ঈমানী শক্তি ও নিয়তের শক্তি কাজে লাগিয়ে মুজাহাদার পথে অগ্রসর হই
খুতবায়ে মাসনূনাহর পর...। প্রথমে একটা কথা বলি। যে কোনো দ্বীনী কাজ নিয়মিত করার অনেক গুরুত্ব। এটি কোনো ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে খাস বা নির্ধারিত নয়। ঢাকা আজিমপুরের ১৩৬ নম্বর বাড়িতে সাপ্তাহিক একটা মাহফিল হত। আমি সেখানে নিয়মিত যেতাম। রমযান ছাড়া অন্য সময় মাহফিল হত প্রতি শনিবারে আর রমযানে হত জুমাবার সকালে জুমার আগে। কোনো ওজরের কারণে রমযানের এক জুমায় আমি যেতে পারিনি। সেদিন ঘোষণা হয়েছিল, আগামী জুমার দিন যেহেতু (৩০ রমযান) সম্ভাব্য ঈদের দিন, সেদিন মাহফিল হবে না। কিন্তু আমি এটা জানতাম না, আমি চলে গিয়েছি। গিয়ে তো কাউকে পাচ্ছি না। সব বন্ধ। বেশ সময় ধরে অপেক্ষা করেছি। আমার মতো আরো এক-দু’জনও এসেছেন। আমরা সেখানে অপেক্ষা করছিলাম। তখন সেই মুরব্বী, যার উদ্দেশ্যে আমরা যেতাম, হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান সাহেব (প্রফেসর হলেও তিনি আলেম-উলামা ও বুযুর্গদের সোহবতপ্রাপ্ত মুরব্বী) বললেন, তোমরা যে ক’জন এসেছ, একজন কিতাব থেকে পড়ো, অন্যরা শোনো! শুধু একজন থাকলে সে নিজে একা একাই পড়বে। কিছুক্ষণ পড়ে মুনাজাত করে চলে যাবে। ব্যস, হয়ে গেছে।
প্রতি সোমবারে মাহফিলের জন্য বড় আয়োজন হয়, অনেক লোকজন আসে, অনেক হুজুর বয়ান করেন। কিন্তু এসব না হলে যে মাহফিল হবে না, এমন কথা নয়। তাই আমরা যে ক’জনই এখানে আসি, বসে যেতে পারি। ওই মসজিদে বসি আর এই মসজিদে বসি। মাঠে বসি আর বারান্দায়, এক জায়গায় বসে আমল শুরু করলেই হয়ে যায়। দু-চার কথা আলোচনা হল। যেগুলোর তালীম এখানে হয়, সেগুলো না পারলেও ফাযায়েলে আমলের তালীম করি! আর যদি এমন হয়, তালীমের জন্য কোনো কিতাবও খুঁজে পাওয়া গেল না, তাহলে নিজেরা বসে দুআ-যিকির করি, দরূদ শরীফ পড়ি। হুজুরদের কাছে যা শুনেছি, শিখেছি, সেগুলো থেকে কিছু নিজেরা আলোচনা করি। মাদরাসা ছুটি চলছে মনে করে চলে যাওয়া- এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। অন্তত জিজ্ঞেস করে তো যেতে হবে। জিজ্ঞেস করা ছাড়া চলে যাওয়া বা জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়ার আগে চলে যাওয়া বা জিজ্ঞেস করেছি এবং বুঝেছি, আজকের মাহফিল তেমন জমবে না, ফলে চলে গেলাম- এটা ঠিক নয়। কারণ মাহফিলের জন্য অনেক বড় মজলিস হতে হয় না, অনেক বক্তা হতে হয় না এবং অনেকক্ষণ বয়ান করতেও হয় না।
এই যে, আজকের মজলিস তো হয়ে গেল। আমরা বসলাম, কিছু কথা হল, এটাও দ্বীনের কথা। এমন যেন আমাদের কখনো না হয় যে, মাহফিলের তারিখে এলাম না, কিংবা এলাম, কিন্তু আয়োজন না দেখে চলে গেলাম। না, মাহফিলের জন্য আয়োজন শর্ত নয়। প্যান্ডেল লাগানো, মাইক লাগানো, অনেক শ্রোতা হওয়া, অনেক বক্তা হওয়া- কিছুই শর্ত নয়। মাহফিল মানে দ্বীনী মুযাকারা। এমনকি একজনও যদি আসে এবং মাহফিল শোনার জন্য নিয়ত করে আসে, এসে কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে, যিকির করে, এরপর চলে যায়, ব্যস, এটাও মাহফিল।
আর আজকে জমজমাট মাহফিলই হবে- ইনশাআল্লাহ। কারণ আজকে এখানে অনেক বড় বড় হুজুর আছেন। যেখানে শুধু আপনাদেরকে দিয়েই মাহফিল হয়ে যায়, সেখানে যদি এত বড় বড় হুজুর থাকেন, তাহলে তো আল্লাহর রহমত!
