Safar 1428   ||   March 2007

মওলুদখানী
হক্ব আদায়ের না-হক পন্থা
ইতিহাস ও বর্ণনার সঠিক পর্যালোচনা

Mawlana Muhammad Abdul Malek

রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৌলিক হক্বসমূহ

উম্মতের প্রতি আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক হক্ব রয়েছে, যথা-

ক. সবচেয়ে বড় হক্ব হল তাঁর প্রতি ঈমান আনা। এই হক্ব আদায়ের মাধ্যমে মানুষ তাঁর উম্মতের অন্তভুর্ক্ত হয়।

তাঁর প্রতি ঈমান আনতে হবে যেভাবে ঈমান আনতে কুরআনে আল্লাহ বলেছেন। যেমন তিনি আল্লাহর নবী এই বিশ্বাসের সঙ্গে এ কথাও বিশ্বাস করা যে, তিনি খাতামুন্নাবিয়ীন। তাঁর পরে আর কোনো নবী নেই। তাঁর পরে আর কোনো নবী আল্লাহ পাঠাবেন না। তাঁর পর  নবুওয়ত, রিসালাত ও ওহীর দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।

খ. তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবই হল হিদায়াতের সর্বশেষ কিতাব এবং তাঁর আনীত শরীয়তই হল সর্বশেষ শরীয়ত। এরপর না আসবে আর কোনো কিতাব, না আসবে নতুন কোনো শরীয়ত। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব এবং আসমানী শরীয়তগুলো অবিকৃতরূপে বিদ্যমানও নেই, আর সেগুলোর বিধিবিধান এখন আর অনুসরণীয়ও নয়। এখন হিদায়াত লাভের এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একমাত্র পথ হল কুরআনের প্রতি ঈমান আনা এবং শরীয়তে মুহাম্মাদীর অনুগত হওয়া।

গ. আল্লাহ তাআলা তাঁকে প্রেরণ করেছেন দাওয়াত, তাবলীগ, তালীম, তাযকিয়া ও জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব দিয়ে এবং তিনি তা পূর্ণরূপে পালনও করেছেন। সৃষ্টির কল্যাণকামিতার চেষ্টায় তিনি কোনো ত্রুটি করেননি। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাঁকে সান্তনা দিয়ে বলেছেন,

فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلٰۤی اٰثَارِهِمْ اِنْ لَّمْ یُؤْمِنُوْا بِهٰذَا الْحَدِیْثِ اَسَفًا.

তো এমন যেন না হয় যে, যদি তারা এই বক্তব্যে ঈমান না আনে তাহলে আপনি (মনের) কষ্টে তাদের পিছনে নিজের জান দিয়ে দিলেন। -সূরা কাহাফ ৬

ঘ. তিনি সম্পূর্ণ মাসুম ও নিষ্পাপ ছিলেন। এ জন্য আল্লাহ তাআলা উম্মতকে তাঁর শর্তহীন আনুগত্যের আদেশ করেছেন এবং তাঁর পবিত্র জীবনকে উম্মতের জন্য উত্তম আদর্শ সাব্যস্ত করেছেন।

ঙ. কুরআন-হাদীসে তাঁর যত গুণ ও বৈশিষ্ট্য এসেছে অন্তরের অন্তস্থল থেকে সেগুলো বিশ্বাস করা এবং স্বীকার করে নেওয়া। অন্যদিকে ওইসব অতিরঞ্জন ও সীমালংঘন থেকেও দূরে থাকা যা খৃস্টান জাতি ও অন্যান্য জাতি তাদের পূজনীয় ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে করেছে।

২. মোটকথা, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যথাযথভাবে ঈমান আনা হল তাঁর প্রথম হক্ব এবং তাঁর প্রতি যথাযোগ্য তাজীম ও মহব্বত পোষণ করা হল দ্বিতীয় হক। এই তাজীম ও মহব্বত ছাড়া তো কারো মুমিন হওয়াই প্রমাণিত হয় না। হাদীস শরীফে  এসেছে,

لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ، وَوَالِدَيْهِ، وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ.

তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হবে না যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা-মাতাসন্তান-সন্ততি ও অন্য সকল মানুষ থেকে প্রিয় না হব।

৩. তৃতীয় হক্ব হল জান-মাল কোরবান করে তাঁর নুসরত করা এবং শরীয়তে মুহাম্মাদীর প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা।

৪. চতুর্থ হক্ব হল জীবনের ভিতর-বাহির সকল ক্ষেত্রকে সুন্নতের ছাঁচে গড়ে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করা।

৫. পঞ্চম হক্ব হল তার পথভিন্ন কোনো নতুন বা পুরাতন পথ, যাকে পরিভাষায় বিদআত বলা হয় এবং যা বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন পর্যায়ের হয়ে থাকে, সেগুলোকে অন্তর থেকে ঘৃণা করা। বিশ্বাস ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রেই এগুলো থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকা এবং সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন বিদআত নির্মূল করে মানুষকে সু্ন্নতের অনুসারী বানাতে চেষ্টা করা।

৬. তাঁর পবিত্র জীবন, গুণ ও চরিত্র সম্পর্কে বেশি বেশি আলোচনা করা। অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, ওয়াজ-নসীহত, কথা ও কাজ তথা দ্বীন প্রচারের সকল  বৈধ পন্থায় এই বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে চর্চা করা।

৭. হাদীস শরীফ, যা সুন্নতের সবচেয়ে বড় উৎস, তার প্রচার ও প্রসার এবং তার পঠন-পাঠনের বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা। হাদীস শরীফ যথাযথ সংরক্ষিত আছে এবং তা দ্বীনের উৎস ও শরীয়তের দলীল, এ কথার বিশ্বাস রাখা।

৮. তাঁর প্রতি, তাঁর শরীয়ত ও সুন্নতের প্রতি, কিংবা শরীয়তের কোনো নিদর্শন বা সামান্য কোনো আদেশের প্রতিও কটাক্ষকারীকে অন্তর থেকে ঘৃণা করা এবং মুখে প্রতিবাদ করা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের ভণ্ড বক্তব্য খণ্ডন করা।

৯. তাঁর আহলে বাইত ও আসহাবের প্রতি ভক্তি, মহব্বত পোষণ করা। তাঁদের হক্বসমূহ আদায় করা এবং তাঁদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে, শরীয়ত তাদেরকে যে মাকাম দান করেছে তার প্রতি লক্ষ রাখা।

১০. তাঁর জন্য সর্বদা আল্লাহর দরবারে দুআ করা। কুরআন-হাদীসে এর যে পন্থা নির্দেশিত হয়েছে তা হল তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা এবং নিয়মিত ওযীফার মাধ্যমে মনোযোগ ও নিবিষ্টতার সঙ্গে দরূদ শরীফ পাঠ করা।

১১. তাঁর উম্মতের দরদে দরদী হওয়া এবং উম্মতের যাবতীয় হক্ব আদায় করা।

এগুলো হল উম্মতের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু মৌলিক হক্ব। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবগুলোই ফরযে আইন। কিছু হক্ব রয়েছে যা শুধু বিজ্ঞ আলেমগণের দায়িত্ব। এগুলো ফরযে কিফায়ার অন্তভুর্ক্ত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাবতীয় হক্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন হওয়া এবং  অব্যাহত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাঁর উম্মতকে এসম্পর্কে সচেতন করা যাতে তারা নবীর হক্ব আদায়ে আগ্রহী ও তৎপর হয় -এটাও আমাদের দায়িত্ব।

সীরাতের দুটি অংশ এবং সীরাত-চর্চার কয়েকটি পন্থা

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতে পাকের দুটি অংশ রয়েছে। এক. জন্ম থেকে নবুওয়ত লাভের পূর্ব পর্যন্ত। দুই. নবুওয়ত লাভ থেকে রাব্বুল আলামীনের সঙ্গে মিলিত হওয়া পর্যন্ত। সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিরোনামটি ব্যাপক অর্থবোধক। নবী-জীবনের উভয় অংশই এই শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিরোনামটি অর্থের দিক থেকে সংকুচিত ও খণ্ডিত। কেননা, তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অংশ, যাকে কুরআনে কারীম উম্মতের জন্য উসওয়াতুন হাসানা বলেছে, তা এই শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত হয় না।

