দরূদ ও সালাম : গুরুত্ব, ফযীলত ও আমল
দরূদের কিছু মাছূর শব্দ-বাক্য
[বেরাদারে আযীয মাওলানা সাঈদ আহমদ বিন গিয়াসুদ্দীনের প্রবন্ধটি পড়ে অধম নিজে উপকৃত হয়েছি। অন্তরে বেশি থেকে বেশি দরূদ শরীফ পাঠের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এই প্রবন্ধসহ তার সমস্ত ইলমী কাজে ভরপুর বরকত দান করুন।
এই প্রবন্ধে প্রায় সব হাদীসই ‘সহীহ’ বা ‘হাসান’। এক-দুইটি বর্ণনা এমন, যেগুলোর সনদে সামান্য দুর্বলতা আছে, যা আমলযোগ্য ও বর্ণনাযোগ্য হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক নয়।
মাওলানা সাঈদ আহমদ (যীদা মাজদুহুম) মাশাআল্লাহ সব হাদীসই হাওয়ালাসহ লিখেছেন। যেসব কিতাবের হাওয়ালা দেখেই বোঝা যায় যে, এই কিতাব থেকে উদ্ধৃত হাদীসটি ‘সহীহ’ বা ‘হাসান’, সেসব কিতাবের কোনো হাদীস উল্লেখ করার পর আলাদাভাবে তার হুকুম বা সনদগত মান বর্ণনা করা হয়নি। আর যেসব কিতাবের হাওয়ালা দেখে এমনটা বোঝা যায় না সেসব কিতাবের হাওয়ালায় কোনো হাদীস উদ্ধৃত হলে সেখানে ‘সহীহ’ শব্দ লিখে দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হল, পারিভাষিকভাবে হাদীসটি সহীহ বা হাসান পর্যায়ের। ওরফে ‘সহীহ’ শব্দটি উভয় প্রকারের হাদীসকেই বোঝায়।
যে দুয়েকটি রেওয়ায়েতের সনদে সামান্য দুর্বলতা আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে লেখা হয়েছে ‘সালিহ লিলআমাল’। অর্থাৎ এই রেওয়ায়েতটি আমলযোগ্য ও বর্ণনাযোগ্য।
এই প্রবন্ধের পরবর্তী কিস্তিতেও হাদীস ও আসারের সনদগত মান এভাবেই উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা এই প্রবন্ধসহ সকল ইলমী খেদমত দ্বারা পাঠকবর্গের ও আমাদের উপকৃত করুন- আমীন। -বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক]
আল্লাহ তাআলা আপন কালামে পাকে তাঁর সর্বাধিক প্রিয় বান্দা ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হুযুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু মহান গুণাবলি এভাবে বর্ণনা করেছেন-
لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ عَزِیْزٌ عَلَیْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِیْصٌ عَلَیْكُمْ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ.
নিশ্চয় তোমাদের নিকট তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল আগমন করেছেন। যাঁর কাছে তোমাদের কষ্ট অসহনীয়, যিনি তোমাদের (কল্যাণের) জন্য ব্যাকুল। এবং তিনি মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত দয়াপরবশ ও পরম মেহেরবান। -সূরা তাওবা (৯) : ১২৮
যে দয়ালু রাসূল-এর ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আপন মহামর্যাদাবান কালামে উক্ত সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তিনি যে (গোটা উম্মতের প্রতি সাধারণভাবে এবং) মুমিনদের প্রতি বিশেষভাবে কতটা দয়াপরবশ- তা তো বলাই বাহুল্য। যাঁকে স্বয়ং ‘রাহমান-রাহীম’ প্রভু অভিষিক্ত করেছেন رَحِیْمٌ তথা পরম দয়ালু বলে, তাঁর দয়া-মায়ার কি কোনো সীমা-পরিসীমা আছে? অক্ষম শব্দ-বাক্যে কি তাঁর মায়া-মমতার পূর্ণ বর্ণনা দেয়া সম্ভব?! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
ব্যস্ সংক্ষিপ্ত কথা এই যে, মহান আল্লাহ তাআলার পরে আমাদের প্রতি যাঁর ইহসান ও অনুগ্রহ এবং মায়া ও মমতা সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন আমাদের পরম প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! বিষয়টা যতটা না বর্ণনা করার, তার চেয়ে বেশি অনুভব করার বিষয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের দান করুন সেই অনুভব-অনুভূতিপূর্ণ মুমিনের দিল।
আমরা এ দুনিয়ায় যা কিছু প্রকৃত খায়ের ও কল্যাণ লাভ করেছি, তা প্রিয় নবীজীর মাধ্যমেই পেয়েছি। আর পরকালীন জীবনেও যদি কোনো কল্যাণ ও সফলতা অর্জিত হয়, নিশ্চয় তা তাঁর বরকতেই লাভ হবে। অতএব সংক্ষেপে শুধু বলি- ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’!