মাহফিলের নেযাম কী? আসরের পরে তালীম হয়। মাগরিবের পরে মশক হয়। তারপর বয়ান হয়। প্রশ্নোত্তর হয় এবং দুআ হয়। মাহফিলের এ পাঁচটা পর্ব। এই সবই আজকে হবে- ইনশাআল্লাহ।
(‘ইসলাহী মাজালিস’ থেকে তালীম হয়েছে এবং হুজুর ব্যাখ্যা ও আলোচনা করেছেন। বলেছেন,)-
মাথায় বিভিন্ন চিন্তা, বিক্ষিপ্ত দুশ্চিন্তা ও খারাপ চিন্তা আসে। চিন্তা আসা মাত্রই আমাদের উচিত, কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া। চিন্তা দূর করার জন্য পেরেশান হওয়া বেকার ও বেহুদা কাজ। এর কোনো ফায়দা নেই। উচিত হল, সাথে সাথে কোনো আমলে লেগে যাওয়া। অজু করে দুই রাকাত নামায পড়া বা কুরআম মাজীদ তিলাওয়াত শুরু করা। বা কোনো মুরব্বী, যেমন নিজের আম্মা-আব্বার কাছে গিয়ে বসে থাকা! উস্তাযের কাছে গিয়ে বসে থাকা! ব্যস। অর্থাৎ দুনিয়ার কাজ হোক আর দ্বীনের কাজ হোক, কোনো না কোনো কাজে লেগে যাওয়া। এভাবে নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখলে দুশ্চিন্তা, ওয়াসওয়াসা, কুমন্ত্রণা, খারাপ চিন্তা, সবই দূর হতে থাকবে- ইনশাআল্লাহ। বেকার থাকলেই ক্ষতি। ব্যস, আজকের তালীম হয়ে গেল!
(তারপর কিছুক্ষণ কুরআনে কারীমের মশক হয়েছে। এরপর বয়ানে হুজুর বলেন,)
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ الَّذِیْنَ جَاهَدُوْا فِیْنَا لَنَهْدِیَنَّهُمْ سُبُلَنَا ؕ وَ اِنَّ اللّٰهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِیْنَ
অর্থাৎ, যারা আল্লাহর রাস্তায় মুজাহাদা করে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ পথে পরিচালিত করেন। [সূরা আনকাবুত (২৯) : ৬৯]
মুজাহাদা করলে অনেক ফায়দা। দ্বীনের উপর চলাও সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ ধরে ধরে দ্বীনের ওপর চালান।
কাকে বলে মুজাহাদা?
মুজাহাদা হল নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে চলা। নফস ও শয়তানের কথা না শোনা। নফস ও শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে দূরে থাকা।
প্রত্যেক বদ অভ্যাস দূর করার জন্যই মুজাহাদার প্রয়োজন। একজনের বদ অভ্যাস, কেবল মোবাইল টেপে। বেহুদা ও অনর্থক কাজে সময় নষ্ট করতে থাকে। কারো বদ অভ্যাস গীবত করা। এভাবে একেকজনের একেক বদ অভ্যাস। যত জনের যত বদ অভ্যাস, সব দূর করার জন্য মুজাহাদার প্রয়োজন হয়।
কীভাবে বদ অভ্যাস দূর হবে?