নবীজির সীরাতের প্রথম অংশের অনেক ঘটনা, হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থে রয়েছে।  আর সীরাতের দ্বিতীয় অংশ, যা শরীয়তের ভিত্তি ও সুন্নতের উৎস এবং প্রত্যেক মুমিনের জন্য উসওয়াতুন হাসানা, তার সম্পূর্ণ বিবরণ হাদীস ও সীরাতগ্রন্থে সুসংরক্ষিত রয়েছে এবং সেগুলোর সনদ এমনই সহীহ, নির্ভরযোগ্য ও সন্দেহাতীত যে, মনে হয় যেন সমগ্র নবী-জীবন তার  সকল সৌন্দয্যর্ ও পবিত্রতা নিয়ে আমাদের সামনে জীবন্ত।

নিঃসন্দেহে এটা ইসলামের এক অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এবং মুসলিম উম্মাহর অত্যুচ্চ সৌভাগ্য যে, তাদের নিকট তাদের প্রিয়তম নবীর পবিত্র জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র  ও বিবরণ অবিকল বিদ্যমান রয়েছে। অথচ পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি ও ধর্মের হাদী ও রাহবারের তেমন কোনো জীবনবৃত্তান্ত সংরক্ষিত নেই।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাতের চর্চার বিভিন্ন পন্থা রয়েছে।

এক. নিজের জীবন ও কর্ম, কথা ও কাজ, চরিত্র ও আচরণ, মোটকথা, জীবনের প্রতিটি অংশকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শে গড়ে তোলা এবং চিন্তা ও অনুভূতিকে তাঁর সুন্নতের আলোকে আলোকিত করা।

দুই. তাঁর শিক্ষা ও তাঁর সুন্নতের পঠন-পাঠন ও প্রচার-প্রসারের প্রতি মনোযোগী হওয়া। এর একটি ধারা হল কুরআন ও হাদীসের শিক্ষাকে সমাজে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা এবং দ্বীনী গ্রন্থাদির শিক্ষাদানের ব্যবস্থা অবলম্বন করা, যেগুলো কুরআন সুন্নাহর আদেশ-নিষেধ, বিধিবিধান ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে রচিত ও সংকলিত হয়েছে। আর দ্বিতীয় ধারা হল, দাওয়াত-তাবলীগ, ওয়াজ-নসীহত এবং এ জাতীয় অন্যান্য পন্থায় এগুলোকে ব্যাপকতর করার চেষ্টা করা।

তিন. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং জীবন ও চরিত্র অধিক পরিমাণে আলোচনা করা। তা হতে পারে ব্যক্তি পর্যায়ে, ঘরোয়া পর্যায়ে এবং সামজিক পর্যায়ে। মোটকথা, নিজের ও অন্যের অন্তরে তাঁকে সমুজ্জ্বল করে তোলার জন্য তাঁর আলোচনার বারংবার পুনরাবৃত্তি জরুরি।

সীরাতচর্চার এই সবগুলো পন্থাই অনুসরণীয়। সালাফে সালেহীন-সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবেতাবেয়ীন, আইম্মায়ে হুদা এবং পরবর্তী যুগের আকাবির ও  মাশাইখ সবাই উপরোক্ত সকল পন্থা অবলম্বন করেছেন। এজন্য তাঁদের প্রতিটি মজলিস ও মাহফিল ছিল কোনো না কোনো পর্বে নবী জীবনের চরিত্রের নূরানী আলোচনায় নূরান্বিত।  এবং তাঁদের প্রতিটি আচরণ ও উচ্চারণ ছিল সীরাতের জ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।

