তাসাব্বুত ও ইতকান
ইলম হাসিলের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত
তাসাব্বুত ও ইতকান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি গুণ। ইলমী অঙ্গনে তো বটেই, স্বাভাবিক জীবনাচারেও এই দুই বৈশিষ্ট্যের কোনো বিকল্প নেই। এই দুইটি ছাড়া কোনো কাজ সুষ্ঠু ও নিখুঁতভাবে করা সম্ভব নয়।
ইতকান অর্থ কোনো কাজ সুচারুরূপে ও নিখুঁতভাবে সম্পাদন করা। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
إِنّ اللهَ يُحِبّ إِذَا عَمِلَ أَحَدُكُمْ عَمَلًا أَنْ يُتْقِنَهُ.
(وفي إسناده "مصعب بن ثابت"، قال في "التقريب":"لين الحديث وكان عابدا"، ولحديثه هذا شواهد).
আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন- তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করে, সে যেন তা নিখুঁতভাবে করে। -মুসনাদে আবু ইয়ালা, খ. ০৪, পৃ. ২৫৩, হাদীস ৪৩৬৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, খ. ০৭, পৃ. ২৩৪, হাদীস ৪৯৩১
আর তাসাব্বুত (تثبُّت) মানে তাড়াহুড়ো না করা, ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা, ধৈর্য ও সতর্কতার সঙ্গে সঠিক বিষয় পর্যন্ত পৌঁছা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে সঠিক বিষয়ের উপর অবিচল থাকা।
تثبُّت -এর কাছাকাছি প্রতিশব্দ تبيُّن। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا ضَرَبْتُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ فَتَبَيَّنُوا...
হে মুমিনগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে সফর করবে তখন যাচাই-বাছাই করে দেখবে...। -সূরা নিসা (৪) : ৯৪
কোনো কেরাতে تَبَيَّنُوا -এর জায়গায় تَثَبَّتُوا আছে। ইমাম আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে উমর ইবনে ইবরাহীম কুরতুবী (৬৫৬ হি.) রাহ. বলেন-
فَتَبَيَّنُوا: من البيان، وتثبتوا: من التثبت. والقراءتان في السبع، وتفيدان: وجوب التوقف والتبين عند إرادة الأفعال إلى أن يتضح الحق، ويرتفع الإشكال.
অর্থাৎ تثبُّت ও تبيُّن উভয়টি দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কোনো কাজ করার আগে অনুসন্ধান করা এবং যাচাই করা, যাতে সঠিক বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় এবং সন্দেহ-সংশয় দূরীভূত হয়ে যায়। এটা শরীয়তের আবশ্যকীয় বিধান। (আলমুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম, আবুল আব্বাস কুরতুবী, খ. ০৭, পৃ. ৩৩৮) (ইনি প্রসিদ্ধ মুফাসসির ইমাম কুরতুবী নন। তাঁর নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে আবু বকর কুরতুবী। ওফাত ৬৭১ হিজরী। তিনি আবুল আব্বাস কুরতুবীর শাগরিদ।)
তাসাব্বুত ও ইতকানের প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে আসাতিযায়ে কেরাম আমাদের বলে থাকেন-
لفظ را تحقيق خوانی تاشوی مرد کمال
এটি দুটি শে‘রের শেষ মিছরা-
علم را ہرگز نيابی تا نداری شش خصال
حرص کوتاه فہم کامل جمع خاطر کل حال.
خدمت استاد بايد ہم سبق خوانی مدام
لفظ را تحقيق خوانی تا شوی مرد کمال.