বদ অভ্যাস দূর করার জন্য নিজের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। ঈমানী শক্তি এবং প্রতিরোধ শক্তি বাড়াতে হবে। প্রতিরোধ বলতে নফস ও শয়তানের আক্রমণ প্রতিরোধ করার শক্তি। আরেক লাগবে নিয়তের শক্তি। আসলে ঈমানী শক্তি আর নিয়তের শক্তির সমন্বয়েই তৈরি হয় প্রতিরোধ-শক্তি। বদ অভ্যাস দূর করার জন্য যে প্রতিরোধ-শক্তি দরকার, নফস ও শয়তানের বিরোধিতার জন্য যে প্রতিরোধ-শক্তির প্রয়োজন, সেটি অর্জিত হয় ঈমানী শক্তি এবং নিয়তের শক্তির মাধ্যমে। এ দুই শক্তির যত ব্যবহার হবে, ততই বদ অভ্যাস দূর করা সহজ হবে। ততই নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়া সহজ হবে।
কিন্তু যদি এই দুই শক্তিকে ব্যবহার না করি, বরং নিজে হার মানতে থাকি, তাহলে কখনোই নফসের বিরোধিতা করা সম্ভব হবে না। শয়তানের বিরোধিতা করা সম্ভব হবে না। হালকা থেকে হালকা কোনো বদ অভ্যাসই দূর করা সম্ভব হবে না। কথার কথা, একজন জর্দা খায়, জর্দা ছাড়া তার পান চলে না। ডাক্তার কাউকে ব্যবস্থাপত্রের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং এড়িয়ে যেতে বলেছেন। তার মিষ্টি খাওয়ার আদত, ডাক্তার বলেছেন, মিষ্টি খেতে পারবে না। তাহলে কীভাবে সে মিষ্টি খাওয়া ছাড়বে? কীভাবে জর্দা ছাড়বে? এগুলোর কোনো কোনোটি সরাসরি বদ অভ্যাস নয়, বরং ডাক্তারের পরামর্শে সাময়িক বিরত থাকতে হবে। আর জর্দার তো এমনিতেই ক্ষতি আছে। তাছাড়া জর্দা একেবারে কোনো ধরনের মাকরূহ বা অনুত্তম পর্যায়েও যে যায় না- এমনটা বলা মুশকিল।
যাইহোক, ডাক্তার যখন নিষেধ করেছেন, ছাড়তে হবে আপনাকে। অথবা পানের পাতা খেতে পারবেন, চুন-সুপারি খেতে পারবেন না। কী করবেন তখন? এগুলো ছাড়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই মুজাহাদা করতে হবে। সহজে ছাড়া যাবে না।
একজন বলেছিল, পান ছাড়া অনেক কঠিন! পান ছাড়া যায় না! আরেকজন বলে উঠল, ‘কে বলেছে ছাড়া কঠিন? আমি ত্রিশ বার ছেড়েছি’!
কত সহজ যে, তিনি ছাড়েন আবার শুরু করেন। এমনকি ত্রিশ বার ছেড়েছেন!
তো ত্রিশ বার ছাড়লেন, অথচ ছাড়তে পারলেন না! কিন্তু যেদিন আপনি নিয়তের শক্তি প্রয়োগ করবেন, পাকা নিয়ত করবেন যে- ‘আমি খাব না! খাব না বলেছি, খাব না, ইনশাআল্লাহ! যা হওয়ার হোক, আমি আর খাবই না; সেদিন থেকে আপনার এই অভ্যাস দূর হতে থাকবে- ইনশাআল্লাহ। এভাবে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হয়। এটা হল নিয়তের শক্তি। এটাকে আরবীতে বলা হয় আয্ম বিল জায্ম (عزم بالجزم) পাকাপোক্ত ইচ্ছা, আবার সঙ্গে দৃঢ় মনোবল। এমন পাকা নিয়ত এবং এমন মজবুত হিম্মত খুব দরকার। আল্লাহর এক ওলী নিজ মুনাজাতে এই সিফাতটিই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন-
تلون مزاجی مری ختم کر + مرے عزم کو تو عطا جزم کر
এটি মূলত হাদীস শরীফে শেখানো দুআ থেকে নেয়া-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الثَّبَاتَ فِي الأَمْرِ، وَأَسْأَلُكَ عَزِيمَةَ الرُّشْدِ.
(জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪০৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৩৫)
যা হোক যে কোনো বদ অভ্যাস ছাড়ার জন্য নিয়তের শক্তি আর ঈমানী শক্তি ব্যবহার করে মানুষকে মুজাহাদা করতে হয় নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে। আর যে কোনো অভ্যাস পরিবর্তন করার জন্যই মানুষকে প্রথমে যেটা করতে হয় সেটা হল নিয়ত বা ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগানো। বদ অভ্যাসের জন্য তো লাগেই, বৈধ কোনো অভ্যাস পরিবর্তনের জন্যও নিয়তের শক্তির প্রয়োজন। মানুষের যিন্দেগী চলার জন্য অভ্যাসের দাস হয়ে থাকা ভালো লক্ষণ নয়। আপনি যদি শান্তির যিন্দেগী চান, তবে নিজেকে কখনোই অভ্যাসের দাস বানাবেন না। অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণে না রেখে বরং যদি অভ্যাসের দাস বনে যান, তাহলে বিপদ আছে। বৈধ অভ্যাসের কথা বলছি! সেক্ষেত্রেও নিজেকে কখনো ওই বৈধ অভ্যাসের দাস বানানো যাবে না। যেমন দৈনিক নাস্তা খাওয়ার অভ্যাস। এটা একটা বৈধ অভ্যাস। একদিক থেকে ভালোও। কিন্তু এমন হওয়া যাবে না যে, কোনোদিন হঠাৎ বাসায় নাস্তার ব্যবস্থা হল না, আপনিও জানেন না। আবার আপনি নিজের নাস্তা নিজে ব্যবস্থা করতেও পারেন না। তাহলে কী উপায় হবে? ক্ষুধায় কাতর হয়ে আছেন। না অফিসে যেতে পারলেন, না কাজ করতে পারলেন। ভেতরে গিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, নাস্তা কই! জবাব আসল, সন্তানরা সবাই অসুস্থ, নাস্তা বানাতে পারেনি। আর আপনি নিজেও পারেন না ঘরের নাস্তা বানাতে বা নিজের নাস্তা বানাতে! কিন্তু আপনার যদি অভ্যাসই এমন হয় যে, নাস্তা করলে ‘আলহামদু লিল্লাহ’, না করলেও খুব মসিবত বা ঝামেলার কিছু নয়, তাহলে আপনার জন্য চলা সহজ হবে। কাজেই নিজেকে কখনো অভ্যাসের দাস বানাতে নেই।
আপনার যদি এই অভ্যাস হয় যে, প্রতিদিন একেবারে শ্যাম্পু মাথায় দিয়ে গোসল করেন, তাহলে একদিন কোথাও সফর করেছেন, পথে যানজটের কারণে ঠিক সময়ে বাড়িতে পৌঁছতে পারেননি, গোসলও করতে পারেননি; বা দৈনিক দুই বার গোসল করার অভ্যাস, আজকে এক বারও পারলেন না; সাবান দিয়ে গোসল করতেন, আজকে সাবান নেই, এমনকি পানিও নেই, তাহলে কী অবস্থা হবে আপনার! জ্যামের মসিবত ও গরম, সঙ্গে তৃতীয় মসিবত যুক্ত হল কি না? কিন্তু আপনি যদি অভ্যাসের দাস না হন তাহলে তৃতীয় মসিবত আর আসবে না।
কাজেই মাঝে মাঝে এমন করুন, আজকে করব না গোসল! বা আজকে শুধু পানি ঢালব শরীরে, সাবান লাগাব না। মানুষ অনেক সময় বৈধ কাজের মধ্যে নিজেকে এমনভাবে অভ্যাসের দাস বানায় যে, সেটা না হলেই মাথাব্যথা হয়ে যায়, একটু ব্যতিক্রম হলেই আর বরদাশত হয় না, সহ্য করতে পারে না, তাহলে সে দুনিয়ারও কোনো বড় ভালো কাজ করতে পারবে না, দ্বীনেরও বড় কোনো ভালো কাজ করতে পারবে না।
এজন্য কেউ যদি নিয়ত ও ইচ্ছাশক্তি সঞ্চয় করতে চায়, যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করার মতো যোগ্যতা যদি অর্জন করতে চায়, তাকে অবশ্যই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে। নিজেকে বৈধ অভ্যাসেরও দাস বানানো যাবে না। আর বদ অভ্যাস এমনিতেই ছাড়তে হবে। তার দাস হওয়া তো দূরের কথা; সেটা এমনিতেই ত্যাগ করতে হবে।
যে লোক বৈধ বিষয়েও নিজেকে অভ্যাসের দাস বানায় না, তার জন্য বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করা সহজ। কারণ তার চর্চা ও অনুশীলন আছে। সে প্রতিরোধ-ক্ষমতা বাড়িয়েছে। ফলে তার জন্য যে কোনো বদ অভ্যাসের মোকাবেলা করা সহজ। এজন্য আমাদের বুযুর্গগণ বলেন, যে বৈধ কাজ তোমার করতে মন চাচ্ছে, করার সুযোগও আছে, সেখানে তুমি একটু ব্রেক লাগাও!