সময়ের বিবর্তন ও সীরাত চর্চার নবরূপ

নবী-যুগ থেকে সময়ের দূরত্ব যতই দীর্ঘ হতে লাগল এবং ঈমানী দুর্বলতা বেড়ে যেতে লাগল, সীরাতের আলোচনা, সীরাতের শিক্ষাদান এবং সীরাতকে জীবনাদর্শরূপে গ্রহণের প্রেরণা ততই শিথিল হতে লাগল। এমনকি নবী আলাইহিস সালামের হক্বসমূহের মধ্যে যে দুটি বিষয় সবচেয়ে আসান ছিল অর্থাৎ সীরাতচর্চা ও দরূদ পাঠ-এই দুটি বিষয়েও আনুষ্ঠানিকতা এসে স্থান দখল করল। মীলাদ পড়া ও পড়ানোকে দরূদ শরীফের বিকল্প ধরে নেওয়া হল, আর তাও হতে লাগল কোনো না কোনো দুনিয়াবী গরজে এবং বিশেষ বিশেষ দিন ও অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। তদ্রƒপ প্রচলিত জলসাজুলুস, যার নাম দেওয়া হয়েছে ঈদে মীলাদুন্নবী, তাকেই সীরাত আলোচনার স্থলবর্তী করা হল। একটু হিম্মতওয়ালা যারা, তারা এই মাহফিলকে শুধু ১২ রবিউল আউয়ালে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রায় মাসের শেষ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করল। কেউ আরও আগে বেড়ে বছরের অন্য কোনো মাসেও সীরাতুন্নবী-নামে সভা-সেমিনার কিংবা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। মোটামুটি এই হল প্রচলিত মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবীর হালহাকীকত। এভাবে দরূদ পাঠ ও সীরাত চর্চার বিষয়টি নিছক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ মুহূর্তে এ পদ্ধতিটির সমস্যা ও প্রচলিত মীলাদুন্নবীর প্রতিকারের  উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, শুধু এটুকু বলাই উদ্দেশ্য যে, নবীর জন্মদিবসের নামে অনুষ্ঠান করা নবীর সুন্নত নয়; বরং সুন্নতের বিরুদ্ধাচারণ যা খৃস্টানদের ক্রিসমাস ডে-এর অনুকরণে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে।

এটা শুরু হয়েছে সপ্তম শতাব্দীতে। প্রচলিত মীলাদের সমর্থকরাও স্বীকার করে যে, ইরবিল অঞ্চলের শাসক আবু সাঈদ মুযাফফারুদ্দীন (৫৪৯-৬৩০ হি.) হচ্ছে মীলাদের প্রবর্তক। এ জন্যই হুঁশ-জ্ঞান আছে এমন ব্যক্তিমাত্রই মীলাদের পক্ষে  লিখতে গিয়ে প্রথমেই এটি বিদআত হওয়া স্বীকার করে নেয়। এরপর একে বিদআতে হাসানা বলে জান বাঁচানোর চেষ্টা করে। মোটকথা বিষয়টি বিদআত ও নব উদ্ভাবিত হওয়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই।

মীলাদের প্রচলনকালে এর সমর্থকরা এমন একটি কথা চালু করেছিল যার দ্বারা এর হাকীকত একদম স্পষ্ট হয়ে যায়। কথাটি হল, যখন ক্রশধারীগণ অর্থাৎ খৃস্টান জাতি তাদের নবীর জন্ম-রজনীকে বড় ঈদ সাব্যস্ত করেছে তখন মুসলিম জাতি তো তাদের নবীর সম্মানের অধিক হক্বদার-আততিবরুল মাসবুক, সাখাভী পৃ. ১৪; আননিমাতুল কুবরা (মাখতুত)

হিন্দুস্তানের মশহুর মৌলভী আব্দুছ ছামী রামপুরী আনওয়ারে ছাতিআ নামক কেতাবের ১৭০ নং পৃষ্ঠায় স্বীকার করেছেন যে, ভারত উপমহাদেশে খৃষ্টান ইংরেজরাই ১২ই রবীউল আউয়ালকে মীলাদুন্নবী নির্ধারণ করেছিল এবং ওই দিনে তারা ছুটি ঘোষণা করেছিল।

মীলাদ অনুষ্ঠানের ইতিহাস প্রসঙ্গে উপরোক্ত দুটি স্বীকারোক্তির পর এ বিষয়ে আর কী বলার থাকে? তবু জেনে রাখা দরকার যে, মীলাদ পন্থীদের সমর্থিত অনুষ্ঠানের আদিরূপ ছিল এই-

১. মীলাদের তারিখে একস্থানে সমবেত হওয়া

২. কুরআনে কারীম থেকে তেলাওয়াত করা

৩. বিশুদ্ধ বর্ণনার ভিত্তিতে নবীর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করা

