প্রশ্নোত্তর
[আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের সর্বশেষ শিরোনাম ‘প্রশ্নোত্তর’। এর অধীনে প্রত্যেক সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ তিন থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। সংক্ষেপের জন্য প্রশ্নকারীর নাম-পরিচয় অনুল্লেখ থাকবে।]
প্রশ্ন ৩১ : আপনাদের পত্রিকায় পড়লাম, কুরআন শরীফে আনা (أنا) শব্দের নুনে টান হয় না। আমাদের হুজুর পড়িয়েছেন, চার জায়গায় আনা শব্দে টান হয়, বাকি জায়গায় হয় না। এ বিষয়টি আরেকটু বুঝিয়ে বললে ভালো হত।
উত্তর : হাঁ, গত জুন মাসের সংখ্যায় আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের প্রশ্নোত্তর পর্বে এ বিষয়টি লেখা হয়েছিল। বিষয়টি মূলত তাই। তবে আপনি যে চার জায়গায় আনা (أنا) শব্দে মদ বা টান হওয়ার কথা বলেছেন, সেগুলোর কোনোটিই মূলত আনা (أنا অর্থাৎ আমি) শব্দ নয়, বরং পরবর্তী অক্ষরের সঙ্গে সংযুক্ত ভিন্ন কিছু শব্দ। সেগুলো হল, اَنَابَ (সে অভিমুখী হয়েছে), اَنَابُوْۤا (তারা অভিমুখী হয়েছে), اَنَاسِيَّ (মানুষজন), اَنَامِلَ (আঙুলসমূহ)। লক্ষ করুন, এখানে আনা (أنا) ‘আমি’ অর্থে স্বতন্ত্র কোনো শব্দ নয়; বরং এগুলো ভিন্ন শব্দের অংশ এবং সেই শব্দগুলোর নিজস্ব রূপ অনুযায়ী এখানে নুনে (ن) মদ বা টান হচ্ছে।
তবে যারা কুরআন কারীমের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী, তাদের সহজে বোঝা ও মনে রাখার সুবিধার্থে মকতবের শিক্ষকগণ এভাবে বলেন যে, ওই চার শব্দ ছাড়া আর কোথাও আনা (أنا)-তে টান হয় না।
প্রশ্ন ৩২ : কুরআন তিলাওয়াতে প্রতি হরফে দশ নেকি লাভের বিষয়টি কি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত?
উত্তর : জি¦, এটি সহীহ হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ.
قال الترمذي : هذا حديث حسن صحيح غريب من هذا الوجه.
যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পড়বে, সে এমন একটি নেকী লাভ করবে, যেটি দশ নেকীর সমান। আমি বলছি না, আলিফ-লাম-মিম একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মিম একটি হরফ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯১০
এই হাদীসে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, কুরআন তিলাওয়াতকারী প্রতিটি হরফে এমন এক নেকী পাবে, যা দশ নেকীর সমান।
আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
اتْلُوهُ فَإِنّ اللهَ يَأْجُرُكُمْ عَلَى تِلَاوَتِهِ كُلّ حَرْفٍ عَشْرَ حَسَنَاتٍ، أَمَا إِنِّي لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ وَلَامٌ وَمِيمٌ.
অর্থাৎ তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর। আল্লাহ এই তিলাওয়াতের কারণে প্রত্যেক হরফের বিনিময়ে দশ নেকী করে সওয়াব দেবেন। আমি বলছি না, আলিফ-লাম-মিম একটি হরফ; বরং আলিফ একটি, লাম একটি, মিম একটি। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২০৪০, ২০৮০; সুনানে দারেমী, হাদীস ৩৩৫১, ৩৩৫৮; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৮৬৪৬-৮৬৪৯)
এই হাদীসেও স্পষ্টভাবে প্রত্যেক হরফে দশ নেকীর কথা বলা হয়েছে।
প্রশ্ন ৩৩ : হযরত নূহ আলাইহিস সালামের আমলে মহাপ্লাবনের সময়ে কি চুলা থেকে পানি বের হয়েছিল? এমন কথাও শুনেছি যে, সর্বপ্রথম নূহ আলাইহিস সালামের স্ত্রী নিজের চুলা থেকে পানি বের হতে দেখেছিলেন।
উত্তর : এক্ষেত্রে কুরআন কারীমের ভাষ্য হল-
حَتّٰۤی اِذَا جَآءَ اَمْرُنَا وَ فَارَ التَّنُّوْرُ.