খুব ক্ষুধা লেগেছে। দস্তরখান সামনে আসা মাত্রই খাওয়া শুরু করব, এমন অবস্থা, এই সময়ও একটু সংযত হও!
এই যে এখানে পড়ার জন্য কিছু বই রাখা বা অন্য কোথাও আছে। জেনারেলদের জন্য জেনারেল বই, আমাদের জন্য দ্বীনী ইলমী বই। আমি হয়তো একটা বিষয় দীর্ঘদিন থেকে খুঁজছিলাম। হঠাৎ সেই বিষয়ের বই এখানে দেখতে পাচ্ছি। দেখেই স্বভাবগতভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ার কথা! কিন্তু আমি যদি পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, আধা ঘণ্টা নিজেকে স্থির রাখতে পারি, এটা একটা অনুশীলন হবে। এভাবে করতে পারলে আমার মধ্যে ধীরে ধীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ-শক্তি বাড়তে থাকবে। এই যে, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, আধা ঘণ্টা সবর করে থাকলাম, এর পরে ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে কিতাব হাতে নিলাম, পৃষ্ঠা উল্টালাম, আস্তে আস্তে পড়লাম। বরং হাতে নিয়েও কতক্ষণ বসে থাকলাম, তারপর খুললাম। এভাবে নিজের মধ্যে অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। মানে একদিকে মনের আকর্ষণ, অপরদিকে বিষয়টা যদি তাৎক্ষণিক পালন করার মতো কোনো বিষয় না হয়, তাহলে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা।
ঠিক এভাবে বদ অভ্যাসও দূর করতে হবে। কারো সিগারেটের বদ অভ্যাস। দৈনিক কয়েকটা খেতে হয়। তো এই লোক যখন নিজের চাহিদার মোকাবেলা করার কিছু অনুশীলন করবে তার জন্য সহজ হয়ে যাবে। কীভাবে করবে? সেটারও উপায় আছে। যেমন, প্রতিদিন আটটা বাজে খেত, আজকে নয়টা বাজে শুধু একটা খেয়েছে। তাহলে এই লোক যে আজকে এক ঘণ্টা দেরি করল, এটা তার একটা অনুশীলন। আগামী দিন দুই ঘণ্টা দেরি করে দশটা বাজাল। এর পরের দিন তিন ঘণ্টা পরে। কিছুদিন পর অর্ধেকটা করে খেল। এভাবে কিছুদিন গেল। এরপর কোনো দিন খায় আবার কোনোদিন খায় না। তারপর একদিন পাকা নিয়ত করল যে, এখন থেকে আর সিগারেট খাব না- ইনশাআল্লাহ। এই পাকা নিয়তটাই শক্তি। এই শক্তি যেদিন সে প্রয়োগ করবে সেদিন থেকে তার সিগারেটের বদ অভ্যাস দূর হয়ে যাবে- ইনশাআল্লাহ।
জায়েয কাজগুলোর মধ্যেও নিজের পছন্দের বিষয়গুলোতে সাড়া দিতে দেরি করা।
ইবাদত-বন্দেগীর কথা ভিন্ন। ইবাদত-বন্দেগীতে এমন অভ্যস্ত হওয়া উচিত যে, ছাড়লে মাথাব্যথা হয়। ইবাদতের এমন অভ্যাস আল্লাহ পছন্দ করেন যে, একেবারে নিয়মিত করা হয়, কোনোদিন ছাড়ে না। ফরয-ওয়াজিব তো নয়ই; নফলও কম হোক আর বেশি, নিয়মিত করে যাওয়া। বিশেষ ওজর ছাড়া বাদ না দেওয়া।
এছাড়া জাগতিক বিষয়ে আপনার কোনো বৈধ অভ্যাস থাকলে নিজের সেই অভ্যাসকে দু’রকম বানিয়ে দেবেন। এটাও করা যায়, ওটাও করা যায়। কোনোটাতে আটকে পড়ে থাকবেন না। এতে আপনার যিন্দেগী চলা সহজ হবে। আরেকটি বড় সুবিধা হল, যে কোনো বদ অভ্যাসের মোকাবেলা করা সহজ হবে। যেহেতু আপনি বৈধ অভ্যাসের ক্ষেত্রে নিজের পছন্দটাকে গ্রহণ করার জন্য ব্যস্ত হন না, তাই কোনো বদ অভ্যাসের পরিস্থিতি সামনে এলে তা থেকে আরো সহজে বেঁচে থাকতে পারবেন। কারণ এখানে বাড়তি সুবিধা হল, আপনি জানেন- বিষয়টা খারাপ। ফলে এই খারাপ অভ্যাস ছাড়া আপনার জন্য সহজ হবে।