حَرِیْصٌ عَلَیْكُمْ-‘তিনি তোমাদের (কল্যাণের) জন্য অতি ব্যাকুল’। আহ! গোটা উম্মতের জন্য এবং উম্মত যেন সকল কল্যাণ লাভ করে নেয় আর যাবতীয় অকল্যাণ থেকে মুক্তি পেয়ে যায়- এর জন্য ব্যাকুলতাই ছিল প্রিয় নবীজীর অন্যতম প্রধান পরিচয় ও নিদর্শন। শুধু মনের ব্যাকুলতাই নয়। এর জন্য তিনি নিজের সর্বস্ব অকাতরে বিলিয়ে গেছেন মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত! অতঃপর উম্মতের জন্য এই ব্যাকুলতা নিয়েই এবং মানবজাতির জন্য প্রকৃত কল্যাণ ও মহামুক্তির ‘মিরাস’ বণ্টন করতে করতেই এই দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন- ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’!
যখন আমাদের প্রতি নবীজীর ইহসান ও অনুগ্রহ (মহান আল্লাহর পরে) সর্বাপেক্ষা বেশি, সুতরাং আমাদের উপর তাঁর হকও সর্বাধিক। আল্লাহ তাআলা নবীজীর হকসমূহ আদায় করার তাওফীক আমাদের দান করুন। তাঁর প্রতি যথাযথভাবে ঈমান আনা, পরিপূর্ণ ভক্তি-ভালবাসা পোষণ করা, তাঁর সুন্নাহ ও উত্তম আদর্শের পূর্ণ অনুসরণ করা, তাঁর জীবনী ও সীরাতের সঠিক চর্চা করা, তাঁর সুন্নাতের প্রতিষ্ঠা ও প্রচার-প্রসারে সাধ্যানুযায়ী অংশগ্রহণ করা- এসব তাঁর বড় বড় হক। এ ছাড়াও আমাদের উপর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটি হক হল- তাঁর প্রতি অধিক পরিমাণে সালাত ও সালাম প্রেরণ করা, দরূদ শরীফ পাঠ করা।
দরূদ শরীফের স্বরূপ, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য
এ বিষয়ে সংক্ষেপে চমৎকার আলোচনা করেছেন বিখ্যাত মনীষী, প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও আলিমে রব্বানী হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নুমানী রাহ.। হযরতের ভাষায়-
‘সালাত ও সালাম’ তথা দরূদ শরীফ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার দরবারে এক মহিমান্বিত ও বরকতময় দুআ-প্রার্থনা, যার দ্বারা আল্লাহর বান্দা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি স্বীয় মহব্বত-ভালবাসার নযরানা পেশ করে এবং পেশ করে নবীজীর প্রতি স্বীয় বিশ^স্ততা ও ওয়াফাদারির প্রমাণ। আর এর আদেশ করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে এবং আদেশও করেছেন বড় শান্দার ও হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে!
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اِنَّ اللهَ وَمَلٰٓىِٕكَتَهٗ یُصَلُّوْنَ عَلَی النَّبِیِّ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا صَلُّوْا عَلَیْهِ وَسَلِّمُوْا تَسْلِیْمًا.
আয়াতে মুমিনদের আদেশ করা হয়েছে নবীজীর প্রতি সালাত ও সালাম প্রেরণ করতে। এটিই আয়াতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। কিন্তু এর সর্বোচ্চ গুরুত্ব বোঝানোর জন্য আল্লাহ তাআলা কথাটি এভাবে বলেছেন- স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর প্রতি ‘সালাত’ প্রেরণ করে থাকেন। অতএব ওহে মুমিনরা! তোমরাও এই মোবারক ও মহিমান্বিত আমলে শরীক হও এবং নবীর প্রতি সালাত প্রেরণ কর এবং প্রেরণ কর অধিক পরিমাণে সালাম!
আর কোনো ক্ষেত্রেই এমন বলা হয়নি যে, আল্লাহ নিজে অমুক আমলটি করেন, অতএব তোমরাও তা কর। একমাত্র সালাত ও সালামের আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে এই অসাধারণ ভঙ্গিমা অবলম্বন করা হয়েছে। (যদিও আল্লাহর সালাত প্রেরণ, ফিরিশতাগণের সালাত প্রেরণ আর আমাদের সালাত প্রেরণ- এসবের প্রত্যেকটির রয়েছে স্বতন্ত্র অর্থ-মর্ম-স্বরূপ এবং ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। তাফসীরের কিতাবাদিতে আয়াতটির তাফসীর দ্রষ্টব্য)।
যাহোক, কুরআনুল কারীমের এই আয়াত থেকেই স্পষ্ট, নবীজীর প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ করা ও দরূদ শরীফ পাঠ করা মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ ও পছন্দনীয় আমল!
