একটি লেখা এবং আমার কিছু অনুভূতি
মাসিক আলকাউসার, অক্টোবর ২০২২ সংখ্যায় মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ দা. বা.-এর ‘মোবারকবাদ হাফেজ তাকরীম! বাদশাহ আবদুল আযীয কুরআন প্রতিযোগিতা, সৌদি আইডল এবং আমাদের হুজুগেপনা’ শিরোনামের প্রবন্ধটি পাঠ করলাম। আমি অধমও মনে মনে চিন্তা করছিলাম, হাফেজ তাকরীমকে মোবারকবাদ জানিয়ে তার ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্পর্কে দু-একটি কথা বলব। এরই মধ্যে হযরত মুফতী ছাহেবের লেখাটি পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত হলাম। আর বলতে কি, আলকাউসার হাতে নিয়েই খুঁজি, মুফতী ছাহেবের সম্পাদকীয় কলামের পর তাঁর হাতের আর কোনো লেখা আছে কি না। থাকলে তা খুব মজা করে পড়ি। বেয়াই বলেই তাঁর লেখার মজা পাই তা নয়; বরং তাঁর লেখায় আমার ধ্যানের ও জ্ঞানের মালমসলা পাই, তাই।
আমাদের প্রিয় ছেলে হাফেজ তাকরীম সৌদি আরবে কুরআন প্রতিযোগিতায় বহু দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকারের গৌরব অর্জন করে আমাদের দেশেরও নাম করেছে। সেজন্য তাকে দেশবাসীর পক্ষ থেকে অফুরন্ত মোবারকবাদ। এখন তার ভবিষ্যৎ কর্মসূচি বা দায়িত্ব-কর্তব্য কী হওয়া উচিত- সে সম্পর্কে তার পিতামাতা ও শিক্ষকগণের কাছে কিছু আবেদন রাখার পূর্বে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে হাফেজ তাকরীমের মতো কিছু ছেলের ভবিষ্যৎ কীভাবে পদস্খলিত হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বলে নিই।
অধম বর্তমানে অশীতিপর বৃদ্ধ। তাই জীবনসায়াহ্নে অছিয়তনামা লিখতে গিয়ে নিজের ছেলেদের উদ্দেশে এক স্থানে লিখেছি-
“বাবারা! তোমরা আপন ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে ছেলেদের, গজল গাওয়ার প্রতি আকৃষ্ট করো না। চাই তা দ্বীনী বা ইসলামী গজলই হোক। কেননা তাতে ইলমে দ্বীনের ক্ষতি হতে দেখেছি। উদাহরণ দিয়ে বলি, আমি ঊনিশ শত পঞ্চাশের দশকে লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ায় পড়ার কালে তথাকার মাঝারি ক্লাসের একজন ছাত্র সুন্দর ইসলামী গজল গাইত। দ্বীনী সভা-সম্মেলনে ওয়াযে মাঝে-মধ্যে গজল গাইতে পারার সুবাদে তাকেও দাওয়াত দেওয়া হত। সেও আনন্দ-উৎসাহে মাহফিলে যোগদান করত এবং কিছুক্ষণ পরপর মঞ্চে বসে বা দাঁড়িয়ে গজল গাইত। সে অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে ওয়ায়েযীনের সঙ্গে মঞ্চে আসন গ্রহণ করে থাকত। বয়স তার তখন আনুমানিক সতের-আঠার বছর। সে কী জানি একজন হয়ে গেছে মনে করে বড়দের মত গাম্ভীর্য ধারণ করে থাকত। তাকে মাদরাসায় সঙ্গী-সাথীদের মাঝে হাসতে দেখা যেত না।
“জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম, তাদের ক্লাসে সে মোটেই উল্লেখযোগ্য ছাত্র নয়। কেননা লেখা-পড়ার প্রতি তার মনোযোগ উঠে গিয়েছিল। সে তো একজন গণ্যমান্য ওয়ায়েয বা শিক্ষকসুলভ ভান নিয়ে চলত। সে নিজেকে ছাত্রদের কাতারের মানুষই মনে করতে পারত না। তার সর্বদার চিন্তা ছিল, কবে কোথায় দ্বীনী মাহফিল হবে এবং বিশিষ্ট মেহমানের মতো সেখানে তার দাওয়াত হবে। অতঃপর তার সুরেলা গজলে সভামঞ্চ এবং আশপাশ মুখরিত হয়ে উঠবে। সভায় শ্রোতাদের ‘বাহবা’ শব্দে সে নিজেও তখন উল্লসিত হয়ে উঠত।
