সাহাবায়ে কেরামের দৃঢ় ঈমান : কিছু দৃষ্টান্ত
ঈমান হচ্ছে সকল নিআমতের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও মূল্যবান নিআমত। ঈমান ছাড়া যাবতীয় আমল নিষ্ফল। আর ঈমান থাকলে ‘সামান্য’ আমলও দামি। ঈমান যত বিশুদ্ধ, মজবুত ও পরিপূর্ণ হবে ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, চলাফেরা, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র তত সুন্দর ও সমৃদ্ধ হবে।
সাহাবায়ে কেরামের ঈমান অত্যন্ত বিশুদ্ধ, মজবুত ও পরিপূর্ণ ছিল। তাঁদের অন্তরে ঈমান গেঁথে গিয়েছিল। তাঁদের ঈমান ছিল পর্বত-প্রমাণ।
সাহাবায়ে কেরামের জীবনে দুঃখ-কষ্ট এসেছে। কাফেররা তাঁদের উপর নির্যাতন করেছে। কাফেরদের একটাই দাবি ছিল, মুহাম্মাদের ধর্ম ছেড়ে দাও। তাহলে আমাদের থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। সেইসঙ্গে ছিল নানা প্রলোভন ও হাতছানি।
কিন্তু সাহাবীগণ এগুলো অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে বরণ করেছেন। ঈমান ও কুফর, তাওহীদ ও শিরকের প্রশ্নে তাঁরা কখনো আপস করেননি। সর্বদা ঈমানকে বুকে আগলে রেখেছেন। ঈমানের জন্য জান-মাল বিসর্জন দিয়েছেন। পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। রণাঙ্গনে তরবারি হাতে জিহাদ করেছেন।
আসলে সাহাবায়ে কেরাম ঈমানের স্বাদ পেয়েছিলেন। ঈমানের স্বাদ লাভের যাবতীয় উপকরণ তাঁদের মধ্যে বিরাজমান ছিল। আর ঈমানের স্বাদ অর্জিত হয়ে গেলে কোনো কষ্ট আর কষ্ট মনে হয় না!
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ: أَنْ يَكُونَ اللهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ المَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلّا لِلهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ.
যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে সে ঈমানের স্বাদ পাবে :
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সব থেকে প্রিয় হওয়া।
২. কাউকে শুধু আল্লাহর জন্য মহব্বত করা।
৩. কুফরের দিকে প্রত্যাবর্তন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত ঘৃণ্য হওয়া। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৬
রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের (তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি) মধ্যে নবীজী ও সাহাবীদের বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসা করেছিলেন এবং শেষে ওইসব বিষয়ে নিজের মন্তব্য ব্যক্ত করেছিলেন। তার মন্তব্যের একটি অংশ হল-
وَسَأَلْتُكَ أَيَزِيدُونَ أَمْ يَنْقُصُونَ، فَذَكَرْتَ أَنَّهُمْ يَزِيدُونَ، وَكَذَلِكَ أَمْرُ الإِيمَانِ حَتّى يَتِمَّ. وَسَأَلْتُكَ أَيَرْتَدُّ أَحَدٌ سَخْطَةً لِدِينِهِ بَعْدَ أَنْ يَدْخُلَ فِيهِ، فَذَكَرْتَ أَنْ لاَ، وَكَذَلِكَ الإِيمَانُ حِينَ تُخَالِطُ بَشَاشَتُهُ القُلُوبَ.
আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তারা (মুহাম্মাদের অনুসারীরা) বাড়ছে, না কমছে। তুমি বলেছ, বাড়ছে। আসলে ঈমানের বিষয়টি এমনই, তা পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত মুমিনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, ইসলাম গ্রহণের পর কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে তা ত্যাগ করে কি না। তুমি বলেছ, না। আসলে ঈমান এমনই হয় যখন এর স্বাদ অন্তরে গেঁথে যায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭
বিশিষ্ট সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. সাহাবীদের সম্পর্কে বলেছেন-
الْإِيمَانُ فِي قُلُوبِهِمْ أَعْظَمُ مِنَ الْجِبَالِ.