প্রত্যেক ইবাদত এবং যিকির ও দুআর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং আছে বিশেষ ফায়দা ও উপকারিতা, খায়ের ও বরকত। দরূদ শরীফের বৈশিষ্ট্য এবং এর বিশেষ উপকারিতা এই যে, দিলের গভীর থেকে অধিক পরিমাণে দরূদ পড়ার দ্বারা একইসাথে লাভ হয় আল্লাহ তাআলার খাস রহমত, বিশেষ করুণা-দৃষ্টি ও মেহেরবানী এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহানী নৈকট্য, গভীর সম্পর্ক ও তাঁর অত্যধিক মায়া-মমতা! দরূদ শরীফ পাঠ করে অধম বান্দা হয়ে যায় মহামহিম আল্লাহ তাআলা ও তাঁর মহামর্যাদাবান আখেরি নবী- উভয়ের মাহবূব ও প্রিয়! দুনিয়া-আখেরাতে বান্দার এর চেয়ে বেশি আর কী চাই?!
পূর্বে বলা হয়েছে, সালাত ও সালাম হচ্ছে এক মহিমান্বিত দুআ। বিভিন্ন হাদীস থেকে পরিষ্কার জানা যায়, এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সদা-সর্বদা অবহিত করা হতে থাকে অর্থাৎ একদল ফিরিশতার মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, অমুক অমুক ব্যক্তি তাঁর জন্য এত এত দরূদ শরীফ পাঠ করেছে!
এখন একটু ভাবুন, আপনি যদি কারো ব্যাপারে জানতে পারে, সে আপনার জন্য এবং আপনার পরিবারবর্গের জন্য খুব দুআ করে। সে নিজের জন্য আল্লাহর কাছে যতটা দুআ করে, তার চেয়ে অধিক দুআ করে আপনার কল্যাণের জন্য এবং এটাই তার পছন্দনীয় আমল! আপনি যদি কারো ব্যাপারে এমনটি জানতে পারেন, তাহলে তার প্রতি আপনি কতটাই না আনন্দিত ও খুশি হবেন! তার প্রতি আপনার দিলে কেমন মহব্বতই না পয়দা হবে! তাকে আপনি কতটাই না ভালবেসে ফেলবেন! অতঃপর কখনো যদি তার সাথে আপনার সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটে, তবে তার সাথে আপনার আচরণ কেমন হৃদ্যতাপূর্ণ হবে! আপনি তার প্রতি কত কত ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রকাশ করবেন। এখান থেকেই বুঝে নিন, যে ব্যক্তি নবীজীর জন্য বেশি বেশি দুআ করে অর্থাৎ তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম প্রেরণ করে এবং দরূদ শরীফ পাঠ করে- সে তাঁর কেমন মহব্বত লাভ করবে এবং কিয়ামত ও আখেরাতে নবীজীর কতটা মায়া-মমতা, দয়া-করুণা ও নৈকট্য লাভে সে ধন্য হবে! আল্লাহ মেহেরবান আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন! (মাআরিফুল হাদীস, খ. ৫, পৃ. ৩৫৩-৩৫৭ [উর্দূ] থেকে গৃহীত)
সালাত ও সালামের ফযীলত, গুরুত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু হাদীস
হাদীসের কিতাবসমূহে এ সম্পর্কে রয়েছে হাদীসের এক বিশাল ভাণ্ডার। স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু বহু হাদীস শরীফে দরূদের ফযীলত, মাহাত্ম্য ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন। যাতে আমরা এই বরকতময় আমলের দ্বারা নিজেদের নেকী ও সৌভাগ্যের পাল্লা ভারী করতে পারি। যুগে-যুগে আলেম ও মুহাদ্দিসগণ এসব হাদীস সংকলন করেছেন। কেউ কেউ তো স্বীয় হাদীস-সংকলনের একটি অধ্যায় বা পরিচ্ছেদে এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত করেছেন। অনেক ইমাম ও মুহাদ্দিস এর জন্য ছোট বা বড় কলেবরের স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন। সেই দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দী (হিজরী) থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল যুগে এই ধারা অব্যাহত থেকেছে এবং এখন পর্যন্ত জারি আছে দরূদ শরীফ সংক্রান্ত হাদীস-আছার সংকলনের মোবারক ধারা।
উপরের আলোচনা থেকে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে যে, হাদীসের ভাণ্ডারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কত বিপুল পরিমাণ হাদীস রয়েছে। বস্তুত এখানে ওইসকল হাদীসের ক্ষুদ্র অংশও বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আমরা এখানে শুধু তিনটি বিষয়ে কয়েকটি হাদীস (বা হাদীসের সারাৎসার) উল্লেখ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ-
১. দরূদ শরীফের ফযীলত, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য।
২. দরূদ পড়ার বিশেষ কিছু ক্ষেত্র।
৩. দরূদ শরীফের কিছু মাছূর শব্দ-বাক্য।
এক.