“বাবারা! এই ছেলের প্রতি কেন জানি একটা কৌতূহল আমার মনে দানা বেঁধে উঠল- দেখব, লেখাপড়ার পর সে কী করে। ঢাকা শহরেরই এক থানার অধিবাসী ছিল সে। লালবাগের কাছে বলে তার থানার দিকেও প্রয়োজনে আমাদের কারো কারো যাতায়াত হত। কয়েক বছর পর সে (মাদরাসার) দাওরায়ে হাদীস পরীক্ষায় কোনো রকম উত্তীর্ণ হয়ে গেল। তখন বেফাক ইত্যাদি পরীক্ষা ছিল না। হঠাৎ একদিন রাস্তার পাশে একটি হোমিও ঔষধালয়ে তাকে দেখে আমি বিস্মিত হলাম। পলিসি করে একটু দূর থেকে দেখলাম। সে সেখানে কী করছে। ভালো করে চেয়ে দেখলাম, সে চিকিৎসার দোকানে বসে চিকিৎসা করছে। ব্যস, নাও! এই তার মাদরাসা পড়ার খোশ-নসীব। রূহের চিকিৎসক না হতে পারলেও দেহের চিকিৎসক তো হল!
“বাবারা আমার! এজাতীয় আরেকটি বিষয়। সেটি হচ্ছে কেরাত জগতে কম্পিটিশন বা প্রতিযোগিতা। তোমার ছেলের গলার আওয়াজটা যদি খুব ভালো হল তবে তোমাকেও আকৃষ্ট করে তুলবে সে। দেখি, মুসলিম জগতে তাকে নম্বরে আউয়াল বা ছানী করা যায় কিনা। যদি হয় ব্যস, আর কী! খ্যাতির তামাশা আর অর্থের তামাশা! বাপ-বেটারে আর পায় কে? حب جاه ও حب مال সম্মানের মোহ ও সম্পদের মোহ তোমাদের আকাশ ধরিয়ে দেবে। কোথায় যাবে এলেম-কালাম, কোথায় বাপবেটার আমল-আখলাক!
“বাবারা আমার! এ দুটি জিনিস থেকে খুব সতর্ক থেকো। ব্যস, আল্লাহ তাআলার রেযামন্দী হাসিল করার উদ্দেশ্যে আমলাদি মকবুল হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছার জন্য তাজবীদ সহকারে ছেলেমেয়েদের পবিত্র কুরআন পাঠ শেখাবে। এটুকুই যথেষ্ট। ছেলের ভালো, নামকরা কারী হয়ে বিভিন্ন সভাসমিতিতে গিয়ে কেরাত পড়ে ‘বাহবা’ কুড়ানোর দরকার নেই। এতে ভবিষ্যতে তার যোগ্য আলেম হয়ে দ্বীনধর্মের খেদমতের পথ ব্যাহত হবে।
“বাবারা! নিজ অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছি; কিছুসংখ্যক কারী ছাহেবানকে দেখেছি, তাদের কেউ কেউ বিদেশে কেরাত প্রতিযোগিতায় গিয়ে গিয়ে সুনাম কামিয়ে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে দেশে এসে কিছুদিন বাহবা কামিয়েছে। কিন্তু আসল যে কাজ ছিল অর্থাৎ ইলমে দ্বীনের প্রতি মনোযোগী হয়ে বিজ্ঞ আলেম হয়ে দ্বীনের ও জাতির আত্মিক খেদমত করা- তাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। নামকাওয়াস্তে আলেম হয়ে মসজিদে ইমামতি করে এবং সেইসাথে একটু দোকানপাট করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
“বাবারা! এসব থেকে তোমরা সবক হাসিল করো। তোমাদের প্রিয় আব্বু অছিয়তের মাধ্যমে তোমাদের আগত ও অনাগত নসল- জেনারেশন সম্পর্কে শিক্ষা-দীক্ষার আলোকপাত করে গেল। তোমরা এসব মেনে চলো- ইহ ও পরকালের জীবন সার্থক হবে। والله الموفق”