৪. তবারক ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা। -আলহাভী লিলফাতাওয়া; সুয়ূতী ১/২৫১

বলাবাহুল্য যে, এখানে প্রথমটিকে বাদ দিলে, অন্য তিনটাতে আপত্তির কিছু ছিল না, কিন্তুু বর্তমানে তা বাড়াবাড়ির এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যা চক্ষুষ্মান সকলেই দেখতে পাচ্ছেন। এ অবস্থায় এটি অবশ্য বর্জনীয় হওয়ার ব্যাপারে মীলাদ প্রেমিকদের পক্ষেও দ্বিমত প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

কিছু ভিত্তিহীন ও জাল বর্ণনা

আলোচনা অন্যদিকে চলে গেল। মীলাদ ও তার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে সপ্তম হিজরীর উদ্ভাবন, কিন্তু আমাদের সমাজের পরিভাষায় যাকে মীলাদ পড়া বা মীলাদ পড়ানো বলা হয় এবং যা কোনো মকসুদ হাসিলের জন্য বা খায়ের-বরকত লাভের জন্য কিংবা কোনো সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিংবা মৃত ব্যক্তির ঈসালে ছওয়াবের জন্য বিভিন্ন সময়ে এবং বিশেষ ফযীলতের দিনে-রাতে হয়ে থাকে তা আরও পরের প্রচলন। মীলাদের সঙ্গে পড়া শব্দটির সংযুক্তি থেকেও তা বোঝা যায়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মবৃত্তান্ত তো বলার বিষয়, পড়ার বিষয় নয়। তবে এমন হতে পারে যে, এ বিষয়ের উপর কোনো কিতাব থেকে কেউ  পড়বে আর অন্যরা শুনবে। মীলাদের শৈশবে এমন প্রচলনও কোথাও ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এটাকেও মুশকিল মনে করার কারণে কতিপয় বে-ইলম মৌলভী কিছু মীলাদনামা তৈরি করল, যা লোকেরা মুখস্থ আওড়াতো এবং আগে পিছে সালাত-সালাম এবং আয়াত-কালাম যোগ করে নিতো। এর নাম হল মওলুদখানী বা মীলাদ পড়া। আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলে

وَلَمَّا تَمَّ مِنْ حَمْلِهِ صلى الله عليه وسلم شَهْرَانِ...

-এই মীলাদনামাটি প্রচলিত রয়েছে। এটি বা এ জাতীয় আরও যেসব মীলাদনামা মওলুদখানীর মজলিসগুলোতে পড়া হয় এগুলো হাদীস ও সীরাতের কিতাবাদি তো দূরের কথা, খাইরুল কুরূনও বহুদূর, পরবর্তী শত বছরেও এসবের নাম নিশানাও ছিল না।

এই ইতিহাসটি স্মরণ রাখুন এরপর দিল্লুর রহমানের মাসিক আলবাইয়িনাত যার উদ্দেশ্যই হল হককে বাতিল এবং বাতিলকে হক্ব সাজানো তার জুন ২০০০ ইং সংখ্যায় প্রকাশিত এই প্রলাপগুলো লা হাওলাসহযোগে পড়ন।

১. আবু বকর সিদ্দীক রা. বলেন, যে ব্যক্তি মওলুদখানীর জন্য একটি দিরহাম খরচ করবে সে জান্নাতে আমার  সঙ্গী হবে।

২. উসমান রা. বলেন, যে ব্যক্তি মওলুদখানীর জন্য একটি দিরহাম খরচ করবে সে যেন বদর ও হুনাইন যুদ্ধে অংশ নিল!

৩. হাসান বসরী রহ. বলেন, হায়! আমার যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত, তাহলে আমি তা মওলুদখানীর জন্য খরচ করতাম?

