Zilqad 1431   ||   November 2010

তলাবায়ে কেরামের উদ্দেশে: তহারাত ও নাযাফাত : উদাসীনতার মূল কারণ কি ব্যস্ততা, না অন্য কিছু

Mawlana Muhammad Abdul Malek

ইসলামে যাহেরী-বাতেনী তহারাত এবং শরীর, লেবাস, কিতাবপত্র এবং ঘর ও তার চারপাশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ঈমানের পর প্রথম স্তরের পালনীয় কাজ। হাদীস শরীফে তহারাতকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। এই গুরুত্বের কারণে কুরআন সুন্নাহ ও ফিকহে ইসলামীতে তহারাত ও নাযাফাতের আহকাম বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সেই সকল লোকদের ভালবাসেন যারা তার দিকে বেশি রুজু করে, এবং ভালবাসেন তাদেরকে যারা বেশি পাক-পবিত্র থাকে।’ (সূরা বাকারা : ২২২)

মুসজিদে কুবার মুসল্লীদের প্রশংসায় আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) সেখানে কিছু লোক আছে যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ তাআলা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন। (সূরা তাওবা : ১০৮)

হাদীসে আছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র এবং পবিত্রতাকে পছন্দ করেন, পরিচ্ছন্ন এবং পরিচ্ছন্নতাকে পছন্দ করেন। দয়ালু, দয়া করাকে পছন্দ করেন, দানশীল, দানকে পছন্দ করেন। সুতরাং তোমরা তোমাদের গৃহের আঙ্গিনা পরিষ্কার কর এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য গ্রহণ করো না।

হযরত সাহল রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফর থেকে ফেরার পথে সাথীদেরকে বললেন, তোমরা তোমাদের ভাইদের নিকট যাচ্ছ। অতএব উত্তম পোষাক পরিধান কর এবং তোমাদের হাওদা (সামানপত্র) গুছিয়ে নাও। যেন তোমাদেরকে মানুষের মাঝে তিলকের ন্যায় (সুন্দর) মনে হয়। আল্লাহ তাআলা মন্দ ও অশ্লীলতাকে পছন্দ করেন না। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৮৬; মুসনাদে আহমদ হাদীস : ১৮০৪; মুসতাদররাকে হাকেম ৪/১৮৩

উল্লেখিত হাদীসে চিন্তা করার মতো কয়েকটি বিষয় রয়েছে। এক. সাধারণত সফর থেকে ফিরে আসার সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না; মনে করা হয় যে, ঘরে গিয়ে গোসল করব এবং কাপড় পাল্টাব। অথচ হাদীসে ঘরে ফেরার আগেই উত্তম পোষাক পরিধান করতে বলা হয়েছে। সুতরাং অন্য অবস্থায় তা কেমন গুরুত্বপূর্ণ হবে তা সহজেই অনুমেয়।

দুই. মানুষ যখন নিজেদের মাঝে থাকে তখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। মনে করে যে, এখানে তো লৌকিকতার প্রয়োজন নেই। হাদীসে এই চিন্তাকেও সংশোধন করা হয়েছে। নিজেদের মাঝে থাকা অবস্থায় বা সফর ইত্যাদি থেকে নিজ পরিবারে ফেরার সময়ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

তিন. وأصلحوا رحالكم

তোমরা তোমাদের সামানাপত্র গুছিয়ে নাও-এই কথা দ্বারা ইশারা করা হচ্ছে যে,  নিজের সামানা এবং চারপাশের পরিবেশকেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে রাখা উচিত। শুধু শরীর ও কাপড়চোপড় পরিষ্কার রাখাই যথেষ্ট নয়। তালাবায়ে কেরাম এখান থেকে এই হেদায়েত নিতে পারেন যে, দরসগাহের কিতাবপত্র ও দারুল ইকামার কাপড়-চোপড় এবং অন্যান্য জিনিস গুছিয়ে রাখা উচিত, মসজিদ বা দরসগাহের দরজায় যে জুতাগুলি থাকে তা সুন্দরভাবে সাজিয়ে  রাখা চাই।

চার. এ আদেশের একটি হেকমত এই যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকা যেমন ব্যক্তির দ্বীনদারী ও দ্বীনী প্রজ্ঞার পরিচায়ক তেমনি অন্যদের জন্যও স্বস্তিদায়ক।

অপরিচ্ছন্ন জিনিসপত্র এবং অগোছালো বস' নজরে পড়লে রুচিশীল লোকদের কষ্ট হয়।

এটিই হাদীস শরীফের বানী-যাতে তোমাদেরকে মানুষের মাঝে তিলকের ন্যায় সুন্দর মনে হয়-এর গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা।

সারকথা এই যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও নির্দেশনার কারণে সাহাবায়ে কেরামের নিকট পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার অসাধারণ গুরুত্ব ছিল। মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বায় বর্ণিত আছে যে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তারা ঘরদোর পরিষ্কার রাখার বিষয়ে এত গুরুত্ব দিতেন যে, একটি খড়কুটাও খুঁজে পাওয়া যেতো না।  যিনি ঘরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে এত যত্নবান তিনি নিজের শরীর ও কাপড়চোপড়ের বিষয়ে কত যত্নবান হবেন তা তো খুব সহজেই বোঝা যায়।