তাঁদের অন্তরে ঈমান পাহাড়ের চেয়েও দৃঢ় ছিল। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ২০৬৭১
সাহাবায়ে কেরামের দৃঢ় ঈমানের ঘটনাবলি হাদীস, সীরাত, তারীখ ও তারাজিমের কিতাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাঁদের গোটা জীবনই ছিল অটল ঈমানের প্রতিচ্ছবি। ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, চলাফেরা, আখলাক-চরিত্র...সর্বত্র ছিল তাঁদের সুন্দর ঈমানের ছাপ। এখানে আমরা বিশেষভাবে ঈমানের সঙ্গে সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত কিছু ঘটনা উল্লেখ করব।
এক.
সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. ইসলাম গ্রহণের আগে থেকেই মায়ের প্রতি যত্নবান ও সদাচারী ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁর মা বলল, তুমি এ কী দ্বীন গ্রহণ করেছ? তুমি তা ত্যাগ করো, নতুবা আমি পানাহার ছেড়ে দেব। আমি না খেয়ে মারা গেলে মানুষ তোমাকে মাতৃহন্তা বলবে। সা‘দ রা. বললেন-
لَا تَفْعَلِي يَا أُمَّ، إِنِّي لَا أَدَعُ دِينِي هَذَا لِشَيْءٍ.
আম্মা! আপনি এমন করবেন না। আমি আমার দ্বীন কিছুতেই ত্যাগ করতে পারব না।
এ কথা শুনেও তাঁর মা দুই দিন না খেয়ে কাটাল। এতে মহিলা ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ল। মহিলা ভেবেছে, এই অবস্থা দেখলে তার মা-ভক্ত ছেলের অন্তরে ‘দয়া’র সৃষ্টি হবে এবং মাকে বাঁচানোর জন্য সে ইসলাম বর্জন করবে! কিন্তু সা‘দ রা. এবার আরো পরিষ্কার ভাষায় বললেন-
يَا أُمَّهْ، تَعْلَمِينَ وَاللهِ يا أُمَّهْ، لَوْ كَانَتْ لَكِ مِائَةُ نَفْسٍ فخَرَجَتْ نَفْسًا نَفْسًا، مَا تَرَكْتُ هَذَا لِشَيْءٍ، إِنْ شِئْتِ فَكُلِي، وإِنْ شِئْتِ فَلَا تَأْكُلِي.
আম্মাজী! আপনি জেনে রাখুন, আল্লাহর কসম, আপনার যদি এক শ প্রাণ থাকত আর সবগুলো একের পর এক বের হয়ে যেত, তবু আমি আমার দ্বীন ত্যাগ করতাম না। আপনার ইচ্ছে হলে খেতে পারেন আর ইচ্ছে না হলে নাও খেতে পারেন। -তারীখে দিমাশক ২০/৩৩১; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১/১০৯; [মূল ঘটনাটি সহীহ মুসলিমেও (বর্ণনা নং ১৭৪৮) রয়েছে।]
এ ঘটনা থেকে আন্দায করা যায় সা‘দ রা.-এর ঈমান কত দৃঢ় ছিল! যার কাছে জন্মদাতা মাও হার মানায়, যেখানে পৃথিবীর সবকিছু একদিকে আর ঈমান আরেকদিকে। সবকিছু ত্যাগ করা সম্ভব, ঈমানত্যাগ সম্ভব নয়। সা‘দ রা. তাঁর মাকে ভালবাসতেন এবং মায়ের প্রতি সদাচারীও ছিলেন; এজন্যই মা তাকে ঈমান থেকে ফেরানোর জন্য ‘মায়ের ভালবাসা’কেই অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আপনাকে ভালবাসি ঠিকই মা, কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে বেশি নয়, ঈমান ও সত্য দ্বীন থেকে বেশি নয়। কারণ, ঈমানবিহীন জীবন জীবনই নয়।
দুই.
সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.-এরই আরেকটি ঘটনা, তিনি বলেন, আমি সপ্তম ইসলাম গ্রহণকারী ছিলাম। হুবলা বা হাবলা (এক প্রকার গাছ)-এর পাতা ছাড়া আমাদের খাওয়ার আর কিছু ছিল না। (এরূপ খাবারের কারণে) আমাদের কেউ কেউ বকরির মত (শক্ত ও শুকনো) মলত্যাগ করত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৪১২
এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সা‘দ রা. ও তাঁর সঙ্গীদের অন্তরে ঈমান গেঁথে গিয়েছিল। তাঁরা ঈমানকে পৃথিবীর সবকিছু থেকে মূল্যবান মনে করতেন। এজন্য গাছের পাতা খেয়ে দিন যাপন করেছেন। তবু ঈমান ছাড়েননি।
তিন
উমর রা. ইসলাম গ্রহণের আগে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন। আল্লাহর রহমতে তিনি ইসলামের ছায়াতলে চলে আসেন। এতে পুরো কুরাইশে হইচই পড়ে যায়। মুসলমান হওয়ার পর তিনি জানতে চাইলেন, কুরাইশের কে সংবাদ প্রচার করে? একজন বলল, জামিল ইবনে মা‘মার। তিনি জামিল ইবনে মা‘মারের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি কি জানো, আমি মুসলমান হয়ে গেছি এবং মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দ্বীন গ্রহণ করেছি? জামিল উত্তর না দিয়ে ত্বরিত উঠে দাঁড়াল। উমর রা. তার পেছনে চললেন। জামিল কা‘বার দরজায় গিয়ে ঘোষণা করল, হে কুরাইশ, ইবনুল খাত্তাব ‘সাবী’ হয়ে গেছে!
উমর রা. পেছন থেকে প্রতিবাদ করে বললেন-
كَذَبَ، وَلَكِنِّي أَسْلَمْتُ وَآمَنْتُ بِاللهِ وَصَدّقْتُ رَسُولَهُ.
সে মিথ্যা বলেছে; আমি বরং ইসলাম গ্রহণ করেছি, আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর রাসূলকে বিশ্বাস করেছি।
এ কথা শোনামাত্র কুরাইশের লোকেরা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সূর্য মাথার উপর ওঠা পর্যন্ত লড়াই চলল। একপর্যায়ে উমর রা. ক্লান্ত হয়ে বসে গেলেন। কুরাইশের লোকেরা তাঁর মাথার উপর দাঁড়িয়ে রইল। তিনি তাদের বলছিলেন-
افْعَلُوا مَا بَدَا لَكُمْ، فَوَاللهِ لَوْ كُنّا ثَلَاثَمِائَةِ رَجُلٍ لَقَدْ تَرَكْتُمُوهَا لَنَا أَوْ تَرَكْنَاهَا لَكُمْ.
তোমাদের যা ইচ্ছা কর। আল্লাহর কসম, আমরা যদি তিন শ লোক হতাম তাহলে তোমাদেরকে মক্কা ছেড়ে চলে যেতে হত। নতুবা আমরা মক্কা ছেড়ে চলে যেতাম।
এমতাবস্থায় রেশমি কাপড় পরিহিত এক লোক এসে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কী হয়েছে? তারা বলল, উমর ‘সাবী’ হয়ে গেছে। লোকটি বলল, তাকে ছেড়ে দাও। একজন নিজের জন্য একটা ধর্ম পছন্দ করেছে, এতে তোমাদের কী? তোমরা কি মনে কর, বনী আদী তাদের লোককে তোমাদের হাতে এমনিতেই ছেড়ে দেবে? তাকে ছেড়ে দাও।
একথা শুনে কুরাইশের লোকেরা উমর রা.-কে ছেড়ে দিল। মনে হল তাঁর শরীর থেকে যেন একটা চাদর সরিয়ে নেওয়া হল। -সহীহ ইবনে হিব্বান, বর্ণনা ৬৮৭৯; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩৭৪
এ ঘটনা প্রমাণ করে উমর রা.-এর ঈমান অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। তাই ঈমানের জন্য তিনি কাফেরদের মারধর-নির্যাতন হাসিমুখে বরণ করেছেন। শুধু তাই নয়; তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কাফেররা যা খুশি করতে পারে, কিন্তু তিনি ঈমান ত্যাগ করবেন না।
চার.
খাব্বাব ইবনে আরাত রা. জাহেলী যুগে কর্মকার ছিলেন। আস ইবনে ওয়াইলের কাছে তাঁর কিছু দিরহাম পাওনা ছিল। পাওনা চাইতে গেলে আস বলল, আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদের সঙ্গে কুফরী না করলে আমি তোমার পাওনা পরিশোধ করব না। খাব্বাব রা. বললেন-
لاَ، وَاللهِ لاَ أَكْفُرُ بِمُحَمَّدٍ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، حَتّى يُمِيتَكَ اللهُ ثُمَّ يَبْعَثَكَ.
