আযীম মুরব্বি হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রাহ.
[জন্ম : ১৩৬৭ হি.-মৃত্যু : ১৪৪২হি.]
[হযরত মাওলানা কাসেমী রাহ. আক্ষরিক অর্থেই ‘মুআল্লিম’ ও শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্নেহধন্য শাগরিদ মাওলানা আবু সাবের আব্দুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে হযরত রাহ.-এর শিক্ষক জীবনের ইতিবৃত্ত ও অনুস্মরণীয় বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।
যদিও তালেবানে ইলম ও উলামায়ে কেরামই এ থেকে বেশি উপকৃত হবেন; কিন্তু সাধারণ পাঠকদের জন্যও এতে শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। বিশেষ করে তারা বুঝতে পারবেন- কওমী মাদরাসার আকাবির উস্তাযগণ কেমন হন এবং উম্মতের প্রতি তাঁদের এহসান ও অবদান কেমন হয়।
আলকাউসারের পাঠকদের উদ্দেশে এ বরকতময় তোহফা পেশ করার জন্য আল্লাহ তাআলা হযরত মাওলানা আবু সাবের আব্দুল্লাহ ছাহেবকে উত্তম বিনিময় দান করুন- আমীন।
-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক]
হযরাতুল উস্তায মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রাহ. আমাদের জন্য এক আলোকবর্তিকা, আঁধারে আলোর মিনার। এখান থেকে আমরা অনেক আলো গ্রহণ এবং হেদায়েত অর্জন করতে পারি। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الْبَرَكَةُ مَعَ أَكَابِرِكُمْ.
আকাবিরের সোহবতে রয়েছে বরকত। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ২১০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৫৯
হাদীসটি জাওয়ামিউল কালিম-এর অন্তর্ভুক্ত। এতে অল্প কথায় অনেক বড় মূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে। আকাবিরের সাথে দ্বীন ও ইলমের নেসবত কেমন হওয়া চাই এবং আকাবির থেকে আসাগির কী কী হাসিল করতে পারে- তার সবই বলে দেওয়া হয়েছে।
তো আকাবিরের সোহবতে বরকত- এর কী অর্থ? কীসের বরকত? ইলমের বরকত, আমলের বরকত, আখলাকের বরকত। আকাবিরের সোহবত থেকে ইলম আমল আখলাক ও তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীন হাসিল হয়। গোটা দ্বীনের সমঝ ও বসীরত হাসিল হয়। শুধু কিতাব পড়ে, ব্যক্তিগত অধ্যয়ন মুতালাআ দ্বারা ইলমের সিহ্হত আসে না। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنَّمَا الْعِلْمُ بِالتَّعَلُّمِ.
ছাত্র হয়ে উস্তাযের কাছে শেখার মাধ্যমে প্রকৃত ইলম হাসিল হয়। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৯২৯; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ২৬৬৩; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১০২৫৪
এর কারণ, উস্তায-শাগরিদের নিরবচ্ছিন্ন প্রজন্ম পরম্পরায় যুক্ত হলেই প্রকৃত ইলম আসে। তেমনি উস্তাযের বলার আন্দায এবং দেহভঙ্গিও মুরাদ-মাফহুম বোঝার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাঁর দিলের কাইফিয়াত থেকে দ্বীনের রুচি-প্রকৃতি আঁচ করা যায়। শায়ের বলেন-
گر مصور صورت آں دل کشاں خواہد کشید/لیک حیرانم کہ نازش را چناں خواہد کشید
চিত্রশিল্পী হয়তো সুন্দর একটি ছবি এঁকে দিতে পারবে- এটুকুই/কিন্তু প্রিয়তমের মনোভঙ্গি রাগ-অনুরাগ সে কীভাবে অংকন করবে!
আলহামদু লিল্লাহ, হযরত নূর হোসাইন কাসেমী রাহ.-এর কিছু সোহবত আমরা পেয়েছি। আজকের এই পরিসরে তালীম-তরবিয়ত সংক্রান্ত তাঁর কিছু স্মৃতি ও নসীহত তুলে ধরছি।
বাজী! নেসাব দাওরায়ে হাদীস নয়, নেসাব তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীন
কথাটি হযরত কাসেমী রাহ. বলতেন, বারবার বলতেন। এই কথা কত ওযনদার ও ওয়াকারপূর্ণ, ছাত্রজীবনের সেই কালে ততটা বুঝিনি। দীর্ঘ দিন যাওয়ার পর, যখন কিছু মুতালাআ হয়েছে, বয়স হয়েছে, এখন এই কথার ওযন খানিকটা বুঝে আসে। হুজুরের কাছে তাফসীরে জালালাইন পড়েছি। তখন তিনি নিম্নোক্ত আয়াত প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাজী! নেসাব দাওরায়ে হাদীস নয়, নেসাব তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীন।’ আয়াত এই-
فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآىِٕفَةٌ لِّیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ .
দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পড়া হয়, এটা একটা নেজামমাত্র। এখন তাখাসসুসও পড়ানো হয়। কোনোটাই আসল নেসাব না। দ্বীনের নেসাব হল তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীন। কী জিনিস তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীন? দ্বীনের বসীরত, দ্বীনী ফিকিরের জামেইয়্যাত, দ্বীনের কখন কী তাকাযা, কখন কী মোতালাবা, এই মুহূর্তে দ্বীন আমার কাছে কী চায়, দ্বীনী শো‘বা ও মাসায়েলগুলোর মাঝে ফরকে মারাতিব কী, ফরযে ফরযেও ফরকে মারাতিব আছে, হারামে হারামেও আছে, এটা বুঝার নাম তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীন। আমল, তাকওয়া, ফিকরে আখেরাত ও তাআল্লুক মাআল্লাহ হল তাফাক্কুহের আলামত। তো তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীনের যে নেসাব, তা হাসিল হয় আকাবিরের সোহবতের মাধ্যমে।
আমাদের উস্তাযে মুহতারাম, শফীক মুরব্বি, আযীম রাহবার, হযরত নূর হোসাইন কাসেমী রাহ.-এর অন্যতম ছিফাত ছিল ‘তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীন’। তিনি দ্বীনের উমূমী সমঝ রাখতেন, বুঝতেন-
দ্বীনের কখন কী তাকাযা। শুনেছি, মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা. বলেছেন, এ দেশের মুরব্বিগণের মাঝে দ্বীনের ‘উমূমী সমঝের’ অন্যতম উদাহরণ হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রাহ.।
কাসেমী ছাহেব রাহ. আকাবিরের অনেক ছিফাতের হামেল ছিলেন। যুহদ, কানাআত, এস্তেগনা, তাওয়াক্কুল, শোকর, সবর ও এ‘তেদাল ইত্যাদি গুণের অধিকারী ছিলেন। বদগুমানী-বদযবানী ও গীবত-শেকায়েত থেকে মুক্ত ছিলেন। আকাবিরে দেওবন্দের প্রতি আযমত-মহব্বত, রহমদিলী ও মেহমানদারীতে সুখ্যাত ছিলেন। নিছক একজন দরবেশ মুদাররিস হয়েও এইসকল গুণাবলির বরকতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান করেছেন। নজিরবিহীন ত্যাগ ও কুরবানীর ইতিহাস রচনা করেছেন। এদেশের উলামা-তলাবার মাহবূব ও আস্থাভাজন মুরব্বি হিসেবে বরিত হয়েছেন। এসকল গুণই তাঁকে জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করে এবং সর্বস্তরের দ্বীনদার মানুষের মাঝে তাঁকে শ্রদ্ধেয় করে তোলে। তাঁর জানাযা এর বড় সাক্ষী।
আদর্শ শিক্ষক দরবেশ মুদাররিস
তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। তিনি বুঝতেন- কোন্ ছাত্রকে কীভাবে শিক্ষা দিতে হবে। তিনি দরদ নিয়ে ছাত্র গড়ার ফিকির করতেন। ফলে তাঁর কড়া শাসনও সবাই মেনে নিতো। হুজুর বলতেন-
ہر كہ ايك جا ہر جا ہر كہ ہر جا ہيچ جا
অর্থাৎ যে এক জায়গায় জমে দ্বীনের এক বিভাগে একনিষ্ঠভাবে নিজেকে গঠন করবে, সে অনেক জায়গায় অবদান রাখতে পারবে। আর যে জীবন গড়ার মুহূর্তে, আত্মপ্রস্তুতি ও আত্মনির্মাণের সময় সব জায়গায় ছোটাছুটি করে, পরিণামে সে কোনো ক্ষেত্রে যথাযথ অবদান রাখার উপযুক্ত হয় না।
হুযূরের ভেতর এর বাস্তবতা দেখা যায়। হুযূর এক জায়গায় প্রথমে নিজেকে শিক্ষক হিসেবে গড়েছেন। বলা যায়, এটা হুজুরের প্রথম এবং প্রধান পরিচয়। এই ময়দানে দীর্ঘ দিন অবিরাম কাজ করেছেন। যার কারণে হুযূর নিজেকে যেমন গড়েছেন তেমনি এক ঝাঁক কর্মবীর যোগ্য আলেম তৈরি করেছেন। যারা দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে সুনামের সাথে কাজ করছে। এটা সম্ভব হয়েছে একনিষ্ঠ মেহনতের কারণে, ছাত্রদের প্রতি দরদ-ব্যথার কারণে।
ছাত্রগড়ার কারিগর : দরদ ও শফকত
হুযূরকে ছাত্রগড়ার কারিগর বলা হয়। কী মূলমন্ত্র ছিল তাঁর কাছে, যার দ্বারা তিনি কারিগরি করতেন? নবীজীকে আল্লাহ তাআলা বলছেন-
وَ لَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِیْظَ الْقَلْبِ لَا نْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَ اسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَ شَاوِرْهُمْ فِی الْاَمْرِ فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَی اللهِ اِنَّ اللهَ یُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِیْنَ.