‘সালাত ও সালাম’ তথা দরূদ শরীফের ফযীলত ও গুরুত্ব
১. হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
যে ব্যক্তি আমার প্রতি এক বার ‘সালাত’ প্রেরণ করবে (দরূদ পড়বে), আল্লাহ তার উপর দশ বার ‘সালাত’ প্রেরণ করবেন (বিশেষ রহমত বর্ষণ করবেন)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪০৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৮৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯০৬
২. আনাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
যে আমার প্রতি একবার ‘সালাত’ প্রেরণ করে, আল্লাহ তাআলা তার উপর দশটি রহমত অবতীর্ণ করেন। এছাড়াও তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেয়া হয় এবং তার মর্তবা দশবার উন্নীত করা হয়। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১২৯৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯০৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ৮৭৯৫
সুবহানাল্লাহ! বান্দা একবার দরূদ পড়লে আল্লাহ কেবল দশটি ‘রহমত’ই অবতীর্ণ করেন না; বরং এরইসাথে গোনাহও মাফ করা হয় এবং মর্তবাও উন্নীত করা হয়! এর পরও কি কেউ দরূদ শরীফ বেশি বেশি না পড়ে থাকতে পারে?
৩. আবু বুরদাহ বিন নিয়ার রা.-এর হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো অধিক সুসংবাদ দান করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি দিলের ইখলাসের সাথে আমার প্রতি একটি সালাত প্রেরণ করবে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার উপর দশটি রহমত প্রেরণ করবেন। তার মর্তবা দশবার উন্নীত করবেন। তার জন্য দশটি নেকি লিখে দেবেন এবং তার দশটি গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন! -সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ৯৮১০; মুজামে কাবীর তবারানী, হাদীস ৫১৩; দাআওয়াতে কাবীর, বাইহাকী, হাদীস ১৭৬; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১৭২৪৫ (সহীহ)
আল্লাহু আকবার! মাত্র একবার দরূদ শরীফ পাঠ করলে এত এত পুরস্কার! এত খায়ের ও বরকত! তাহলে কেউ দশবার দরূদ পাঠ করলে আরো কত বেশি লাভ করবে! আর যদি কোনো বান্দা খুব বেশি নয়, ১০০ বার দরূদ পাঠ করে, তাহলে আল্লাহ মেহেরবান তাকে কী পরিমাণ দান করবেন? তার প্রতি বর্ষণ করা হবে এক হাজার ‘সালাত’ (বিশেষ রহমত)! মাফ করে দেওয়া হবে এক হাজার গোনাহ! তার আমলনামায় লেখা হবে এক হাজার নেকি! আর তার মর্তবা উন্নীত করা হবে এক হাজার বার!
দেখুন, কেউ শুধু পড়ল-
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ.
অথবা পড়ল-
صَلَّى اللهُ عَلٰى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّسَلَّمَ.
তাহলেই দরূদ পড়া হয়ে গেল। এখন কেউ যদি এমন সংক্ষিপ্ত দরূদ ১০০ বার পড়ে (যাতে সর্বোচ্চ ১৫-২০ মিনিট সময় ব্যয় হবে), তাহলে সে উপরোক্ত সওয়াব, আজর ও মহা পুরস্কার লাভ করে ফেলবে! এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? আল্লাহ আমাদের তাওফীক দানে ধন্য করুন- আমীন!