আল্লাহর কসম, তুমি যদি মারা যাও তারপর পুনরায় জীবিত হও, তবু আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কুফরী করব না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪২৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৯৫
আস ইবনে ওয়াইল মনে করেছিল, খাব্বাব রা. পাওনার জন্য কুফুরী করে ফেলবেন; কিন্তু খাব্বাব রা. তাকে জানিয়ে দিলেন, ঈমানের বিপরীতে অর্থ-বিত্ত কিছুই না। অর্থের জন্য কুফরী করা সম্ভব না; কস্মিনকালেও না।
পাঁচ.
উমর রা. তখন আমীরুল মুমিনীন। ইসলামের জয়ধ্বনি চতুর্দিকে বেজে গেছে। বাজতে শুরু করেছে প্রসিদ্ধ শহর শামেও। এই শহরের অবস্থা-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি রওনা হলেন। সঙ্গে ছিলেন শহরের গভর্নর আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রা.।
উমর রা. উটে করে চললেন। দীর্ঘ পথ। চলতে চলতে সামনে একটা অগভীর পানির স্থান পড়ল। তিনি উট থেকে নামলেন। মোজা জোড়া খুলে কাঁধে রাখলেন। তারপর উটের লাগাম ধরে পায়ে হেঁটে স্থানটি পার হলেন। আবু উবায়দা রা. বললেন, আপনি আমীরুল মুমিনীন হয়ে এমন করছেন! আমার মনে হয় না, শহরবাসী আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে!
উমর রা. তাঁকে ধমক দিয়ে বললেন-
إِنَّا كُنَّا أَذَلَّ قَوْمٍ، فَأَعَزَّنَا اللهُ بِالْإِسْلَامِ، فَمَهْمَا نَطْلُبُ الْعِزَّةَ بِغَيْرِ مَا أَعَزَّنَا اللهُ بِهِ، أَذَلَّنَا اللهُ.
আমরা ছিলাম অপদস্থ জাতি। আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমে আমাদের সম্মানিত করেছেন। আমরা যদি ইসলাম ছাড়া অন্যভাবে সম্মান খুঁজি তাহলে তিনি আমাদের অপদস্থ করে ছাড়বেন। -মুসতাদরাকে হাকেম ১/১১৯-১২০
এ থেকে বোঝা যায় উমর রা.-এর অন্তরে শুধু ইসলামই প্রোথিত হয়নি; বরং এই অনুভূতিও বদ্ধমূল হয়েছিল যে, একমাত্র ইসলামেই সম্মান নিহিত। ইসলাম ছাড়া অন্যপথে সম্মান খুঁজলে কপালে শুধু লাঞ্ছনাই মিলবে।
ছয়.
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে দান-সদকার প্রতি উৎসাহিত করলেন। তখন উমর রা.-এর কাছে বেশ সম্পদ ছিল। তিনি অর্ধেক সম্পদ দান করলেন। আর আবু বকর রা. ঘরে যা ছিল সব নিয়ে এলেন। নবীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি বললেন-
أَبْقَيْتُ لَهُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ.
আমি তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৬৭৫
ঘরের সবকিছু আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়ে এমন কথা বলতে পারা কেবল আবু বকর রা.-এর মত পর্বতসম ঈমানদারের পক্ষেই সম্ভব। আমরা শুধু সে ঈমানের আলো থেকে কিঞ্চিৎ আলো লাভের আশায় তাঁদের ঘটনাগুলো বারবার পড়ি, বারবার শুনি।
সাত.