(পরিশেষে যখন আমার হুকুম এসে গেল এবং তান্নুর উথলে উঠল। -সূরা হূদ (১১) : ৪০
এ আয়াতাংশে বলা হয়েছে, তান্নুর থেকে সবেগে পানি বের হয়েছে। আরবী ভাষায় তান্নুর শব্দটি চুলা অর্থেই বেশি ব্যবহার করা হয়, তবে ভূ-পৃষ্ঠ অর্থেও এর ব্যবহার রয়েছে। অধিকাংশ মুফাসসিরের এটাই মত যে, প্লাবনের শুরুতে চুলা থেকে পানি বের হয়েছে। কোনো কোনো তাফসীরবিদ তান্নুরের অপর অর্থ গ্রহণ করে বলেছেন, ভূ-পৃষ্ঠ ফেটে পানি বের হয়েছে। আসলে এই দুই বক্তব্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। চুলা থেকে পানি উথলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভূ-পৃষ্ঠ ফেটেও পানি বের হওয়া সম্ভব। (লিসানুল আরব ২/২৪২১; তাজুল আরূস ১০/২৯৯৪-২৯৫; তাফসীরে তবারী ১২/৪০৬; তাফসীরে কুরতুবী ৭/৩৪)
প্রশ্ন ৩৪ : হুজুর, আমি একজন মাদরাসার ছাত্র। আমি একজনকে বলতে শুনেছি, সূরা আহযাবের ৭২ নং আয়াত অর্থাৎ-
اِنَّا عَرَضْنَا الْاَمَانَةَ عَلَی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ الْجِبَالِ فَاَبَیْنَ اَنْ یَّحْمِلْنَهَا وَ اَشْفَقْنَ مِنْهَا وَ حَمَلَهَا الْاِنْسَانُ.
(আমি আমানত পেশ করেছিলাম আকাশম-লী, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনে। তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল ও তাতে শঙ্কিত হল। আর মানুষ তা বহন করে নিল। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৭২
এখানে الْامَانَة অর্থ ‘আল্লাহর মহব্বত-ভালবাসা এবং মা‘রিফাত’। আমার জানার বিষয় হল, আল্লাহকে তো তার সকল সৃষ্টিজীবই ভালবাসে। তাহলে ভালবাসা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণ কী? আসলে উক্ত আয়াতে আমানত দ্বারা কী উদ্দেশ্য?
উত্তর : এখানে أمانة অর্থ ‘আল্লাহ তাআলার সকল আদেশ-নিষেধ’। আল্লাহ মানুষের স্বভাবজাত ও প্রকৃতিগত নিয়মনীতি ছাড়াও মানুষকে এমন বিধানাবলি দিয়েছেন, যেগুলো মানা বা না মানার ক্ষেত্রে মানুষের নিজের ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। অর্থাৎ মানবজাতিকে আল্লাহ তাআলা শরীয়তের বিধান দিয়েছেন। মানুষ যদি নিজ ইচ্ছায় আল্লাহর সেই বিধানাবলি মেনে চলে, তাহলে সে আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত দান করবেন। আর যদি না মানে, তাহলে অবাধ্য বান্দা হিসেবে গণ্য হবে। এ বিষয়টি আকাশম-লী, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনেও পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা এটি গ্রহণ করেনি।
যদিও এখানে أمانة -এর ব্যাখ্যায় সাহাবায়ে কেরাম ও মুফাসসিরীনের আরও বক্তব্য রয়েছে। তবে এসকল বক্তব্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। কেউ কেউ শরীয়তের কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে এর উদ্দিষ্ট বলেছেন। আর অধিকাংশগণ ব্যাপকভাবে পুরো দ্বীন ও শরীয়ত তথা আল্লাহ তাআলার সকল বিধিবিধানকে এর উদ্দিষ্ট বলেছেন। উপরিউক্ত ব্যাখ্যায় সকল মতই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর ব্যাখ্যা কেবল ‘আল্লাহর মহব্বত-ভালবাসা বা মা‘রিফাত’ করলে এর অর্থ যথাযথ আদায় হয় না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য মুফতী শফী রাহ.-এর মাআরিফুল কুরআনের এ আয়াতের তাফসীর দেখুন। (আরও দ্রষ্টব্য; তাফসীরে কুরতুবী ১৪/২৫৩, তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৮৩০)