সারা লরেন : একটি আয়াত
যাঁকে ইসলামের পথে অনুপ্রাণিত করেছে
সারা লরেন। একজন বৃটিশ সাংবাদিক, ব্রডকাস্টার এবং মানবাধিকার কর্মী। তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডের একটি খ্রিস্টান পরিবারে। বাবা-মা কেউই ধর্ম তেমন মানতেন না। বাবা ছিলেন মদ্যপ, মা ছিলেন একজন ফ্যাশন মডেল। কিন্তু তিনি ছোটবেলা থেকেই বিশ্বাস করতেন, এ জগতের সৃষ্টিকর্তা একজন অবশ্যই আছেন।
সারা বলেন, পাঁচ বছর বয়স থেকে, যখন আমি একেবারে ছোট ছিলাম, প্রার্থনা করতে ভালবাসতাম। বিশ্বাস করতাম খোদা একজন। অন্য খ্রিস্টানদের মতো কখনোই তিন খোদায় বিশ্বাস করতাম না।
সারার মনে ইসলামের প্রতি আগ্রহ জাগে যখন তিনি একজন সংবাদকর্মী হিসাবে ফিলিস্তিনে যান। সেখানে তিনি দেখলেন, প্রতিটি ঘরে একটি বই অবশ্যই আছে। তা হল কুরআন। সারা দেখলেন, এই মানুষগুলো ইহুদীদের এত জুলুম নির্যাতন সহ্য করে। কারো সন্তান নিহত হয়েছে, কেউ বাবা-মা হারিয়েছে, কেউ হাত পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে আছে, কারো ভাগ্যে জুটেছে কারাগার। এত কিছু সত্ত্বেও তারা আশাবাদী। হতাশা কী- তারা জানেই না! সারার মনে হল, এরা তার চে অনেক সুখী ও স্বচ্ছন্দময় জীবনের অধিকারী।
তিনি জানতে চাইলেন, এর রহস্য কী?
তারা বলল, কুরআন আমাদের জীবনকে এভাবে পরিচালিত করেছে।
সারা বলেন, ‘তখন আমার মনে হল, এ বই ভালো মানুষ হওয়ার একটি গাইডবুক। আমি জানতাম, আমি কোনো ভালো মানুষ নই।’
ইংল্যান্ডে ফিরে আসার আগে সারা শপিং করতে গেলেন। তিনি একটি লিস্ট করলেন। সে তালিকায় ছিল কুরআনে কারীমও। তিনি কুরআনে কারীম সংগ্রহ করলেন এবং ঘরে ফিরে এসে হাতে নিলেন।
সারা বলেন, ‘কুরআনে কী আছে দেখার জন্য হাতে নিয়ে খুললাম। আমি সূরা হুদের ১০২ নম্বর আয়াত পড়লাম-
وَکَذٰلِکَ اَخْذُ رَبِّکَ اِذَاۤ اَخَذَ الْقُرٰی وَهِیَ ظَالِمَۃٌ اِنَّ اَخْذَهٗۤ اَلِیْمٌ شَدِیْدٌ.