ছয়টি গুণ অর্জন ব্যতীত কিছুতেই ইলম হাসিল করতে পারবে না। (দুনিয়ার প্রতি) লোভ সংবরণ, পরিপূর্ণ বুঝ ও সদা মনোযোগ।
উস্তাযের খেদমত করা, সেইসঙ্গে নিয়মিত সবক ইয়াদ করা এবং প্রতিটি শব্দ তাহকীকের সঙ্গে পড়া। তাহলেই তুমি যোগ্য (আলেম) হতে পারবে।
যাহোক তাসাব্বুত ও ইতকান অত্যন্ত ব্যাপক বিষয়। বয়স, মেধা, যোগ্যতা ও স্তর অনুযায়ী সবার জন্যই তা জরুরি। বয়স কম বা নিচের জামাতে পড়ে বলে তার জন্য এটা জরুরি নয়- বিষয়টি এমন নয়। সবার জন্যই জরুরি। বরং তার জন্য তো আরো বেশি জরুরি। কারণ ছোট বয়সে অভ্যাস হয়ে গেলে বড় হওয়ার পর তা পালন করা ও রক্ষা করা সহজ হয়ে যায়। সুতরাং এখনো যারা ছোট তাদের অলসতা না করে এখন থেকেই তাসাব্বুত ও ইতকানের মেহনত শুরু করে দেয়া উচিত। তাই তারা কয়েকটি কাজ করতে পারে-
১. শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার অভ্যাস গড়ে তোলা। (অবশ্য পিতা-মাতা ও আসাতিযার সঙ্গে তাদের ভাষায় কথা বলা মুনাসিব)
২. যেটাই পড়বে বা মুখস্থ করবে, ভালোভাবে করবে। বুঝে পড়বে। পড়ায় যেন কোনো অস্পষ্টতা না থাকে।
৩. শব্দের সঠিক উচ্চারণের প্রতি যত্নবান হতে হবে। সঠিক উচ্চারণের জন্য হরফকে ঠিক তার মাখরাজ থেকে আদায় করতে হবে এবং শব্দের মধ্যে যেন হরকত ও ইরাবের কোনো ভুল না থাকে সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। বিশেষত নামের যব্তের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। (যেমন, ইবনে হাব্বান, নাকি ইবনে হিব্বান) এ ব্যাপারে অনেকের মাঝে উদাসীনতা দেখা যায়, যা একদম অনুচিত। প্রথমবার পড়ার সময়েই যদি সঠিক যব্তটা জেনে নিই তাহলে সারাজীবনের জন্য আমার উচ্চারণ শুদ্ধ হয়ে গেল। নতুবা দেখা যাবে, জীবনভর ভুল উচ্চারণ করে যাচ্ছি অথচ আমার কোনো খবর নেই।
সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. সন্তানদের কথায় ভুল হলে শাসন করতেন। উমর রা. সম্পর্কে বর্ণিত আছে, একবার তিনি দুই ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা তীরন্দাজি করছিল। তখন একজন আরেকজনকে বলল-
أَسَبْتَ.
অর্থাৎ ص -এর পরিবর্তে س উচ্চারণ করল। তখন উমর রা. বললেন-
سُوءُ اللَّحْنِ أَشَدُّ مِنْ سُوءِ الرَّمْيِ.
উচ্চারণের ভুল তীর নিক্ষেপের ভুলের চেয়ে মারাত্মক। -আলআদাবুল মুফরাদ, বর্ণনা ৮৮১
৪. কিতাবের ইবারত সহীহভাবে পড়া। এক্ষেত্রে অনেকে প্রকাশকের দেয়া হরকতের উপর নির্ভর করে। এর অনেক ক্ষতি। প্রথমত এর দ্বারা প্রাথমিক স্তরের তালিবে ইলমদের ইসতিদাদ তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটে। দ্বিতীয়ত অধিকাংশ প্রকাশকই এ বিষয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন না। যেনতেনভাবে হরকত ও আলামাতুত তারকীম (যতি-চিহ্ন) বসিয়ে দেন। ফলে তাদের দেয়া হরকত ও আলামাতুত তারকীমের উপর নির্ভর করলে অনেক সময় মারাত্মক বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়।
কিছু শব্দ এমন থাকে, যেগুলো লেখার ধরন একই। যেমন- تعلم। এটা تَعْلَمُ، تَعَلَّمَ، تُعَلِّمُ ، تُعْلِمُ সবই হতে পারে। কিন্তু এখানে কোন্টা হবে, তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা চাই। হাদীসে আছে-
نَهَى عَنِ الْحِلَقِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ قَبْلَ الصّلَاةِ.