তুমি যদি রুক্ষ মেযাজের হতে, কঠিন হৃদয়ের হতে, তবে তারা ভেগে যেত।...
হুযূর বলতেন, ‘এই আয়াতে উস্তায ও মুরব্বির কিছু ছিফাত বয়ান করা হয়েছে।’ বাস্তবে হুযূরের ভেতর এই গুণগুলো ছিল। এর ছোঁয়া দিয়ে তিনি ছাত্রদের গড়ে তুলতেন।
ছাত্র গড়ার জন্য দরদ-মায়া, ¯েœহ-ভালবাসা, ক্ষমা ও বিচক্ষণতা জরুরি। শাসনও একপর্যায়ে কাজে লাগে। ছাত্রের দিল দেমাগ মন মেযাজ পরিবর্তন করে মূলত উস্তাযের দরদ ও শফকত। দরদ-সোহাগযুক্ত ফিকির যদি উস্তাযের ভেতর থাকে, তবে ঐ ফিকির ছাত্র গড়বে। আল্লাহ তাআলা উস্তাযের দিলে নতুন নতুন কৌশল ‘এলকা’ করবেন, অমনযোগী ও হতাশ ছাত্র কীভাবে লেখাপড়ামুখী হবে, কীভাবে দিশা পাবে, তার অন্তরে আলো জ্বলবে, এর ফর্মুলাগুলো আস্তে আস্তে উস্তাযের আয়ত্বে আসবে। হুজুর এই দরদ আর শফকত দিয়ে অমনযোগী ছাত্রকে মনোযোগী করেছেন, দিশেহারাকে দিশা দিয়েছেন, হতাশাগ্রস্তকে আশাবাদী করেছেন। এর উদাহরণ অনেক।
তালেবে ইলমের প্রতি নসীহত
ইলমের তলব, তড়প আর ক্ষুধা-পিপাসা যার মাঝে আছে, তাকে বলে তালেবে ইলম। উস্তায, কিতাব, মাদরাসা আর ইলমই হবে তার কাছে সবচে প্রিয়। আমাদের কওমী মাদরাসায় প্রাণভোমরার মতো একটি শে‘র একসময় গুঞ্জরণ তুলতো-
ہمیں دنیا سے کیا مطلب مدرسہ ہے وطن اپناظمرينگے ہم کتابوں پر ورق ہوگا کفن اپنا
আমরা এই শে‘রগুলো যেমন ভুলে যাচ্ছি, তেমনি এর মর্মবাণীও -আল্লাহর পানাহ- আমাদের পরিবেশ থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে। কওমী মাদরাসার এই রূহানিয়াত ধরে রাখা অপরিহার্য। এর জন্য পেরেশান থাকতেন হযরত কাসেমী রাহ.। তিনি বড় দরদ নিয়ে উস্তায-ছাত্রদেরকে বিভিন্ন নসীহত করতেন। বলতেন-
বাজী! এনহেমাক ছাড়া ইলমী মাকাম তয় করা যায় না
‘পরীক্ষার সময় পনের-বিশ দিনের এনহেমাক ও একাগ্রতার ফলে প্রায় সারা বছরের পড়া আয়ত্বে এসে যায়। এই এনহেমাক যদি পুরো বছর ধরে রাখা যায়, তাহলে তোমার ইলমি জীবন কেমন উচ্চতায় পৌঁছবে?’ এনহেমাক পয়দা করার তরীকা হল-
১. সালাফের ইলমী যিন্দেগী পাঠের মাধ্যমে ইলমের আযমত ও মহব্বত দিলে বসানো এবং ক্ষুধা-পিপাসা তৈরি করা।
২. খালওয়াত এবং একসূঈ অবলম্বন করা, ইলম-বহির্ভূত শোগল থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
৩. যামানার আহলে ইলম ও আহলে ফযল বুযুর্গদের সোহবত এখতিয়ার করা।
৪. যথাসম্ভব মাদরাসার পরিবেশে অবস্থান করা।
৫. পঞ্চইন্দ্রীয়কে গুনাহ থেকে হেফাজত করা।
৬. এখতেলাত, বন্ধুত্ব চর্চা, আড্ডাবাজি ও বহিঃর্মুখিতা বর্জন করা।
খোকা! উস্তাযের তাকরীরের উপর এক্তেফা করো না
‘শুধু উস্তাযের তাকরীরের উপর এক্তেফা করবে না। উস্তায মুতালাআ করেছেন উস্তাযের ফায়দা হবে। তোমার এস্তেদাদ ও যোগ্যতা হবে না। হয়তো পরীক্ষায় ভালো করবে, কিন্তু তোমার বসীরত হবে না। তাই উস্তাযের তাকরীরের আলোকে তুমি নিজেও মা’খাজ (মূল উৎসগ্রন্থ) মুতালাআ করো। দেখবে তোমার অন্যরকম একটা বুঝ তৈরি হবে। ঐ বুঝ ও মাসআলা আবার সাজাও, উস্তাযকে দেখাও।’