আজকাল ব্যাপকভাবে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, পোষাক মানুষের চোখে বেশি পড়ার কারণে তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে কিছু হলেও লক্ষ রাখা হয়। কিন্তু  শরীরের পরিচ্ছন্নতার দিকে লক্ষ রাখে না। অথচ পরিচ্ছন্নতার মূল হেকমত হল তা আল্লাহ তাআলার কাছে প্রিয় এবং ফেরেশতাদের কাছেও পছন্দনীয়। আর তা ফিতরাত ও সুস্থ স্বভাবের চাহিদা। এসব হেকমতের দাবি হল নিজেকে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।

শারীরিক পরিচ্ছন্নতার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি একদিকে  যেমন মানুষের স্বভাবগত চাহিদা অন্যদিকে তা সকল নবী রাসূলের সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে দুটি হাদীস তো সকল তালেবে ইলমেরই জানা রয়েছে।

১. হযরত আবু হুরায়রা রা, থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পাঁচটি বিষয় ফিতরাতের  (সুস্বভাবের) অন্তর্ভুক্ত : ক্ষৌরকার্য সম্পাদন করা, খতনা করা, মোচ খাটো করা, বগলের চুল উপড়ে ফেলা ও নখ কাটা। (সহীহ বুখারী হাদীস : ৫৮৯১; সহীহ মুসলিম হাদীস : ২৫৭; জামে তিরমিযী হাদীস : ২৭৫৬

২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র রা. থেকে বর্ণিত, নবীকরীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দশটি বিষয় ফিতরতের অন্তর্ভুক্ত : মোচ খাটো করা, দাঁড়ি লম্বা করা, মেসওয়াক করা, নাকে পানি দেওয়া, নখ কাটা, আঙুলের ভাঁজসমূহ ধৌত করা, বগলের পশম উপড়ানো, নাভির নীচের স্থান চেছে পরিষ্কার করা, স্তিজ্ঞায় পানি ব্যবহার করা।

এই হাদীসের একজন রাবী মুসয়াব রাহ. বলেন, দশম বিষয়টি আমি ভুলে গেছি। তবে তা কুলি করাহতে পারে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৬১; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৭৫৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৯৩

ফিতরাত সংক্রান্ত সুন্নত ও আহকাম আরো অনেক বেশি। কোনো হাদীসেই উল্লেখিত বিষয়গুলোর মাঝে সীমাবদ্ধ করা উদ্দেশ্য নয়।

এটাই মিনে তাবয়ীযিয়্যাহর অর্থ। দুই হাদীসে মোট এগারোটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যার সবগুলোই তাহারাত ও নাযাফাত সংক্রান্ত

এখানে আমি শুধু তিনটি বিষয় নিয়ে কিছু কথা আরজ করতে চাই। তা হচ্ছে মেসওয়াক করা, নখ কাটা ও মোচ খাটো করা।

মেসওয়াক করা 

ইসলামে মেসওয়াকের আহাম্মিয়াত, ফযিলত ও যাহেরী-বাতেনী ফায়েদা সম্পর্কে তালিবে ইলম ভাইরা নিঃসন্দেহে অবগত। কিন্তু এখন সর্বদা অযুর হালতে থাকা ও নতুন অযুর সুন্নতের উপর আমল কমে যাওয়ায় এবং ব্রাশের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে মেসওয়াকের আমল কমে গেছে, উপরন্তু ব্রাশের ব্যবহারও দৈনিক শুধু দুএক সময় করা হয়। যেমন রাতে বা দিনে ঘুম থেকে উঠার পর। অথচ প্রত্যেক অযুর সময় মেসওয়াক করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। অযু ছাড়াও অন্য অনেক সময় মেসওয়াক করা মুস্তাহাব। যেমন নামাযের আগে, ঘরে গিয়ে, ঘর থেকে বের হওয়ার আগে, ঘুমানোর আগে, ঘুম থেকে উঠে।  আল্লাহর সন'ষ্টি অর্জনের জন্য বারবার মেসওয়াক করা উচিত। কোনো অযু মেসওয়াক থেকে খালি না থাকা চাই। এরপরও সুস'তা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য দৈনিক কমপক্ষে পাঁচবার নিয়মিত মেসওয়াক করা চাই। কেউ যদি ব্রাশ করতে চায় তাহলে ঘুমানোর আগে, ঘুম থেকে উঠে বা ভারি খাবারের পর করতে পারে। অন্যসময় মেসওয়াক করবে।