তবে এই হাদীস থেকে এ কথাও জানা যায়, দরূদ শরীফের উক্ত ফযীলত পেতে চাইলে তা পড়তে হবে দিলের ইখলাসের সাথে।
৪. আবু তালহা আনসারী রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে তাশরীফ আনলেন। তখন তাঁর চেহারা মুবারক খুশি ও আনন্দে উজ্জ্বল ছিল। (এর কারণ বর্ণনা করতঃ) তিনি (নবীজী) ইরশাদ করলেন-
আমার কাছে জিবরাঈল এসেছেন এবং (আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে) বলেছেন, হে মুহাম্মাদ! আপনার খুশি ও সন্তুষ্টির জন্য এ কি যথেষ্ট নয় যে, আপনার উম্মতের যে কেউ আপনার প্রতি সালাত প্রেরণ করবে, আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। আর আপনার উম্মতের যে কেউ আপনার প্রতি সালাম প্রেরণ করবে, আল্লাহ তার উপর দশবার শান্তি বর্ষণ করবেন! -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১২৯৫; সুনানে দারেমী, হাদীস ২৭৭৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯১৫
আল্লাহর দরবারে প্রিয় নবীজীর কী মহামর্যাদা! আল্লাহর কাছে তাঁর খুশি ও সন্তুষ্টির কত মূল্য! তাই তো আল্লাহ তাআলা নবীজীর মর্যাদা প্রকাশের এবং তাঁর সন্তুষ্টির বহু আয়োজন করেছেন। সেসবেরই একটি এই যে, তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম প্রেরণের জন্য রেখেছেন মহাপুরস্কার। এবং আপন মর্যাদাবান ফিরিশতা জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে সেই পুরস্কারের কথা নবীজীকে জানিয়েও দিয়েছেন।
বর্তমান হাদীস দ্বারা এও জানা গেল, সালাত ও সালাম এই দুটির প্রত্যেকটির জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ও স্বতন্ত্র পুরস্কার। অর্থাৎ সালাত প্রেরণ করলে দশটি রহমত আর সালাম প্রেরণে দশ সালাম লাভ করবে! এজন্যই উলামায়ে কেরাম বলেছেন, উত্তম হল সালাত ও সালাম উভয়টি পাঠ করা। যেমন, শুধু صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ না বলে এমন বলা-
صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
৫. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন সকল মানুষের মধ্যে আমার অধিক নৈকট্য লাভ করবে ওই ব্যক্তি, যে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশি সালাত প্রেরণ করবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৮৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ৩২৪৪৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯১১
কিয়ামতের মতো কঠিনতম দিনে নবীজীর সাথে বিশেষ সম্পর্ক ও তাঁর নৈকট্য লাভ- এর চেয়ে বড় নিআমত ও সৌভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না নিঃসন্দেহে। এটি লাভ করার সহজ ও বড় মাধ্যম হল ইখলাসের সাথে অধিক পরিমাণে দরূদ শরীফ পাঠ করা।
ওইদিন যে ব্যক্তি নবীজীর অধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হবে, তাকে কি তিনি শাফাআত দ্বারা ধন্য করবেন না? সে কি আখেরী নবীর মহান শাফাআত দ্বারা সৌভাগ্যমণ্ডিত হবে না? অবশ্যই ইনশাআল্লাহ। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সামনের হাদীসটিতে এই সুসংবাদই প্রদান করা হয়েছে!
৬. রুওয়াইফে ইবনে ছাবিত আনসারী রা. বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি সালাত প্রেরণ করবে এবং সাথে এই দুআও পড়বে-
اَللّهُمَّ أَنْزِلْهُ الْمَقْعَدَ الْمُقَرَّبَ عِنْدَكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
(অর্থ : হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিয়ামতের দিন আপনার নিকটবর্তী মাকামে অধিষ্ঠিত করুন)- তার জন্য আমার শাফাআত অবধারিত হয়ে যাবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৯৯১; মুজামে কাবীর, তবারানী, হাদীস ৪৪৮০; আততারগীব ওয়াততারহীব, হাদীস ২৬০৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১৭২৫৯ (সালিহ লিলআমাল)
এমনিভাবে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এই দরূদ পড়বে-
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ، وَّ عَلٰى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلٰى مُحَمَّدٍ، وَّعَلٰى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلٰى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ إِبْرَاهِيْمَ، وَتَرَحَّمْ عَلٰى مُحَمَّدٍ، وَّعَلٰى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا تَرَحَّمْتَ عَلٰى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ إِبْرَاهِيْمَ.