৪. ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি মওলুদখানীর জন্য তার বন্ধুবর্গকে একত্র করে, খাবারের আয়োজন করে, একটি স্থান শূন্য রাখে, ইহসানের সঙ্গে আমল করে এবং এই মওলুদখানীর ব্যবস্থা করে, তাকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন সিদ্দীকীন, শুহাদা ও ছালেহীনদের সঙ্গে হাশর করাবেন এবং তাকে জান্নাতুন নায়ীমে অবস্থান করাবেন।

৫. জালালুদ্দীন সুয়ূতী তার রচিত আলওয়াসাইল ফী শরহিশ শামাইল গ্রন্থে লিখেন, যে গৃহ, মসজিদ বা মহল্লায় মওলুদখানী হয় সেই গৃহ, মসজিদ ও মহল্লাকে ফেরেশতাগণ ঘিরে ফেলে এবং তাদের জন্য দু্আ করে, আর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মাফ করে দেন। আর যারা নূর দ্বারা পরিবেষ্টিত অর্থাৎ জিব্রাইল মীকাইল, ইসরাফীল ও আজরাইল, তাঁরা ওইসব মওলুদখানীর ব্যবস্থাকারীদের জন্য দুআ করতে থাকেন।

এগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন বর্ণনা। যাদের নামে এগুলো চালানো  হয়েছে তাদের সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।

এগুলোর ভিত্তিহীনতা তো একেবারেই স্পষ্ট। কারণ যদি এগুলোর কোনো ভিত্তি থাকত, তাহলে তো মীলাদকে পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত বিদআত বলে স্বীকার করার  প্রয়োজন হত না। বরং সহজেই মীলাদকে সাহাবাদের আমল বলে প্রমাণ করা যেত। আসলে মওলুদখানীর প্রচলনের আরও অনেক পরে কোনো বে-ইলম ব্যক্তি এগুলোকে ঘরে বসে তৈরি করেছে।

রাজারবাগীরা এই জাল বর্ণনাগুলোর সমর্থনে আননিমাতুল কুবরা আলাল আলম-এর উদ্ধৃতি দিয়েছে। অথচ তাতে এগুলোর চিহ্নমাত্র নেই। এই কিতাবটির মাখতুতাহ (পাণ্ডুলিপি) দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যা কায়রোতে (ইতিহাস ২৫০৮/১৯২১) সংরক্ষিত রয়েছে এবং আমাদের কাছে তার ফটোকপি রয়েছে। আমরা তা আদ্যোপান্ত পড়েছি।

এর বিপরীতে আন্নিমাতুল কুবরা কিতাবে ইবনে হাজার মক্কী রহ. মীলাদ কে ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর অনেক পরের  উদ্ভাবিত বিষয় বলেছেন এবং মীলাদের তথাকথিত বর্ণনাগুলো খণ্ডন করে বলেছেন যে, মানুষকে এগুলো থেকে দূরে রাখা ওয়াজিব। -আননিমাতুল কুবরা ২-৩ (পাণ্ডুলিপি)

রাজারবাগীরা মানুষকে ধোকা দেওয়ার জন্য একটি নকল আননিমাতুল কুবরার হাওলা দিয়েছে, যা ইস্তাম্বুলের মাকতাবাতুল হাকীকাহ, (দারুশ শাফকাহ ফাতিহ, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক)-এর ছাপা। তুরস্কের এই প্রকাশনীটি কট্টর  বিদআতপন্থীদের। এরা বিভিন্ন প্রচলিত শিরক ও বিদআতের সমর্থনে কিতাবপত্র প্রকাশ করে থাকে। এমনকি কখনো কখনো কোনো বিদআতপন্থী লেখকের বাজে কিতাব হাজির করে কিতাবের বা লেখকের নাম পরিবর্তন করে পূর্ববর্তী কোনো সর্বজনস্বীকৃত আলিমের নামে চালিয়ে দেয়। এরপর কিতাবটির এমন একটি নাম নির্বাচন করে, যে নামে উক্ত মনীষীর কোনো কিতাব ছিল, কিন্তু বর্তমানে তা মুদ্রিত নেই। এখানেও মাকতাবাতুল হাকীকাহ ওয়ালারা এ কারসাজিই করেছে। ইবনে  হাজার মক্কী রাহ.-এর নাম ও তাঁর কিতাব আননিমাতুল কুবরার নাম এমন একটি কিতাবের উপর লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যা কোনো বে-দ্বীন ও নির্বোধ বিদআতীর রচনা, যার কিছুটা বুদ্ধি খরচ করে জাল বর্ণনা তৈরি করারও যোগ্যতা নেই। যাতে কিছু সময়ের জন্য হলেও, কিংবা কিছু মানুষের কাছে হলেও তা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। বেচারা তো এতই সফেদ মিথ্যা বলে যে শোনামাত্র ধরা পড়ে যায়। সে এটুকু চিন্তা করেনি যে, আট-নয়শ বছর পরের উদ্ভাবিত মওলুদখানীর ফযীলত যদি হযরত আবু বকর রা. ও উসমান রা.-এর নামে চালানো হয় তবে কে তা বিশ্বাস করবে? তদ্রƒপ হাসান বসরী (২১-১১১ হি.) ও ইমাম শাফেয়ী রহ. (১৫০-২০৪ হি.) -এর নামে এমন প্রলাপ চালু করা হলে  তা কি বাজারে চলবে? তদ্রƒপ বেচারা এটাও চিন্তা করেনি যে, জালালুদ্দীন সুয়ূতী তো আমাদের নিকটবর্তী সময়ের।  তাঁর নামে কোনো বানোয়াট কি গোপন থাকবে? অথচ বেচারা সেটাই করেছে এবং সুয়ূতী রহ.-এর নামে এমন কিতাব জুড়ে দিয়েছে যে নামে তার কোনো রচনাই নেই! সুয়ূতী রহ. নিজে তাঁর রচনাবলীর তালিকা লিখে গেছেন এবং তার পরের আলেমগণও তাঁর রচনাগুলো গণনা করেছেন, যা মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু  আলওয়াসাইল ফী শরহিশ শামাইল নামে তাতে কিছু নেই।