ব্যস, অনেক কথা হয়ে গেল। সারকথা হল, বদ অভ্যাস ছাড়ার জন্য বৈধ অভ্যাসেরও দাস হওয়া যাবে না। অর্থাৎ কোনো বিষয় এমন অভ্যাসে পরিণত হওয়া যাবে না, যেটা না হলে একেবারে পেরেশান হতে হয়। অভ্যাস হয়ে গেলে তার বিপরীত অনুশীলন করে করে হালকা বানাতে হবে। করলেও ক্ষতি নেই, না করলেও কষ্ট নেই।
আর পছন্দের কোনো বৈধ জিনিস পেলেই তা গ্রহণ করার জন্য হুড়োহুড়ি না করে একটু দেরি করা। একটু সবর করা ও সংযত হওয়া। এভাবে একটু দেরি করে গ্রহণ করলে আপনার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ-শক্তি বাড়বে। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অন্য অনেক কাজ আপনি করতে পারবেন।
বদ অভ্যাস একটু একটু করে কমাতে থাকুন। দেখা যাবে, কাজটা সামনের দিনগুলোতে কোনো দিন হবে, কোনো দিন হবে না। আর হলেও একবারের বেশি হবে না। এভাবে করতে করতে একপর্যায়ে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ-শক্তি যখন আরো বৃদ্ধি পাবে, একদিন আপনি একেবারে ‘নাওয়াইতু...’-আল্লাহ, আমি পাকা নিয়ত করলাম বলতে পারবেন। যেমন নামাযের নিয়ত করা হয়। মানুষ নামাযের নিয়ত করলে নামায শেষ না করে নিয়ত ছাড়ে না। তেমনিভাবে এমন নিয়ত করা যে, জীবনভর এই কাজ আমি আর করব না। ব্যস, এটা যিন্দেগীর নিয়ত। নিয়তের শক্তি আর ঈমানের শক্তির সমন্বয় যতদিন আমরা করব না, ততদিন নফসের বিরোধিতা করা, শয়তানের বিরোধিতা করা এবং বদ অভ্যাস ত্যাগ করা সম্ভব হবে না। নিয়তের শক্তি ও ঈমানের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নফস ও শয়তানের বিরোধিতা করা, বদ অভ্যাস ছাড়ার জন্য নিজের নফস ও শয়তানের মোকাবেলা করার নামই হল মুজাহাদা। এই মুজাহাদা যে যে পরিমাণে করবে, সেই পরিমাণে সে সুফল পাবে। মুজাহাদা যদি করতে থাকে, একসময় পুরো দ্বীনের ওপর চলা তার জন্য সহজ হবে। কারণ আল্লাহর নুসরত ও সাহায্য সে পাবে। আল্লাহ বলেছেন-
وَ الَّذِیْنَ جَاهَدُوْا فِیْنَا لَنَهْدِیَنَّهُمْ سُبُلَنَا ؕ وَ اِنَّ اللّٰهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِیْنَ
যারা আমার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে উপনীত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৬৯
নিয়তের শক্তি আল্লাহর বড় দান। শর্ত হল এটাকে জাগ্রত করে ব্যবহার করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
[মাসিক দ্বীনী মাহফিল
মারকাযুদ দাওয়াহ জামে মসজিদ, হযরতপুর, কেরাণীগঞ্জ
০৭-১১-১৪৪৩ হি./৯-৫-২০২২ ঈ.
শ্রুতলিখন : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম]