Safar 1444   ||   September 2022

চলে গেলেন আমাদের মুরব্বি
হযরাতুল উস্তায মাওলানা আবদুল হালীম বোখারী রাহ.

মাওলানা যুবাইর হানীফ

উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন, দেশের শীর্ষস্থানীয় দ্বীনী প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক, আল-হাইআতুল উলয়া কওমী শিক্ষাবোর্ডের স্থায়ী কমিটির সদস্য, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের মহাসচিব, আমাদের সকলের মুরব্বি ও রাহবার হযরাতুল উস্তায মাওলানা আবদুল হালীম বোখারী রাহ. গত ২০-১১-১৪৪৩ হি./২১-৬-২০২২ ঈ. মঙ্গলবার সকাল ৮:৪৫ মিনিটে চট্টগ্রাম সিএসসিআরহাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

إنا لله وإنا إليه راجعون، إِنّ لِلهِ مَا أَخَذَ، وَلَهُ مَا أَعْطى، وَكُلّ شَيءٍ عِنْدَهُ بِأَجَلٍ مُسَمّى.

ইন্তেকালের খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো জামিয়া পটিয়ায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পুরো পরিবেশটা ভারি হয়ে ওঠে। সিদ্ধান্ত হয়, রাত দশটায় জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হবে।

হযরাতুল উস্তাযের জানাযায় অসংখ্য ছাত্র, মুরীদ, মুহিব্বীন অংশগ্রহণ করেন। প্রায় লাখ খানেক মানুষের উপস্থিতি ছিল হুজুরের জানাযায়। দলমত নির্বিশেষে দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম থেকে নিয়ে রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সকল শ্রেণির মানুষই অংশগ্রহণ করেন।

হুজুরের বড় ছাহেবযাদা মাওলানা রেজাউল করীম ছাহেব জানাযার নামায পড়ানোর দায়িত্ব হযরত মুফতী আহমদুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-কে প্রদান করেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেন। তিনি বলেন, হযরত বোখারী ছাহেব তাঁর জীবদ্দশায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন। 

১. জামিয়া পটিয়ার সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৮১ বছরে যেসব ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে, যার পাণ্ডুলিপি সংখ্যা প্রায় ৬৫ খণ্ড; তিনি তাঁর তত্ত্বাবধানে  কয়েকজন মুফতীকে নিয়ে ৬৫ খণ্ডের ফাতোয়া পাণ্ডুলিপি থেকে ফতোয়াকোষ প্রণয়নের বৃহৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিলেন। সেই সংকলনের কাজ বেশ এগিয়েছিল। দুটি খ- ছাপার জন্য প্রস্তুত। তা ছাপার আগেই তিনি আল্লাহর কাছে চলে গেলেন।

২. তিনি তাঁর জীবদ্দশায় নায়েবে মুহতামিম নির্ধারণ করে গেছেন। তাকে নিজের সঙ্গে রেখে সকল কাজ বুঝিয়ে ও দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।

এরপর মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ ছাহেব দা. বা. সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। যারা দূর দূরান্ত থেকে এসেছেন তাদের জন্য দুআ করেন। পটিয়ার জন্য দুআ চান। হযরত মুফতী আহমদুল্লাহ ছাহেব দা. বা.-এর ইমামতিতে রাত ১০:২০ মিনিটে জানাযার নামায সম্পন্ন হয়।

জানাযার সময় পুরো জামিয়ার কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। মাঠ-ঘাট, মাদরাসার প্রত্যেক ভবনের সামনের বারান্দা, গাড়ী চলাচলের রাস্তা, রেল লাইন ইত্যাদি সব কানায় কানায় ভরপুর ছিল। জানাযা রাখা হয়েছিল গাড়ী চলাচলের রাস্তা ও রেল লাইনের পশ্চিম পাশে। মাদরাসার আশপাশের সবগুলো রাস্তা বন্ধ ছিল। রাত ১১ টার পর জামিয়ার মাকবারায়ে আজিজিতে হযরত নূরুল ইসলাম কাদীম ছাহেব রাহ.-এর পাশে হযরাতুল উস্তাযের দাফন সম্পন্ন হয়।

نورالله مرقده وجعل الجنة مثواه.

