মোবারকবাদ হাফেজ তাকরীম
বাদশাহ আবদুল আযীয কুরআন প্রতিযোগিতা
সৌদি আইডল এবং আমাদের হুজুগেপনা
বাংলাদেশের ছেলে হাফেয সালেহ আহমাদ তাকরীম সৌদি আরবে বাদশাহ আবদুল আযীয কুরআন প্রতিযোগিতায় ১১১টি দেশের মধ্যে তৃতীয় হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে আন্তরিক মোবারকবাদ। মোবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য তার পিতা-মাতা ও সম্মানিত উস্তাযগণও। বর্তমান দুনিয়ায় কত কিছুরই তো প্রতিযোগিতা হয়। সেখানেও এমন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ বিভিন্ন স্তরে পুরস্কৃত করা হয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলার কালাম মুখস্থ করা ও সুন্দর তিলাওয়াতের তুলনা তো নিজেই। সুতরাং পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই আল্লাহর কালাম সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করা হবে তার সৌরভ অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছড়াবেই। এমন একটি বড় প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়ার অর্থই হল, প্রতিযোগী আল্লাহর কালাম ভালোভাবে আত্মস্থ করেছে। নিজের দেশের একটি ছেলে এমন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরস্কার লাভ করলে স্বাভাবিক কারণেই মন আনন্দিত হয়।
হাফেয তাকরীমকে মোবারকবাদ দেওয়ার সাথে সাথে প্রসঙ্গের বিবেচনায় আরও দুয়েকটি কথা আরজ করতে চাই। এটি তো তার জীবনের প্রথম ধাপ মাত্র। এখনো সে শিশু বয়সে রয়েছে। হিফজুল কুরআনের পর সামনে তার পড়াশোনার পুরো জগৎ রয়ে গেছে। আল্লাহর কালাম মুখস্থ করার পর তার অর্থ-মর্ম বোঝা, সে অনুযায়ী নিজের জীবন গড়া এবং সে মর্মবাণী দুনিয়ার মানুষের কাছে প্রচারের দায়িত্ব নেওয়া- এ সবই একজন হাফেজে কুরআনের প্রধান কাজ। আর একজন প্রতিভাদীপ্ত মেধাবী ছাত্র তার ধ্যান-মন ইলমেদ্বীন ও সমাজের উপকারে নিবেদন করলে নিঃসন্দেহে প্রভূত উপকার ও উন্নয়ন সাধিত হয়। আমরা আশা করব, হাফেজ তাকরীমকে সে পথেই তার অভিভাবক ও উস্তাযগণ পরিচালিত করবেন। এই আশাবাদ ও নিবেদনের পেছনে অন্য আরেকটি কারণও রয়েছে। সেটি হচ্ছে, অতীতেও দেখা গেছে, এভাবে বিভিন্ন প্রতিভাবান হাফেজে কুরআন বিভিন্ন দেশে বড় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে, তাদেরকে নিয়ে মাতামাতিও হয়েছে, কিন্তু এর পরে তারা বড় আলেম হয়ে নিজেরা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে, সমাজের বড় কোনো খেদমতে লেগেছে- এমন কথা শোনা যায়নি; বরং কারও কারও ক্ষেত্রে উল্টো অভিযোগও শোনা যায় যে, তাদেরকে একশ্রেণির লোকেরা নিজেদের ব্যক্তি সুবিধা লাভের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাতে থাকে এবং নিজেদের প্রচারণা করতে থাকে। এতে করে ওই ছাত্রের মন-মানসে টাকা-পয়সা, দুনিয়ার মোহ ও জৌলুস জীবনের শুরুতেই ঢুকে পড়ে এবং একটি মেধাবী প্রতিভা অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায়।