দেখুন ড. আব্দুল হালীম চিশতী কৃত তাযকিরায়ে জালালুদ্দীন সুয়ূতী ১১৭-৩৮০

তদুপরি সুয়ূতী রহ. নিজে তার কিতাব আলহাভী ১/২৫১-২৫২ তে মীলাদ অনুষ্ঠানকে নব উদ্ভাবিত বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাহলে তিনি কীভাবে এর উক্ত ফযীলত বয়ান করতে পারেন?

ওই লোকটি যেমন মিথ্যাচারে বুদ্ধি খরচ করেনি তেমনি ইস্তাম্বুলের মাকতাবাতুল হাকীকাহর লোকেরাও এই মিথ্যুকের কিতাবে ইবনে হাজার মক্কী এর কিতাব আননিমাতুল কুবরার নাম ব্যবহারের প্রতারণাটিও কুশলীভাবে করতে পারেনি। তাদের ভাবা উচিত ছিল যে, ইবনে হাজার মক্কী (মৃত্যু ৯৭৪ হি.) একজন প্রসিদ্ধ আলেম এবং  তার কিতাব আননিমাতুল কুবরাও একটি প্রসিদ্ধ রচনা, যার পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন গ্রন্থাগারে বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং সেসব পাণ্ডুলিপির সাথে এই প্রকাশিত কিতাবটি মিলিয়ে দেখলেই তাদের প্রতারণা ফাঁস হয়ে যাবে; বরং বিজ্ঞ আলেমগণ এই কিতাব পড়ামাত্রই বলে দিবেন যে, তা ইবনে হাজার মক্কী রহ.-এর রচনা হতেই পারে না। একে তার নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র।

রাজারবাগীরা যদি এই সব ইতিহাস জানা সত্ত্বেও সাধারণ মুসলিম জনগণকে ধেঁাকা দেওয়ার জন্য এই সকল জাল ও ভিত্তিহীন বর্ণনার  উপর আননিমাতুল কুবরার উদ্ধৃতি ব্যবহার করে থাকে তাহলে এটি হবে তাদের পক্ষ থেকে অন্যকে বিপথগামী করার  একটি নতুন দৃষ্টান্ত। অবশ্য এমন নজির তাদের আরও আছে। আর যদি অজ্ঞতাবশত তারা এরূপ করে থাকে -এই সম্ভাবনা অবশ্য খুবই ক্ষীণ, তাহলে বাস্তব বিষয়টি জানার পর এখন তাদের তওবা করা উচিত এবং সাধারণ মানুষকে প্রকৃত বিষয়ে অবগত করার জন্য সংশোধনী প্রকাশ করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা তাদের হিদায়াত দান করুন। আমীন।

 

advertisement