আমি কিয়ামতের দিন তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করব এবং তার জন্য শাফাআত করব। -আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৬৪১; আলকাউলুল বাদী, সাখাবী, পৃ. ১১২ (সহীহ)
আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে নবীজীর এই ইরশাদ বর্ণিত হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি সকালে আমার প্রতি দশবার ‘সালাত’ প্রেরণ করবে এবং সন্ধ্যায়ও দশবার, কিয়ামতের দিন তার ভাগ্যে আমার শাফাআত জুটবেই! -আস্সালাতুন নববিয়্যাহ, ইবনু আবি আসিম, হাদীস ৬১; আলকাউলুল বাদী, পৃ. ২৬১ (সালিহ লিলআমাল)
এছাড়া আরো একাধিক হাদীসে দরূদ শরীফ পড়ার বিনিময়ে কিয়ামতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফাআত লাভের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
দুনিয়া-আখেরাতের সবচেয়ে কঠিন ও ভয়াবহ দিনে নবীজীর শাফাআত লাভের কথা জানার পরও কেউ কি অধিক পরিমাণে দরূদ শরীফ পড়ায় উৎসাহিত না হয়ে পারে? এ ব্যাপারে তার মধ্যে অবহেলা থাকতে পারে? কিছুতেই না ইনশাআল্লাহ!
৭. উবাই বিন কা‘ব রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আরজ করলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি অত্যধিক পরিমাণে আপনার প্রতি সালাত প্রেরণ করে থাকি। তো, আমি আমার দুআর কতটুকু সময় আপনার (প্রতি দরূদের) জন্য নির্ধারণ করব? (অর্থাৎ আমি নিজের জন্য দুআতে যে সময় ব্যয় করি, তার কতটুকু দরূদ শরীফের জন্য নির্দিষ্ট করে নেব?)
নবীজী কোনো সময় বেঁধে না দিয়ে বললেন, তুমিই যতটুকু চাও, তার জন্য নির্ধারণ করে নাও!
উবাই রা. বলেন, আমি বললাম, দুআর এক চতুর্থাংশ সময় নির্দিষ্ট করি?
নবীজী ইরশাদ করলেন, যেমন তুমি চাও! তবে যদি (দরূদের জন্য) আরো বেশি সময় ব্যয় কর, তবে তোমারই জন্য উত্তম হবে।
আমি বললাম, তাহলে দুআর অর্ধেক সময় (তার জন্য) নির্ধারণ করি?
নবীজী বললেন, যেমন তুমি চাও। তবে আরো অধিক নির্ধারণ করলে তোমারই জন্য ভালো হবে।
আমি বললাম, তবে দুআর দুই তৃতীয়াংশই নির্দিষ্ট করে নিই?
নবীজী বললেন, যেমন তুমি চাও। আর যদি আরো অধিক সময় তার জন্য ব্যয় কর, তবে তোমারই অধিকতর কল্যাণ হবে!
আমি আরজ করলাম, তাহলে তো আমি আমার দুআর পুরো সময় আপনার প্রতি সালাত প্রেরণের জন্য নির্ধারিত করে নিচ্ছি! তখন নবীজী বললেন, এমন করতে পারলে গায়েব থেকে তোমার সকল চিন্তা-পেরেশানী দূর করে দেওয়া হবে। অধিকন্তু তোমার গোনাহগুলোও ক্ষমা করে দেওয়া হবে! -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৭; মুসনাদে আবদ বিন হুমাইদ, হাদীস ১৭০; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৬২০ (সহীহ)
প্রায় একই ধরনের হাদীস আরো সাহাবায়ে কেরাম থেকেও বর্ণিত আছে। যেমন আবু হুরাইরা রা., হাব্বান বিন মুনকিয্ রা., আইয়ূব বিন বাশীর রা. প্রমুখ। (দ্র. আলকাউলুল বাদী, পৃ. ২৫৬-২৫৮)
আল্লাহর যে বান্দা দুআর পুরোটা সময় জুড়ে নিজের জন্য ও নিজের পরিবারবর্গের জন্য দুআ না করে শুধু প্রিয় নবীজীর জন্য দুআ করে অর্থাৎ দরূদ শরীফ পাঠ করে- সে নবীজীকে কতটা যে ভালবাসে, তার হৃদয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য কত যে মহব্বত, তা তো বলাই বাহুল্য! অতএব আল্লাহর মাহবুবে আযম, তাঁর মহামর্যাদাবান নবীর প্রতি এমন মহব্বত-ভালবাসা এবং অত্যধিক পরিমাণে দরূদ পাঠের বদৌলতেই ওই ব্যক্তির চিন্তা-পেরেশানী দূর করে দেওয়া হবে এবং গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সুতরাং কী বরকতময় আমল! আর কত উত্তম প্রতিদান!