 

সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত

জন্ম ও বংশ

হযরাতুল উস্তায বোখারী রাহ. ১৩৬৪ হি./১৯৪৫ ঈ. সালে জানুয়ারি মাসের কোনো এক বুধবারে চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানার রাজঘাটাগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এক ইলমী খান্দানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা আবদুল গনী বোখারী রাহ. ছিলেন খ্যাতিমান বক্তা। দীর্ঘদিন রাজঘাটা হুসাইনিয়া আজিজুল উলূম মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম ছিলেন। সন্তান জন্মের খবর শুনে, সুসংবাদ নিয়ে দৌড়ে যান কাশ্মীরী রাহ.-এর প্রিয় ছাত্র মুহাদ্দিস হযরত আবুল মুজাফ্ফর রাহ.-এর কাছে। তিনি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর শোনা মাত্রই কুরআনে কারীমের সূরা সফফাতের আয়াত তিলাওয়াত করেন-

فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ.

এ আয়াতের শেষ শব্দ হালীমদিয়ে বরকতের জন্য নাম রাখেন আবদুল হালীম। পূর্বপুরুষরা ছিলেন বোখারার উজবেকিস্তানের অধিবাসী। উজবেকিস্তান থেকে তাঁর পিতার পূর্বপুরুষগণ দাওয়াতের কাজে এ দেশে এসেছিলেন।

শিক্ষা-দীক্ষা

হযরাতুল উস্তায মাওলানা শাহ আবদুল হালীম বোখারী রাহ. রাজঘাটা হুসাইনিয়া আযিযুল উলূম মাদরাসায় ইবতিদায়ী থেকে সুউম (হেদায়া জামাত) পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। এ সময়ে তাঁর সম্মানিত পিতা এই মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম ছিলেন। উপরের জামাতগুলো পড়ার উদ্দেশ্যে ১৯৬২ সালে তাঁর পিতা আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় পাঠান। জামিয়া পটিয়ায় এসে দুউমে (হেদায়া জামাতের উপরের জামাত)  ভর্তি হন। ১৩৮৪ হি./১৯৬৪ ঈ. সালে জামিয়া পটিয়া থেকে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। দাওরায় হযরতের হাদীসের উস্তায ছিলেন-

১. হযরত মাওলানা ইমাম আহমদ ছাহেব রাহ. (সহীহ বুখারী ১ম খ-)

২. হযরত মাওলানা ইসহাক গাজী ছাহেব রাহ. (সুনানে আবু দাউদ)

৩. হযরত মাওলানা আমীর হুসাইন ছাহেব রাহ. (জামে তিরমিযী)

৪. হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম ক্বদীম ছাহেব রাহ. (সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ্)

৫. হযরত মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালবী রাহ. (মুআত্তান)

৬. হযরত মাওলানা মুফতী ইবরাহীম ছাহেব রাহ. (তাফসীরে বায়যাবী)

৭. হযরত মাওলানা ফজলুর রহমান ছাহেব রাহ. (সহীহ বোখারী ২য় খ-, সহীহ মুসলিম মুকাম্মাল)।

এ বছর (১৩৮৪ হিজরী) দাওরায়ে হাদীসের বার্ষিক পরীক্ষায় হযরাতুল উস্তায প্রথম স্থান অর্জন করেন। পরীক্ষার পূর্ণ মান ছিল ৫০; কিন্তু কিছু কিতাবে তাঁর মেধার স্বাক্ষর হিসেবে ৫১ ও ৫২ নম্বর দেয়া হয়। 

১৯৬৫ সালে জামিয়ার অধীনে উচ্চতর বাংলা সাহিত্য ও গবেষণা বিভাগেঅধ্যয়ন করেন। অন্যদিকে সাতকানিয়া আলিয়া মাদরাসা থেকে আলিম ও গোপালপুর মাদরাসা থেকে ফাজিল এবং ১৯৬৯ সনে টাঙ্গাইল কাগমারি এইচএসসি এবং ১৯৭৫ সালে স্নাতক পাস করেন। সবগুলো পরীক্ষায় স্টার মার্ক পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পাশাপাশি তিনি লাহোর ডন হোমিওপ্যাথিক কলেজে বায়োক্যামিকের ওপর দুবছর মেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করেন।

