নড়াইল : ঘটনাগুলো যেভাবে শুরু হয়
দৃশ্যত ব্যাপারগুলো সামনে আনা হয় শুধু ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ নাম দিয়ে। কিন্তু ঘটনাগুলোর সূচনা কিংবা প্রেক্ষাপট তৈরি হয় সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কারো কারো পক্ষ থেকে ইসলাম-অবমাননা কিংবা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার পর প্রথমে প্রতিবাদ-উত্তেজনা তৈরি হয়। এরপর উদ্ভূত পরিস্থিতির অনাকাক্সিক্ষত ও অসমর্থনযোগ্য কিছু প্রতিক্রিয়াকে প্রধান সমস্যা হিসেবে তুলে ধরে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ ইস্যু সৃষ্টি করা হয়। শুরু হয় একমুখী হাহাকার, মাতম এবং প্রতিবাদের অনিঃশেষ যাত্রা। যথারীতি দেশের প্রধান গণমাধ্যম, সুশীল মহল ও সেক্যুলার-বাম রাজনীতিকরা ব্যাপক ছোটাছুটি ও চিৎকার শুরু করেন। যেন ‘হিন্দু নির্যাতনের’ চেয়ে বড় নির্যাতন এই দেশে আর নেই! ‘হিন্দু নির্যাতনের’ চেয়ে বড় ও জাতীয় কোনো ইস্যুও আর নেই!
মাসখানেকের বেশি সময় ধরে নড়াইল জেলার নামটি এ প্রক্রিয়াতেই গণমাধ্যমের নেতিবাচক শিরোনাম। ফেসবুকে হিন্দু যুবক কর্তৃক ইসলাম-অবমাননার ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে নড়াইলে অবস্থান ও মিছিল হয়। পক্ষ-বিপক্ষ, বাধা ও উস্কানির কারণে সেখানে উত্তেজনা হয়। এবং এরই একপর্যায়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়ি, দোকান ও একটি বাড়ি সংলগ্ন মন্দিরে কিছু ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদী উত্তেজনা থেকে এসব ভাংচুরের ঘটনা ঘটলেও এবং এর প্রেক্ষাপট হিসেবে এক হিন্দু যুবকের ইসলাম-অবমাননার মতো ঘটনাই মূল কারণ হলেও আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে চাই, হিন্দু সম্প্রদায় কিংবা কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে কিংবা উপাসনালয়ে ভাংচুর-হামলার ঘটনা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বাছবিচারহীন হামলার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। দেশীয় আইনেও এটা অন্যায় এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বাস্তব ফলাফল-বিবেচনা থেকে এ ধরনের হামলা-ভাংচুরের ঘটনা ইসলাম অবমাননাকারীদের অবস্থানকেই শেষ পর্যন্ত শক্তি যোগায়। আর সবচেয়ে মারাত্মক যে ব্যাপারটি ঘটে সেটি হল, হিন্দু/সংখ্যালঘু কর্তৃক উপর্যুপরি ইসলাম অবমাননার ঘটনাগুলো পুরোপুরি চাপা দিয়ে দেওয়ার রাস্তা তৈরি করা হয় এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের ‘মাতমে’ চারদিক ‘বিমর্ষ ও মেঘাচ্ছন্ন’ করে তোলা হয়।
এর আগে জুনের মাঝামাঝি সময়ে নড়াইলেরই একটি কলেজে আরেক হিন্দু ছাত্র কর্তৃক ইসলাম-অবমাননার ঘটনা ঘটেছিল। তখনো প্রতিবাদ ও উত্তেজনার মধ্যে কলেজের হিন্দু অধ্যক্ষের ভূমিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে হিন্দু ছাত্রটিকে সহযোগিতা করার। সেই অধ্যক্ষকে গ্রেফতার ও জনতার রোষ থেকে বাঁচাতে কেউ কেউ প্রকাশ্যে তাকে অপমান করার কৌশল গ্রহণ করে। কিন্তু সেই ঘটনাকেও নড়াইলে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ বিশাল ঘটনা হিসেবে প্রচার দেওয়া হয়।
দুই.
সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে ছোটখাটো ভাংচুর-হামলার এ-জাতীয় ঘটনার ক্ষেত্রে প্রধান একটি বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, এসব ঘটনার সূচনাতেই কি সংখ্যালঘু পীড়নের বিষয়টিই মূল? অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের কারো পক্ষ থেকে কোনো উস্কানি-ইন্ধন ছাড়াই হঠাৎ করে বা পরিকল্পনা করেই এই ভাংচুরটি হয়েছে, নাকি এর আগে সংখ্যালঘু নাগরিকদেরই কারো কারো পক্ষ থেকে ইসলাম-অবমাননার কোনো ঘটনা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলতে ভূমিকা রেখেছে? হোক সেই অবমাননা অফলাইনে অথবা অনলাইনে, হোক সেই আঘাত চলতি কোনো ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে কিংবা পুরোনো ও সাধারণ কোনো সূত্র ধরে? সম্প্রতি নড়াইলের দুটি ঘটনা; জুনে অধ্যক্ষকে ‘হেনস্থা’ এবং জুলাইয়ে বাড়িঘর ভাংচুর-এর পেছনে রয়েছে একই জেলার ভিন্ন দুই যুবকের ফেসবুকে ইসলাম-অবমাননার ঘটনা। হেনস্থা বা ভাংচুর প্রথম ও আক্রমণাত্মক ঘটনা ছিল না, ছিল ধর্মানুভূতিতে আঘাতের পর আঘাতকারীর গ্রেফতার-বিচার নিয়ে সংশয়জনিত ক্ষোভের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া।
হামলা-হেনস্থার কোনো ঘটনাই খুব পরিকল্পিত ছিল বলে মনে হয়নি। কিন্তু এসব ঘটনার প্রচারই বেশি হচ্ছে। অথচ হিন্দু যুবক কর্তৃক ইসলাম-অবমাননার প্রসঙ্গটিকে গুরুত্বেই নেওয়া হচ্ছে না। যেন এটা কোনো অপরাধই নয়। যদিও অবমাননাকারী ও হামলাকারীদের পরে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কোনো সংখ্যালঘুর বাড়ি-দোকানে হামলার ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়- একথা আমরা জানি ও মানি; কিন্তু এদেশে সংখ্যালঘু কর্তৃক ইসলাম অবমাননার ঘটনা, ইসলাম-বিদ্বেষী, প্রিয় নবীজীর প্রতি বিষোদ্গারকারী নূপুর শর্মাকে সমর্থনের ঘটনা কি গ্রহণযোগ্য? পরিস্থিতিগুলোর সূচনাই তো হচ্ছে এসব ইসলাম-বিদ্বেষী ঘটনার মাধ্যমে। তাহলে মূল অপরাধ-ঘটনার দিকে চোখ না দিয়ে পরের তাৎক্ষণিক ও অগোছালো ভুল প্রতিক্রিয়া নিয়ে দিনের পর দিন পাল্টা পরিস্থিতি তৈরির যৌক্তিকতা কতটুকু?
আসলে এদেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু উভয় সম্প্রদায়ের দায়িত্বই বড়। ইসলাম-অবমাননা ও ধর্মানুভূতিতে আঘাতের ‘বাজার’ গরম করতে দিয়ে সব পরিস্থিতি সবসময় শান্ত থাকবে- এমন প্রত্যাশা ও ভাবনা যথাযথ নয়। প্রশাসনের দায়িত্বও এক্ষেত্রে বড়। তাৎক্ষণিক ও আন্তরিক পদক্ষেপ নিলে এসব ঘটনা হাতাহাতি-ভাংচুর পর্যন্ত যেতে পারে না। দ্রুত ইসলাম-অবমাননাকারী নির্দিষ্ট অপরাধীর শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা নিলে ‘একজনের অপরাধে অপর পাঁচজনের ওপর’ প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রই রচিত হতে পারে না। সংখ্যালঘুদের সবাই তো দোষী নন, প্রতিবাদকারী সবাই-ও তো অপরাধী নন। কিন্তু সময় ক্ষেপণ করলে এবং দোষীকে শাস্তি দিতে দেরি করলে পরিস্থিতি দীর্ঘ হতে থাকে। পক্ষ-বিপক্ষের মাত্রা ও সীমানা স্ফীত হতে থাকে। এটা কোনোভাবেই কল্যাণকর হতে পারে না।
তিন.
নড়াইল ইস্যুতে মুখচেনা গণমাধ্যমগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আনতে পারত। এ-জাতীয় ঘটনা ও ইস্যুতে এমন প্রশ্ন কিংবা প্রশ্নের উত্তর সাধারণত সামনে আনতে হয়। কিন্তু একপাক্ষিক মাতম ও উত্তেজনার বাইরে এ-জাতীয় মৃদু সাম্প্রদায়িক অস্বস্তির সূচনা, পটভূমি-প্রেক্ষাপট এবং কার্যকারণ নিয়ে তারা কোনো কথাই বলতে চায় না।
সেই প্রশ্নটি হল, গত দশ-বারো বছর ধরে এদেশে হিন্দু যুবকদের মধ্যে ইসলাম-বিদ্বেষের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে উঠছে কেন? ইসকন, আরএসএস, বিশ^ হিন্দুপরিষদের শাখাগুলো কি এখন এদেশে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে? বিজেপির ‘হিন্দু-ভারতে’ সংখ্যালঘু মুসলিমদের যেভাবে যেভাবে কষ্ট ও অস্বস্তির মধ্যে ফেলা হচ্ছে, এদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের একটি অংশ কি সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সেই অস্বস্তি ও সংকটের মধ্যে ফেলতে চাইছে? ভারত রাষ্ট্রের কাঁটায়-পাতায় পল্লবিত হিন্দুত্ববাদ ও ইসলাম-বিদ্বেষের কু-বাতাস এদেশের হিন্দুদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে? তা না হলে দুদিন পর পর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে একশ্রেণির হিন্দু যুবক-যুবতী ইসলাম-অবমাননার ঘটনায় নিজেদের জড়াচ্ছে কেন?
মতলবি গণমাধ্যম এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজতে চাইলেও সচেতন দেশবাসীর দায়িত্ব- এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করা। উগ্র হিন্দুত্ববাদ, সম্প্রসারণশীলতা ভারতে এবং বাংলাদেশে উসকে দেওয়া বিদ্বেষবাদের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। সাদা চোখে এসব কিছুকে নিছক হিন্দু ধর্মীয় হুজুগ-সংস্কৃতি মনে হলেও বাস্তবে এসবের সঙ্গে উপমহাদেশব্যাপী হিন্দুত্ববাদের মানচিত্র বিস্তারের স্বপ্নজালটির ছায়া চোখে পড়ে।
আরেকটি ব্যাপার! হিন্দু সম্প্রদায় কিংবা একটু বড় পরিসরে বললে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্প্রদায়-সচেতনতা তো বেশ চাঙ্গা। যে কোনো ঘটনায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানার নিয়ে তারা শহীদ মিনার অথবা শাহবাগে এসে দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমান নামধারীদের মধ্য থেকে তাদের অনুমিত মিত্র মুখচেনা সুশীলদের ব্যস্ত করে তোলেন। প্রতিটি ছোট-বড় ঘটনায় তাদের ‘অসহায়ত্ব’ এবং রাষ্ট্র ও সংখ্যাগুরু সমাজের দায়িত্ব নিয়ে অনেক রকম আওয়াজ সামনে আনেন। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে যখন যারাই ইসলাম-অবমাননার ঘটনা ঘটায় তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করেন না কেন? ওইসব বেদনাদায়ক ও উত্তেজক ইসলাম-অবমাননাকর ঘটনার বিচার দাবি ও নিজেদের গোটা সম্প্রদায়কে ‘দায়মুক্ত’ ঘোষণা করার কাজটি করেন না কেন? তারা অনেক বেশি সম্প্রদায়-সচেতন, কিন্তু সহাবস্থান-সচেতনতার এই বোধটুকুর কোনো লক্ষণ তাদের মধ্যে দেখা যায়নি; বরং উল্টো ইসলাম-বিদ্বেষী হিন্দু যুবক-যুবতীদের বাঁচাতে নানারকম কথাবার্তা বলতে থাকেন। এতে দূরত্ব, সংকট, আস্থাহীনতা ও উত্তেজনা আরো বাড়তে থাকে। একজনের দোষে যেমন অপর পাঁচজনের ঘরে ঢিল মারা ঠিক নয়, তেমনি একজনের ইসলাম-বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক আচরণের দায়ও সম্প্রদায়গতভাবে সবার নেওয়াটাও তো সঠিক নয়। তাদের সম্প্রদায়-সচেতনতা তো ভালো, আন্তঃসম্প্রদায়-সচেতনতা এবং সহাবস্থান সচেতনতাও আরো ভালো হওয়া দরকার। পাশের বড় দেশের অভব্য শক্তির দিকে তাকিয়ে অসহিষ্ণুতাকে সঙ্গ দেওয়াটা মোটেও বুদ্ধির কাজ নয়।
চার.
বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার। মিয়ানমার বৌদ্ধ-প্রধান এবং আয়তনে আমাদের দেশের চেয়ে কিছুটা বড়। ভারত হিন্দু-প্রধান এবং আয়তনে অনেক বড়। এ দুটি রাষ্ট্রই অর্থনীতি ও উন্নয়নের সাধারণ সূচকে, আধুনিকতা ও শক্তিতে বাংলাদেশের চেয়ে উন্নত অবস্থানে। কিন্তু প্রতিবেশী এ দুটি দেশেরই ভেতরের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও জন-সামাজিক স্তরে অত্যন্ত ভয়ংকর। অপর ধর্মের নাগরিকদের প্রতি, বিশেষত মুসলিমদের প্রতি এদের সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, মারধর, হামলা-হত্যা, উচ্ছেদ-বাড়িঘর ধসিয়ে দেওয়া, নাগরিকত্বহীন করে দেওয়া, পাশের দেশে (বাংলাদেশে) পুশব্যাক করা, ব্যবসা-বাণিজ্য-শিক্ষা চাকরি-রাজনীতিতে মুসলিমদের চরম অবহেলা ও সংকোচন করার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ও স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। এমন ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় প্রতিবেশের মধ্যে বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সম্পর্ক ও নাগরিক-যাত্রার পরিস্থিতি কতোটা উন্নত ও সহাবস্থানপূর্ণ- এটা কে অস্বীকার করতে পারবে? এর প্রধান কৃতিত্ব এদেশের সংখ্যাগুরু ধর্মপ্রাণ মুসলিম নাগরিকদের। কিন্তু স্বীকৃত ও উজ্জ¦ল এই সম্প্রীতির সৌন্দর্যকে ঢেকে দিতেই দরকার পড়ে যায় এদেশের ‘সাম্প্রদায়িক কদাকার’ একটি চেহারা বানিয়ে প্রকাশ করার। নড়াইল-জাতীয় ঘটনা নিয়ে বিশাল-ব্যাপক প্রচারণার পেছনে একটি বড় কারণ ও উপলক্ষ এই ‘দরকারের’ ব্যাপারটিই।
নড়াইল তো চলতি জুন-জুলাইয়ের ইস্যু। এখানে তো ঢিল-পাটকেল, হাতাহাতি, ভাংচুরের কিছু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গত কয়েকমাস আগে ঢাকার তেজগাঁওয়ে এক সংখ্যালঘু নারীর কপালের ‘টিপ’ নিয়ে টিজ করার মিথ্যা ঘটনাটির কথা ভাবুন। শাহবাগ থেকে সংসদ সব জায়গায় ছিল ‘গেল গেল’ আওয়াজ। প্রভাবশালী সব মিডিয়া ভেসে গিয়েছিল কান্না ও মাতমের অশ্রুতে! যেন হিন্দু নারীদেরকে এদেশে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ‘টিপ’ নিয়ে এতসব প্রচার-তোলপাড়ের কয়েকদিন পরই জানা গিয়েছে, ‘টিপ’ নিয়ে টিজ করার অভিযোগের কোনো সত্যতাই পাওয়া যায়নি। একটি টিপের এই মিথ্যা ঘটনা থেকেও বোঝা যায়, এদেশকে অতি তুচ্ছ ছুতায় হলেও ‘সাম্প্রদায়িক’ বদনাম করার একটা ‘দরকার’ কারো না কারো গরজের মধ্যে আছে। এই গরজটি যার বা যাদের তারা দেশের ভেতরেরও হতে পারেন, দেশের বাইরেরও হতে পারেন। কিন্তু দরকার ও গরজের এই কাজটি যারা লেখায়-বক্তৃতায়, মিডিয়ায় আঞ্জাম দিচ্ছে, তারা এদেশেরই মানুষ। মিডিয়া, বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির কিছু মুখচেনা জন। ধর্মীয় বিষয়ে দেশকে এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেহারাকে বীভৎস করে দেখাতে তারা সবসময় একটু বেশি উদগ্রীব। আনুগত্য ও রাজনীতির জন্য করলেও তাদের এসব কাজে দেশের পথচলার যে ক্ষতিটি হয়- সেটি অনেক দীর্ঘ ও গভীর। নড়াইলের ক্ষেত্রেও সেই ক্ষতিটি ঘটেছে এবং ঘটছে।
এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন অতি বুদ্ধিমান একটি মহল নড়াইল প্রচারণার সময়েও কুমিল্লা, ঠাকুরগাঁও, নাসিরনগর, পাবনা, ভোলার কথা তুলেছেন এবং কথাগুলো এমনভাবে বলেছেন যেন ‘সাম্প্রদায়িক হামলার’ একটা পরিকল্পিত ধারাবাহিকতা চলছে। অথচ খেয়াল করুন, প্রায় প্রতিটি ঘটনার শুরুতে হিন্দু যুবক কর্তৃক ইসলাম-অবমাননাকর ফেসবুক পোস্ট বা বক্তব্য ছিল। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই বিক্ষিপ্ত ও অপরিকল্পিত ভাংচুরের পর্যায়ে ছিল। কুমিল্লা ও ভোলার ঘটনায় কয়েকজন মুসলিম বিক্ষোভকারী পুলিশের গুলিতে জীবন দিয়েছেন। অপরদিকে গত দশ-কুড়ি বছরে কোনো ‘সাম্প্রদায়িক’ ইন্ধনে দেশের কোথাও কোনো হিন্দু/সংখ্যালঘু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। তবুও তারা নড়াইলে ‘হিন্দু নির্যাতনের’ বয়ানগুলো অত্যন্ত ভীতিকর ভাষায় পেশ করে চলেছেন। সাহারানপুরে আদিত্যনাথের বুলডোজার এবং আরাকান জুড়ে বর্মিজ বাহিনীর মুসলিম উচ্ছেদের ঘটনা চাপা দিতেই কি তবে এদেশে এসব অতি-প্রচারণার কসরত?
