সততা ও আমানতদারির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত কত কিছুই না ঘটে! সব কি আর সবার নজর কাড়ে? কিন্তু কিছু বিষয় বাস্তবেই সচেতনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হৃদয়কে আলোড়িত করে। চেতনাকে নাড়া দিয়ে যায়। যার ফলে তাকওয়ার স্নিগ্ধ আলো হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে যায়। জীবনের অঙ্গনে নতুনভাবে কাজ করবার বা অন্ধকার জীবনের পাট চুকিয়ে জীবনকে নতুনভাবে সাজাবার অনুপ্রেরণা খুঁজে পায় মানুষ। আলোময় ভুবনে পদার্পণের স্পৃহা জেগে ওঠে হৃদয়ের মণিকোঠায়। কিছুদিন আগে এরকম একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর হেড কোয়ার্টারে পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন এক ভদ্রলোক। মাথায় টুপি। মুখে সফেদ দাড়ি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে চাকরিজীবন থেকে অবসরে যান। চাকরির সুবাদে বিভিন্ন সময় ট্রেনে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতেন। অনেক সময় ঝামেলা ও সময় স্বল্পতার কারণে টিকেট না কেটেই বিনা টিকেটে তাকে ট্রেনে যাতায়াত করতে হতো। কিন্তু জীবনে কতবার টিকেট না কেটে ট্রেনে ভ্রমণ করেছেন- সেই হিসাব তিনি টুকে রেখেছেন। হিসাব অনুযায়ী সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে ২৫৩০ টাকা ট্রেনের বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করে দিলেন।
ট্রেনের বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করে দায়মুক্ত হওয়া নজির স্থাপনকারী মানুষটি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি সরকারি চাকরির সুবাদে প্রায়শই রাজধানী ঢাকায় ট্রেনে আসা যাওয়া করতাম। এতে অনেক সময় ব্যস্ততা, ভিড় বা সময় স্বল্পতার জন্য ট্রেনের টিকেট কাটতে পারি নাই। জীবনের শেষ বয়সে এসে আগের ট্রেনের ভাড়া না দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আমি অনুশোচনায় ভুগছিলাম। সেই অনুশোচনা থেকেই আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে এসে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতীর দুই হাজার ৫৩০ টাকার সমমূল্যের আসনবিহীন টিকেট কেটে দায়মুক্ত হলাম।’ (সময় নিউজ, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২)
প্রশংসনীয় কাজ সন্দেহ নেই। এই মহতী কাজের মাহাত্ম্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই। নিঃসন্দেহ এটি একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
দুর্নীতি দমনের জন্য কত আইন কানুনই তো করা হয়! দেশের শত শত কোটি টাকা কেবল সংশ্লিষ্ট বিভাগের জন্যই খরচ করা হয়। কিন্তু সেই অব্যাহত প্রচেষ্টার কাক্সিক্ষত ফলাফল কোথায়?
দেশের চলমান পরিস্থিতির জন্য যেখানে দুর্নীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অসহনীয় মূল্যে আমজনতার নাভিশ্বাস, তখন সরকারের এই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার চেতনাদীপ্ত কর্ম সকলকে নাড়া দিয়েছে।
এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সততা ও আমানতদারির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এমদাদুল হকের আরেকটি উক্তি। লোকটি একজন সাধারণ মুসলিম ও ধর্মপ্রাণ মানুষ, কিন্তু কথা বড় চমৎকার! বলেছেন- ‘আমি যত পুণ্যই করি না কেন, এই দেনার দায় তো কোনো পুণ্য দিয়ে শোধ করার উপায় নেই। তাই সরাসরি রেলের খাতেই জমা দিয়ে দিলাম। জানি না, তাতে আমার দায়মুক্তি হবে কি না। তবে অন্তত মানসিক প্রশান্তি পাব।’ (ঢাকা টাইমস, ৫-৯-২০২২)
দৈনিক প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছিল তাঁর। সেখানেও তিনি এ বলেছেন- “আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে। এটা বাংলাদেশের মানুষের টাকা। সরকারের কোষাগারের টাকা। বিনা টিকেটে ভ্রমণ মানে আখেরাতে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে।” (দৈনিক প্রথমআলো ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২)
আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁর সম্মুখে জবাদিহির ভয় কীভাবে মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে! দায়মুক্তির আশায় কীভাবে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের হক মানুষ এতটা যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করে তা বুঝিয়ে দিতে পারে।
হাঁ, এটা তখনই সম্ভব যখন অন্তর পরিশুদ্ধ হয়। তাকওয়ার আলোয় আলোকিত হয়। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً: إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّهُ، أَلاَ وَهِيَ القَلْبُ.