কর্মজীবন

শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়। ১৯৬৭-১৯৬৮ ঈ. দুই বছর তিনি টাঙ্গাইল দারুল উলূম আলিয়া মাদরাসার আরবী প্রভাষক ছিলেন। এরপর খতীবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রাহ. ও অধ্যক্ষ মাওলানা হাবিবুল্লাহ রাহ.-এর অনুরোধে তিনি সাতকানিয়া মাহমুদুল উলূম আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে চার বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৭২ সালে তিনি পুনরায় টাঙ্গাইল দারুল উলূম আলিয়া মাদরাসায় চলে যান। ১৯৭২-১৯৮২ পর্যন্ত সেখানে মুহাদ্দিস ও শায়খুল হাদীস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে তৎকালীন জামিয়া পটিয়ার প্রধান পরিচালক হযরত মাওলানা হাজী ইউনুছ রাহ. তাঁকে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসেন। ২০০৩-২০০৮ পর্যন্ত জামিয়ার সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পর ১৪২৯ হি./২০০৮ ঈ. সন থেকে মৃত্যু অবধি  প্রায় ১৪ বছর জামিয়া পটিয়ার প্রধান পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি জামিয়া পটিয়ার সুষ্ঠু পরিচালনার পাশাপাশি আরও বহু মাদরাসার পরিচালনা ও পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সমাজ উন্নয়ন ও সংস্কারধর্মী সংগঠনের পরিচালনার মাধ্যমে জাতির অনেক বড় খেদমত করে যান।

হযরাতুল উস্তায তাঁর আমলে জামিয়া পটিয়ার শিক্ষা ও অবকাঠামোগত বেশ উন্নয়ন সাধন করেন। মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের মেহনতের ফলে প্রতি বছর ইত্তেহাদ ও আল-হাইআতুল উলয়ার কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। ২০১৮ সালে আল-হাইআতুল উলয়া গঠিত হলে এর স্থায়ী কমিটির সদস্য মনোনীত হন। বাংলাদেশ তাহফীজুল কুরআন সংস্থার সভাপতি ও জামিয়া পটিয়ার মুখপত্র মাসিক আত-তাওহীদের প্রধান সম্পাদক ছিলেন তিনি। মেধা ও মননশীলতার বহুমাত্রিকতা তাঁর জীবনকে করেছে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

দেওবন্দী চেতনা সযত্নে লালন করায় আকাবিরের উসূল অনুযায়ী চলতে সচেষ্ট ছিলেন। আশআরি ও মাতুরিদি দর্শন তার চিন্তাধারাকে ঋদ্ধ করে। আরবী, বাংলা, উর্দু, ফারসি ও ইংরেজি ভাষার উপর তাঁর বেশ দখল ছিল। ১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছর জামিয়া পটিয়ায় খেদমত করেছেন। দীর্ঘ ১৪ বছর মুহতামিম ও ৫ বছর মুঈনে মুহতামিমের জিম্মাদারী পালন করেছেন। ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ বোর্ডকে তিনি সুগঠিত ও উন্নত করেছেন।

ব্যক্তিজীবন

ব্যক্তিজীবনে হযরাতুল উস্তায ছিলেন সহজ সরল। চলাফেরায় ছিলেন একদম সাদামাটা। সবার সাথে নম্রভাবে কথা বলতেন। কেউ দোষ বা বড় কোনো অপরাধ করলেও সহজে রেগে যেতেন না। বিচক্ষণতার সাথে ঠাণ্ডা মাথায় জটিল ও কঠিন সমস্যা সমাধান করতেন।  মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পূর্বে নিজের বাস্তুভিটা সমঝোতার ভিত্তিতে ছেলেমেয়েদের মাঝে বণ্টন করে দেন; যাতে তাঁর অনুপস্থিতিতে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি না হয়।