এছাড়া আমাদের তো হুজুগে বাঙালী বলে একটা বদনামও রয়েছে। কোনো একটি বিষয় নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠা এবং সীমাহীন মাতামাতিতে লিপ্ত হওয়া আমাদের কিছু লোকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মনে পড়ছে, জেনারেল এরশাদের আমলে একজন আলেমেদ্বীন প্রতিমন্ত্রী হওয়ার কথা। এরশাদ তাঁকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। এরপরে যে শুরু হল মাতামাতি। আজ এ মাদরাসা, কাল ও মাদরাসা, আজ এ অনুষ্ঠানে তো কালকে সে অনুষ্ঠানে, যেন তিনি রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্বশীল নন, শুধু মাদরাসার কোনো বড় ব্যক্তি। এসব মাতামাতিতে যোগ দিতে দিতে হয়তো তিনি রাষ্ট্রের দায়িত্বও ঠিকমতো পালন করতে পারেননি। একসময় তাঁর পদই চলে যায়। এমনিভাবে আমাদের কিছু শিশু বা যুবকের বড় অর্জন নিয়েও অহেতুক মাতামাতি হতে দেখা যায়। কয়েকদিন আগে একটি ছোটখাটো পুরস্কারের জন্য খেলোয়াড়দের এয়ারপোর্ট থেকে আনতে একটি আস্ত বাস কেটে ফেলা হয়।
মনে হয়, তাদেরকে খোলা দেখানোর আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অথচ পরে জানা গেছে ছাদ খোলা বাসও স্টকে ছিল। আসলে এগুলো আমাদের কা-জ্ঞান নিয়েই ঘুরে ফিরে প্রশ্ন উঠায়।
যাইহোক, আমরা আবার হাফেয তাকরীম ও তাঁর মতো প্রতিভাবান তালিবে ইলমদের কথাই বলতে চাই। তারা যেন কোনোক্রমেই তলবে ইলমের পথ থেকে বিচ্যুত না হয়। আমাদের এই প্রতিভাগুলো কোনোভাবেই যেন হারিয়ে না যায়। কেউ যেন নিজের বা নিজের প্রতিষ্ঠান বা ভুল স্বার্থ হাসিলের জন্য কোনো তালিবে ইলমকে ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে না পারে- এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সতর্ক থাকা একান্ত কাম্য।
ছেলেটির সুন্দর তিলাওয়াত শুনে আমিও মুগ্ধ হয়েছি। তখনই মনে হয়েছে, তাকে মোবারকবাদ দেওয়া ও দু-চারটি কথা আরজ করা দরকার। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ছেলেটিকে তাফাক্কুহ ফিদ্দীন, রুসুখ ফিল ইলম নসীব করুন। উম্মতের জন্য হাদী এবং রাহবার বানান- আমীন।
আরেকটি কথা, বর্তমানে আমাদের দেশেও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা আয়োজনের কথা শোনা যায়। আগে কোনো বিশেষ চ্যানেলে প্রচারিত হলেও বর্তমানে এ ধরনের আয়োজন বিভিন্ন চ্যানেলে হয়ে থাকে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে তো এটি ভালো ও সুন্দর পদক্ষেপ। আল্লাহর কালাম মুখস্থকারী মেধাবীদেরকে উৎসাহিত করা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু টেলিভিশনগুলোর এ ধরনের আয়োজনের বিষয়ে বিজ্ঞমহলের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন আছে।
প্রথমত, যেসব চ্যানেল এ ধরনের আয়োজন করে তাদের রাতদিনের অনুষ্ঠানগুলো ইসলাম পরিপন্থী কাজকর্মে ভরা থাকে। এমনকি অনেক সময় ইসলামী অনুষ্ঠানের সাথে সাথেই বেপর্দা নারীদের গান বাদ্যও নাকি শুরু হয়ে যায়। এছাড়া স্পন্সর ও বিজ্ঞাপনদাতাদের হালাল-হারামের বিষয়টি তো রয়েছেই। পুঁজিবাদের আগ্রাসনের এ যুগে কে কোন্ মতলবে যে কোন্ ‘ইসলামী’ কাজ করে- তা বোঝা অনেক সময় মুশকিল হয়ে ওঠে। নামায রোযার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই, কারবারের আদ্যোপান্ত সুদের ভেতর ডোবা অথচ খুলে ফেললেন ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স। শিক্ষানবীস কর্মকর্তার পদ থেকে শুরু করে এমডি হওয়া পর্যন্ত সাড়া জীবন সুদের চাকরি আবার হঠাৎই দেখা গেল তিনি তথাকথিত কোনো ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অর্থাৎ পুঁজিবাদের পরতে পরতে অন্যান্য ষড়যন্ত্রের সাথে পবিত্র ও শাশ্বত দ্বীন ইসলামকেও অপব্যবহার করার তৎপরতা দেখা যায় এখন সবখানে। আর তাদেরকে সহযোগিতা দিয়ে যায় একশ্রেণির অবুঝ অথবা মতলবী লোকজন। তাই দ্বীনদার মহলকে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কেউ যেন নিজ হীন স্বার্থ চরিতার্থে আমাদের বড় ক্ষতি না করে ফেলতে পারে। আমরা যেন তাদের হাতে প্রতারিত না হই। মুমিনের শান হল সে কখনো প্রতারণার আশ্রয় নেয় না। সাথে এটিও তার বৈশিষ্ট্য যে, সে অন্যের হাতে প্রতারিত হয় না।