নড়াইল কিংবা এজাতীয় ঘটনার অতি প্রচারের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সাংঘাতিক ‘অসহায়’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টাটাও করা হয়। এদেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় বড় পদ-পদবি দেখলে কি অসহায়ত্বের এসব প্রচারকে সঠিক মনে হয়? আমরা মনে করি, সংখ্যালঘুদের কোনো একজনের জন্যও কষ্টের কোনো একটি ঘটনাও ঘটাতে দেওয়া উচিত না। রাজনীতি কিংবা দেশের বাইরের ‘মিশন বাস্তবায়নে’ ফাঁদ ফেলে কোনো বিপদ ঘটানো কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু সার্বিক বিষয়ে পরিমিতি, ভারসাম্য, সত্যাসত্য এবং প্রতিবেশ ও পূর্বাপর কার্যকারণের বিবেচনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ-জাতীয় ঘটনার শুরুতেই দরকার দায়িত্বশীলদের সচেতন পদক্ষেপ। আর আগে-পরে সবসময় দরকার অতিমাত্রার একপেশে অতিপ্রচার বিষয়ে সতর্ক থাকা। মনে রাখতে হবে, এজেন্ডা নিয়ে যারা এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করে- তাদের কাজ সব বিচারে দেশেরই বিরুদ্ধে যায়।
পাঁচ.
প্রয়োজনীয় আরেকটি প্রসঙ্গ হচ্ছে, ইসলাম-অবমাননার প্রতিবাদ ও বিচার। সংখ্যালঘু কিংবা নামধারী মুসলিম যেই শ্রেণির লোকই ইসলাম-অবমাননা করুক, প্রথমত ও প্রধানত রাষ্ট্র ও প্রশাসনের দায়িত্ব তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং তার শাস্তি নিশ্চিত করা। পরিস্থিতি বিবেচনার কথা তো পরে, নৈতিক কারণেই এ-জাতীয় বেয়াদব ও আইন লংঘনকারী অপরাধীকে ছাড় দেওয়ার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। আর এসব শাতেম ও অপরাধীদের শাস্তি না দিলে সহাবস্থান ও শৃঙ্খলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। বিষয়টি সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর নয়, বিষয়টি ইসলাম-অবমাননা ও ধর্মানুভূতিতে আঘাতের। ধর্মপ্রাণ মানুষকে কষ্টের করাতের নিচে রেখে দেওয়া ইনসাফ ও স্বস্তির কোনো কথা নয়। তাদেরও তো শান্তিতে থাকার অধিকার আছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, ইসলাম-অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আয়োজন ধর্মপ্রাণ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু প্রতিবাদ-উত্তেজনায় এলোপাথারি ভাংচুর-হামলা, একজনের দোষে একটি সম্প্রদায়ের অন্য পাঁচজনকে শাস্তি দেওয়ার ঘটনার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না এবং কোনো সুফলও পাওয়া যায় না; বরং বৈরী প্রচারের এ-যুগে এসব অনিয়মিত আচরণের দায় ও চাপ নিতে হয় অনেক বড় পরিসরে। এমন কর্মকা- থেকে বিরত থাকা এবং একইসঙ্গে প্রতিবাদী-প্রতিরোধী থাকাটাই ঈমানদারের দায়িত্ব।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নিরাপত্তা, ইনসাফ সবার জন্যই অবারিত হোক। দুআ করি, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু কাউকে যেন বঞ্চনা ও দুঃখে চোখের অশ্রু মুছতে না হয়- রাষ্ট্র এমন হয়ে উঠুক।