জেনে রাখো, শরীরে রয়েছে একটি মাংসপিণ্ড। যখন তা সুস্থ থাকে গোটা দেহ সুস্থ আর যখন তা নষ্ট হয় তখন গোটা দেহও হয় নষ্ট। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২; সহীহ মুসিলম, হাদীস ১৫৯৯
অর্থাৎ অন্তর যখন পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হবে তখন কাজ-কর্ম, আচার-আচরণও পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত হবে।
যুগপরম্পরায় বহমান ইসলামী বৈশিষ্ট্য
খোদাভীতি ও পরকালে জবাবদিহির ভয় একজন মানুষকে যে কতটা সৎ ও পরিশুদ্ধ করতে পারে- এ ঘটনা থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু এ কেবল ব্যক্তি এমদাদুল হকের বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, যুগ পরম্পরায় বহমান ইসলামী শিক্ষার ধারাবাহিক প্রকাশ। মুসলিম মনীষীগণের জীবনী পড়লে পাওয়া যায় এমন বহু ঘটনা। আল্লামা তাকী উসমানী দা. বা. বলেন- ‘আমার শ্রদ্ধেয় পিতা হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. একবার রেলগাড়ীতে সফর করার জন্য স্টেশনে যান। গিয়ে দেখেন, যে শ্রেণীর টিকেট কিনেছেন সেখানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ওদিকে গাড়ী ছেড়ে দেয়ার সময় হয়ে গিয়েছে; হাতে টিকেট পরিবর্তন করে নেওয়ার মত সময়ও নেই। বাধ্য হয়ে তিনি উপর শ্রেণীর বগিতে আরোহণ করেন। তিনি ভেবেছিলেন, টিকেট চেককারী এলে তার থেকে টিকেট পরিবর্তন করে নেবেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে সারা পথে কোনো চেকারও আসেনি। অবশেষে তিনি এ অবস্থাতেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছেন। গাড়ী থেকে নেমে তিনি সোজা টিকেট কাউন্টারে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে জেনে নেন, উভয় শ্রেণীর ভাড়ার মধ্যে ব্যবধান কতটুকু। তারপর ওই পরিমাণ মূল্যের একটা টিকেট কিনে সেখানেই ছিঁড়ে ফেলেন। এ দেখে রেলওয়ের যে হিন্দু অফিসারটি টিকেট দিয়েছিল, তার মনে বিস্ময় জাগল। হয়ত বা আমার পিতার মস্তিষ্কের সুস্থতার ব্যাপারেই তার সন্দেহ জেগেছে। সে বাইরে এসে আব্বাজানকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি টিকেট ছিঁড়ে ফেললেন কেন?