আমার প্রাণপ্রিয় দাদু হাফেজ তাকরীম সম্পর্কে তার পিতা ও শিক্ষকদের কাছে কিছু আবেদন নিবেদন করার ওয়াদা করেছিলাম। আর তার পূর্বে এরকম ছেলে সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার আলোচনা করলাম। এখন আমার মনে হচ্ছে, হাফেজ তাকরীমের মুরব্বীদের কাছে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই; বরং স্বনামধন্য মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেবের লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দাদু হাফেজ তাকরীম সম্পর্কে কিছু লিখতে এবং তার অভিভাবকদের কাছে কিছু আবেদন করতে চেয়েছিলাম, তা মুফতী ছাহেবের লেখার মুখ্য কয়েকটি লাইনে এসে গেছে। পাঠকদের সামনে আজকের আলোচনার সারসংক্ষেপ হিসেবে সে কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করে আমার বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটাচ্ছি।
“হাফেয তাকরীমকে মোবারকবাদ দেওয়ার সাথে সাথে প্রসঙ্গের বিবেচনায় আরও দুয়েকটি কথা আরজ করতে চাই। এটি তো তার জীবনের প্রথম ধাপমাত্র। এখনো সে শিশু বয়সে রয়েছে। হিফজুল কুরআনের পর সামনে তার পড়াশোনার পুরো জগৎ রয়ে গেছে। আল্লাহর কালাম মুখস্থ করার পর তার অর্থ-মর্ম বোঝা, সে অনুযায়ী নিজের জীবন গড়া এবং সে মর্মবাণী দুনিয়ার মানুষের কাছে প্রচারের দায়িত্ব নেওয়া- এ সবই একজন হাফেজে কুরআনের প্রধান কাজ। আর একজন প্রতিভাদীপ্ত মেধাবী ছাত্র তার ধ্যান-মন ইলমেদ্বীন ও সমাজের উপকারে নিবেদন করলে নিঃসন্দেহে প্রভূত উপকার ও উন্নয়ন সাধিত হয়। আমরা আশা করব, হাফেজ তাকরীমকে সে পথেই তার অভিভাবক ও উস্তাযগণ পরিচালিত করবেন।” হ
‘মাসিক আলকাউসার’-এর মূল্যবৃদ্ধি এবং আমার অনুভূতি
মাসিক আলকাউসার-এর পথচলা শুরু হয়েছে ২০০৫ সালে থেকে। তখন থেকে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পত্রিকাটির মূল্য ছিল মাত্র ১৫ টাকা। এরপর গত কয়েকবছর আগে ৫ টাকা বৃদ্ধি করে মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২০ টাকা। আর বর্তমানে ৩০ টাকা।
আল্লাহ তাআলার অশেষ শুকরিয়া যে, ২০১৪ সাল থেকে আমি এর নিয়মিত পাঠক ও গ্রাহক। করোনাকালের কয়েকটি সংখ্যা ছাড়া চলতি মাসসহ বিগত বছরের সব সংখ্যা-ই আমার সংগ্রহে আছে আলহামদু লিল্লাহ!
এই যে পত্রিকাটির মূল্যবৃদ্ধি, এর সাথে আমার একটি ছোট্ট অনুভূতি হল, এর দাম যদি বাড়তে বাড়তে ১০০ টাকাও হয়ে যায় এবং এর সাথে কোনো পৃষ্ঠা বৃদ্ধি না-ও করা হয়, তবুও আমি প্রতি মাসে তা সংগ্রহ করব ইনশাআল্লাহ! কারণ এর ভেতরের একেকটি কথা, একেকটি নির্দেশনা আমার কাছে কোটি টাকার হীরা-মানিকের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে হয়! বিশেষ করে মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব হুজুরের ইলমী ও তাহকীকী কথাগুলো, মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ সাহেবের সমসাময়িক পর্যালোচনাগুলো এবং ‘আপনি যা জানতে চেয়েছেন’ বিভাগের দিল-প্রশান্তকারী অমূল্য ফতোয়াগুলো!
তো ১০০ টাকায় যদি আমি কোটি টাকার ফায়েদা পেয়ে যাই, তাহলে এতে বিনিয়োগ করতে আর আপত্তি কোথায়?