ح-এ কাসরা এবং ل-এ ফাতহা। حَلْقَةٌ-এর বহুবচন। কিন্তু একজন পড়েছেন الْحَلْق। ح-এ ফাতহা এবং ل-এ সুকূন। ফলে হাদীসের যে ভুল অর্থ তিনি বুঝেছিলেন তাতে মনে করতেন, জুমার দিন জুমার নামাযের আগে মাথা হলক করা নিষেধ! চল্লিশ বছর পর তার এই ভুল ভাঙে। ঘটনাটি শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ ‘মাআলিমু ইরশাদিয়্যা’ কিতাবে (পৃ. ৩৩১) উল্লেখ করেছেন ইমাম খাত্তাবীর ‘মাআলিমুস সুনান’-এর বরাতে।
তালিবে ইলমের সামনে মতনের মু‘র্আরা (معرّى) নুসখা থাকবে, যাতে হরকত-ইরাব কিছুই থাকে না; এমনকি আলামাতুত তারকীমও (যতি-চিহ্ন) থাকে না। এমন নুসখাতে কিতাব পড়াটাই এক যবরদস্ত তামরীন এবং ইজরা, যা ইস্তিদাদ পয়দা হওয়ার জন্য অনেক মুফীদ।
৫. এরপর কাজ হল, ইবারত পড়ে যা বুঝে আসল তা যাচাই করা এবং ইবারতের সহীহ মাফহুম নিশ্চিত করা। তার জন্য যেসব বিষয় লক্ষ রাখা জরুরি সেগুলো যতেœর সঙ্গে লক্ষ রাখা।
৬. তারপর বিষয়টি ভালোভাবে আত্মস্থ করা; যাতে প্রয়োজনের সময় তা যথাযথভাবে উদ্ধৃত করতে পারে। কখনো কোথাও সন্দেহ হলে অলসতা না করে তৎক্ষণাৎ মুরাজাআত করা এবং দেখে নিশ্চিত হয়ে নেয়া।
৭. লেখার ক্ষেত্রে শব্দের বানান ও বাক্যের গঠন যেন বিশুদ্ধ হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা। হাতের লেখা নির্ভুল সুন্দর ও স্পষ্ট হওয়া কাম্য। এগুলো ইতকানের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
একবার খতীব ছাহেব হযরত মাওলানা উবায়দুল হক রাহ. (১৪২৮ হি.) [সাবেক খতীব, বায়তুল মুকাররম ঢাকা] মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকায় তাশরীফ এনেছিলেন। দীর্ঘ বয়ানের শেষের দিকে তিনি যে কথা গুরুত্বের সাথে বলেছিলেন তা এই- ‘‘মানতিক শাস্ত্রে ইনসানের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে ‘হাইওয়ানে নাতিক’, তার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ‘হাইওয়ানে কাতিব’ হওয়ারও চেষ্টা করবে। আর লেখার ক্ষেত্রে সুন্দর হস্তলিপি, বানানের শুদ্ধতা, ভাষার বিশুদ্ধতা এবং মযমুনের সিহ্হাত এই চার বিষয়ে মনোযোগী হবে।’’
লেখার ক্ষেত্রে রসমুল খত (লিখন-রীতি) এবং আলামাতুত তারকীম (যতি-চিহ্ন)-এর বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটির সঠিক ব্যবহার ইতকানের অন্তর্ভুক্ত।
৮. পরিষ্কার ভাষায় কথা বলবে। কথায় কোনো প্যাঁচ বা অস্পষ্টতা রাখবে না।
৯. উস্তায বা মুরব্বী কেউ কোনো আদেশ করলে প্রথমে তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। কোনো অস্পষ্টতা বা সন্দেহ থাকলে তখনই জিজ্ঞেস করে নেবে। অনেকে কথা ভালোমত না শুনে না বুঝে কেবল ইজতিহাদ করে কাজ করে। এতে অনেক সময় ভুল হয়।
১০. কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যেটুকু জানা আছে সেটুকুই সাফ ভাষায় বলে দেবে। আন্দাজ করে বাড়িয়ে কিছু বলবে না। একবার হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক আছে কি না? সে বলল, ঘুমাচ্ছে। পরে জানা গেল, আসলে সে তার কামরায় সজাগই ছিল। তখন থানভী রাহ. সেই ছাত্রটিকে সতর্ক করলেন। বললেন, ধারণা করা বিষয়কে নিশ্চিত মনে করা ভুল। যদি তুমি নিজে সেটাকে নিশ্চিত না মনে কর তাহলে সেটা যে তোমার ধারণা মাত্র, তা শ্রোতার সামনে প্রকাশ করে দেয়া উচিত। এভাবে বলতে পার- সম্ভবত ঘুমাচ্ছে। এটাও বললে على سبيل التنزل বলা যেতে পারে। নতুবা আসল উত্তর হল, আমার জানা নেই; দেখে বলব। এরপর দেখে নিশ্চিত হয়ে সঠিক জবাব দেবে। (আদাবুল মুআশারাত, পৃ. ২৩-২৪)
১১. মাদরাসা ও বাড়ির সাধারণ কাজগুলোও সুন্দর সুশৃঙ্খল ও পরিপাটিভাবে করার চেষ্টা করা।
১২. নিজের কিতাবাদি ও জিনিসপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা।
১৩. পোষাক-পরিচ্ছদ ও কাপড়-চোপড় পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখা।