এমনই হয় আপনার রবের পাকড়াও, যখন তিনি জনপদসমূহকে এ অবস্থায় পাকড়াও করেন যে, তা অন্যায় অপরাধে লিপ্ত। নিশ্চয় তাঁর পাকড়াও যাতনাদায়ক, কঠোর।
আমি ভয় পেয়ে যাই। কুরআনের প্রতিটা পৃষ্ঠা যেন আমাকে বলছিল, আমি একজন পাপী। আমাকে জাহান্নামের শাস্তি পেতে হবে। আল্লাহ আমার প্রতি অসন্তুষ্ট। তখন ২০০৬ সাল। মদ পান করতাম, ধূমপান করতাম। আমি ছিলাম স্বার্থপর, বিলাসী।’
সারা মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করেন একজন অমুসলিম সাংবাদিক হিসাবে। কিন্তু মুসলমানদের অকৃত্রিম আচরণে তিনি অভিভূত হন। প্রথমবার পশ্চিম তীর ভ্রমণে তিনি রামাল্লায় আসেন। শীতের মৌসুম ছিল। তাঁর কাছে উপযুক্ত শীতের কাপড় ছিল না। সারা বলেন, ‘আমি শীতে কাঁপছিলাম। হঠাৎ এক বৃদ্ধা আমাকে বললেন, এদিকে এসো, এদিকে এসো। তিনি আমাকে তার ঘরে টেনে নিয়ে গেলেন। আমি ভাবতেও পারছিলাম না এটা বাস্তবে ঘটছে। এই একবিংশ শতাব্দীতে... আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।’ এ ঘটনায় তিনি অনেক প্রভাবিত হন।
দুই হাজার আট সালে তিনি আবার ফিলিস্তিনে আসেন। তখন ছিল রমযান মাস। এই দ্বিতীয় সফর তার উপর অনেক বড় প্রভাব ফেলে। সেবার তিনি এক ফিলিস্তিনী পরিবারের সাক্ষাৎ পান। তারা তাঁকে ইফতারের দাওয়াত দেন। সারার মুখেই শোনা যাক সে ঘটনা। তিনি বলেন-
‘আমি তাদের দরজায় নক করলাম। গৃহকর্ত্রী দরজা খুলে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ বলে স্বাগত জানালেন। আমি দেখলাম, একজন আলোকিত মানুষ। উজ্জ্বল দুটি চোখ তাঁর। চেহারায় নূর ঝলমল করছে। তিনি এমন করে স্বাগত জানালেন, যেন তিনি আমাকে তাজমহলে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন! যেন তিনি পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর ঘরটিতে থাকেন! অথচ ঘরে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, কিছুই নেই। একটি শূন্য কক্ষ। কিছুই নেই। শুধু দেয়াল, মেঝে আর ছাদ। মেঝেতে একটি পাটি বিছানো। তার উপর দশজন মানুষের ইফতার রাখা। তাও ইফতার কী ছিল? প্লাস্টিকের একটি প্লেটে হুমুস, একটি প্লেটে রুটি আর আরেকটি প্লেটে সালাদ! ব্যস। আমি খেতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু তিনি মানলেন না। বললেন, আপনি আমাদের মেহমান।
আমাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে দিতে থাকলেন। তিনি আমার ‘না’ শুনছিলেনই না। আমার কিছুটা রাগ হচ্ছিল। ইসলামের প্রতি রাগ হচ্ছিল। কুরআনের প্রতি রাগ হচ্ছিল; যা ক্ষুধার্ত লোকদের আরও ত্রিশ দিন ক্ষুধার্ত থাকতে বলে। আমি কুরআনের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলাম, যা এই দরিদ্র মহিলাকে পানি পান না করতে এবং খাওয়া দাওয়া না করতে বলে। অথচ তার সম্বলই হল, কিছু ময়লা পানি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কেন রোযা রাখছেন?
তিনি বললেন, আমি রমযানে রোযা রাখি দরিদ্রদের স্মরণে! আল্লাহু আকবার! তিনি আমাকে বললেন, আমি রমযানে রোযা রাখি দরিদ্রদের স্মরণে! আল্লাহু আকবার! এই মা, যার কিছুই নেই এই দুনিয়ায়। কিছুই নেই, হয়ত জীবনে কিছু হবেও না তার। তিনি তাদের কথা ভাবছেন, যারা তার চাইতেও খারাপ অবস্থায় আছে! এই মহিলা যাঁকে সারাদিন কাজ করতে হয়, তিনি না খেয়ে থাকছেন তাঁর রবের শুকরিয়া আদায় করতে!’