সুতরাং দৃশ্যত কোনো সুন্দর অনুষ্ঠানও যেন আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও জীবন গঠনের পথে বাধা না হয়ে ওঠে- সে বিষয়ে অভিভাবক ও সম্মাানিত শিক্ষকদের সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে।
প্রসঙ্গ সৌদি আইডল
সৌদি আরবের হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা এবার সে দেশের সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। হয়তোবা বাদশাহ সালমান ও তাঁর গুণধর ছেলে যুবরাজের বিভিন্ন ইসলাম-বিরোধী তৎপরতার কারণে যে ইমেজ সংকটে পড়েছে সৌদি সরকার তাতে কিছু রাখঢাক তৈরি করতে মিডিয়াগুলো এমনটি করেছে। ইতিমধ্যে যুবরাজ এমবিএসকে বহুদিন পর হারামাইন সফর করতেও দেখা গেছে। এগুলো দেখে কেউ কেউ মনে করেছিলেন, সৌদি সরকার এবং তার প্রকৃত নিয়ন্ত্রকদের হয়তোবা কিছুটা বোধোদয় হচ্ছে। কিন্তু না, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটি কয়লা ধুইলে ময়লা না যাওয়ার মতোই থেকে গেছে। এখন আবার পত্রিকায় প্রচারিত হয়েছে, ভারতের আদলে সৌদিতে অনুষ্ঠিত হবে সৌদি আইডল। খবরটি ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। দুনিয়ার মানুষকে ভুল পথে পরিচালনার ঠিকাদারী নেওয়া দ্বীনবিমুখকারী মিডিয়াগুলো তো এমন খবরের অপেক্ষায়ই থাকে। আফসোস সৌদি আরব এখনও ভুল পথে হাঁটছে, যে পথটি আসলে তার নয়। যতই চেষ্টা করুক এ পথে তাদের সফলতা আসবে না। আসা সম্ভব নয়। একদিক থেকে খবর আসছে, মদীনা শরীফসহ সৌদির একাধিক স্থানে বিভিন্ন দামী ধাতুর খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। এজন্য তারা শুকরিয়া আদায় করবে কী, উল্টো তারা বিলাসিতা ও বেহায়াপনার আয়োজনগুলোই আরও বাড়াচ্ছে। একদিকে হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন অন্যদিকে বেহায়াপনার মহোৎসব। এ যেন-
حجِ کعبہ بھی کیا اور گنگا کا اشنان بھی
راضی رہے رحمان بھی اور خوش رہے شیطان بھی
কা‘বায় গিয়ে হজ্বও করেছি, করেছি গঙ্গায় স্নানও,
আল্লাহ্ও রাজি থাকুক, শয়তানও নারাজ না হোক।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।
সেপ্টেম্বরের শেষ দশকেই সৌদি আরবের জাতীয় দিবস উদ্যাপিত হয়। এবারও বেশ মাতামাতি করে দিবসটি উদ্যাপিত হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন আলেমকে দিয়েও সরকার বক্তব্য দেওয়াচ্ছে। একজন সুপ্রসিদ্ধ লেখক শায়েখকে সৌদির জাতীয় দিবস উপলক্ষে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বক্তব্য দিতে দেখা গেল। একপর্যায়ে তিনি বললেন, সৌদি রাজতন্ত্র জাযিরায়ে আরবে দ্বীন-ঈমান ও সুখ-শান্তির জন্য যে আয়োজন করেছে খুলাফায়ে রাশেদীনের পরে আর কেউ কি এমনটি করেছে? ইতিহাসে কেউ কি দেখাতে পারবে?
শায়েখের বক্তব্য শুনে হাসব না কাঁদব কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমাদের হাজার বছরের শিক্ষা-সংস্কৃতি, মর্যাদা, সম্মান, শান্তি ও সমৃদ্ধির ইতিহাস তো এ ডক্টরের না জানার কথা নয়। তাহলে কেন তারা এমন গলত কথা বলেন। দরবারের ভয়ে না দরবার থেকে অর্জনের জন্যে। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। হ