Jamudal Ula 1444   ||   December 2022

পথের কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া
জান্নাত লাভের একটি সহজ আমল

Mawlana Mummadullah Masum

লোকটি ইতিপূর্বে কখনো কোনো নেক আমল করেনি। (না সালাত আদায় করেছে, না রোযা রেখেছে। না আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, না দান-সদকা করেছে। না রাত জেগে কুরআন তিলাওয়াত করেছে। কিছুই না) কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন। কেন? কারণ পথ থেকে একটি কাঁটাদার গাছের ডাল সে সরিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহ তার কাজটির মূল্যায়ন করেছেন। তাকে জান্নাত দান করেছেন। (দ্র. সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২৪৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৪০)

এমন এক ব্যক্তির গল্প শুনিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবীদেরকে পথের কষ্ট দূর করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কারণ নিরাপদ পথের প্রয়োজনীয়তা আমাদের সমাজবদ্ধ জীবনে সকলের জন্যই অনস্বীকার্য। এর জন্য নবীজী যেমন উৎসাহিত করেছেন, অবহেলার জন্য ভীতিও প্রদর্শন করেছেন। 

ঈমানের শাখা

কুরআন-সুন্নাহ্য় ঈমানের অনেক শাখা-প্রশাখার কথা এসেছে। ঈমানের পূর্ণতার জন্য সেগুলো নিজের মাঝে ধারণ করতে হবে। পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়াও ঈমানের একটি শাখা। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

الْإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ - أَوْ بِضْعٌ وَسِتّونَ- شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لَا إِلهَ إِلّا اللهُ، وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الْأَذَى عَنِ الطّرِيقِ، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيمَانِ.

ঈমানের সত্তরোর্ধ্ব কিংবা ষাটোর্ধ্ব শাখা রয়েছে। তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠতম শাখা হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহবলা আর  সবচেয়ে সাধারণ শাখা রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৫৮৪৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৯২৬

অর্থাৎ ঈমানের নূন্যতম দাবি, চলার পথে সাধ্যানুযায়ী কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। এটি আমার নাজাতেরও কারণ হয়ে যেতে পারে!

পথের কষ্ট বিভিন্নভাবে হতে পারে। চলার পথে কোনো গর্তে পড়ে পা মচকে যেতে পারে। পড়ে থাকা কোনো কাঁটা বা ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো কারো পায়ে বিঁধে যেতে পারে। ইটের টুকরা বা শক্ত কোনো কিছুতে কেউ হোঁচটও খেতে পারে। পড়ে থাকা কোনো ফলের খোসা কিংবা পলিথিনে কারো পা পিছলে যেতে পারে। ময়লা-আবর্জনা বা দুর্গন্ধযুক্ত কোনো কিছু পথিকের কষ্টের কারণ হতে পারে। এমনকি দৃষ্টিকটু কোনো বিষয়ও অন্যদের কষ্ট ও বিরক্তির কারণ হতে পারে। তাই ইমাম নববী রাহ. বলেন-

وَالْمُرَادُ بِالْأَذَى كُلّ مَا يُؤْذِي مِنْ حَجَرٍ أَوْ مَدَرٍ أَوْ شَوْكٍ أَوْ غَيْرِهِ.

কষ্ট দ্বারা উদ্দেশ্য, পাথর, মাটির টুকরো, কাঁটাসহ কষ্টদায়ক সবকিছু। -শরহু মুসলিম, নববী ২/৬

তাছাড়া এটি আপেক্ষিক বিষয়ও বটে। কারো জন্য কষ্টের, আবার কারো জন্য কষ্টের নাও হতে পারে। কষ্টের ধরন একসময় হতে পারে স্বাভাবিক সহনীয়, আরেক সময় অস্বাভাবিক ও অসহনীয়। কোনোটা দেখতে দৃষ্টিকটু হওয়ার কারণে কষ্টদায়ক, কোনোটা চলতে গেলে কষ্টের কারণ হয়। আবার কোনোটা বড়দের কষ্ট না হলেও ছোটদের জন্য কষ্টকর।

আমাদের উসতাযের মুখে শুনেছি, রাস্তায় এক টুকরা টিস্যু পেপার পড়ে থাকতে দেখে কারো জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে, আবার কারো গোবর দেখেও কোনো সমস্যা না হতে পারে। কাজেই আমাদেরকে সরিয়ে ফেলতে হবে সবকিছু, যাতে কোনো ধরনের দৃষ্টিকটু জিনিস চোখে না পড়ে।