আধ্যাত্মিক সাধনা

হযরাতুল উস্তায আবদুল হালীম বোখারী রাহ. সর্বপ্রথম হযরত হাজ্বী ইউনুস ছাহেব রাহ.-এর হাতে বায়আত হন। তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত শাহ্ আবরারুল হক রাহ.-এর হাতে বায়আত হন। এরপর হযরত মুফতী আজিজুল হক রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা জামিয়া ইসলামিয়া দারুস সুন্নাহ হ্নীলার সাবেক শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা ইসহাক ছাহেব (ছদর ছাহেব নামে খ্যাত) হুজুরের হাতে বায়আত গ্রহণ করেন এবং খেলাফত লাভে ধন্য হন। বর্তমানে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ও মুরিদ রয়েছে। অনেকেই তাঁর কাছ থেকে  আধ্যাত্মিক তরবিয়ত পেয়ে ধন্য হয়েছেন।

রাজনৈতিক ময়দান

হযরাতুল উস্তায বোখারী রাহ. বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রাহ.-এর শীষ্য ও রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন। খতীবে আযম রাহ. বোখারী ছাহেব রাহ.-কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। স্মৃতিচারণমূলক এক নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম খতীবে আযম রাহ.-এর রাজনৈতিক জীবনের সহকর্মী। সে সুবাদে আমি সবসময় তার সাথে থাকতাম।  (খতীবে আযম স্মারকগ্রন্থ’, চট্টগ্রাম, ২০২২)

 

অনন্য কিছু গুণ-বৈশিষ্ট্য

গীবত করতেন না, করতে দিতেন না

হযরাতুল উস্তায কখনো কারো গীবত করতেন না, অন্যকেও করার সুযোগ দিতেন না। বিভিন্ন মাদরাসার শূরার সদর ও মুরব্বি হওয়ায় অনেকেই তার সহকর্মী, মুহতামিমের নামে গীবতে লিপ্ত হতে চাইত, কিন্তু হুজুরের সামনে তা সম্ভব হতো না। হুজুরের অফিসের দেয়ালে এ বাক্যদুটি লেখা ছিল-

بات ختم  ہونے کے بعد دیر نہ فرمائيں کيونکہ مشغوليت زيادہ ہے ۔

(কথা শেষ হলে বিলম্ব না করি)

براہ کرم  کسی کی غیبت سے پرہیز  فرمائیں۔

(দয়া করে কারো গিবত করবেন না।)

সারা জীবন কম কথা বলতেন। প্রয়োজনের বাইরে এক শব্দও বলতেন না। যতটুকু জরুরত ততটুকু কথা বলতেন। বলা যায় হাদীসের ভাষায়-

أملك عليك لسانك

(তোমার যবানকে নিয়ন্ত্রণ কর)

-এর মিসদাক ছিলেন তিনি।

সময়ের মূল্যায়ন

হুজুরের কাছে সময়ের মূল্যায়ন ছিল খুব বেশি। সব কাজ সময় অনুপাতে করতেন। প্রতিটি কাজ ঠিক সময়ে আঞ্জাম দিতেন। একটু এদিক সেদিক হতো না। হুজুর কখনো অলস সময় কাটাতেন না। হুজুরের জীবন ছিল গোছানো। যতক্ষণ জেগে থাকতেন, কাজে কাটাতেন। আলসেমিকে প্রশ্রয় দিতেন না, পছন্দও করতেন না।

কর্মময় জীবন

তিনি একাই একটা সমাজ ছিলেন। বলা যায় একটা লাজনা (বোর্ড) ছিলেন। বৃহৎ একটা লাজনার কাজ নিজে একাই আঞ্জাম দিতেন। একাধারে জামিয়া পটিয়ার প্রধান, জামিয়ার শাইখুল হাদীস, মাসিক আত-তাওহীদের প্রধান সম্পাদক, বাংলাদেশ তাহফীজুল কুরআন সংস্থার সভাপতি, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের মহাসচিব।

ইত্তেহাদুল মাদারিস বোর্ডকে নিজে ঢেলে সাজিয়েছেন। হুজুর বলেন, ইত্তেহাদের কাজের জন্য চট্টগ্রাম শহরে আসা-যাওয়া করতে করতে আমার চুল সাদা হয়ে গেছে। আজীবন নিজেকে পটিয়ার জন্য, পটিয়া সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। এমন নয় যে, নামে আছেন শুধু, কাজে নেই। হযরাতুল উস্তায যেমন নামে ছিলেন তেমনি ছিলেন কাজেও।

আমলের পাবন্দি

সবসময় জামাতের সঙ্গে নামায পড়তেন। শেষ বয়সে দুর্বলতার কারণে মাঝেমধ্যে জামাতে উপস্থিত হতে পারতেন না। তিনি ঘরে থাকেন কিংবা সফরে, তাহাজ্জুদ ছুটত না। যত রাতেই ঘুমাতেন, ঠিক তাহাজ্জুদে উঠে যেতেন। এলার্ম বাজুক আর না বাজুক। শেষরাতে যখন উঠতেন, কাউকে ডাকতেন না। এমনকি শেষ বয়সেও নিজে কষ্ট করে ওজু-এস্তেঞ্জা করে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন, যিকির করতেন। অথচ অন্য সময় হুজুরকে ধরে ধরে সব করাতে হতো।

পাঠদান পদ্ধতি

হযরাতুল উস্তায আজীবন হাদীসের খেদমত করেছেন। পটিয়াতেই চল্লিশ বছর হাদীসের খেদমত করেছেন। জীবনের ৫০টি বসন্ত হাদীসের খেদমতে কাটিয়েছেন। এ সময় তিনি সহীহ বুখারি, জামে তিরমিযী ও তাহাবীর দরস প্রদান করেন।  তাঁর পাঠদান পদ্ধতি আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর হওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাঁর দরসে অধীর আগ্রহ নিয়ে হাজির হত। কঠিন বিষয়কে সহজ ও সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিতেন, যার দরুন সর্বস্তরের ছাত্ররা তাঁর দরস-তাকরীর বুঝত।

হাদীসের দরসে হুজুর ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যৌবনদীপ্ত সময়ে হুজুর তিরমিযীর দরস দিতেন নিজস্ব ও অনন্য পদ্ধতিতে। সে সময়কার তালিবুল ইলমরা পটিয়াতে দাওরা পড়ে ইলম আহরণের জন্য যেতেন দারুল উলূম দেওবন্দ। দেওবন্দের মত প্রতিষ্ঠানে যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীদের কাছে পড়েও তারা হুজুরের তিরমিযীর দরসের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা ভুলতে পারতেন না। এ কথা সকলের মুখে মুখে রয়েছে। একাধিক উস্তাযের কাছেও এ কথা শুনেছি। হুজুর নিজস্ব ধারায় বুখারী আওয়ালের দরস দিয়েছেন আমৃত্যু।  স্পষ্ট ভাষায় ধীরে-সুস্থে তাকরীর, গোছানো বর্ণনা এবং অভিনব পদ্ধতিতে আলোচনা ছিল হুজুরের দরসের মূল বৈশিষ্ট্য। হাদীসশাস্ত্রের ওপর বিশেষ পাণ্ডিত্য থাকলেও তাফসীর, ফিকহ, সাহিত্য, ইলমুল কালাম, নাহু-সরফ ও বালাগাত শাস্ত্রে তার বিচরণ ছিল সমান।

ঋণ থেকে দূরে থাকতেন

হুজুরের সবচে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ঋণ থেকে সবসময় দূরে থাকতেন। কখনো ঋণ করতেন না; যত কষ্টই হোক। হুজুর বলতেন-

القرض مقراض المحبة.