৮. আবু হুরাইরা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি ইরশাদ করেছেন-
তোমরা নিজেদের ঘরগুলোকে কবরসদৃশ (অর্থাৎ যিকির ও ইবাদতশূন্য) করো না। আর আমার কবরকে উৎসব ও মেলার স্থান বানিয়ো না। তবে হাঁ! তোমরা (যেখানেই থাক) আমার প্রতি সালাত প্রেরণ করো। কেননা তোমাদের সালাত আমার নিকট পৌঁছানো হয়! -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২০৪২ (সহীহ)
যখন আল্লাহর কোনো বান্দার ‘সালাত ও সালাম’ নবীজীর দরবারে পৌঁছানো হয় এবং তাঁর কাছে পেশ করা হয়, তখন তিনি তার প্রতি কত খুশীই না হন! সে প্রিয় নবীর কতই না সন্তুষ্টি অর্জন করে নেয়! তো দরূদ শরীফ পড়ার কারণে একদিকে আল্লাহর খাস রহমত ও মেহেরবানী, অপরদিকে আল্লাহর হাবীবের খুশি ও সন্তুষ্টি- উভয়টি হাসিল হয়। আহ! এর চেয়ে আনন্দ ও সৌভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে যে, পেয়ারা নবীজী দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন শত শত বছর পূর্বে, কিন্তু সদা-সর্বদা তাঁকে খুশি করার ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের বরকতময় ওসীলা (সালাত ও সালাম) আমাদের জন্য অবশিষ্ট রাখা হয়েছে। অতএব আছে কি কেউ এ থেকে উপকৃত হওয়ার; অধিক থেকে অধিক পরিমাণে?!
একটি হাদীসে এ কথাও এসেছে যে, ফিরিশতাদের এক দল আছেন, যাঁদের কর্তব্যই হল উম্মতের সালাত ও সালাম নবীজীর দরবারে পৌঁছানো। তাঁরা এই যমীনের বুকে ঘুরে বেড়ান এবং যে যেখানে দরূদ শরীফ পড়ে, তার দরূদ নবীজীর খেদমতে পৌঁছে দেন। (দ্র. সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১২৮২) (সহীহ)
আল্লাহ তাআলার কাছে দরূদ শরীফের কী মর্যাদা ও গুরুত্ব! এজন্যই তো উম্মতের এই আমল নবীজীর দরবারে পৌঁছানোর এমন ইহতেমাম ও মহা ব্যবস্থাপনা করা হয়।
৯. আলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
(প্রকৃত ও বড়) বখিল হচ্ছে ওই ব্যক্তি, যার সামনে আমার আলোচনা হল, তা সত্ত্বেও সে আমার প্রতি সালাত প্রেরণ করল না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৪৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯০৯
পূর্বে দরূদ শরীফের যে অস্বাভাবিক ফযীলত-মর্যাদা ও গুরুত্ব-মাহাত্ম্য উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকেই স্পষ্ট যে, এ ব্যাপারে অবহেলার শিকার হওয়া বড় মাহরূমী এবং নিজেকে বহু কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা। বিশেষত এর চেয়ে বড় অবহেলা আর হতে পারে না যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আলোচনা শুনেও তাঁর প্রতি দরূদ পড়ল না। অথচ তিনি উম্মতের জন্য যা যা করেছেন এবং উম্মত তাঁর বদৌলতে যা-কিছু লাভ করেছে, সেসবের বিনিময়ে তাঁর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করে দিলেও তাঁর হক আদায় হবে না। এজন্যই উক্ত ব্যক্তিকে বড় বখিল আখ্যায়িত করা হয়েছে।
শুধু এতটুকুই নয়। এমন ব্যক্তির জন্য কঠিন ওয়ীদ (সতর্কবাণী) বর্ণিত হয়েছে। নি¤েœর হাদীসটি গভীর মনোযোগ সহকারে পড়–ন-
১০. কাআব বিন উজ্রা রা. ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত-
একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে আরোহণ করলেন। তিনি যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে উঠলেন তখন বললেন ‘আমীন’। দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠেও ‘আমীন’ বললেন এবং তৃতীয় সিঁড়িতে উঠেও বললেন, ‘আমীন’! আমরা কারণ জিজ্ঞাসা করলে নবীজী উত্তরে ইরশাদ করলেন-
মিম্বরে আরোহণের সময় আমার কাছে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এলেন (এবং তিনটি বদদুআ করলেন, আর আমি তাঁর প্রত্যেক বদদুআর উপর ‘আমীন’ বললাম) :
আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তিনি বললেন- ওই ব্যক্তি কল্যাণপ্রাপ্ত না হোক, যে রমযান মাস পেল। তারপরও তার গোনাহ ক্ষমা করা হল না। আমি বললাম, ‘আমীন’!
যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তিনি বললেন- ওই ব্যক্তি কল্যাণপ্রাপ্ত না হোক, যার নিকট আপনার নাম উল্লেখ করা হল। তা সত্ত্বেও সে আপনার প্রতি দরূদ পড়ল না। আমি বললাম, ‘আমীন’!