মক্কা-জীবন সাহাবায়ে কেরামের জন্য কঠিন পরীক্ষা ছিল। যিনি-ই ইসলাম গ্রহণ করতেন কাফেররা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। কাফেরদের অত্যাচার থেকে কেউই নিরাপদ থাকেননি; নবীজীও নন। তাদের নির্যাতনের কারণে ইবাদত-বন্দেগী করা তো দূরের কথা, ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকাই দায় ছিল।
সাহাবায়ে কেরাম নবীজীর নির্দেশে নিরাপদে দ্বীন চর্চার লক্ষ্যে ঘরবাড়ি ও অর্থসম্পদ ছেড়ে নিঃস্ব হয়ে হাবাশা-মদীনা হিজরত করেন। এই হিজরত তাঁদের ঈমানের দৃঢ়তার এক জ্বলন্ত সাক্ষী।
একবার আবু বকর রা. হাবাশা হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বের হয়ে যান। পথে মক্কার এক নেতা ইবনুদ দাগিনার সঙ্গে দেখা হল। ইবনুগ দাগিনা জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আবু বকর রা. বললেন, আমার সম্প্রদায় আমাকে বের করে দিয়েছে। আমি এখন ইচ্ছে করেছি, শহর-নগরে ঘুরব আর আল্লাহর ইবাদত করব। সে বলল, আপনার মত মানুষ মক্কা ছেড়ে চলে যেতে পারেন না এবং আপনার মত মানুষকে বের করে দেওয়া যায় না। আপনি নিঃস্বকে সাহায্য করেন। আত্মীয়তা রক্ষা করেন। অক্ষমের বোঝা বহন করেন। মেহমানদারি করেন। দুর্যোগে মানুষকে সাহায্য করেন। আমি আপনাকে আশ্রয় দেব। আপনি ফিরে যান এবং নিজ শহরে গিয়ে আপনার প্রতিপালকের ইবাদত করুন।
আবু বকর রা. মক্কা ফিরে এলেন। ইবনুদ দাগিনা কুরাইশের নেতাদের বলল, আবু বকরের মত মানুষ মক্কা ছেড়ে চলে যেতে পারেন না এবং তার মত মানুষকে বের করে দেওয়া যায় না। আপনারা কি এমন লোককে বের করে দিচ্ছেন, যিনি নিঃস্বকে সাহায্য করেন, ...।
ইবনুদ দাগিনার আশ্রয়কে কুরাইশের নেতারা মেনে নিল। কিন্তু তারা ইবনুদ দাগিনাকে বলল, তুমি আবু বকরকে বলে দাও, সে যেন নিজের ঘরে ইবাদত করে। নামায পড়ে এবং যত খুশি তিলাওয়াত করে। তবে তা দ্বারা যেন আমাদের কষ্ট না দেয় এবং প্রকাশ্যে না করে। কেননা প্রকাশ্যে করলে আমাদের স্ত্রী-পুত্ররা ফেতনায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়।
ইবনুগ দাগিনা কথাগুলো আবু বকর রা.-কে জানিয়ে দিল। আবু বকর রা. নিজের ঘরেই ইবাদত করতে থাকেন। ঘর ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ্যে নামায ও তিলাওয়াত করতেন না। কিছুদিন পর তাঁর মনে অন্য এক খেয়াল এল। তিনি ঘরের আঙিনায় নামাযের জায়গা করে সেখানে নামায ও তিলাওয়াত করতে লাগলেন। কাফেরদের স্ত্রী-সন্তানরা সেখানে ভিড় জমাতে শুরু করে। তারা মুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। আবু বকর রা. কোমল হৃদয়ের ছিলেন। তিলাওয়াতের সময় চোখের পানি ধরে রাখতে পারতেন না।
এতে কুরাইশের নেতারা ঘাবড়ে গেল। তারা ইবনুগ দাগিনাকে ডেকে বলল, আমরা এই শর্তে তোমার নিরাপত্তা বহাল রেখেছিলাম যে, সে নিজের ঘরে ইবাদত করবে। কিন্তু সে তা অমান্য করে ঘরের আঙিনায় নামাযের স্থান করে সেখানে নামায ও তিলাওয়াত করছে। আমাদের আশঙ্কা হয়, এতে আমাদের স্ত্রী-পুত্ররা ফেতনার শিকার হবে। তুমি তাকে বল, সে যদি নিজের ঘরে ইবাদত করে তবে ঠিক আছে। কিন্তু প্রকাশ্যে করলে যেন তোমার নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেয়। ইবনুগ দাগিনা আবু বকর রা.-কে তা জানালে তিনি বললেন-
إِنِّي أَرُدُّ إِلَيْكَ جِوَارَكَ، وَأَرْضَى بِجِوَارِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ.
আমি তোমার নিরাপত্তা ফেরত দিচ্ছি। আমি আল্লাহ তাআলার নিরাপত্তায় সন্তুষ্ট। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৯০৫
শত্রুর চতুর্মুখী হুমকি সত্ত্বেও নিরাপত্তার আশ্রয় ফিরিয়ে দেওয়া তো তাঁদের পক্ষেই সম্ভব, যাদের রয়েছে রব্বুল আলামীনের আশ্রয়ের প্রতি পূর্ণ ঈমান ও তাওয়াক্কুল।
তাঁদের মত দৃঢ় ঈমানই তো মুমিনের জীবন সাধনা। আল্লাহ আমাদেরও দান করুন সাহাবীদের মত দৃঢ় ঈমান। হ