হুযূরের কাছে আমি জালালাইন আউয়াল, শরহে আকায়েদ, তিরমিযী ও শামায়েল পড়েছি। নিচের দিকের বুনিয়াদি কোনো কিতাব পড়ার সুযোগ হয়নি। হুযূর আমাদেরকে তাঁর তাকরীরের মা’খাজ বলে দিতেন এবং ঐ জায়গাগুলো মুতালাআ করেছি কি না তারও মুহাসাবা করতেন। উস্তাযের তাকরীরের আলোকে মা’খাজ ও মাসাদির মুতালাআ করে সারসংক্ষেপ সাজিয়ে লিখতে বলতেন। তখন মালিবাগ মাদরাসায় কিতাব ছিল না। এখন তো ছাপা কিতাবের ক্ষেত্রে বিপ্লবই হয়ে গেছে! আরও বিপ্লব অপেক্ষা করছে। অনেকে মনে করে, এখন ইলম বাড়ছে। আসলে এখন ‘আসবাবে ইলম’ বাড়ছে কিন্তু ‘মূল ইলম’ কমছে, সমঝ-ফাহম কমছে। আগে ইলম বেশি ছিল, আসবাবে ইলম কম ছিল। ইলম তো বক্ষে থাকে।
إنما العلم في صدور الرجال
কিতাবে থাকে নুকুশ। ঐ নুকুশ থেকে ইলম বক্ষে ধারণকারী ব্যক্তি কমে গেছে।
বেটা! সহীহ ফিকির ও তরবিয়ত হাসিল করো
হুজুর রাহ. এবিষয়ে যারপরনাই তাকিদ করতেন। সালাফে সালেহীন ও আকাবিরে দেওবন্দের তারিখ-সাওয়ানেহ পাঠের উপর জোর দিতেন। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ. এবং আকাবিরে দেওবন্দের মাসলাক-মাশরাব ও ফিকির সম্পর্কে দরসে ও দরসের বাইরে প্রচুর আলোচনা করতেন। আমলি তরবিয়তের জন্য কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত, সুন্নতের উপর আমল, নামাযের এহতেমাম এবং আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণের নির্দেশ দিতেন।
উস্তাযদের প্রতি নসীহত : ছাত্রের মেধা থেকে কাজ নেওয়া
‘বাজী! ছাত্রের মেধা থেকে কাজ নেন। যত কাজ নেবেন মেধা তত বিকশিত হবে।’ কাজ নেয়ার অর্থ-
ক. সামনের সবক মুতালাআ করানো। ছাত্র নিজে নিজে ইবারত সহীহ করে পড়বে, তারকীব বোঝার চেষ্টা করবে, ইসমে ইশারা ও জমীরের মারজে ঠিক করবে। তরজমা ও মতলব বোঝার চেষ্টা করবে।
খ. দরসে উস্তায ছাত্রকে দিয়ে ইবারত পড়াবেন, সীগা ধরবেন, তারকীব জিজ্ঞেস করবেন।
গ. মাঝে মাঝে বিভিন্ন বাক্যের তরজমা ও মতলব জিজ্ঞেস করবেন।
ঘ. নিচের দিকের কিতাবে প্রচুর অনুশীলন করাবেন। নাহু-সরফের এজরা করাবেন।
ঙ. বাংলা থেকে আরবী আর আরবী থেকে বাংলা করাবেন। ইনশা এবং রচনা লেখাবেন।
চ. ছাত্রকে দিয়ে মা’খাজ মুতালাআ করিয়ে খোলাসা লেখাবেন।
ছ. হাদীস, মাসায়েল ও বিভিন্ন মূল ইবারতের তাখরীজ করাবেন।
হযরত থানবী রাহ-এর একটি রেসালা ছাত্র জীবনে পড়েছি, ‘নাছিহুত তালাবা’। সেখানে থানবী রাহ. বলেছেন, কোনো তালেবে ইলম যদি তিন কাজ করে, তবে নিশ্চিত তার এস্তে‘দাদ হবে। আমাদের হুজুরও এটা বলতেন এবং ছাত্রদের কাছ থেকে ঐ তিন কাজ আদায় করে ছাড়তেন।
প্রথম কাজ : সামনের সবক মুতালাআ করে হাজির হওয়া। এর অর্থ, নিজে নিজে এবারত সহীহ করে পড়ার চেষ্টা করা। নিজে নিজে তরজমা তোলার চেষ্টা করা। শব্দের অর্থ না জানলে আরবী লোগাত দেখা। নিজে নিজে মতলব বোঝার চেষ্টা করা। না বুঝলে আরবী হাশিয়া দেখা। কমপক্ষে এতটুকু মুতালাআ করে সবকে আসা, যাতে মালুম আর মাজহুলের মাঝে কিছুটা তমিয হয়ে যায়।
দ্বিতীয় কাজ : দরসে নিয়মিত হাজির থেকে উস্তাযের তাকরীর মনোযোগ দিয়ে শোনা। মুতালাআ না করে দরসে বসলে একেবারে মাজহুল জিনিস কানে আসবে। এতে সবক বুঝতে সমস্যা হবে। মুতালাআ করে আসলে দ্রুত সবক বুঝে আসবে, এস্তে‘দাদ গঠন হবে। উস্তাযের তাকরীরের সাথে ছাত্রের বুঝ যদি মিলে যায় অহংকার নয়, আল্লাহর শোকর আদায় করা।
তৃতীয় কাজ : সাথীদের নিয়ে তাকরার ও মোযাকারা করা। এখন মাদরাসাগুলোতে তাকরার আছে, তবে মোযাকারা নেই বললে চলে। এই তিন কাজ করলে কিতাব আয়নার মতো হয়ে যাবে, বসীরত আসবে। ইলম বসীরতের নাম, পরিষ্কার বোঝার নাম। এই তিন কাজ করলে ছাত্র বনবে। আরেকটি কাজ নফল, প্রতিদিন পিছনের কিছু সবক মুতালাআ করা।
হুজুর আপবীতী পড়ার কথা বারবার বলতেন। শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.-এর পিতা হযরত ইয়াহয়া কান্দলবী যখন হযরত রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রাহ.-এর খানকায় থাকতেন, ইলিয়াস রাহ.-ও সেখানে ছিলেন। খানকাহের এক পাশে পাটিতে বসে ইলিয়াস রাহ. মুরাকাবার হালতে থাকতেন, চোখ বন্ধ করে রাখতেন। এ অবস্থায় যাকারিয়া রাহ. কারীমা পড়তেন চাচার কাছে। ফার্সি এবারত সঠিকভাবে পড়া, তরজমা করা এবং মতলব বয়ান করা ছাত্র যাকারিয়ার দায়িত্বে। সঠিক হলে উস্তায ইলিয়াস রাহ. শুধু হুঁ বলতেন আর ভুল বললে উঁহুঁ। দ্বিতীয়বার ভুল বললে কিতাব বন্ধ করে দিতেন। কাসেমী ছাহেব হুজুর বলতেন, এভাবে নাহবেমীর থেকে কাফিয়া-শরহেজামী পর্যন্ত পড়ানো উচিত। যেখানে উস্তাযের কাজ হবে হুঁ আর উহুঁ, বাকি কাজ ছাত্রের। কিন্তু এখন উল্টো, সব কাজ উস্তাযের, ছাত্রের কাজ শুধু শোনা। ফলে ছাত্রের এস্তে‘দাদ গঠন হচ্ছে না।
ছাত্রকে কাজ দিয়ে দেওয়া
হাতের লেখা সুন্দর ও দ্রুত করার কাজ দেওয়া, ভাষা ও বানান শুদ্ধ করা। রচনা লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করা, আকাবিরের জীবনী পড়তে দেওয়া। কাজগুলো কতটুকু হল না হল নিয়মিত খবর নেওয়া। দরসী কিতাবের সহযোগী এবং ইযাফী মুতালাআ কতটুকু কী হল হিসাব নেওয়া। ছুটি ও বিরতির দিনগুলোর জন্য ইলমী, আমলী, দাওয়াতী ও খেদমতে খালক-মূলক কাজ দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
ছাত্রদেরকে কিতাবমুখী রাখা
হুজুর শেষ যিন্দেগীতে রাজনীতি করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় অনেক কাজ করেছেন। একসময় হুজুর ছাত্রদেরকে সম্পূর্ণ কিতাবমুখী থাকতে আদেশ করতেন। তখন বলতেন, ‘বাজী! বরফ খাও। মাথা গরম করো না, ঠাণ্ডা রাখো।’ কিন্তু শেষ যিন্দেগীতে হুজুর ‘সাংগঠনিক পদায়নসহ ছাত্ররাজনীতির’ পক্ষে গিয়েছেন। এটা ইজতিহাদী বিষয়। আদব রক্ষা করে যদি কেউ এর সাথে এখতেলাফ করে তবে তা মাসলাকে আকাবিরে দেওবন্দের খেলাফ হবে না।
হুজুর ভাবতেন, ‘তানজীমী সিয়াসতের’ সাথে দ্বীনের হেফাজত, ই‘লা ও বুলন্দির সম্পর্ক রয়েছে। তালেবে ইলমরা এটা ভুলতে বসেছে, ফারেগ হওয়ার পরও মানে-পরিমাণে উল্লেখযোগ্য লোক দ্বীনী খেদমতের এই ময়দানে আসছে না। তাই চাচ্ছিলেন, ছাত্রজীবন থেকেই এ বিষয়ে ছাত্রদেরকে সজাগ-সচেতন করতে। তবে তিনি কড়া দৃষ্টি রাখতেন, ‘সাংগঠনিক রাজনীতির’ কারণে তার ইলমী জীবন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। হযরত থানবী রাহ. তো একে سم قاتل (প্রাণ সংহারক বিষ) বলতেন। হযরত মাদানী রাহ. ‘ইলমী সিয়াসত’ পর্যন্ত অনুমোদন করতেন। এখনও দেশের অধিকাংশ আলেম এমনটাই মনে করেন। সরাসরি ময়দানের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া থেকে মাদরাসা ও তালিবে ইলম এবং তালীম ও তরবিয়তের ভিত্তি যেসকল উস্তায, তাদের সবাইকে মুক্ত রাখা জরুরি মনে করেন।
আযাদী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা
হুযূর বলতেন, নিয়মিত দরস দান, সবক উসুল করা এবং ইযাফী কাজ দেওয়া হলে অত বিধিনিষেধ লাগে না। অতিরিক্ত বিধিনিষেধ না দিয়ে ছাত্রকে কাজে ব্যস্ত রাখার মূলনীতি অনুসরণ করা দরকার। কারণ অতিবিধি মেধার বিকাশ ব্যাহত করে।
উস্তায গড়ার ফিকির
মুহতামিম ও মাদরাসা কর্তৃপক্ষের জন্য শুধু ছাত্র গড়ার ফিকিরই নয়, যোগ্য উস্তায ও আলেম গড়ার ফিকিরও থাকা একান্ত প্রয়োজন। যাতে একজন উস্তায যোগ্য মুদাররিস, মুফাক্কির, মুনাযির ও মুসান্নিফ হিসেবে গড়ে ওঠেন। হুজুর এমন ফিকির সবসময় করতেন। হুজুর আমাদেরকে বারিধারা মাদরাসার শুরুর দিকে বলতেন-
মতন থেকে মাসআলা হল্ করবেন
উস্তায-ছাত্র সকলকে বলতেন, ‘বাজী! মতন থেকে মাসআলা হল্ করবেন।’ এর নিয়ম হল :
ক. কিতাবের মতন প্রথমে অন্তত তিনবার গভীরভাবে মুতালাআ করা।
খ. মতনের মাঝে নিহিত মাসআলা এবং প্রচ্ছন্ন বক্তব্য উদ্ধারের চেষ্টা করা।
গ. মতনের ভেতর অস্পষ্টতা থাকলে কিতাবের ভিন্ন নুসখা এবং কদীম থেকে কদীম মাসাদের থেকে যাচাই করা।
ঘ. মতনের সাথে পরিচিতির পর আরবী হাশিয়া ও শরাহ মুতালাআ করা।
ঙ. আরবীভীতি বা অলসতার কারণে উর্দু-বাংলার উপর এক্তেফা না করা।
দরসে বমি করবেন না
ক. মতন থেকে সরাসরি ধরিয়ে না দিয়ে কোনোমতে মাসআলাটা বুঝিয়ে দেওয়া।
খ. মুতালাআর পর যাচাই বাছাই না করে ছাত্রের উপযোগী-অনুপযোগী সব বলে দেওয়া।
গ. ছাত্রের বুঝ-সমঝের প্রতি লক্ষ্য না রেখে তাকরীর করা- এসব বমি করার শামিল, এমনটা করবেন না।
চোখ খুলে মুতালাআর পর চোখ বন্ধ করেও মুতালাআ করবেন!