আব্বাজান তাকে পুরা ঘটনা শুনিয়ে বললেন, উপর শ্রেণীতে ভ্রমণ করার কারণে এই পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা আমার দায়িত্ব হয়ে যায়। তাই টিকেট ক্রয় করে রেলওয়ের দেনা পরিশোধ করলাম। আর টিকেটের যেহেতু এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই তাই ছিঁড়ে ফেললাম।
তখন অফিসারটি বলল, আপনি তো স্টেশন থেকে বের হয়ে এসেছেন। এখন আপনার নিকট অতিরিক্ত ভাড়া কে চাইবে? তখন আব্বাজান উত্তর দিলেন, জী, হাঁ। কোনো মানুষ তো এখন আর আমার কাছে তা চাওয়ার নেই। কিন্তু যে হকদারের হক চাওয়ার কেউ থাকে না তা অবশ্যই আল্লাহ তাআলা চাইবেন। একদিন আমাকে তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে। তাই এটা করতে আমি বাধ্য ছিলাম। (যিক্র ও ফিক্র, পৃ. ১০৯-১১০)
এমনই আরেকটি ঘটনা। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. একবার সাহারানপুর থেকে কানপুর যাচ্ছিলেন। রেলগাড়ীতে আরোহণের উদ্দেশ্যে স্টেশন পৌঁছে বুঝতে পারেন, একজন যাত্রীর জন্য যে পরিমাণ মালপত্র বিনা ভাড়ায় নেওয়ার অনুমতি রয়েছে, তাঁর সঙ্গে এরচেয়ে বেশি মালামাল রয়েছে। তাই তিনি যেখানে মাল ওজন করে অতিরিক্ত মালের ভাড়া উসুল করা হয় সেখানে যান। সেখানে যে অফিসারটি কর্মরত ছিল, সে ছিল অমুসলিম। কিন্তু সে হযরত থানভী রাহ.-কে চিনত এবং তাঁকে অত্যধিক শ্রদ্ধা করত। হযরত মাল বুক করার কথা বললে অফিসারটি বলল, মাওলানা! রেখে দিন। আপনার থেকে আর মালের ভাড়া কী নিব? আপনার মাল বুক করাতে হবে না। আমি গার্ডকে বলে দিচ্ছি, অতিরিক্ত মালের জন্য সে আপনাকে কিছুই বলবে না।
মাওলানা বললেন, এই গার্ড আমার সঙ্গে কতদূর পর্যন্ত যাবে?
-গাজীয়াবাদ পর্যন্ত। রেলওয়ে অফিসার উত্তর দিল।
-গাজীয়াবাদের পর কী হবে?
-এই গার্ড পরবর্তী গার্ডকেও বলে দেবে।
-দ্বিতীয় গার্ড কোন্ পর্যন্ত যাবে?
-সে কানপুর পর্যন্ত আপনার সঙ্গে যাবে।
-কানপুরের পর কী হবে?
-কানপুরের পর আর কী হবে? সেখানে তো আপনার সফরই শেষ হয়ে যাবে।
অবশেষে হযরত বললেন, না, আমার সফর তো অনেক দীর্ঘ, কানপুরে গিয়েও তা শেষ হবে না। এ দীর্ঘ সফর শেষ হবে সেই আখেরাতে গিয়ে। এবার বলুন, যখন আল্লাহ তাআলা আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তোমার মাল ভাড়া দেয়া ছাড়া কেন এবং কীভাবে নিয়ে গেলে? তখন কি এই গার্ডরা আমাকে কোনো প্রকার সাহায্য করতে পারবে?
তারপর মাওলানা তাদেরকে বোঝালেন, এই রেলের মালিক আপনি বা গার্ড নন। যতদূর আমি জানি, রেলওয়ে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আপনাকে বা গার্ডকে এই এখতিয়ারও দেয়া হয়নি যে, আপনারা যে যাত্রীকে ইচ্ছা বিনা টিকেটে কিংবা তার মাল বিনা ভাড়ায় রেলে তুলে দেবেন। তাই আপনার ছাড় দেয়ার সুযোগকে ব্যবহার করে যদি আমি ভাড়াবিহীন মাল বহন করি, এটা চুরির অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তাআলার সম্মুখে আমাকে এ অপরাধের জবাবদিহি করতে হবে। তখন আমাকে আপনার এই সুযোগের অনেক চড়া মূল্য দিতে হবে। বিধায় অনুগ্রহপূর্বক আমার কাছে থেকে পরিপূর্ণ ভাড়া নিয়ে নিন।