১৪. অমনোযোগিতা পরিহার করা। যা-ই করবে, মনোযোগ দিয়ে করবে।
১৫. কোনো কিছুতে তাড়াহুড়ো না করা। তাড়াহুড়ো করলে ভুল হওয়ার আশংকা বেড়ে যায়। তাসাব্বুত ও ইতকানের ভিত্তি হল, হিল্ম ও আনাত- সহনশীলতা ও ধীরস্থিরতা।
১৬. মনে রাখতে হবে, মা‘লুমাত মাত্রই ইলম নয়। মা‘লুমাতের সঙ্গে চারটি সিফাত যুক্ত হলেই তাকে ইলম বলে-
ক. ظن বা সন্দেহ মুক্ত হওয়া।
খ. إبهام তথা অস্পষ্টতা মুক্ত হওয়া।
গ. نقص বা অসম্পূর্ণতা না থাকা।
ঘ. দলীল নির্ভর হওয়া। অর্থাৎ كذب ও خطأ মুক্ত হওয়া।
সুতরাং আমার মা‘লুমাতের মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত এই চার সিফাত হাসিল না হচ্ছে, আমাকে মেহনত চালিয়ে যেতে হবে। এই চার সিফাত হাসিল হলে তবেই সেটা ইলম হবে।
তাসাব্বুত ও ইতকানের অনেক বড় ক্ষেত্র কথা, সেইসঙ্গে লেখা। সেজন্য কিছু বলা বা লেখার আগে চিন্তা করতে হবে, তা সঠিক কি না? এতে আপত্তির কিছু আছে কি না? ইমাম নববী রাহ. ‘রিয়াযুস সালিহীন’ কিতাবে এক অধ্যায়ের শিরোনাম করেছেন এভাবে-
باب الحثِّ عَلَى التثبُّت فيما يقوله ويحكيه.
অর্থাৎ কোনো কিছু বলা বা বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। প্রথমে তার শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করা এবং তা প্রচারে ফায়দার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া। এরপর তা প্রচার করা।
এই অধ্যায়ে তিনি যেসব আয়াত-হাদীস উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে একটি আয়াত এই-
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا.
যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই (তাকে সত্য মনে করে) তার পেছনে পড়ো না। জেনে রেখ, কান, চোখ ও অন্তর- এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞেস করা হবে। -সূরা ইসরা (১৭) : ৩৬
এটা শরীয়তের অনেক বড় মূলনীতি। যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, যে বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট ধারণা নেই সে বিষয়ে আমার মুখ খোলা বারণ। মুখ খুললে আল্লাহ তাআলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সেজন্য যাচাই না করে এবং পরিপূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ ধারণা নিয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীস তো আমরা সকলেই জানি-
كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ.
কারো মিথ্যা বলার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তা-ই বর্ণনা করে। -মুকাদ্দিমা, সহীহ মুসলিম, হাদীস ০৫
এই ধমকি দ্বীনী-দুনিয়াবী উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেজন্য উভয় ক্ষেত্রেই সতর্কতা জরুরি। তবে বিষয়টা যদি দ্বীনী হয় এবং ইলমে দ্বীন সংশ্লিষ্ট হয় তাহলে আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে। তাসাব্বুত ও ইতকানের পূর্ণ পরিচয় দিতে হবে। পরিপূর্ণ তাহকীক ও যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো হাদীস বর্ণনা করা যাবে না। ঠিকমত না জেনে কোনো মাসআলা বয়ান করা যাবে না এবং কোনো আয়াত বা হাদীসের তরজমা বা ব্যাখ্যা করা যাবে না। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলা ও অসতর্কতা গ্রহণযোগ্য নয়। এতে অসতর্কতা ও অবহেলা করলে অনেক ক্ষতি। এক ক্ষতি তো গোনাহের ক্ষতি। আরেক ক্ষতি হল, এরূপ ব্যক্তির প্রতি আস্থা থাকে না। তার নির্ভরযোগ্যতা হারিয়ে যায়। তার পক্ষে আর মুকতাদা ও অনুসরণীয় আলেম হওয়া সম্ভব নয়। কারণ ইলমী মহলে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।
ইমাম মালেক রাহ., যার ফাযায়িল ও মানাকিব এক কথায় প্রকাশ করতে গিয়ে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. যে শব্দ ব্যবহার করেছেন তা এই-
رأس المتقنين وكبير المتثبتين.