সবকে যাওয়ার আগে মুতালাআর খোলাসা তরতীব দেওয়া, উপস্থাপন কৌশল সম্পর্কে ফিকির করা, পুরো আলোচনা গুছিয়ে নেওয়া। এটা হল চোখ বন্ধ করে মুতালাআ। এটা না করলে সফল মুদাররিস হওয়া যায় না, ছাত্ররা এস্তেফাদা করতে পারে না।
লকীর কে ফকীর মত্ বনো
নিজের দেমাগ না খাটিয়ে অন্যের উপর এতেমাদে কুল্লি করা। কারো বক্তব্য যাচাই বাছাই না করে অন্ধভাবে চলা, অন্ধভাবে নকল করা। উপযোগী-অনুপযোগী বিচার করতে না পারা। এ হলো ‘লকীর কা ফকীর’- এমন হবেন না। বুকে বল নিয়ে দরসে আলোচনা করবেন, ভাসা ভাসা কথা বলবেন না।
আহলে ফন ও আহলে ইলম হওয়ার ফিকির
হুজুর বলতেন, ‘সবক মুতালাআ’ ও ‘কিতাব মুতালাআ’র সাথে সাথে ‘ফন মুতালাআ’র প্রতিও সচেষ্ট থাকবেন।
যওক অনুসারে একেক উস্তায একেক ফনের মুতালাআ ও তাসনীফের কাজে লেগে যাবেন। আহলে মাদরাসা সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করবেন এবং কিতাব তাকসিমের সময় এ দিকটির প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। ফন্নি মুতালাআ না থাকলে ইলমী জীবন অগ্রসর হয় না, ইহকাকে হক ও ইবতালে বাতিলের কাজ যথাযথভাবে করা যায় না।
উলামায়ে কেরামের প্রতি নসীহত
ক. তাফরীক বাইনাল আকাবির না করা
হুজুর রাহ. সকল আকাবিরের প্রতি মহব্বত ও আযমত পোষণ করতেন। কারো সম্পর্কে বিরূপ আলোচনা বরদাশত করতেন না। একজনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে অন্যজনের তানকীস সহ্য করতেন না। হুজুর শায়েখ যাকারিয়া রাহ.-এর কিতাব ‘আলইতিদাল ফী মারাতিবির রিজাল’ পড়তে বলতেন।
খ. ‘ইমসাক বি মারূফ তাসরীহ বি ইহসান’
فَاِمْسَاكٌۢ بِمَعْرُوْفٍ اَوْ تَسْرِیْحٌۢ بِاِحْسَانٍ.
-এর কুরআনী নীতি অনুসরণ করা।
সম্পর্ক ধরে রাখলে উত্তমভাবে রাখা, বিচ্ছেদ করলেও ভদ্রভাবে করা। বিচ্ছেদ যেন শত্রুতায় না গড়ায়। কুরআন মাজীদে এই নীতি আলোচিত হয়েছে দাম্পত্যের সম্পর্ক-বিচ্ছেদ বিষয়ে। কিন্তু এই নীতি সকল সম্পর্ক ও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। উস্তায নিয়োগ-বিয়োগসহ সকল ক্ষেত্রে এই নীতি ধারণ করা একান্ত কর্তব্য। মালিবাগ মাদরাসায় জালালাইনের দরসে হুজুর আমাদেরকে এই নসীহত করেছেন।
‘তাকসীমে কার’-এর নীতি অবলম্বন
হুযূর আপন উস্তায শাইখুল আদব হযরত মাওলানা ওয়াহীদুয যামান কীরানবী রাহ.-এর বরাতে বলতেন, ‘তাকসীমে কার হো তাকসীমে ফিকির না হো।’ দ্বীনের ভিন্ন ভিন্ন শাখায় একেকজন কাজ করবেন, কিন্তু সকল শাখার ব্যক্তিগণ পরস্পরে এক ফিকিরের হবেন, সময় সুযোগ মতো একে-অপরকে সহযোগিতা ও সমর্থন যুগিয়ে যাবেন। কেউ নিজের কাজের ফযীলত এমনভাবে বয়ান করবেন না যে, অন্য কাজ বেহুদা সাব্যস্ত হয়।
ভবন নয় ছাত্র-শিক্ষকের নাম মাদরাসা
বর্তমানে যেখানে বারিধারা মাদরাসার মসজিদ, মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকালে সেখানে ছিল ছোট্ট একটি দেয়ালবিহীন মসজিদ, একচালা টিনের ছাপড়া। সবগুলো টিন গাঁথা-বাঁধা ছিল না। শুধু রোদ-বৃষ্টিতে কোনোরকম আড়াল হওয়া যেত। জোরে বাতাস এলে টিন উড়ে যেত। বাকি জায়গায় ছিল কাদা পানির অগভীর ডোবা। হুজুর ১৯৮৮ সনের রমযানের কয়েক দিন পূর্বে বললেন, বাজী! এখানে দাওরায়ে হাদীস মাদরাসা হবে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম! হতভম্ব হয়ে গেলাম। মালিবাগ ছেড়ে এখানে? হুযূর বললেন, তুমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসো। রমযানে একসাথে থাকব।
