ১/৩৬৭