কথাগুলো শুনে রেলওয়ের সেই অফিসারটি মাওলানার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। তবে সে একথা স্বীকার করল যে, আপনার কথাই সঠিক। (যিক্র ও ফিক্র, পৃ. ১০৮-১০৯)
আরেকটি ঘটনা হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ.-এর নিজেই লেখেছেন। তিন লেখেন- আমি সাহারানপুর যাচ্ছিলাম। থানাভবন স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছি। এক নতুন আগন্তুক মৌলভী সাহেব ট্রেন থেকে নামলেন। তিনি দিল্লী থেকে আমার সাথেই সাক্ষাতের জন্য এসেছেন। বিষয়টি জানার পর বললাম, ‘আমি তো এখন সফরে যাচ্ছি, আপনার ইচ্ছা হলে সাহারানপুর পর্যন্ত আমার সাথে যেতে পারেন। ট্রেনে কথা হবে। টিকেট নিয়ে নিন।’ কিন্তু সময় ছিল না। তিনি টিকেট নিতে পারলেন না। গার্ডকে বলে ট্রেনে উঠে পড়লেন। যখন ট্রেন নানূতা স্টেশনে পৌঁছল- এটা থানাভবনের পরের স্টেশন- আমি তাকে বললাম, এখন গার্ডের কাছে যান এবং তাকে টাকা দিয়ে রশীদ নিয়ে নিন। সামনের জন্যও টিকেট কেটে ফেলুন। গার্ড তাকে বলল, থানাভবন (থেকে নানূতা) পর্যন্তের ভাড়া মাফ করে দিচ্ছি, এরপর নানূতা থেকে সাহারানপুরের টিকেট দিয়ে দিল।
মৌলভী সাহেব আমার কাছে এসে ঘটনাটা জানালে আমি বললাম, এটা তো না-জায়েয হয়েছে। গার্ড তো গাড়ির মালিক নয়... সে রেলওয়ের একজন কর্মচারীমাত্র। তার তো মাফ করার অধিকার নেই। আপনার উপর এই ভাড়াটা ঋণ হয়ে থাকছে, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবশ্যই আদায় করতে হবে, কিন্তু এখন তো গার্ডের কাছ থেকে এর রশীদ নেয়ার সুযোগ নেই। কাজেই আপনি পরে এই পরিমাণ অর্থের টিকেট কিনে তা ছিঁড়ে ফেলবেন। এভাবে রেলওয়েতে আপনার ভাড়া পৌঁছে যাবে।’
ঐসময় এক ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলোকও গাড়িতে ছিলেন। আগাগোড়া গোটা বিষয়টা লক্ষ্য করে তিনি বললেন, জনাব, আমি আমার একটি দুর্বলতা আপনাদের কাছে প্রকাশ করছি। যখন গার্ড তাকে বলল, নানূতা পর্যন্ত ভাড়া মাফ করে দিয়েছি, আমি মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম যে, এক গরীব বেচারার কিছু উপকার হল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমার খুশি হওয়াটা ঠিক ছিল না। আমি তো একটি অনৈতিক বিষয়ে খুশি হয়েছিলাম। ন্যায়ের কথা তো সেটাই, যা আপনি বলেছেন।
এই ঘটনা উল্লেখ করে হাকীমুল উম্মত বলেন-
میں کہتا ہوں کہ یہ تو ایک چھوٹی سی بات ہے، یہ تو اسلام کی ادنی جھلک ہے، اگر اہل انصاف ہمارے پاس چند روز رہیں تو ان کو اسلام کی بڑی بڑی خوبیاں معلوم ہونگی.
আমি বলি, এটা তো খুব সামান্য একটি ব্যাপার ছিল। এ তো ইসলামের খুব সামান্য একটি ঝলক মাত্র। ন্যায়নিষ্ঠ লোকেরা যদি আমাদের কাছে কিছুদিন থাকেন তাহলে তারা ইসলামের বড় বড় সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে পারবেন। -খুতুবাতে হাকীমুল উম্মত (মাহাসিনে ইসলাম), ৮/ ৫৪-৫৫
একটি বিষয় স্মরণ রাখা উচিত। ব্যক্তির হক যদি নষ্ট করা হয় তার কাছে ক্ষমা চাওয়া যায়, কিন্তু যদি সমষ্টিগত বা রাষ্ট্রীয় কোনো হক নষ্ট করা হয় তখন ক’জনের কাছে ক্ষমা চাওয়া যাবে?