তৃতীয় সিঁড়িতে উঠলে তিনি বললেন- ওই ব্যক্তিরও কল্যাণ না হোক, যে পিতা-মাতার উভয়কে বা তাদের একজনকে বার্ধক্যে উপনীত পেল। কিন্তু তারা তার জন্য জান্নাতে প্রবেশের কারণ হল না (অর্থাৎ সে তাদের খেদমত করে জান্নাত কামাই করতে পারল না)। আমি বললাম, ‘আমীন’! -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭২৫৬; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৬৪৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০৯; আলকাওলুল বাদী, পৃ. ২৯২)
আমরা শুরুতেই উল্লেখ করেছি, সালাত ও সালামের (দরূদ শরীফের) ফযীলত, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে যে বিপুল পরিমাণ হাদীস রয়েছে, তার কিয়দংশও এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। উপরে যে অল্প কয়টি হাদীস উল্লেখিত হল, তার সারকথা এই যে, দরূদ শরীফের বরকতে-
- বান্দার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও শান্তি বর্ষিত হয়।
- আমলনামায় নেকী লেখা হয়।
- মর্যাদা বুলন্দ করা হয়।
- গোনাহ মাফ করা হয়।
- কিয়ামতের কঠিন দিনে নবীজীর নৈকট্য লাভ হবে।
- তাঁর শাফাআত লাভ হবে।
- চিন্তা-পেরেশানী দূর করে দেওয়া হয়।
অতএব দরূদ শরীফের ব্যাপারে অবহেলার শিকার হওয়ার অর্থ- নিজেকে বিপুল আজর ও সওয়াব থেকে মাহরূম করা ছাড়া আর কিছু নয়। বিশেষত পেয়ারা নবীজীর নাম শুনেও তাঁর প্রতি দরূদ না পড়া বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়। এ এমনই মন্দকর্ম, যার উপর হযরত জিবরাঈল আ. বদ দুআ পর্যন্ত করেছেন (আল্লাহর পানাহ)!
দরূদ শরীফের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য
আমার পরম শ্রদ্ধেয় উস্তায হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা. একটি প্রবন্ধে অত্যন্ত গভীরভাবে দরূদ শরীফের মাহাত্ম্যের কথা তুলে ধরেছেন। বর্তমান আলোচনার সমাপ্তিতে হযরাতুল উস্তাযের দুটি কথা উল্লেখ করা মুনাসিব মনে হচ্ছে।
হযরাতুল উস্তায দা. বা. লিখেছেন-
আল্লাহ ও নবীর নাম একত্রে উচ্চারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল সালাত ও সালাম (দরূদ শরীফ)। প্রত্যেক সালাত ও সালামে আল্লাহর নবীর জন্য দুআ করা হচ্ছে। এ কারণে সালাত ও সালাম যেমন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হক আদায়ের একটি সেরা আমল, তেমনি সেটি দুআ ও প্রার্থনার সর্বোত্তম পদ্ধতি হিসেবে অনেক বড় ইবাদত।
সালাত ও সালাম বা দরূদ শরীফের সৌন্দর্য ও তাৎপর্যের মধ্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, এতে একইসঙ্গে আল্লাহর ইবাদত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হক আদায়, উভয়ের প্রতি ভালবাসায় দৃঢ়তা, ইত্তেবায়ে সুন্নতের তাওফীক, আল্লাহ ও রাসূলের শোকরগোযারি, উভয়ের সন্তুষ্টি অর্জন, হাশরের ময়দানে নবীয়ে করীমের সুপারিশ লাভ ও নিজের মর্তবা বৃদ্ধি- সবকিছুই নিহিত রয়েছে।
দুঃখের বিষয়, সালাত ও সালামের এতসব ফায়েদা এবং শরীয়তে এর প্রতি এই পরিমাণ তাকিদ থাকা সত্ত্বেও আমরা এক্ষেত্রে চরম শিথিলতা করছি। একে আমরা কেবল একটি রসমি আমল ও প্রথাসর্বস্ব ব্যাপার বানিয়ে ফেলেছি এবং আনুষ্ঠানিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত করেছি। অথচ এটি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, দিন-রাত ও সকাল-সন্ধ্যায় পালনীয় সকল যিকির-আযকারের মধ্যে যা হওয়া উচিত শীর্ষস্থানে। (দ্র. মাসিক আলকাউসার, ফেব্রুয়ারি ২০১১ ঈ.)
আগামীতে পড়–ন-
দরূদ শরীফ পড়ার বিশেষ কিছু ক্ষেত্র <br>
সালাত ও সালামের কিছু মাছূর শব্দ-বাক্য