মুতকিনদের প্রধান এবং তাসাব্বুত অবলম্বনকারীদের সরদার। -তাকরীবুত তাহযীব, জীবনী ৬৪২৫
তিনি বলেন-
اعْلَمْ أَنّهُ لَيْسَ يَسْلَمُ رَجُلٌ حَدّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ، وَلاَ يَكُونُ إِمَامًا أَبَدًا وَهُوَ يُحَدِّثُ بِكُلِّ مَا سَمِعَ.
মনে রেখ, যে ব্যক্তি যা-ই শোনে তা-ই বর্ণনা করে, সে (ভুল থেকে) নিরাপদ থাকতে পারে না। আর যার স¦ভাব এরকম, সে কখনো ইমাম (অনুসরণীয়) হতে পারে না। -মুকাদ্দিমা, সহীহ মুসলিম, বর্ণনা ১১
সুতরাং নিজের ইলমকে মজবুত করতে হলে এবং ইলমী অঙ্গনে নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তাসাব্বুত ও ইতকান ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমাদের সালাফ ও মহান পূর্বসূরিগণ যেসব বিষয়ের কারণে অনুসরণীয় হয়েছেন এবং আজ অবধি উম্মাহ্র শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও আস্থার আসনে অধিষ্ঠিত আছেন তার মধ্যে এ দুটি গুণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সালাফের তাসাব্বুত ও ইতকানের দু-তিনটি নমুনা এখানে পেশ করছি-
১. ইমাম আযম আবু হানীফা (১৫০ হি.) রাহ.। তাঁর সম্পর্কে ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন (২৩৩ হি.) রাহ. বলেন-
كان أبو حنيفة ثقة لا يحدث بالحديث إلا ما يحفظ ولا يحدث بما لا يحفظ.
আবু হানীফা রাহ. নির্ভরযোগ্য মানুষ ছিলেন। তিনি কেবল সেই হাদীস বর্ণনা করতেন, যেটা তার মুখস্থ ছিল। আর যেটা মুখস্থ ছিল না সেটা বর্ণনা করতেন না। -তারীখে বাগদাদ, খতীব বাগদাদী, খ. ১৩, পৃ. ৪৪৯
এখান থেকে আমরা অন্তত এটুকু গ্রহণ করতে পারি- যে বিষয়টা আমি ভালোভাবে আত্মস্থ করেছি বা যথাযথ বুঝেছি, কেবল সেই বিষয়টাই বর্ণনা করব। আর যেটা আত্মস্থ হয়নি এবং যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম হয়নি সেটা বলব না। কোনো হাদীস বা মাসআলা বর্ণনার ক্ষেত্রে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করব।
২. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (২৪১ হি.) রাহ.। একবার তাঁকে ‘গরীবুল হাদীস’ (হাদীসে বর্ণিত স্বল্প ব্যবহৃত শব্দ)-এর কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা হল। তখন তিনি বললেন-
سَلُوا بعضَ أَصْحَابِ الْغَرِيب، فَإِنِّي أكره أَن أَتكَلّم فِي قَول رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم بِالظّنِّ فأخطئ.
‘গরীবুল হাদীস’ সম্পর্কে যারা অভিজ্ঞ তাদের কাউকে জিজ্ঞেস কর। কারণ আমি এটা অপছন্দ করি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী সম্পর্কে আমি ধারণা করে বলব আর ভুল করব। -আলইলাল ওয়া মা‘রিফাতুর রিজাল, ইমাম আহমাদ, বর্ণনা ৪১৩ (মায়মুনীর বর্ণনা)
দেখুন, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ. হলেন হাদীস এবং ফিকহ উভয় শাস্ত্রের ইমাম। এর পরও ‘গরীবুল হাদীসের’ বিষয়ে তিনি কী সতর্কতা অবলম্বন করলেন! এখান থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় শিখতে পারি-
ক. যে বিষয়ে বা যে শাস্ত্রে আমার জানোশোনো নেই, অভিজ্ঞতা নেই সে বিষয়ে আমি দখল দেব না। স্পষ্ট জানিয়ে দেব, এ বিষয়ে আমি জানি না। আর এতে লজ্জার কিছু নেই।
খ. প্রয়োজনে আহলে ফন ও শাস্ত্রজ্ঞদের শরণাপন্ন হব।
গ. অনেক ক্ষেত্রে না জানাটা অন্যায় নয়। তবে না জানার পরও যদি আন্দাজে বলি আর ভুল হয়, সেটা মারাত্মক অন্যায়। বিশেষত যদি সেটা কুরআন-হাদীস ও দ্বীন-শরীয়ত সম্পর্কিত হয়।
৩. ইমাম বাক্কার ইবনে কুতায়বা (২৯০ হি.) রাহ.। ইমাম তহাবী (৩২১ হি.) রাহ.-এর খাস উস্তায। তিনি ইমাম শাফেয়ী (২০৪ হি.) রাহ.-এর শাগরিদ ইমাম মুযানী (২৬৪ হি.) রাহ.-এর কিতাব ‘আলমুখতাসারুল কাবীরে’ দেখলেন, তাতে কিছু মাসআলায় ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর বক্তব্যকে সমর্থন করে ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মতামতগুলোকে খ-ন করা হয়েছে। সেজন্য তিনি ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর বক্তব্যগুলো খ-ন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। ইমাম মুযানী রাহ. তখনো জীবিত। বাক্কার ইবনে কুতায়বা রাহ. দুই ব্যক্তিকে ইমাম মুযানীর কাছে পাঠালেন আর বললেন, তোমরা মুযানীর কাছে যাও এবং তাঁকে জিজ্ঞেস কর, এই কিতাবে যেসব মাসআলা আছে সেগুলো ইমাম শাফেয়ীর বক্তব্য কি না? তারা গেল এবং মুযানী রাহ.-এর কাছে পুরো ‘মুখতাসার’ কিতাবটি শুনল। এরপর জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ইমাম শাফেয়ীকে এসব মাসআলা বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, হাঁ। ফিরে এসে তারা বাক্কার রাহ.-কে সব জানাল। তখন তিনি বললেন-
الآن استقام لنا أن نقول : "قال الشافعي".
এখন আমাদের জন্য এটা বলা ঠিক হবে যে, ইমাম শাফেয়ী এই কথা বলেছেন। -রফয়ুল ইস্র আন কুযাতি মিস্র, ইবনে হাজার আসকালানী, পৃ. ১০৫ ; আততা‘লীকুল কওয়ীম আলা মুকাদ্দিমাতি কিতাবিত তা‘লীম, মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী, পৃ. ২১-২২
কারো বক্তব্য উদ্ধৃত করার ক্ষেত্রে কতটা সতর্কতা দরকার, এই ঘটনা থেকে আমরা তা শিখতে পারি। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে অনেক অবহেলা। আমরা তথ্য যথাযথভাবে যাচাই করি না। যাচাই না করেই বলে ফেলি, অমুক এই কথা বলেছে; এরপর তার রদ শুরু করে দিই। এটা যেমন তাসাব্বুত ও ইতকানের খেলাফ, তেমনি আমানতেরও খেলাফ। বিশেষত যখন কোনো বাতিলপন্থী লোক বা দলের খ-ন করা হয় তখন তো আরো বেশি সতর্ক থাকা জরুরি। নতুবা দেখা যাবে, আমি তো আটকা পড়বই, উপরন্তু আমার কারণে পুরো আহলে হকের বদনাম হবে এবং হকের দিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেজন্য এক্ষেত্রে উদাসীনতা ও অসতর্কতা একদম অনুচিত।
আপাতত এ তিনটি উদাহরণ পেশ করা হল। এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ সালাফের জীবনীতে রয়েছে। অতএব আমরা যদি নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাই এবং দ্বীনের আস্থাবান খাদিমদের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই, আমাদেরকে সালাফেরই অনুসরণ করতে হবে। সালাফের পথেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। এর বাইরে অন্য কোনো পথ নেই।
তাসাব্বুত ও ইতকান এক দিনে অর্জিত হয় না। এর জন্য মেহনত করতে হয়। অনুশীলন চালিয়ে যেতে হয়। এরপর ধীরে ধীরে আল্লাহর মেহেরবানীতে একসময় তা অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন বলা যাবে, এই ব্যক্তি মুতকিন, মুতাসাব্বিত। এক-দুবারের কাজ দিয়ে তাসাব্বুত ও ইতকান সাব্যস্ত হয় না।
তাসাব্বুত ও ইতকান সম্পর্কে আপাতত এ কয়টি কথা আরয করা হল। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হিলম ও আনাত এবং তাসাব্বুত ও ইতকান দান করুন। সেইসঙ্গে তাফাক্কুহ ফিদ্দীন এবং রুসূখ ফিল ইলম নসীব করুন- আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
০৮-১২-১৪৪৩ হি.
জুমাবার