বাংলাভাষায় এমন ভারসাম্যপূর্ণ, সৃজনশীল, ইলমী-আমলী এবং দ্বীন-শরীয়তের মেযাজ ও শুদ্ধতার এতটা নিকটবর্তী গবেষণাধর্মী ইসলামী পত্রিকা ‘মাসিক আলকাউসার’ ছাড়া আমার দৃষ্টিতে আর কোনোটা ছিল বা আছে বলে মনে হয় না!
বি. দ্র. : বর্তমানে আলকাউসারের যে মূল্যবৃদ্ধি তা যৌক্তিক কারণে এবং বাধ্য হয়েই করা হয়েছে। কারণ কাগজের দাম আগের চেয়ে প্রায় ডাবল হয়ে গেছে। সামান্য খোঁজখবর রাখেন এমন ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি মোটেও অজানা নয়। তবে মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে চলতি মাস থেকে পত্রিকার কলেবরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে ছিল ৪৮ পৃষ্ঠা আর এখন থেকে ৫৬ পৃষ্ঠা।
‘মাসিক আলকাউসার’-এর মূল্যবৃদ্ধি এবং আমার অনুভূতি
মাসিক আলকাউসার-এর পথচলা শুরু হয়েছে ২০০৫ সালে থেকে। তখন থেকে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পত্রিকাটির মূল্য ছিল মাত্র ১৫ টাকা। এরপর গত কয়েকবছর আগে ৫ টাকা বৃদ্ধি করে মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২০ টাকা। আর বর্তমানে ৩০ টাকা।
আল্লাহ তাআলার অশেষ শুকরিয়া যে, ২০১৪ সাল থেকে আমি এর নিয়মিত পাঠক ও গ্রাহক। করোনাকালের কয়েকটি সংখ্যা ছাড়া চলতি মাসসহ বিগত বছরের সব সংখ্যা-ই আমার সংগ্রহে আছে আলহামদু লিল্লাহ!
এই যে পত্রিকাটির মূল্যবৃদ্ধি, এর সাথে আমার একটি ছোট্ট অনুভূতি হল, এর দাম যদি বাড়তে বাড়তে ১০০ টাকাও হয়ে যায় এবং এর সাথে কোনো পৃষ্ঠা বৃদ্ধি না-ও করা হয়, তবুও আমি প্রতি মাসে তা সংগ্রহ করব ইনশাআল্লাহ! কারণ এর ভেতরের একেকটি কথা, একেকটি নির্দেশনা আমার কাছে কোটি টাকার হীরা-মানিকের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে হয়! বিশেষ করে মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব হুজুরের ইলমী ও তাহকীকী কথাগুলো, মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ সাহেবের সমসাময়িক পর্যালোচনাগুলো এবং ‘আপনি যা জানতে চেয়েছেন’ বিভাগের দিল-প্রশান্তকারী অমূল্য ফতোয়াগুলো!
তো ১০০ টাকায় যদি আমি কোটি টাকার ফায়েদা পেয়ে যাই, তাহলে এতে বিনিয়োগ করতে আর আপত্তি কোথায়?
বাংলাভাষায় এমন ভারসাম্যপূর্ণ, সৃজনশীল, ইলমী-আমলী এবং দ্বীন-শরীয়তের মেযাজ ও শুদ্ধতার এতটা নিকটবর্তী গবেষণাধর্মী ইসলামী পত্রিকা ‘মাসিক আলকাউসার’ ছাড়া আমার দৃষ্টিতে আর কোনোটা ছিল বা আছে বলে মনে হয় না!
বি. দ্র. : বর্তমানে আলকাউসারের যে মূল্যবৃদ্ধি তা যৌক্তিক কারণে এবং বাধ্য হয়েই করা হয়েছে। কারণ কাগজের দাম আগের চেয়ে প্রায় ডাবল হয়ে গেছে। সামান্য খোঁজখবর রাখেন এমন ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি মোটেও অজানা নয়। তবে মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে চলতি মাস থেকে পত্রিকার কলেবরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে ছিল ৪৮ পৃষ্ঠা আর এখন থেকে ৫৬ পৃষ্ঠা।
মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম
খাদিমুত তলাবা, মাদরাসা উমর রা. আলইসলামিয়া ঢাকা।
শাহিনবাগ, তেজগাঁও, ঢাকা।
১২-১০-২২ ঈ.