ঋণ মহব্বত-সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়।

কখনো এমনও হয়েছে, তিন দিন পর্যন্ত উপবাস থেকেছেন তার পরও কারো কাছ থেকে ঋণ করেননি; ধৈর্য ধারণ করেছেন। 

তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলি

হযরত রাহ. প্রতিটি দরসের নোট নিজ হাতেই তৈরি করতেন। পরবর্তীতে পাঠ্যক্রমভুক্ত অনেক কিতাবের ব্যাখ্যা লিখেছেন। এসব ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকে ছাত্র-শিক্ষক সমানভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। নিম্নে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হল।

১. তাসহীলুত তাহাবী (১ খণ্ডে তাহাবী-র ব্যাখ্যাগ্রন্থ)

২. তাসহীলুত তিরমিযী (৪ খণ্ডে জামে তিরমিযী ব্যাখ্যাগ্রন্থ )

৩. তাসহীলুল উসূল [যা ইত্তেহাদুল মাদারিস বোর্ডে শশুমে (কাফিয়া জামাতে) নেসাবভুক্ত]

৪. তাসহীলুল বুখারী (প্রকাশিতব্য)

৫. ইকতিসাদে ইসলামী

এছাড়াও বেশ কিছু বাংলা রিসালা রয়েছে।

সফল মুহতামিম

২০০৮ সালে পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর জামিয়া পটিয়ার গৌরবোজ্জ্বল অতীত সংরক্ষণের পাশাপাশি বর্তমানকে সমৃদ্ধ ও ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁর নিষ্ঠাপূর্ণ সুষ্ঠু পরিচালনায় জামিয়া পটিয়া এখনো বহুমুখী উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। তিনি ছিলেন আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সফল মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদীস। সুদীর্ঘ আট দশকের ইতিহাসে জামিয়া পটিয়া যেসব সৃজনশীল মনীষী, তীক্ষ্ণ মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান আলেম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, তাঁদের অন্যতম প্রধান হলেন হযরাতুল উস্তায মাওলানা আবদুল হালীম বোখারী রাহ.। তাঁর পরিচালনায় জামিয়া পটিয়ার নিয়ম-শৃঙ্খলা নতুনভাবে সজীবতা লাভ করে। জামিয়ার ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল সদা নিবিষ্ট। তাই তিনি যখন অনুভব করলেন, জীবন হয়ত বেশিদিন সঙ্গ দেবে না, তখনই তিনি ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করেন। এক্ষেত্রে তিনি পূর্বসূরিদের ঐতিহ্য অনুসরণ করেন এবং উত্তরসূরিদের জন্য দৃষ্টান্ত রেখে যান। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতী শাহ আজিজুল হক রাহ. জীবদ্দশায় মাওলানা হাজ্বী মুহাম্মাদ ইউনুস রাহ.-কে পরবর্তী মুহতামিম নিয়োগ করে যান। তিনি জীবিত থাকতে হযরত মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রাহ.-কে পরবর্তী মুহতামিম ঠিক করে যান। হযরত মাওলানা আবদুল হালীম বোখারী রাহ., প্রথমত মজলিসে আমেলার মাধ্যমে, পরবর্তীতে মজলিসে শূরার অনুমোদনক্রমে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা দা. বা.-কে নায়েবে মুহতামিম নির্ধারণ করেন।

বিগত ৭ই যিলহজ্ব ১৪৪৩ হি./৭ই জুলাই ২০২২ ঈ. রোজ বৃহস্পতিবার জামিয়া পটিয়ায় শূরার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে সকলের সম্মতিতে হযরত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ ছাহেব দা. বা.-কে জামিয়া পটিয়ার মুহতামিমের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

আল্লাহ হযরতের ভরপুর মাগফিরাত করেন। জান্নাতের আলা মাকাম দান করেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সবরে জামীলের তাওফীক দান করেন। জামিয়া পটিয়াসহ তাঁর খেদমতের সকল প্রতিষ্ঠান ও সকল অঙ্গনকে আল্লাহ তাআলা নিজ হেফাজতে রাখেন- আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।

 

তথ্যসূত্র:

১. আত্মজীবনী, মুকাদ্দিমা তাসহীলুত তিরমিযী

২.খতিবে আজম স্মারকগ্রন্থ, চট্টগ্রাম, ২০২২

৩. মাসিক আত-তাওহীদ (জুলাই ও আগস্ট সংখ্যা)

৪. দৈনিক নয়া দিগন্ত, উপসম্পাদকীয়,

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

২৭ জুন ২০২২ ঈ. হ

 

advertisement