আসলে ইসলামের শিক্ষা মেনে চললে সবরকম কষ্টদায়ক বস্তু থেকেই পথঘাট মুক্ত থাকবে।

এটি সদাকা

অন্যেকে দান করে কমবেশি আমরা সদাকার সওয়াব লাভ করি। যদিও সেটি সদাকার প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ উপায়, কিন্তু এর বাইরেও সদাকার সহজ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু পথ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাতলে দিয়েছেন। একটি হল পথের কষ্ট দূর করা। সদাকার মাধ্যমে যেভাবে সদাকা-গ্রহীতার প্রতি উপকার ও কল্যাণ পৌঁছে দেওয়া হয়, পথের কষ্ট দূর করা ও পথচারীর নিরাপদ পথ চলা সহজ করার মাধ্যমেও আমার পক্ষ থেকে পথচারীর প্রতি এক ধরনের কল্যাণ পৌঁছানো হয়। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

وَتُمِيطُ الْأَذَى عَنِ الطّرِيقِ صَدَقَةٌ .

পথের কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া সদাকা। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০০৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৪৯৩

এক হাদীসে নবীজী পথের কষ্টদায়ক কিছু বস্তুর নাম ধরে ধরেও বলেছেন- পথ থেকে এগুলো সরিয়ে দেওয়া সদাকা। ইরশাদ হয়েছে-

وَإِمَاطَتُكَ الحَجَرَ وَالشّوْكَةَ وَالعَظْمَ عَنِ الطّرِيقِ لَكَ صَدَقَةٌ.

রাস্তা থেকে পাথর, কাঁটা, হাড্ডি সরানোও সদাকা। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৫৬

জান্নাতে সুখে-শান্তিতে থাকার উপায়

আমাদের গন্তব্য জান্নাত। জান্নাত আমাদের স্বপ্ন ও ঠিকানা। মুমিনের সকল কাজই হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের আশায়। পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে শান্তিতে মানুষের চলাফেরার ব্যবস্থা করলে জান্নাতেও থাকা যায় সুখে-শান্তিতে। আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

لَقَدْ رَأَيْتُ رَجُلًا يَتَقَلّبُ فِي الْجَنّةِ، فِي شَجَرَةٍ قَطَعَهَا مِنْ ظَهْرِ الطّرِيقِ، كَانَتْ تُؤْذِي النّاسَ.

আমি জান্নাতে এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে ও সুখে-শান্তিতে ঘোরাফেরা করছে। কারণ সে রাস্তা থেকে একটি গাছ কেটে ফেলে দিয়েছে, যা মানুষকে কষ্ট দিত। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯১৪; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১০৬৪৪

মুমিনের উত্তম আমলসমূহের অন্যতম

যত আমলই করি না কেন, কেবল সেই আমলটিই সুন্দর, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে সুন্দর। ওই কাজটাই অসুন্দর, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে অসুন্দর। তাই চলার পথে একটু থেমে গিয়ে, একটু দাঁড়িয়ে, একটু মাটির দিকে ঝুঁকে, কখনোবা নিজের অহংবোধ ঝেড়ে ফেলে বা আভিজাত্য বিসর্জন দিয়ে পথের একটুখানি কষ্ট যদি দূর করতে পারি, সেটি হয়ে যেতে পারে আমার জন্য হীরকখ-। কারণ এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে অনেক প্রিয় আমল! প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু যর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

عُرِضَتْ عَلَيّ أَعْمَالُ أُمّتِي حَسَنُهَا سَيِّئُهَا، فَوَجَدْتُ فِي مَحَاسِنِ أَعْمَالِهَا الْأَذَى يُمَاطُ عَنِ الطَّرِيقِ، وَوَجَدْتُ فِي مَسَاوِي أَعْمَالِهَا النُّخَاعَةَ تَكُونُ فِي الْمَسْجِدِ، لَا تُدْفَنُ.

আমার উম্মতের ভালো ও মন্দ আমলসমূহ আমার কাছে পেশ করা হল। আমি তাদের নেক আমলসমূহের মধ্যে দেখতে পেলাম- পথের কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। আর মন্দ আমলসমূহের মধ্যে দেখতে পেলাম- মসজিদে ফেলা কফ মাটি দিয়ে ঢেকে না রাখা। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৫৩; আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ২৩০

নবীজীর বিশেষ নির্দেশনা

পথের কষ্ট দূর করার মতো ছোট্ট এই আমলটি একদিকে যেমন সমাজের শৃঙ্খলা ও পথের নিরাপত্তায় সহযোগিতা করে, তেমনি নিজের জন্যও একাধারে আল্লাহর সন্তুষ্টি, সওয়াব, আত্মশুদ্ধি ও পরোপোকারের নেকীসহ বহুমাত্রিক কল্যাণ বয়ে আনে। এজন্যই সম্ভবত নবীজী আবু বারযা রা.-কে এর জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি যখন বলেছেন-

يَا نَبِيّ اللهِ عَلِّمْنِي شَيْئًا أَنْتَفِعُ بِهِ.