এ দৃশ্য তাঁর হৃদয়ে স্থান করে নিল। কিন্ত তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। এর ঠিক দুই বছর পরে রমযান মাসে তিনি তার এক বান্ধবীর সাথে একটি মসজিদে প্রবেশ করলেন। রমযানে মুসলমানরা কী করেন তা জানার জন্য। রমযান মাস, মসজিদ মুসল্লীতে ভরপুর। তিনি বসে বসে দেখতে লাগলেন। তাঁর মনে হল যেন শান্তির এক ঝর্ণার নীচে তিনি বসে আছেন। তিনি বুঝতে পারলেন, ইসলামেই শান্তি। ইসলামই সত্য। এর এক সপ্তাহ পরে তিনি লন্ডনের আরেকটি মসজিদে যান এবং কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করেন। ইমাম ও মুআযযিন সাহেব তাঁর সাথে কথা বলেন। তাঁকে সূরা ফাতিহার ব্যাখ্যা শোনান। সারা বলেন, ‘যতক্ষণ তাঁরা কথা বলছিলেন, আমার মনে হচ্ছিল পুরো কক্ষে একটি গুরুগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করছে। একটি অন্যরকম অনুভূতি ছড়িয়ে আছে চারপাশ জুড়ে।’
সারার গল্পের সবচাইতে সুন্দর অংশ হল, যখন তিনি তাঁর দুই মেয়েকে ইসলাম গ্রহণের কথা জানান তাদের একজনের বয়স ছিল আট আরেকজনের দশ। সারা বলেন, ‘আমি তাদেরকে বললাম, তোমাদের আম্মু ভাবছে মুসলমান হয়ে যাবে? তোমরা কী বলো?
তারা বলল, আমাদের তিনটি প্রশ্ন আছে :
প্রথম প্রশ্ন : যখন তুমি মুসলমান হয়ে যাবে, তুমি কি আমাদের আম্মু থাকবে?
বললাম, অবশ্যই; বরং আরো ভালো মা হব।
দ্বিতীয় প্রশ্ন : মুসলমান হওয়ার পরও কি তুমি মদ পান করবে?
আমি বললাম, আর কখনো আমি মদ পান করব না।
তৃতীয় প্রশ্ন : ইসলাম গ্রহণের পরও কি তুমি খোলামেলা পোশাক পরবে?
বললাম, কেন তোমরা এ প্রশ্ন করছ?
আমার মেয়ে হলি বলল, কারণ সবসময় তোমার গলা আর বুকের বড় অংশ খোলা থাকে। আমরা এটা অপছন্দ করি এবং চাই তুমি আর এটা করবে না।
আমি বললাম, দেখো আমি যদি মুসলমান হয়ে যাই তাহলে সবসময় শালীন পোশাক পরে বের হব। তখন তারা বলে উঠল, তাহলে আমরা ইসলামকে ভালবাসি।
আলহামদু লিল্লাহ আমার মেয়েরাও ইসলাম গ্রহণ করে এবং তখন থেকেই আমার সাথে নামায পড়তে শুরু করে। সুবহানাল্লাহ।’
সারার পরিবার একটি বিখ্যাত পরিবার। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার তার বোনের স্বামী। কিন্তু টনি ব্লেয়ার শতাব্দীর মানবতা বিরোধী সবচাইতে ভয়ংকর অপরাধীদের একজন হওয়ায়, তাদের সাথে তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করেন। সবাই তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলে তিনি বললেন, জালেম যেই হোক, যত কাছের মানুষ হোক, তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না।
সারার ইচ্ছা, তিনি তার আশপাশে যে নারীরা ইসলাম গ্রহণ করছেন, তাদের জন্য বসবাসের ব্যবস্থা করবেন। যেন বাসস্থানের অভাব ও কষ্ট তাদেরকে দ্বীন ত্যাগ করতে বাধ্য না করে।
সারা আরবী জানেন না। কিন্তু তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতে ভালবাসেন। কুরআনের ব্যাপারে তাঁর অনুভূতি হল, দুইদিন কুরআন থেকে দূরে থাকলে তাঁর জীবন চলা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ধারালো কাচের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো। প্রথমে শুধু জাহান্নামের শাস্তির আয়াত দেখে ভয় পেলেও, এখন তাঁর সামনে কুরআনের সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে। কুরআন এখন তার জীবনের ভালবাসা।
[বিশিষ্ট দাঈ ফাহাদ আলকান্দারীর প্রোগ্রাম ‘বিলকুরআন ইহতাদাইতু’ অবলম্বনে] হ