এবার আরেকটি ঘটনা বলছি একদম প্রথম যুগের, যাকে বলা হয় ‘সোনালী যুগ’। প্রসিদ্ধ ঘটনা। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে এক রাখালের সাথে দেখা। তার কাছে ছিল বকরির বিরাট পাল। ইবনে উমর রা.-এর মনে তাকে পরীক্ষা করার ইচ্ছা জাগল। প্রস্তাব করলেন, এখান থেকে আমার কাছে একটা বকরি বিক্রি করে দাও! রাখাল বলল, আমি তো এগুলোর মালিক নই; আমি কেবল এগুলোর পাহারাদার।
ইবনে উমর রা. তাকে বুদ্ধি দিলেন, তুমি আমার কাছে বিক্রি করে মালিককে গিয়ে বলবে, একটা বকরি নেকড়ে খেয়ে ফেলেছে। সুবহানাল্লাহ, ঈমানদীপ্ত কণ্ঠে রাখাল যা বললেন, হৃদয়ে ঝাঁকুনি সৃষ্টি করার মতো। বাক্যটি ছিল-
فَأَيْنَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ؟
তাহলে আল্লাহ কোথায়?! (অর্থাৎ, মিথ্যা বলে যদিও মালিকের চোখ ফাঁকি দিতে পারব, কিন্তু আসল মালিক আমার আল্লাহ্কে কীভাবে ফাঁকি দিব?)
ইবনে উমর রা. হতভম্ব হয়ে গেলেন। ‘ফাআইনাল্লাহ’ ‘ফাআইনাল্লাহ’ বলে কান্না শুরু করলেন। তারপর ওই রাখাল ক্রীতদাসকে কিনে মুক্ত করে দিলেন। -তারিখু দিমাশক, ইবনে আসাকির ২৭/৩৮৫; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী, ২/৮৪৩
সত্য কথা হল, হৃদয়ে যখন আল্লাহর ভালবাসা ও পরকালের জবাবদিহির ভয় জাগরূক থাকবে, তখন কারো দ্বারা কেউ কষ্ট পাবে না। অন্যায়ভাবে কারো হক নষ্ট বা দখল হবে না।
প্রয়োজন তাকওয়া ও খোদাভীতির ব্যাপক অনুশীলন
দারুল উলূম দেওবন্দের নাম কে না জানে! শেষ যামানায় উম্মতের জন্য এক বিরাট রহমত এ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে অনেক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, যাদের পরিশীলিত জীবন যেন সাহাবায়ে কেরামের জীবনেরই জীবন্ত নমুনা। মুফতী শফী রাহ. বলেন, যাঁরা দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম দিককার উস্তায ছিলেন, তাঁরা ছিলেন নিঃস্বার্থ আমানতদার মানব। দারুল উলূমের ব্যস্ত সময়ে যদি তাঁদের কাছে কোনো মেহমান আসত, তাঁরা মেহমানের জন্য ব্যয়িত সময়টি নোট করে রাখতেন। গোটা মাস এভাবেই করতেন। মাসের শেষে তাঁরা এ বলে দরখাস্ত দিতেন যে, অমুক দিন অমুক সময় আমি ব্যক্তিগত কাজে দারুল উলূমের সময় নষ্ট করেছি। তাই আমার বেতন থেকে ওই পরিমাণে বেতন কেটে নেয়া হোক। -ইসলাহী খুতুবাত ৬/৮৮
সুবহানাল্লাহ, কেবল ইসলামের মধ্যেই রয়েছে এমন অনুভূতি জাগ্রত করবার শক্তি! কাজেই আইন-আদালত, নিয়ম-কানুন যতই সাজানো হোক, যতই ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক করা হোক, নিরাপত্তাবাহিনী বা সিসি ক্যামরা যতই বসানো হোক, বলার আর অপেক্ষা রাখে না, তাকওয়া ও ইসলামী শিক্ষার বিকল্প নেই। এই শিক্ষা ও অনুশীলনকে ব্যাপক করতেই হবে। সুতরাং সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষার বিলুপ্তি বা কাটছাট নয়; দেশের সকল বিভাগের সকল স্তরেই ইসলামী শিক্ষার অনুশীলন ও চর্চা ব্যাপক করা চাই।
আসুন, তাকওয়া ও খোদাভীতির চর্চা করি! সততা ও আমানতদারির পাঠ গ্রহণ করি! ব্যক্তি ও পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজ, সর্বত্র আল্লাহর ভয় এবং ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক অনুশীলন করি। তবেই আমরা লাভ করতে পারব একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ। হ