মসজিদের একপাশে আমি বেফাকের খাতা দেখি। হুযূর দিনভর মাদরাসার ফিকিরে বাইরে বাইরে থাকতেন। তারাবীর পর কখনো কখনো হযরত মাওলনা আবদুল মান্নান ছাহেব ফুলবাড়িয়া, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া রাহ., মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন ছাহেব প্রমুখ হুজুরের সাখে দেখা করতে আসতেন। মালিবাগ থেকে কিছু ছাত্রও এল। এভাবে বিরানভূমি একটু একটু করে আবাদ হতে শুরু করল।
শাওয়ালের প্রথমার্ধ নাগাদ একটি তিন রুমের একচালা ঘর উঠল। যতদূর মনে পড়ে, পঞ্চাশ ফিট লম্বা, পনের ফিট প্রস্থ। দমকা বাতাসের সময় ছাত্ররা টিনের চালটা যেন উড়ে না যায়, এজন্য রসি বেঁধে ঝুলে-বসে রাত পার করে দিত। প্রথম বছর মক্তব হেফজখানা ছিল না। দেড়শ’র মতো ছাত্র ভর্তি হল। জায়গা হত না, কিতাব ছিল না, খাবারের ব্যবস্থা হত না। কিন্তু আজব ব্যাপার- মাদরাসা ছিল। ছিল ভালো মাপের উস্তায, মেধাবী মেহনতি ছাত্রও।
প্রায়ই দুপুরের ডাল-ভাত হতে হতে বিকাল চারটা বেজে যেত। রাতের কোনো ব্যবস্থা নেই। কখনো শুধু গরম ভাত কাঁচা মরিচ। তখন মাতবাখে নাশতার এন্তেজামও ছিল না। হাতে-পকেটে কানা কড়িও নেই, দরসের সময় হয়ে গেছে। রাতের আধাপঁচা ডাল খেয়ে দরসে যাওয়া। এমন হয়েছে বহু দিন। হুজুরও তাই করতেন।
১৯৯৭ সনে এই কষ্টের মাদরাসা যখন বেদখল হয়ে গেল তখন তো রাস্তায় রাস্তায় তিন শ ছাত্র-শিক্ষক খেয়ে না খেয়ে হুজুরের সাথে সাথে! বিস্ময়ের ব্যাপার- মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, কিন্তু পুরো মাদরাসা আছে! চলতা-ফেরতা মাদরাসা। তখন বুঝলাম, সালাফের যামানায় ভবনের নাম মাদরাসা ছিল না, ছাত্র-শিক্ষকের নাম ছিল মাদরাসা। হুজুরের মুখেই আমরা প্রথম শুনেছি- ‘ছাত্র-শিক্ষকের নাম মাদরাসা!’ হুযূর যেখানে গিয়েছেন ছাত্র তাঁর সাথে গিয়েছে। কিছু নেই আবার সবই আছে। কয়েক মাস পর সকল ছাত্রশিক্ষক ডেরা ফেলল ধউরে। সুবহানিয়ার গাছতলায় চলতে লাগল মাদরাসা!
ঐ সময়ের কষ্টবেদনা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। হুযূর মনে কতটা আঘাত পেয়েছেন কখনো তা প্রকাশ করেননি। এমন অবস্থায়ও হুজুরকে কোনোদিন কারো বিরুদ্ধে শেকায়েত করতে শুনিনি। আল্লাহ তাআলার ফয়সালার প্রতি রাজী ছিলেন, সবর-তাহাম্মুলের পাহাড় ছিলেন।
স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ
হুজুরের ভেতর অভাব-অনটন আর দরিদ্রতার কারণে কোনো আক্ষেপ আফসোস ছিল না; বরং তৃপ্তি ছিল, কানাআত ছিল। দারিদ্র্যকে হুজুর ভয় পেতেন না। হুজুর স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ করেছেন, সানন্দে গ্রহণ করেছেন। দ্বীনী কাজে সময় বাড়ানোর জন্য রোযগারের কাজে একটুও সময় দিতে কখনো রাজী হননি।
আল্লাহ তাআলা হুজুরকে জান্নাতুল ফিরদাউসের আ‘লা মাকাম নসীব করুন। হুজুরের জীবন থেকে আমাদেরকে আলো গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
-আবু সাবের আবদুল্লাহ
মালিবাগ, ঢাকা
১৩-৪-১৪৪৪ হি.
১০-১১-২০২২ ঈ.