ব্রাশ দিয়ে মেসওয়াকের মূল সুন্নত হয়তোবা আদায় হবে কিন্তু মেসওয়াকের ফায়েদা ও নূরানিয়াত দ্বারা কীভাবে পাওয়া যাবে? আর অধিকাংশ ব্রাশ ও পেষ্ট বিধর্মীদের তৈরি। বিশেষ করে ইহুদিদের। অথচ তাদের উৎপাদিত পণ্য বর্জন করাই ঈমানী ও আখলাকি গায়রতের তাকাযা।

জেনে রাখা উচিত যে, দাঁত আল্লাহ তাআলার নেয়ামত, সুস'তা আরো বড় নেয়ামত, মুখের সৌন্দর্যও আল্লাহর একটি নেয়ামত। তাই মেসওয়াক না করা ও মুখ পরিষ্কার না রাখার অর্থ হবে এই তিন নেয়ামতের বে-কদরী করা। সফর-হযর সর্বহালতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জিনিসিগুলো সাথে রাখতেন তার মধ্যে গুরুতপূর্ণ হল মেসওয়াক। এই কারণে প্রত্যেক তালিবে ইলমের সাথে মেসওয়াক থাকা চাই। যাতে এই সুন্নত কখনো না ছোটে। ব্রাশ ও টুথপেস্ট কি সর্বদা সাথে রাখা যায়? যায় না। অতএব ব্রাশে অভ্যস্ত ব্যক্তির এই সুন্নত অবশ্যই ফওৎ হবে। আল্লাহ মাফ করুন।

কোনো কোনো তালেবে ইলম তো পানেও অভ্যস্ত। শিক্ষক হওয়ার পর এই অভ্যাস আরো মজবুত হয়ে যায়। অনেকে নতুন করে অভ্যাস করে। তাদের অনেকের ধারণা হল, পান খেতে হলে ঠোঁট, দাঁত ও জিহ্বার রূপ বিকৃত করেই খেতে হবে। তাই তারা আল্লাহর এই তিন নেয়ামতের উপর এত বেশি জুলুম করে যে, বস্থা দেখে তাগয়ীরে খালকিল্লাহ্‌র কথা মনে পড়ে যায়।   পানই কি একমাত্র জিনিস, যারা দ্বারা আমরা আকাবিরের সুন্নতকে যিন্দা করতে চাই। এটা ঠিক যে, কিছু আকাবির পানে অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্তু তারা দাঁত ও মুখ কীভাবে পরিষ্কার রাখতেন তাও তো মনে রাখা উচিত।

এ বিষয়ে যে বন্ধুরা আকাবিরের হাওলা দিয়ে থাকেন তাদেরকে হযরত মাওলানা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর নুকুশে রাফতেগাঁথেকে হযরত মাওলানা মুফতী মাহমুদ রাহ.-এর সম্পর্কে লিখিত নিবন্ধটি পড়ার অনুরোধ করব। তাহলে জানতে পারবেন যে, পানে অভ্যস্ত আকাবির পান খাওয়াকে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন। যাই হোক, এটা তো একটা প্রাসঙ্গিক কথা। মুল আলোচনা ছিল মেসওয়াক সম্পর্কে। যারা পানে অভ্যস্ত তারা যেন বেশি বেশি ও ভালোভাবে মেসওয়াক বা ব্রাশ করে মুখ ও জিহ্বা পরিষ্কার রাখেন।

আমাদের জানা আছে যে, মৃত্যুশয্যায়ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেসওয়াক ছাড়েননি। সুতরাং তাঁর আখেরি আমল মেসওয়াকই ছিল। (মুসনাদে আহমদ ৬/৪৮, হাদীস : ২৪২১৬; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৪৪৯ ইত্যাদি গ্রন্থে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার গৃহে অবস্থানের দিন আমার কাছে আমার বুকে (মাথা রেখে)  ন্তিকাল করেন। ঐ সময়ের ঘটনা, আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর সেখানে এল। তার কাছে ছিল একটি তাজা  মেসওয়াক। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেসওয়াকটির দিকে তাকালেন। আমার মনে হল, এটা তাঁর প্রয়োজন, তখন আমি তা নিলাম এবং চিবিয়ে নরম করে তাকে দিলাম। তিনি এত সুন্দর করে মেসওয়াক করলেন যে, এর চেয়ে সুন্দর মেসওয়াক করতে কখনো তাঁকে দেখিনি। এরপর তিনি তা আমাকে দিতে চাইলেন। কিন্তু দিতে পারলেন না। তাঁর হাত থেকে পড়ে গেল ... এবং তিনি আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন আররাফীকাল আলাআররাফীকাল আলা।অর্থাৎ তিনি রাফীকাল আলার ডাকে সাড়া দিলেন। সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি আমার ও তার লালা মোবারককে পৃথিবীর শেষ দিনে ও আখেরাতের প্রথম দিনে একত্র করেছেন। আহা! আমরা যদি এই আমলটির কদর করতাম, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রফীকে আলার সাথে মিলিত হওয়ার সময় নিজের জন্য পছন্দ করেছেন এবং ছাকারাতুল মাওতের সময়ও তার গুরুত্ব দিয়েছেন। 

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

অনুবাদ : মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান

 

advertisement