আমি উপকৃত হব, এমন কোনো কাজ আমাকে বাতলে দিন!

নবীজী বললেন-

اعْزِلِ الْأَذَى، عَنْ طَرِيقِ الْمُسْلِمِينَ.

মুসলমানদের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দাও! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬১৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯৭৯১

রাস্তায় আবর্জনা ফেলার জন্য রয়েছে কঠিন হুঁশিয়ারি

মুমিন তো সে, যার কারণে অন্য কেউ কষ্ট পায় না। মুমিন তো সে, যে অন্যের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করে। অন্যকে আরাম পৌঁছানোর চিন্তা করে। এমনকি আরেক ভাই যেন কষ্টের শিকার না হন তার জন্য সে নিজেও কষ্ট করতে প্রস্তুত থাকে। এটি মুমিনের আখলাক এবং ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেকসময় আমাদের থেকেও এমন কাজ হয়ে যায়, যা কখনো মুুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। এক্ষেত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘৃণিত একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন এবং তাকে অভিশাপের কারণ বলেছেন।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দুই অভিশাপকারী থেকে তোমরা সতর্ক থাকো! তারা বললেন, আল্লাহর রাসূল! দুই অভিশাপকারী কী?

তিনি বললেন-

الّذِي يَتَخَلّى فِي طَرِيقِ النّاسِ، أَوْ فِي ظِلِّهِمْ.

যে মানুষের চলাচলের রাস্তায় অথবা তাদের ছায়া গ্রহণের স্থানে পেশাব-পায়খানা করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৪১৫

আমি আমল করি, অন্যরা আমাকে দেখে শিখবে

সমাজের সব মানুষ যদি এ আমলের ব্যাপারে সচেতন হয়, যত্নবান হয় তাহলে সমাজ সুন্দর হবে, পথ হবে নির্ঝঞ্ঝাট, নিরাপদ ও আরামদায়ক। আসুন, নিজ নিজ জায়গা থেকে অগ্রসর হই! আমি যদি আমলে যত্নবান হই, অন্যরা আমাকে দেখে শিখবে। এমনকি ছোটরাও দেখে শিখবে এবং এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হবে, ইনশাআল্লাহ।

একটি ঘটনা- কুররা ইবনে ইয়াস আলমুযানী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি একবার মাকিল ইবনে ইয়াসার রা.-এর সাথে কোথাও যাচ্ছিলাম। পথে তিনি একটি কষ্টদায়ক বস্তু দেখে সরিয়ে দিলেন। কিছুদূর পর আমিও এমন একটি কষ্টদায়ক বস্তু দেখে সরিয়ে দিলাম। তখন তিনি আমার হাত ধরে বললেন, ভাতিজা! কোন্ জিনিস তোমাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করল?

আমি বললাম, আপনাকে দেখে শিখলাম। আপনার অনুসরণ করলাম।

তখন তিনি বললেন, (তাহলে শোনো বলি!) আমি নিজ কানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

مَنْ أَمَاطَ أَذًى عَنْ طَرِيقِ الْمُسْلِمِينَ كُتِبَتْ لَهُ حَسَنَةٌ، وَمَنْ تُقُبِّلَتْ مِنْهُ حَسَنَةٌ دَخَلَ الْجَنّةَ.

যে ব্যক্তি মুসলিমদের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দিল, তার নামে একটি নেকী লেখা হবে। যার একটি নেকী কবুল হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৫০২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭৪৭৯

অনুরূপ ঘটনা মুআয ইবনুল জাবাল রা.-এর বেলায়ও ঘটেছে। বিখ্যাত সাহাবী মুআয ইবনুল জাবাল রা. রাস্তা দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আরেক ব্যক্তি ছিল। মুআয রা. পথে কষ্টদায়ক যা পাচ্ছেন সরিয়ে দিচ্ছেন। এ দেখে লোকটি প্রশ্ন করল, মুআয! আপনি এটি কী করছেন?

মুআয বললেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মুসলিমদের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেবে, তার নামে একটি নেকী লেখা হবে। যার একটি নেকি কবুল হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৫৩৯; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৬৮৭৩

আসুন, আমরা সচেতন হই! নবীজীর শিক্ষা অনুযায়ী আমল করি। তাহলে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন, জান্নাতে দাখিল করবেন। হ

 

advertisement